ট্রেড ইউনিয়নের দাবি গণদাবি হয়ে উঠবে কবে?
ট্রেড ইউনিয়নের দাবি গণদাবি হয়ে উঠবে কবে?
শান্তনু ভৌমিক
শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— ২৮-২৯ শে মার্চ, ২০২২ প্রায় ২৫ কোটি শ্রমিক-কৃষক ১২ দফা দাবিতে দু’দিনের ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী, শ্রমিক বিরোধী ও দেশবিরোধী আর্থিক নীতির প্রতিবাদে। দশটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও সবকটি জাতীয় ফেডারেশন একসঙ্গে এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সংযুক্ত কিসান মোর্চা এই ধর্মঘটে সমর্থন জানিয়ে গ্রামীণ ভারতেও ধর্মঘট পালন করে। এই ১২ দফা দাবির প্রায় ৭টি দাবিই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। যেমন আয়করের বাইরে থাকা নাগরিকদের মাসে নগদ ৭৫০০ টাকা প্রদান ও বিনামূল্যে রেশন, সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমানো, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানো, কৃষি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাজেটে আরও ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি, মনরেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং তা শহরেও লাগু করা ইত্যাদি। আর বাকি দাবিগুলি সরাসরি শ্রমিকের জীবন-জীবিকার সঙ্গে যুক্ত— যেমন, শ্রম কোড বাতিল করা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ বাতিল, ঠিকা কর্মীদের স্থায়ীকরণ, আইসিডিএস-আশা সহ বিভিন্ন প্রকল্প কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করা, জাতীয় পেনশন প্রকল্প বাতিল করা ইত্যাদি। অর্থাৎ এই ১২ দফা দাবির অধিকাংশই কোনও-না-কোনও ভাবে সাধারণ মানুষের দাবির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কিন্তু জনজীবন স্তব্ধ করতে পারল কি এই দু’দিনের ধর্মঘট? অর্থাৎ সাধারণ মানুষ কি এই দু’দিনের ধর্মঘটকে একেবারে নিজেদের ধর্মঘট বলে পালন করলেন? যদি তা না হয় তাহলে কোথাও কি কোন ব্যবধান তৈরি হচ্ছে? ট্রেড ইউনিয়ণের দাবি কি সর্বতোভাবে গণদাবি হয়ে উঠতে পারছে না? জনগণ এই দাবিগুলির সঙ্গে তাত্ত্বিকভাবে যুক্ত থাকলেও আত্মিক যোগাযোগ কি ক্ষীণ হচ্ছে? যদি সত্যি তা হয় তাহলে কিন্তু সেটা অশনি সঙ্কেত ভবিষ্যত সমাজের পক্ষে। এই পর্যালোচনায় ঢোকার আগে প্রথমে ট্রেড ইউনিয়নের ইতিহাসটা ফিরে দেখে নেওয়া যাক।
ট্রেড ইউনিয়নের জন্ম ও ইতিহাস
ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই শ্রমিকেরা সাম্রাজ্যবাদ শাসন এবং দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের শোষণ উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই-আন্দোলন চালিয়ে এসেছে। আধুনিক শিল্পের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে একসঙ্গে শ্রমজীবীর শ্রেণীর সংহতিও বেড়ে ওঠে। ভারতবর্ষে রেল, ডাক ও তার, বস্ত্র ও চা শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের শ্রেণী-আন্দোলনও বেড়ে ওঠে। শিল্পে কাজের অমানুষিক পরিবেশ ও শোষণ শ্রমিককে সংগ্রামের জমিতে এনে দাঁড় করায়। কিন্তু প্রথমদিকে জাতীয় নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের বিষয়ে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। কারণ তাঁদের ভয় ছিল যে শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করলে পাছে দেশিয় পুঁজিপতি মালিক শ্রেণী চটে যায় এবং তার ফলে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইতে তারা অংশগ্রহণ না করে। ১৯০৩-০৮ সময় কালে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে শুরু করে। এই সময়েই শ্রমিকরা ক্রমশ আশু আর্থিক বিষয়গুলি থেকে বৃহত্তর রাজনৈতিক বিষয়গুলিতে দৃষ্টিপাত করে এবং সচেতনভাবে বৃহত্তরভাবে সংগঠিত হতে থাকে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং ১৯০৮ সালে বাল গঙ্গাধর তিলকের ছয় বছরের কারাদণ্ডের প্রতিবাদে প্রায় ১ লাখ শ্রমিকের ছয়দিন ব্যাপী ধর্মঘট এই বৃহত্তরভাবে সংগঠিত হওয়ার পথে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। “Swaraj is my birth right and I shall have it.” এই কথা বলার অপরাধে বাল গঙ্গাধর তিলক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পরবর্তীকালে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সোভিয়েত বিপ্লব যখন বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবার শ্রমিক-কৃষকের যৌথ শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল, তখন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নতুন জোয়ার আসল। রাওলাট, সত্যাগ্রহ, অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলন ১৯২০-২২ সালে শ্রমিক শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করতে নতুনভাবে উৎসাহিত করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এআইটিইউসি) প্রতিষ্ঠিত হয় ৩১ অক্টোবর, ১৯২০ সালে আজ
থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে- যার প্রেসিডেন্ট ছিলেন লালা লাজপৎ রায় ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান চমন লাল। পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ যে পরস্পরের পরপূরক তা জন্মলগ্ন থেকেই শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন বুঝতে পারে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এই শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের সঙ্গে প্রথম থেকেই মানসিকভাবে যুক্ত থাকেন। পরবর্তীকালে মুজাফফর আহমেদ, ডাঙ্গে প্রমুখ কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরধাদের অংশগ্রহণ ও পরিচালনায় ১৯২১ সালে ঝরিয়াতে স্বরাজের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ জাতীয় কংগ্রেস তার লাহোর সেশনে ১৯২৯ সালে পূর্ণ স্বরাজের যে দাবিকে স্বীকৃতি দেয় তার প্রায় ৮ বছর আগেই এআইটিইউসি পূর্ণ স্বরাজের দাবি উত্থাপন করেছিল। ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি এবং ঔপনিবেশিক শাসনের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন যখন পূর্ণস্বরাজের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে তখন শ্রমিক শ্রেণী ভারতীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে প্রতিবাদ সংঘটিত করেন সারা ভারত জুড়ে। লালা লাজপৎ রায় লাঠির আঘাতে নিহত হন। একইসময় তিনটি স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে- “Down with imperialism“ ‘Inquilab Zindabad’’ এবং ‘workesr of the world unite”। অর্থাৎ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনজীবী, দেশবিরোধী ইত্যাদি বলে যতই গাল পাড়ুন, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের একটি অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে। জনগণের সঙ্গেই তারা সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরে শ্রমিক শ্রেণী খুব বেশী লাভবান হল না। যদিও ভাবা হয়েছিল ঔপনিবেশিকতার অবসান শ্রমিকের জীবনে নতুন ভোর আনবে কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে বাদ দিয়ে শুধু রাজনৈতিক মুক্তি এই নতুন ভোর আনতে পারল না। স্বাধীনতার পরে পরেই বুর্জোয়া ও জমিদারদের যে সম্মিলিত শক্তি সরকারে ক্ষমতাসীন হল তারা পুঁজিবাদী বিকাশের পথে হাঁটতে শুরু করল। পরিণতিতে সংবিধানে অঙ্গীকৃত সমাজতন্ত্রের অনুসারী সমাজ (Socialistic) গঠন সুদুরের স্বপ্নই থেকে গেল। বর্তমানে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির কর্মহীন বৃদ্ধি (jobless growth) ও উৎপাদনী ক্ষেত্রের বদলে পরিষেবা ক্ষেত্রের অধিকতর প্রসারণের ফলে কাজ কমার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যাও কমেছে। ২৯টি শ্রম আইনকে ৪টি শ্রম কোডে রূপান্তরিত করা হলে ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়নের দর কষাকষির ক্ষমতা একদিকে যেমন কমতে থাকছে অন্যদিকে খুব সহজেই ট্রেড ইউনিয়নকে বৃহৎ লক্ষ্য থেকে ক্ষুদ্র লক্ষ্যে ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। মার্কসের বর্ণনা অনুযায়ী ‘reserve army of labour’ যত বাড়বে, শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্দ্বন্দ্ব (intra-class contradiction) ততই বাড়বে কারণ বেকারত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মজুরির হার ও পরিমাণ নির্ধারণের রাশ চলে যেতে থাকবে মালিকপক্ষের হাতে। বেকারির জ্বালা ভুলে এই সচেতনতা আনা খুবই শক্ত যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাঁচানোর লড়াই শুধু ঐ সংস্থার ট্রেড ইউনিয়নের না, সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব বেকারদের কর্তব্যও বটে।
যে নয়া উদারবাদী অর্থনীতিতে স্থায়ী কাজ ব্যাপকহারে কমেছে সেখানে অসংগঠিত শ্রমিকের অধিকারের পরিধি যে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠবে সে আর নতুন কথা কি। কারণ তাদের কথা বলার সংগঠন থাকলেও দুর্বল ও সীমিত পরিধির। আর অর্থনৈতিক দাবির বিচারে সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকের ব্যবধান দুস্তর। শাসকশ্রেণীও দরকার মতো এই ব্যবধানকে ব্যবহার করে সামগ্রিকভাবে শ্রমিকশ্রেণীকে দুর্বল করার চেষ্টা করতে ছাড়ে না। যতদিন পর্যন্ত না বৃহত্তর লক্ষ্যে সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিক কে বাঁধা যাবে, ক্ষুদ্র লক্ষ্য তাদের সব সময় পরস্পরের প্রতি উদাসীন করে রাখবে। এক্ষেত্রেও সংগঠিত শ্রমিকদেরকেই বৃহত্তর দায়িত্ব নিতে হবে কারণ অপেক্ষাকৃত ভাবে কিছুটা হলেও অর্থনৈতিকভাবে তারা শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। কিন্তু সংগঠিত শ্রমিক সংগঠনগুলি কি সেই দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন নাকি উদাসীন? ট্রেড ইউনিয়নের দূরের ও কাছের লক্ষ্য সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে তারা প্রয়োজনীয় স্বার্থত্যাগও করতে পারবে না। এই দুটি লক্ষ্য পরস্পরের সাথে ওতপ্রোত সম্পর্কিত কিন্তু সম্পর্কের জটিলতা রয়েছে। অতি সন্তর্পনেই দুটি লক্ষ্যের সম্পর্কের পথে হাঁটতে হবে। এই পথ প্রায় razor's edge বলা যায়। প্রতি মুহূর্তে দুটি লক্ষ্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে দিকভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
ট্রেড ইউনিয়নের লক্ষ্য
ট্রেড ইউনিয়নের লক্ষ্য দুটি। একটি আশু লক্ষ্য আর অন্যটি দীর্ঘকালীন। আশু লক্ষ্য নিঃসন্দেহে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায় করা এবং মালিকের থেকে যতটা সম্ভব অধিকার অর্জন করা। মার্কস এটিকে মালিকের পুঁজি ও শ্রমিকের শ্রমের মধ্যেকার প্রতিদিনের গেরিলাযুদ্ধ বলছেন। আর বড় লক্ষ্যটি হল শ্রেণীচেতনা থেকে রাজনৈতিক চেতনায় উন্নীত হওয়া ও সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে অংশগ্রহণ করা। এই দুটি লক্ষ্যই একসঙ্গে যদি স্থিরীকৃত না হয় তাহলেই ট্রেড ইউনিয়ন জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাদের দাবি প্রকৃত অর্থে গণদাবি হলেও জনগণ সেই দাবিগুলির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়বেন। যদি আশু লক্ষ্যই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তাহলে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতির ফলের (effect) বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হয়, কারণগুলির (causes) সঙ্গে লড়াই এর ক্ষমতা সে হারায়। ১৯৯১ সালের পর থেকে যে ২১টি সাধারণ ধর্মঘট সংঘটিত হল সবকটি এই ফলের (effects) বিরুদ্ধে। একটি অধোগতিকে বাধা দিতে, বিপরীত কোনও গতি তৈরি করতে নয়। অর্থাৎ রোগের ওষুধ ব্যবহার করতে রোগ প্রতিরোধ করতে নয় মার্কসের কথায়- শ্রমজীবী মানুষ এখনও “পরিণতি বা ফলাফলের (effects) বিরুদ্ধে লড়ছে, কিন্তু সেই ফলাফলের কারণের (causes) বিরুদ্ধে লড়াই করছে না। তারা অধোগতিকে মন্থর করছে বটে কিন্তু গতির দিক বদল করতে পারছে না। তারা উপশমকারি (palliative) ব্যবহার করছে বটে কিন্তু রোগ নিরাময়ের (curing the malady) চেষ্টা করছে না।” অর্থাৎ আর্থিক নীতিকে বদল করতে হলে রাজনৈতিক সচেতনতার এমন স্তরে লড়াইকে নিয়ে যেতে হবে যে স্তর থেকে শ্রমজীবী মানুষ তার রাজনৈতিক বন্ধু বা শত্রুকে চিনে নিতে পারবে। নয়া উদারবাদকে প্রতিহত করা শুধুমাত্র ট্রেড ইউনিয়নের লড়াই নয়। এটি একটি সামূহিক রাজনৈতিক লড়াই। যতদিন পর্যন্ত না শ্রমজীবী মানুষ কোনও রাজনৈতিক শক্তি তাদের শ্রেণী স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের হয়ে লড়াই করে তা চিনে নিতে পারছে ততদিন পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে আর্থিক নীতির বদল সম্ভব নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও এটা সত্যি যে এই দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শ্রমিক কর্মচারীদের সেই রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব রয়েছে। এখন তারা মূলত অর্থনৈতিক আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকছেন। দু’একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সব ট্রেড ইউনিয়নই এহেন দোষে দুষ্ট। এই কারণেই দেখা যায় শ্রমিক-কর্মচারীরা সারা বছর যে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ধর্মঘট করছেন, ভোটের সময় আবার সেই সরকারকেই পুনর্নির্বাচিত করছেন। কোন রাজনৈতিক শক্তি তাদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করছে তা তারা চিনে নিতে তো পারছে না, উল্টে শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক স্বার্থই চরিতার্থ করছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া অধিকারের যে সংগ্রাম তার সঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে রাজনৈতিক ও আদর্শগত সচেতনা বাড়ানোর সংগ্রামকে। কিন্তু এটা একেবারেই সহজ কাজ নয়। সচেতনতার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম ছাড়া শ্রমজীবী মানুষের সত্যিকারের পরিবর্তন একেবারেই অসম্ভব। আবার এই সচেতনতার সংগ্রাম বর্তমানের কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই লাগাতার ভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বর্তমান শাসক নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি ও সাম্প্রদায়িকতাকে ক্রমাগত ব্যবহার করছে। বাজার ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিপজ্জনক সংমিশ্রণের দ্বারা শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণী সচেতনতার উপর ক্রমাগত আঘাত নেমে আসছে। এই শ্রেণী সচেতনতাই তার প্রকৃত বন্ধু ও শত্রুকে চিনে নিতে সাহায্য করে। নয়া-উদারবাদ শুধুমাত্র যে অর্থনৈতিক আক্রমণ করছে তা নয়, শ্রমিক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আদর্শগত আক্রমণও চালিয়ে যাচ্ছে। নয়া উদারবাদ মাধ্যমেই ভোগবাদ ও উগ্র স্বার্থপরতাকে আদর্শ হিসেবে প্রচার করে। সামূহিক শ্রেণী সচেতনতা নষ্ট করে ব্যক্তিসত্তা গুরুত্ব পায় নয়া উদারবাদী আদর্শে। যার ফলে মূল শ্রেণী বিষয়গুলিকে আমরা ভুলে যাই ও শাসকের শ্রেণীচরিত্রও বুঝতে ভুল করি। অর্থাৎ শ্রমিকের শ্রেণী সচেতনতাকে জাগ্রত করার অন্যতম শর্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে নয়া উদারবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নিরন্তর রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। লেলিন তার ‘কি করিতে হইবে’ গ্রন্থে লিখছেন “শ্রেণী নির্বিশেষে স্বৈরাচার, অত্যাচার, হিংসা, অপব্যবহারের বিরুদ্ধে যতক্ষণ না পর্যন্ত শ্রমিক তার বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে শিক্ষিত হয়ে উঠছে ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষের সচেতনতা সত্যিকারের রাজনৈতিক সচেতনতা হয়ে উঠতে পারেনা“। তিনি আরও বলেছেন – শ্রমজীবী মানুষকে "প্রত্যেকটি শ্রেণী যেসব প্রচলিত বাঁধাবুলি ও প্রতারণার মাধ্যমে নিজেদের প্রাণান্তক স্বার্থপরতাকে লুকিয়ে রাখে তাদের যেমন মর্মোদ্ধার করতে হবে তেমনি তাদের ভেতরের কাণ্ডকারখানা সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান এবং আইন কাদের স্বার্থসিদ্ধি করে এবং কীভাবে করে তাও বুঝতে হবে। কিন্তু এই স্বচ্ছ ধারণা যান্ত্রিকভাবে বই থেকে পাওয়া যাবে না। তা পাওয়া যাবে জলজ্যান্ত উদাহরণ, মুখোশ-খুলে-যাওয়া ঘটনা, প্রতি মুহূর্তে আমাদের চারপাশে ঘটতে থাকা ঘটনাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, চারদিকের আলোচনা এমনকি কানাঘুষো পর্যন্ত, বিভিন্ন ঘটনা, পরিসংখ্যান, আদালতের রায় ইত্যাদি প্রত্যেকটিকে ব্যাখ্যা করা। জনগণের বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপে শিক্ষার প্রয়োজনীয় এবং মৌলিক শর্ত হল ঘটনাবলির সামগ্রিক রাজনৈতিক স্বরূপ উদঘাটন।” এই রাজনৈতিক আদর্শগত চেতনা জাগ্রত করার অভাবেই আজও আমাদের সংগ্রাম রক্ষণাত্মক থেকে যাচ্ছে। যা কিনা শাসক শ্রেণীর আক্রমণের গতি মন্থর করার জন্য কিন্তু তার অভিমুখ পরিবর্তনের জন্য নয়। এই সংগ্রামকে উপেক্ষা করার অর্থ শ্রমজীবী মানুষকে উপেক্ষা করা যা চরম অপরাধ। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের জন্য চেতনার লড়াই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে ট্রেড ইউনিয়ন ক্রমাগতই জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হবে ও তাদের দাবিগুলি জনগণের দাবির কথা বললেও জনগণ সেগুলির দ্বারা খুব বেশি উজ্জীবিত হবে না। আশু অর্থনৈতিক দাবিতে মালিক শ্রেণী ও সরকারের সঙ্গে ক্রমাগত সংগ্রাম করার সঙ্গে সঙ্গে, গণসচেতনতা গড়ে তোলার লড়াইয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে ট্রেড ইউনিয়নের দাবিগুলিকে প্রকৃত অর্থে জনগণের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আর তখনই ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা ধর্মঘট শ্রমজীবী জনতার সমর্থন লাভ করে সত্যিকারের সাধারণ ধর্মঘটের রূপ ধারণ করতে পারবে এবং গণদাবিগুলিকে ছিনিয়ে নিতে পারবে।
ঋণ স্বীকার: শতঞ্জীব দাস, প্রাক্তন সহ-সভাপতি সারা ভারত বীমা কর্মচারী সমিতি
— লেখক জীবন বীমা কর্মচারী সমিতির কলকাতা সংগঠক।