বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
মায়ের খাকি পোষাক। বুক-ঘেঁষে আটকানো বেবি-ক্যারিয়রে ছোট্ট এক শিশু। শেষ কয়েক দিন এমন একটি ছবি নিয়ে প্রচুর চর্চা হচ্ছে সমাজমাধ্যমে। ক্যারিয়ারে ঝোলানো বাচ্চারা মায়ের বুকের ওমে নিশ্চিন্ত আরামে থাকে, হাঁটাচলার দুলুনিতে ঘুমিয়েও পড়ে সহজেই। আজকাল পথেঘাটে এমন মা-শিশু যুগল হামেশাই দেখা যায়। এই ছবিটি এমনিতে ভাইরাল হতো না, হয়েছে কেবল মায়ের পেশা এবং কর্মস্থলের কারণে। ছবির মা আরপিএফ-এর কনস্টেবল রীনা, বুকে শিশুটিকে নিয়ে নয়াদিল্লি রেল স্টেশনে ভিড় সামলাচ্ছিলেন। এ ভিড় আবার যে-সে ভিড় নয়। দেশ সুদ্ধু লোক আঁতকে উঠে দেখেছে, এই ভিড়েই পদপৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন শিশু-সহ আঠেরো জন মানুষ। আহত হয়েছেন কত জন, তার ইয়ত্তা নেই। রীনার ছবি দেখে হইহই পড়ে গিয়েছে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে — যে হাত দোলনা দোলায়, সেই হাতই দেশ শাসন করে। মা আসলে দশভুজা, একখানি হাত তাঁর সর্বদা শিশুর মাথায়। হাজারটা কাজ তিনি এক সঙ্গে করতে পারেন, লুকনো আটখানা হাত প্রয়োজন মতো বের করে। আশার কথা, এত হইহই প্রশংসা আর উথলে ওঠা আবেগে বাঁধ দিতে দু’এক জন ঠাণ্ডা মাথার মানুষ বলছেন, ‘‘রোসো বাপু! মেয়েদের আর মায়েদের মহিমা কীর্তন করতে গিয়ে আসল প্রশ্নগুলো ভুলে যাচ্ছো না তো?’ অমন একটা বিপজ্জনক জায়গা, যেখানে জারি করা হয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত চূড়ান্ত সতর্কতা, সেখানে একটা দুধের শিশুকে কি নিয়ে যাওয়ার কথা? কতখানি নিরুপায় হলে এক জন মা বাচ্চাকে নিয়ে অত বিপদের কাজ সামলাতে যান, সেটা এক বার ভেবে দেখব না আমরা?’’
কাজের জায়গায় ক্রেশের দাবি নতুন নয়। স্রেফ বাচ্চাকে দেখার কেউ নেই বলে কত মেয়ে কাজে যোগ দিতে পারেন না, কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন! আজ থেকে ৫০ বছর আগে, সেই ১৯৭৪ সালে দেশে মেয়েদের অবস্থা নিয়ে একটি চমৎকার রিপোর্ট লেখা হয়। তার নাম ‘টুওয়ার্ডস ইক্যুয়ালিটি: রিপোর্ট অন দ্য স্টেটাস অব উইমেন ইন ইন্ডিয়া’। সেখানেও বার বার জোর দেওয়া হয়েছিল কর্মক্ষেত্রে ক্রেশের গুরুত্বের উপরে।
কাজের বাজারে নারী-পুরুষ বৈষম্য প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন লিখেছেন, ‘‘চারপাশে এখন যা দেখি, তা আসলে ইতিহাসের কৌটোর তলায় লেগে থাকা গুঁড়ো।’’ দু’শো বছরের তথ্য ঘেঁটে মহিলাদের কাজে যোগদান এবং পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে মজুরির ফারাক নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, উনবিংশ শতকে যখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ক্রমশ শিল্পমুখী চেহারা নিতে থাকে, তখন বিবাহিত মহিলারা সরে আসেন শ্রমের বাজার থেকে। বিংশ শতকে পরিষেবা ক্ষেত্রের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ‘কর্মরতা’দের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করে।
ক্লডিয়া দেখিয়েছেন, উন্নত বিশ্বে শিক্ষিত মহিলারা এখন কাজের বাজারে উপস্থিত থাকলেও রোজগার বা পদোন্নতির নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন তাঁদের এক সময়ের পুরুষ সহপাঠীদের তুলনায়। এ সব নিয়ে যে সে সব দেশে চর্চা হয় না, তা কিন্তু নয়। নারী আন্দোলনের কর্মীরা বার বার বলেন, মহিলাদের আরও প্রতিযোগিতামুখী হতে হবে, শ্রমের বাজারে দরাদরির ক্ষেত্রে আরও কঠিন মনোভাব দেখাতে হবে, ম্যানেজারদের বৈষম্যমূলক আচরণের কথা আরও বেশি বেশি করে প্রকাশ্যে আনতে হবে, সরকারকে আরও কঠোর ভাবে নিশ্চিত করতে হবে একই কাজের জন্য যেন একই বেতন পান মহিলা ও পুরুষেরা। এ বিষয়ে নিত্য দিন কাগজের উত্তর-সম্পাদকীয় এবং বই লেখা হচ্ছে। ব্যক্তিগত স্তরে আবার মেয়েদের তাড়িয়ে বেড়ায় অন্য রকম হিসেবনিকেশ। নিজের মতোই কর্মব্যস্ত কাউকে কি ডেট করা ঠিক হবে? নিজস্ব একটা পরিবার চাইলেও কি ঠেকিয়ে রাখা উচিত সন্তানধারণের সিদ্ধান্ত? পঁয়ত্রিশ বছর বয়স, তবু পছন্দমতো সঙ্গী মেলেনি, এখনই কি করে ফেলা উচিত ডিম্বানু-সংরক্ষণ? হাইস্কুল থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তিলে তিলে তৈরি হয়েছে যে কেরিয়ার, তা কি ছেড়ে দেওয়া উচিত সন্তানপালনের কারণে? নইলে তার টিফিনবক্স গুছিয়ে দেবে কে? সাঁতারের ক্লাসে নিয়ে যাবে কে? স্কুল থেকে ফোন করলে কে-ই বা ছুটে যাবে উর্ধ্বশ্বাসে?
ক্লডিয়ার মতে, বিচ্ছিন্ন ভাবে আধুনিক সময়ের নিরিখে দেখলে এই সমস্যার তল পাওয়া অসম্ভব। কর্পোরেট সিঁড়ির শেষ ধাপে পোঁছনো দু’এক জন মহিলার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে, বা পিতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া জনাকয়েক আদর্শ বাবার নজির দেখিয়ে বিশেষ লাভ হবে না। গোটা সমাজের কাঠামোটাই যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই অসাম্যের ভিতের উপরে, সেখানে ব্যক্তির সাফল্য বা অসাফল্যে বেশি নজর দেওয়া যেন প্লেগের রোগীর হাতে এক বাক্স ব্যান্ড-এড তুলে দেওয়ার সমতুল। ইতিহাস খুঁড়ে অনুভব করতে হবে এই বৈষম্যের শিকড়কে, সমাজ-রাজনীতির গভীরে যা চারিয়ে গিয়েছে শতকের পর শতক ধরে। গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের কর্মখালি কলামের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত, ‘‘বাচ্চার মায়েরা দয়া করে আবেদন করবেন না,’’… ‘‘শিশু-সহ বিবাহিত মহিলারা কর্মপ্রার্থী হিসাবে স্বাগত নন,’’ … ‘‘গর্ভাবস্থায় বহু মহিলাই কাজ ছেড়ে দেন, তাই আমরা চাই ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পরেই বিবাহিত মহিলারা আবেদন করুন।’’
গত শতাব্দীর সাতের দশকেই কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দস্তুরমতো বিপ্লব ঘটে যায়। মেয়েদের বিয়ের বয়স বা উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে তাঁদের উপস্থিতি এক লাফে অনেকটা বেড়ে যায়। উপার্জন করতে শুরু করেন বহু মহিলা। নারীবাদী তাত্ত্বিকদের মতে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল বাজারে জন্মনিরোধক বড়ি বা পিলের আবির্ভাবের ফলে।
তার খানিক ছোঁয়াচ লেগেছিল এ দেশের শিক্ষিত অংশের মধ্যেও। তার প্রভাব আমরা দেখি সে সময়ের সাহিত্য, সিনেমা, নাটকে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বহু গল্প-উপন্যাসে পড়ি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে-বউদের চাকরি করতে যাওয়ার বিবরণ। গলির মোড়, বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি, রেস্টুরেন্ট, অফিসঘর, সর্বত্র দেখা যেতে লাগল একা মেয়েদের। টেলিফোন-অফিসে কাজ নেওয়া বিবাহিত মেয়ে সিঁথির সিঁদুর মুছে, হাতের শাঁখা খুলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরোয়, কেউ বা বিয়ে ভেঙে কুমারী সেজে একা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে মধ্যবিত্ত পাড়ায়, কেউ আবার এক-অফিস পুরুষের সামনে টাইপিস্টের কাজ করতে করতে ঠিক করে জীবনে কখনও প্রেমে পড়বে না। ঘরের বাইরে বা ভিতরে পুরুষও অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যায়। একার রোজগারে সংসার চালাতে না-পারার ব্যর্থতা, কর্তৃত্ব হারানোর ভয়, প্রেম, ঈর্ষা, সন্দেহ, নিরাপত্তাহীনতা নানা জটিল সমীকরণে উঠে আসে সে সব গল্প উপন্যাসে। ঘরের মহিলাটি কাজে বেরিয়ে গেলে অভ্যাসের যত্ন-আত্তিতেও টান পড়ে, হাত লাগাতে হয় ঘরের কাজে। শেষ পর্যন্ত অনেক পুরুষই বলে, করতে হবে না চাকরি, আমিই চালাব সংসার।
মৃণাল সেনের ‘পুনশ্চ’ ছবিতে সুবোধ বলে তার প্রেমিকা বাসু চাকরি পেলে সস্তা সিগারেট ছেড়ে সে গোল্ড ফ্লেক ধরবে। রিচার্ডসন অ্যান্ড রবার্টসন কোম্পানিতে বাসু চাকরি পাওয়ায় তার বাবা আপত্তি করে বলেন, ‘‘আমি তো এখনও বেঁচে আছি, পঙ্গুও হয়ে যাইনি!’’ গল্প এগোলে দেখা যায়, সেই মেয়ের টাকাতেই তাঁর সংসার চলছে। পরিবারের প্রতি সে দায়িত্ব পালন করলে তার প্রেমিকের মনে হয় তার পরিবার স্বার্থপর, বাসুর ভালমন্দের প্রতি কারোর মনোযোগ নেই। পুনশ্চ ছবিটি খুব সূক্ষ্ম ভাবে প্রশ্ন তোলে, বিয়ে করে মেয়েদের যে পরিবার হয়, সেখানে সে দায়িত্ব নিলে স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন ওঠে না কেন। পুনশ্চ বাসুর কাছাকাছি বয়সের আরেকটি মেয়ের গল্পও বলে। সে বাসুর অল্পশিক্ষিতা বউদি। স্বামী রাজনীতি করে বেড়ায়। বৃদ্ধ শ্বশুর ছেলের সম্পর্কে রাগ, বিরক্তি অনর্গল প্রকাশ করতে থাকেন বউমার কাছে। পাহাড়-প্রমাণ অপমান মাথায় নিয়ে সে বাসুকে গিয়ে বলে, ‘‘আমাকে ইংরেজি শেখাবে, ঠাকুরঝি?’’
আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস ‘শশীবাবুর সংসার’-এর কাহিনি নিয়ে সুধীর মুখোপাধ্যায়ের ছবিতেও আমরা দেখি অবসরপ্রাপ্ত দাপুটে শ্বশুর ছবি বিশ্বাসের আপত্তি অগ্রাহ্য করে মাথায় আঁচল দিয়ে চাকরি করতে যাচ্ছেন পুত্রবধূ অরুন্ধতী দেবী। স্বামীর কম রোজগার, তাই নিয়ে খোঁটা দেন শ্বশুর। তাই চাকরি করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। মেয়েদের বিষয় নিয়ে তৈরি করা সিনেমা-সিরিজের এখন ছড়াছড়ি। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, মেয়েদের কাজ বা স্বাধীন জীবিকা সংক্রান্ত জরুরি প্রশ্নগুলি কিন্তু ‘পুনশ্চ’ বা ‘শশীবাবুর সংসার’-এর মতো সিনেমাই তুলেছিল। আজকের সংবেদনশীল সিনেমাও সেই প্রশ্নগুলিকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। পাশাপাশি টিভি সিরিয়াল এবং মূল ধারার অনেক ছবিতে পারিবারিক মূল্যবোধের নামে লিঙ্গসাম্যের সমস্ত ধারণাকে দুরমুশ করা হচ্ছে। মেয়েদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বস্তুটিই যে সমস্ত গোলমালের মূলে, তা বুঝিয়ে দেওয়াই যেন নির্মাতাদের প্রধান কাজ। সমাজমাধ্যমের নারীবিদ্বেষীদের মতেও যত নষ্টের গোড়া ওই জিনিসটাই।