বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

পরিযায়ী শ্রমিকেরা কবে স্বীকৃতি পাবে?

পরিযায়ী শ্রমিকেরা কবে স্বীকৃতি পাবে?

অশোক সরকার

photo

পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কত তাই নিয়ে যথেষ্ট ধন্দ আছে। কারণ পরিযায়ী শ্রমিক বলতে আমরা যা বুঝি আমাদের সেন্সাস থেকে ঠিক সেই তথ্য পাওয়া যায় না। সেন্সাস অনুযায়ী পরিযায়ী হল সে, যে কমপক্ষে ছয়মাস ধরে জন্ম যে জেলায় তার বদলে অন্য কোথাও আছে। এর মধ্যে নানা রকমের মানুষ আছেন। বিবাহসূত্রে অন্য জায়গায়, পড়াশোনা করার জন্য অন্য জায়গায়, কর্মসূত্রে অন্য জায়গায়, এমনকি অতিথি হিসেবে অন্য যায়গায় আছেন ইত্যাদি। কর্মসূত্রে অন্য যায়গায় থাকা মানুষকে সেন্সাস বলে পরিযায়ী শ্রমিক। তবে এর মধ্যে আমিও পড়ি। আমার জন্ম বীরভূমে, কর্মসূত্রে আমি মাদ্রাজে, ভুবনেশ্বরে, দিল্লীতে বাঙ্গালোরে, কলকাতায় থেকেছি কিন্তু কেউ আমাকে পরিযায়ী শ্রমিক বলবে না।
মুশকিলটা আসলে পরিযায়ী শ্রমিকের পরিযানের চরিত্রকে নিয়ে। বাঙ্গালোরে তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে যে বাঙ্গালীরা যুক্ত আছেন তাঁরা এবং তাঁদের মত অন্যান্য কর্পোরেট সেক্টর, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে যারা যুক্ত আছেন তাঁরা অনেকেই জন্মস্থানের বাইরেই আছেন, কিন্তু তাঁরা সমাজের এলিট অংশ, স্থানীয় সমাজে তাঁরা অনেকটাই মিশে গেছেন বা নিজেদের সমাজ তৈরি করে নিয়েছেন, তাঁরা নিজেদের পরিযায়ী শ্রমিক বলে গণ্য করেন না, সমাজ বা রাষ্ট্রও তা গণ্য করে না।
পরিযায়ী শ্রমিক আসলে সেইজন যিনি কাজের প্রয়োজনে কিছু সময়ের জন্য বাইরে যান, এবং তাঁরা মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রে বা সংগঠিত ক্ষেত্রের অসংগঠিত অংশে কাজ করেন। তাঁরা নিজেদের পরিযায়ী শ্রমিক বলেই মনে করেন, এবং তাঁদের মালিক বা ম্যানেজারেরাও সেটাই মনে করেন। বৃহত্তর সমাজও তাই। তিন কি চার ধরনের পরিযান এঁদের মধ্যে দেখা যায়। এক, কৃষি শ্রমিক হিসেবে নির্দিষ্ট মাসে তাঁরা যান ও ফেরত আসেন, যাকে বলা হয় ঋতুভিত্তিক পরিযান। দুই, অল্প সময়ের কাজের জন্য পরিযান। অল্প সময়টি নির্দিষ্ট নয়, তিনমাস বা ছয় মাসও হতে পারে, কাজের উপর নির্ভর করে। এই দুটি পরিযান মূলত ঘটে অদক্ষ বা বড়জোর কিছু অর্ধ দক্ষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে। তৃতীয় ধরনের পরিযান হল বেশি সময়ের জন্য, তা নির্মাণ শিল্প বা কলকারখানায় হতে পারে বা পরিষেবাতেও হতে পারে। দিল্লিতে থাকার সময় দেখেছি সুখদেব বিহারে ও তার আশেপাশে যারা রিক্সা চালাতেন তাঁরা প্রায় সবাই হয় বিহারের কোনও জেলার নয়ত পশ্চিমবঙ্গের মালদা মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। এই পরিযানে সাধারণত অর্ধ দক্ষ ও দক্ষ শ্রমিকদেরই পাওয়া যায়। বেশি সময় বলতে ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি সময়। এই সময়ভাগগুলি আলগা ভাবে বলা; কারণ কাজের জোগান অনুযায়ী পরিযানের সময়ের অনেক তারতম্য দেখতে পাওয়া যায়।
পরিযায়ী শ্রমিকদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য তাঁরা অনেকেই একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে একাধিক জায়গায় কাজ করে বাড়ি ফেরেন। আসলে বারবার বাড়ি ফেরাটাই পরিযায়ী শ্রমিকদের আমাদের মত পরিযায়ীদের থেকে আলাদা করে। তাঁদের ভিটে থাকে এক জেলায় বা রাজ্যে আর কাজের জায়গা থাকে অন্য জেলায় বা রাজ্যে। কাজের জায়গা গ্রামে ও শহরে দুইই হতে পারে। কাজের জায়গা থেকে তাঁরা বার বার তাঁদের ভিটেতে ফেরত আসেন। তাই ইংরেজিতে একটা কথা ব্যবহার হয় circular migration, বা বৃত্তাকার পরিযান। লকডাউনের পর যে কোটি কোটি মানুষ ভিটেতে ফিরছিলেন, তাঁরা সবাই পরিযায়ী শ্রমিক। আমরা বৃত্তাকার পরিযায়ী নই, আমাদের সঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের এটাই মূল তফাত।
এই বৃত্তাকার পরিযায়ীদের সংখ্যা কত? একটা আন্দাজ পাওয়া যায় বিভিন্ন গবেষণা থেকে আর এনএসএসও সার্ভে থেকে। একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে ২০১১ সালে অল্প সময়ের (মানে ছয় মাসের কম) বৃত্তাকার পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ১০ লক্ষ, সেটা ২০১৮-এ বেড়ে হয় ৫ কোটি ৮০ লক্ষ।1 এর মধ্যে ২০১১ সালে শহরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ৪ কোটি, ২০১৮ সালে তা হল ৪ কোটি ৪০ লক্ষ, বাকিটা গ্রামে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক।
এর মধ্যে অন্য রাজ্যে গ্রামে বা শহরে কাজ করতে যাওয়া অল্প সময়ের বা লম্বা সময়ের (মানে ছয় মাসের বেশি) বৃত্তাকার পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কত? ২০১৮ সালে এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে অন্য রাজ্যে অল্প সময়ের জন্য শহরে কাজ করতে যাওয়া বৃত্তাকার পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লক্ষ। অর্থাৎ বাকি ২ কোটি মানুষ রাজ্যের মধ্যেই কোনও শহরে বা টাউনে অল্প সময়ের জন্য কাজ করতে গেছেন। অন্য রাজ্যে লম্বা সময়ের জন্য শহরে কাজ করতে যাওয়া বৃত্তাকার পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ৯০ লক্ষ। এও জানা যাচ্ছে যে অন্য রাজ্যের গ্রামে বৃত্তাকার পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা মোট হল ৯০ লক্ষ, যার মধ্যে অল্প সময়ের জন্য যাচ্ছেন এমন মানুষ ৪০ লক্ষ আর লম্বা সময়ের জন্য কাজ করতে যাচ্ছেন ৫০ লক্ষ। গ্রামে কাজ বলতে কৃষি শ্রমিকের কাজ, বড় বড় ফলের বাগানে কাজ (যেমন আম, পেয়ারা, আতা, আপেল ইত্যাদি), চা বা কফি বা নারকেল বাগানে কাজ, অথবা কাপাস, আখ জাতীয় ফসলের চাষের ক্ষেতে কাজকে বোঝাচ্ছে। এছাড়া ইটভাটা, পাথর খাদান, চাল কল জাতীয় গ্রামীণ অ-কৃষি কাজেও তাঁদের পাওয়া যায়।
এই যে হিসেবগুলি দিলাম এগুলি সবই আনুমানিক। এনএসএসও ২০০৭-২০০৮ সালে একটা পরিযানের সার্ভে করেছিল যেখানে অল্প সময়ের বৃত্তাকার পরিযান, লম্বা সময়ের পরিযান, পরিবার সমেত পরিযান, ইত্যাদি নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছিল। এর পরে ২০২০-২১-এ periodic labour force survey যে পরিযানের সার্ভে করেছে সেখানে সেন্সাসের সংজ্ঞাই ব্যবহার হয়েছে, ফলে পরিযায়ী শ্রমিকের আসল চিত্র তার থেকে বেরোয় না।
পরিযায়ী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তাদের সেই পরিচিতি। যেহেতু তাঁদের বড় অংশ অস্থায়ী শ্রমিক তাই গন্তব্যের রাজ্যও তাঁদের, সেই রাজ্যের মানুষের সঙ্গে এক করে দেখতে রাজি নয়। মালিক ও ম্যানেজমেন্ট তাই চায়। এটা কারুর মনে আসে না যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা আসলে গন্তব্য রাজ্যের অর্থনীতি এবং সম্পদ বৃদ্ধিতে একটা বড় অবদান রাখে। ২০২০ সালের এক রিপোর্টে International Labour Organisation বলে ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকেরা দেশের জিডিপিতে ১০ভাগ অবদান রাখে। ২০২০-র হিসেবে তা ২ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা। সব রকমের পরিযায়ী শ্রমিক আর সব রকমের গন্তব্যস্থল ধরলে মাত্র ১০-১২টি রাজ্য হবে। অর্থাৎ এই অবদান মাত্র ১০-১২টা রাজ্য থেকে আসছে, যার অর্থ ওই সব রাজ্যগুলির state domestic product-এ পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান ১০ ভাগের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ সেই রাজ্যগুলিও পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন।
ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপন্নতার শেষ নেই। এই বিষয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে। একটি উদাহরণ দিলেই বিপন্নতার আন্দাজ পাওয়া যাবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তরফে দিল্লী, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, হরিয়ানায় নির্মাণকর্মী, কারখানার শ্রমিক, হোটেল রেস্তোরাঁর কর্মী, কৃষি শ্রমিক, রিকশাচালক, গৃহ কর্মী হিসেবে কর্মরত ৪০০ করে মোট ১৬০০ শ্রমিকদের মধ্যে একটি সার্ভে হয়েছিল ২০১৯ সালে। দেখা গেল ৮০-৮৫ ভাগের বেশি পরিযায়ী কর্মীদের হয় থাকার কোনও ঘর নেই, অথবা সেই ঘর অতি নিম্নমানের। ৭০-৭৫ ভাগ কর্মীর কাজে স্বাস্থ্যের ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে, তার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই। ৬০-৬৫ ভাগ কর্মী কোন সরকারি সরকারি যোজনার সুবিধা পাননি। ৪৮-৫২ ভাগ কর্মীকে ৮ ঘণ্টার অনেক বেশি কাজ করতে হয়, ইত্যাদি। এছাড়া, স্বাস্থ্য সুবিধা না পাওয়া, দালালদের ও ম্যানেজমেন্টের তরফে নানা হয়রানি ও কম মজুরি পাওয়া, অন্যান্য বিপন্নতা তো আছেই।2 এই ধরনের বিপন্নতার কথা প্রায় সব গবেষণাতেই উঠে এসেছে।
কি করণীয় তাই নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তাতে কয়েকটি বিশেষ কাজের কথা উঠে এসেছে। এক, পরিযায়ী শ্রমিকদের যারা নিয়োগ করছেন তাঁদের শ্রম দপ্তরের কাছে সেই শ্রমিকদের নাম ঠিকানা নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। দুই, পরিযায়ী শ্রমিকেরা যাতে রেশনের বরাদ্দ পায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। তা করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের মত অন্যান্য রাজ্যেও ব্যক্তি প্রতি রেশন কার্ড চালু করতে হবে, এবং এই কার্ডগুলি ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতই সারা দেশে ব্যবহারযোগ্য এই আইন আনতে হবে। তিন, গন্তব্য রাজ্যগুলিতে migrant labour welfare board তৈরি করে পরিযায়ী শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচা করতে হবে। প্রয়োজনে যে সব ক্ষেত্রে পরিযায়ী শ্রমিক ব্যবহার হচ্ছে সেখানে বিশেষ সেস বসাতে হবে। চার, নির্মাণকর্মীদের জন্য বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য রাজ্যের যে প্রকল্প আছে তাতে পরিযায়ী শ্রমিকদেরও সামিল করতে হবে। পাঁচ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটলে বিমা ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত গন্তব্য রাজ্যগুলিকেই করতে হবে। এই মুহূর্তে তো গন্তব্য রাজ্যগুলি স্বীকারই করে না যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা অর্থনীতির বড় অংশীদার, এই পাঁচটি পদক্ষেপ সেই স্বীকৃতির প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। ❑
1 Ravi Srivastava, Covid 19 and circular migration in India; Review of Agrarian Studies vol 10, issue 1, January-June 2020.
2 https://nhrc.nic.in/sites/default/files/Approved_Health%20and%20social%20security%20ISMW_KDS-NHRC.pdf

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.