বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

অধিকার কেন্দ্রিক আইনগুলির কি হল?

অধিকার কেন্দ্রিক আইনগুলির কি হল?

অশোক সরকার

photo

অগাস্ট মাস থেকে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজ চালু হবার কথা ছিল, হয়নি। একটা ছোট্ট খবর বেরিয়েছিল, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কেউই তা চালু করতে বিশেষ আগ্রহী নয়। খবরটা পড়ে একটা মূল প্রশ্ন মাথায় এল। গত দুই দশকে যে এতগুলি অধিকার কেন্দ্রিক আইন হল, তাতে কি বদলাল? ১০০ দিনের কাজের অধিকার, তথ্য জানার অধিকার, বন সম্পদের উপর অধিকার, খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, হকারির অধিকার, হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার — অধিকারের ফিরিস্তি তো কম নয়। তাতে সত্যিই কি কিছু বদলেছে? উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়ের সাংবিধানিক স্বপ্নকে অধিকারের মোড়কে জনগণকে উপহার দেওয়ার চেষ্টার বয়স প্রায় ২০ বছর হয়ে গেল। কাজেই কিছু দরকারি প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে, তার আগে দেখে নেই সব মিলিয়ে হাতে কি রইল।
১৮ বছর বাদে সরকারি তথ্য থেকেই এটা পরিষ্কার, যে ছয়টি অধিকার ১০০ দিনের কাজের আইনে স্বীকৃত হয়েছিল, তার একটাও গ্যারান্টি হয়নি। এখন ১০০ দিনের কাজ একটা যোজনা হয়ে গেছে, টাকা থাকলে আর সরকারের ইচ্ছে থাকলে কাজ পাবে, কাজের গ্যারান্টি বলে কিছু নেই। শিক্ষার অধিকারের প্রায় ১৫ বছর বাদে এটা পরিষ্কার যে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ৯২ ভাগ ছেলে মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু কি শিখছে তার চিত্র ভয়াবহ। মাপদণ্ডটাই হল পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী দ্বিতীয় শ্রেণীর বই পড়তে পারে কিনা, পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী ভাগ করতে শিখেছে কিনা – দু’ ক্ষেত্রেই ২০০৮ থেকে ২০২৩ – এই পনেরো বছরের মধ্যে প্রায় সব রাজ্যেই অবস্থার অবনতি হয়েছে। এর সঙ্গে সরকারি স্কুল বন্ধ হওয়া, প্রাইভেট স্কুলের রমরমা, সরকারি স্কুলে সাড়ে পাঁচ লক্ষ শিক্ষকের পদ খালি – এসবও মেলাতে হবে। রেশন পেতে বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা আসার পরে খাদ্য সুরক্ষার মূল কথাটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। খাদ্য সুরক্ষা আইনে অঙ্গনওয়াড়ি সম্পর্কে যা বলা আছে, তার একটাও সারা দেশে প্রায় ১২ বছর বাদেও গ্যারান্টি করা যায়নি। ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রায় ১০ কোটি বনবাসী ও অরণ্য-নির্ভর পরিবারের মধ্যে মাত্র ২৯ লক্ষ পরিবার ব্যক্তিগত বনপাট্টা পেয়েছেন, সামুদায়িক পাট্টার সংখ্যা মাত্র ১ লক্ষ। রাস্তায় হকারির অধিকার আইন কাগজে রয়ে গেছে, রাস্তায় নামেনি। তথ্যের অধিকার গত ১৯ বছরে বার বার তার ধার হারিয়েছে, প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১০০-র কাছাকাছি মানুষ, আক্রান্ত হয়েছেন ৩০০-র বেশি। প্রায় প্রতিটি সরকার তথ্য জানার অধিকার আইনে স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। ১৯ বছর বাদে, হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তির মালিকানা আদৌ কিছু বেড়েছে কিনা তা বুকে হাত দিয়ে বলাই যাচ্ছে না।
এর পাশাপাশি সংবিধানে স্বীকৃত অধিকারগুলির কথা না বললেই নয়। ন্যায় বিচারের অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত, কিন্তু ৩ কোটি ৮৫ লক্ষের বেশি মামলা আমাদের দেশের আদালতগুলিতে ঝুলে রয়েছে, যার ৬২ ভাগ ১ বছরের বেশি পুরনো। সমান কাজে সমান মজুরি সংবিধানে স্বীকৃত হলেও অল্প কিছু সরকারি চাকরি ছাড়া কোথাও তা কার্যকর হয়নি। জাতি, ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে সবাই আইনের চোখে সমান একথা সংবিধান বললেও সংবিধান মেনে তৈরি হওয়া সরকার এখন আর তা বলতে রাজি নয়। নারী-পুরুষ সাম্যের কথা সংবিধানে স্বীকৃত হলেও, সরকার সমাজ ও বাজার কেউই তা মানে না। উদাহরণের অভাব নেই।
অধিকারের আর অপ্রাপ্তির তালিকা আরও লম্বা করা যায়, কিন্তু ছবিটা এই দাঁড়ায় যে, অধিকারের সংখ্যা ও বহর বাড়লে যে প্রাপ্তি খুব একটা বাড়বে তা নয়। তাহলে প্রশ্ন, রাষ্ট্রকে অধিকারে বাধ্য করা সত্ত্বেও আদতে বিশেষ কিছু হচ্ছে না কেন? একটা উত্তর হতে পারে নেতাতন্ত্র আর আমলাতন্ত্র আসলে অধিকারের ধার-ধারে না, আইনের দৌড় আমাদের শাসন ব্যবস্থায় অতি সীমিত। এটা তো ঠিক যে কেরালা, তামিলনাড়ু, হিমাচলে শিক্ষা স্বাস্থ্য, পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার, কেরালায় গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ — এগুলো কোনওটাই আইনি অধিকারের ভিত্তিতে হয়নি, সরকার চেয়েছিল তাই হয়েছে। সারা দেশ জুড়ে গ্রামীণ সড়কের যে বিস্তৃত ও অত্যন্ত জরুরি পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে তার জন্য রাস্তার অধিকার বলে কোনও আইন পাশ করতে হয়নি। আর একটা উত্তর হতে পারে, অধিকারের ভাষা এসেছিল জনসমাজ থেকে, উল্লিখিত কোনও অধিকারই মূলস্রোতের রাজনীতির কাছ থেকে জন্মায়নি, জন্মেছিল জনসমাজের মধ্যে থেকে, তাই নেতা-আমলাতন্ত্র তার মোড়ক-টা নিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে।
মোড়কটা গ্রহণ করার উদ্দেশ্য এই যে রাষ্ট্রকে জনহিতকামী, প্রগতিশীল দেখানো যায়, কিন্তু কাজটা রাষ্ট্রের হাত থেকে চলে আসে জনগণের উপরে। কাজ পাওনি, মজুরি পাওনি, বন-পাট্টা পাওনি, তথ্য পাওনি, শিক্ষা পাওনি, সম্পত্তির ভাগ পাওনি — তুমি লড়ে নাও, তোমাকে অধিকার দেওয়া আছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই, কিন্তু অধিকার আছে, টিচার নেই কিন্তু শিক্ষার অধিকার আছে, বন অধিকার রূপায়ণ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই, অধিকার আছে। তুমি কার্ড বানাও, তুমি ফরম জমা দাও, তুমি দাবিদারদের তালিকা বানাও, তুমি প্রমাণ জোগাড় কর, তুমি হাতের ছাপ ঠিক কর, আধার লিঙ্ক কর, তুমি মামলা কর — অধিকার তোমার, দায়িত্ব তোমার, মাথাব্যাথাও তোমার। আর এখন তো ডিজিটাইজেশনের (digitization এর) নামে সুপরিকল্পিত ভাবে ওই অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পঞ্চায়েতে গিয়ে মানুষ কাজের খোঁজ চাইলে বলা হয়, ‘ওয়েবসাইট দেখে নাও’। রেশনে নাম উঠল কিনা উত্তর দেবে ওয়েবসাইট!
অধিকারকেন্দ্রিক আইনগুলিকে সফল করতে গেলে, নীতি ও জনসমাজের এজেন্ডা থেকে রাজনীতিতে মুখ্য জায়গা নিতে হয়, নির্বাচনী এজেন্ডার মধ্যে আসতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলি এবং তাদের সূত্রে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজনীতি সাধারণত যে ভাষায় কথা বলে তা জনতার অধিকারের ভাষা নয়, নেতাদের দয়া-কৃপার ভাষা। কোন নেতা কাকে কি দিলেন, উন্নয়নের রাজনীতি সেই পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এখন তো নেতারা ‘নিজেরা’ কি দিলেন, তার কথা বলেন; একজন নাকি রেশন দিচ্ছেন, গ্যাসের সিলিন্ডার দিচ্ছেন, আরেকজন নাকি ভাঁড়ারে টাকা দিচ্ছেন। অন্য এক রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলতেন, তিনি বোতাম টিপলেই জনতার ঘরে টাকা পৌঁছে যাচ্ছে।
যে জনসমাজ এই ক’ বছর আগেও অধিকার কেন্দ্রিক নীতিগুলি নিয়ে কাজ করত, সরকারের কাছে এই আইনগুলি রূপায়ণ করার জন্য প্রতি নিয়ত আওয়াজ তুলত, তাদের একটি বড় অংশ ক্রমশ সেই ভাবধারা ও কর্মধারা থেকে সরে এসেছে। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই আর অধিকার আইনগুলি নিয়ে চিন্তিত নয়, বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে তা লঙ্ঘন করাতেই ব্যস্ত। শুধু তাই নয়, অধিকার নিয়ে সবচেয়ে সক্রিয় জনসমাজের সংস্থা ও সংগঠনগুলিকে সরকার নানাভাবে আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। এমনকি যে সব দাতা সংস্থারা অধিকারকেন্দ্রিক সক্রিয়তাকে নানাভাবে সমর্থন দিত তাদের উপর সরকারি আক্রমণ নেমে এসেছে খোলাখুলি। অন্যদিকে কর্পোরেট সোশাল রেস্পন্সিবিলিটি-র নামে যে সব দাতা সংস্থা এখন উন্নয়নের নানা কাজে ঢুকে পড়েছে, তারা স্পষ্টতই অধিকারের আইনগুলি নিয়ে কাজ করতে আদৌ আগ্রহী নয়। রাজনৈতিক দলগুলি এই সব অধিকার রূপায়ণের ব্যাপারে কোনও দিনই উদ্যোগী ছিল না, আজও নেই। ফলে সব মিলিয়ে এই আইনগুলির পাশে কেউ নেই।
শাসন ব্যবস্থায় অধিকার কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশ এসেছিল ১৯৯৫-১৯৯৬ সাল নাগাদ। তার প্রথম প্রকাশ হয়েছিল প্রতিবন্ধীদের অধিকার আইন দিয়ে। তারপর এসেছিল অনেকগুলি আইন, আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম অধিকার থাকলে সরকারকে দায়বদ্ধ করা যাবে। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাবে। প্রমাণিত হল তা হয়নি। নীতি, রাজনীতি দুটিই অধিকার পেরিয়ে এখন সরাসরি দয়া–কৃপায় আশ্রয় নিয়েছে। বদলে তা নাগরিকের কাছে চাইছে ভক্তি। সরকারের তৈরি আইন নিয়ে সরকারকে প্রশ্ন করলে এখন মিলছে, হয় দুর্নাম, নয়ত লাঠি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.