বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ জুলাই ২০২২— ১৯৩৭ সালে কবি সমর সেন বেকার যুবকের অভিশপ্ত জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে ছন্দবন্দে লিখেছিলেন—
কলতলায় ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক-সভ্যতার শূণ্য মরুভূমি।
পরাধীন ভারতের বেকার যুবকের যন্ত্রণাদীর্ণ জীবনকে ‘শূণ্য মরুভূমি’র সঙ্গে তুলনায় করেছিলেন কবি সমর সেন তাঁর একটি বেকার প্রেমিক কবিতায়। তার এক দশক পরে দেশ স্বাধীন হয়। ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে দেশের সাবালক হওয়ার বয়সও হয়ে গেল পঁচাত্তর বছর। সেই সাবালকত্বের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের তোড়জোড় চলছে দেশ জুড়ে। কত তার আয়োজন। কত তার জৌলুষ। অথচ আজও মরুভূমির শূণ্যতা বুকে নিয়ে দেশের যুব সমাজের সিংহভাগ অর্থবিযুক্ত দিশাহীন জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিদিন। যন্ত্রণায় দীর্ণ হতে হতে হয়ত আজও তারা সমাজকে বলছে—
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো
হানো ইস্পাতের মতো উদ্যত দিন।
বেকার যুবকের এই কাতর আর্তি দেশের রাষ্ট্র নায়কদের কর্ণকূহরে প্রবেশ করেনি। বেকারির জ্বালা দূর করে ‘নতুন পৃথিবী আনা’র কোনও পরিকল্পনা না করে তারা বরং সুদিনটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে। ফলে অসহনীয় বেকারিত্ব এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে যে কোনও দিন, যে কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে এদেশে।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, বেকারত্বের হারে (unemployment rate) দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত শীর্ষ স্থান অধিকার করেছে। ভারতে বেকারির শতকরা হার ৮.০ শতাংশ। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা দেশটির নাম মালদ্বীপ, বেকারি ৬.৩ শতাংশ। বাংলাদেশ (৫.৪), ভুটান (৫.০), শ্রীলঙ্কা (৪.৯), নেপাল (৪.৭), এমনকি পাকিস্তানেও (৪.৩) বেকারির হার ভারতের থেকে অনেকটাই কম। বেকারির আগ্নেয়গিরির উপর দাঁড়িয়ে আছে গোটা দেশ বিস্ফোরণের অপেক্ষায়। বেকারত্বের সমস্যা এতোটাই গভীর যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী কিংবা ডক্টরেট করা ছেলেমেয়েরাও ডোমের চাকরি পেতে মরিয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে আমাদের রাজ্যে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার চাকরির প্রবেশিকা টেট পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ২৩ লক্ষ। পরীক্ষা দিয়েছিলেন ২০ লক্ষ। ৪২ হাজার শূণ্য পদের জন্য এই বিপুল পরিমাণ আবেদন থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, রাজ্যের বেকারত্বের সমস্যার শেকড় কতটা গভীরে প্রোথিত। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যেটুকু সুযোগ সুবিধা ছিল তা সরকারি নীতির ফলে ব্যাপক হারে সংকুচিত হয়েছে। বিলগ্নিকরণের পথে হেঁটে দীর্ঘদিন ধরে অর্জিত জাতীয় সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে করপোরেট সংস্থার কাছে। একাধিক সরকারি সংস্থাকে বিলুপ্ত করা হয়েছে অথবা একাধিক সংস্থাকে একসাথে মিলিয়ে একটি করা হয়েছে। অনেক সংস্থাকে রাতারাতি বেমালুম বিলুপ্ত করা হয়েছে। জাতীয়করণের পর থেকে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে চাকরির একটা বড় পরিসর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি সরকার অত্যন্ত সুচারুভাবে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ করে একাধিক ব্যাঙ্কের অস্তিত্ব বিলোপ করেছে। ফলে কর্ম সংস্থান সংকুচিত হয়েছে। রেল বা অন্যত্র লক্ষ লক্ষ শূন্য পদ থাকা সত্ত্বেও সেই অর্থে কোনও নিয়োগ হচ্ছে না। চুক্তি-শ্রমিকদের মাধ্যমে আশু প্রয়োজন মিটিয়ে নিয়ে কোনও রকমে কাজ চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার বড় বেসরকারি বিনিয়োগের কোনও উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত আমাদের কাছে নেই। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠা করে প্রচুর কর্মসংস্থানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা কার্যকর হয়নি। যেটুকু বিনিয়োগ হয়েছে তা পুরোপুরি পুঁজি নির্ভর, শ্রম নির্ভর নয়। তাছাড়া কৃত্রিম মেধা (artificial intelligence) অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মানুষের কর্ম সংস্থানের জায়গা দখল করে নেওয়ার ফলে বেকার সমস্যা পাহাড় প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকরির এই আকালেও গ্রামীণ ভারতের বিশেষ করে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্রের যুবকরা লেখাপড়া শিখে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে স্থায়ী চাকরি পাওয়ার একটা স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত ছিল। সেনাবাহিনীর চাকরি করে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামাজিক সুরক্ষার দেওয়ার একটা বড় সুযোগ ছিল যুব সমাজের কাছে। প্রতি বছর প্রায় পঞ্চাশ হাজার ছেলেমেয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে পরিবারের জন্য একটা আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হত। কেন্দ্রীয় সরকারের নব ঘোষিত “অগ্নিপথ” প্রকল্প যুব সমাজের সেই স্বপ্নকে ভেঙে খানখান করে দিয়েছে। চার বছরের ঠিকা সৈনিকের জন্য তারা চার বছর ধরে প্রস্তুতি নেয়নি। পনেরো বছরের চাকরির নিরাপত্তা এবং অবসরকালীন সুযোগ সুবিধার কথা মাথায় রেখে তারা কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তুত করে তুলেছে। যুবদরদী, সেনাদরদী সরকার এখন বলছে চার বছরের জন্য তাদের ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ দেওয়া হবে। অবসরের পর সরকার তাদের আর কোনও দায়িত্ব নেবে না। বিজেপির দপ্তরে দপ্তরে, বেসরকারি সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে প্রাক্তন দেশরক্ষকদের দিন গুজরানের রসদ সংগ্রহ করে মোদি কথিত “আত্মনির্ভর” হতে হবে। এই প্রকল্প শুধু ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি নয়; দেশের বেকার যুব সমাজের প্রতি তীব্র অবমাননা। এই তীব্র অসম্মান এবং অনিশ্চয়তায় জারিত হয়ে রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে ফুঁসছে দেশের যুব সম্প্রদায়। বাস ট্রেন পুড়িয়ে, রাস্তা অবরোধ করে নিজেদের ক্ষোভকে জানান দিচ্ছে তারা। স্বপ্নভঙ্গের তীব্র দহন বুকে নিয়ে আসলে তারা নিজেদের অসহয়তাকে ব্যক্ত করে শাসককে সজাগ করতে চাইছে। কিন্তু শাসকশ্রেণী বেকারের কথায় কর্ণপাত করতে বিন্দুমাত্র রাজি নয়। ভারতবর্ষে বেকারি কোনওদিন রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠতে পারেনি। বেকারি ভোটের বাক্সে কোনও সময় কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই রাজনীতির কুশীলবরা এই বিষয়ে নির্বিকার শুধু নয়, নির্মমও বটে। অগ্নিবীর নিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন প্রশমিত করার জন্য নির্ঘন্টের আগে নিয়োগের সূচি এগিয়ে এনে, ঘোষণা করা হয়েছে যারা আন্দোলনে সামিল হবে তারা সরকারি চাকরিতে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না। এই হুমকি আসলে যুব সমাজের প্রতি সরকারের নৃশংস মানসিকতাকে ব্যক্ত করে।
বেকার যুবক-যুবতীদের প্রতি সরকার বাহাদূরের এই নির্মমতার দৃষ্টান্ত আমাদের রাজ্যেও বিরল নয়। এই তো গত কয়েকদিন আগের কথা, হবু শিক্ষকদের ন্যায় সঙ্গত আন্দোলনকে পুলিশ নামিয়ে ছত্রখান করা হল সকলের চোখের সামনে। যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শরীরশিক্ষা এবং কর্মশিক্ষা বিভাগের শিক্ষকদের সত্তর দিন ধরে চলা শান্তিপূর্ণ গণঅবস্থান ভেঙে দিয়ে মমতার পুলিশ লাঠিপেটা করে প্রিজন ভ্যানে তুলল। প্রকাশ্য দিবালোকে হবু শিক্ষিকার চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে মাতঙ্গিনী হাজারার পাদদেশে থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। সুবিধাভোগী রাজ্যের নাগরিক সমাজ শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের প্রতি এই নির্মমতা দেখেও নির্বিকার থাকল। অথচ এ কথা মহামান্য আদালতে প্রমাণ হয়ে গেছে যে মেধা তালিকায় নাম নথিভুক্ত প্রার্থীকে চাকরি না দিয়ে যোগ্যতার পরীক্ষায় অকৃতকার্য অযোগ্য প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট নিযুক্ত প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিত বাগের রিপোর্টে সরকারি স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি ভূরিভূরি প্রমাণ মিলেছে। কর্মশিক্ষা ও শরীর শিক্ষা, এসএসসির নবম-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষক নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির হদিস মিলেছে। মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা চাকরির দাবিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্ণা-অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন। কলকাতা হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে সিবিআই সিট গঠন করে গোটা বিষয়টির তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, স্কুল সার্ভিস কমিশনের (SSC) উপদেষ্টা কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান শান্তিপ্রসাদ সিনহা, উপ শিক্ষামন্ত্রী পরেশ অধিকারীসহ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের আধিকারিকদের সিবিআই জিজ্ঞেসাবাদ করেছে। উপশিক্ষা শিক্ষামন্ত্রী যে নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত সে কথা কোর্টে প্রমাণিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির সাক্ষ্য মিলেছে। মহামান্য আদালতের নির্দেশে ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অবৈধভাবে নিযুক্ত ২৬৯ জন প্রাথমিক শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার মাধ্যমে যে ৪২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিল তাতে ভারিভুরি দুর্নীতি হয়েছে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে গোটা স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাটাই দুর্নীতির পাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। গভীর পরিতাপের বিষয় এই যে কঠোর পরিশ্রম করে, অর্থ ব্যয়ে লেখাপড়া শিখে, চাকরি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে রাজ্যের হাজার হাজার বেকার যুবক-যুবতীকে ঘরবাড়ি ছেড়ে মাসের পর মাস রাজপথে বসে রোদে পুড়ে,জলে ভিজে ন্যায় অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আর অন্যদিকে অযোগ্য কিছু মানুষ রাজনৈতিক অনুমোদনের জোরে এবং অর্থবলকে কাজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রবেশাধিকার পেয়ে গিয়ে, শিক্ষা দানের মতো পবিত্র কাজকে কলুষিত করছে। শিক্ষক হিসেবে এর থেকে চরম লজ্জার এবং অপমানের আর
কি হতে পারে। আরো মর্মাহত হচ্ছি এই ভেবে যে শিক্ষিত এবং যোগ্য বেকারদের ন্যায্য দাবিকে সমর্থন না করে সরকার দুর্নীতির পক্ষে সওয়াল করছ। শিক্ষিত বেকারদের ন্যায্য দাবির পক্ষে বা দাঁড়িয়ে সরকার দুর্বৃত্তায়নকে হাতিয়ার করে শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনে যারা প্রবেশ করল, তাদের রক্ষা কবচ হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে ভীষণ ব্যগ্র।
লেখাপড়া না শিখে বা শিখতে না পেরে, প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেদের যোগ্য করে গড়ে না তুলে যারা অল্প বয়সে কায়িক শ্রমে জীবিকা অর্জনের পথ বেছে নিয়েছে তাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু যারা কঠোর পরিশ্রম করে, অর্থ ব্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করে, চাকরির পরীক্ষায় নিজেকে যোগ্যতর প্রমাণ করেও চাকরির নিয়োগ পত্র হাতে পেলেন না তাদের অসহায়তার কথা ভাবলে সত্যিই বিবেক ব্যথিত হয়।
দেশের ছাত্র-যুব সরকারের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুক্ষে দাঁড়িয়েছে। অগ্নিপথের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে। ভারতীয় কৃষক সভা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের প্রতিবাদী মানুষ তাদের সাথে সামিল হয়েছেন। এ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন চলছেই। সমাজের সর্ব স্তরের মানুষ এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। আসুন, আমরা সবাই মিলে দেশ জুড়ে চলা ছাত্র-যুবদের এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ভবিষ্যতে প্রজন্মের পাশে দাঁড়িয়ে দেশকে সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করি।