বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

পথই যেখানে নীতিহীন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক

পথই যেখানে নীতিহীন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক

দীপক পিপলাই

(এক)
শ্রমজীবী ভাষা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— জ্ঞান হওয়া থেকেই দেখছি পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি আর কংগ্রেস দলের লড়াই। পঞ্চাশের দশক থেকেই। কংগ্রেসের কোনও মিটিং মিছিল ছোটবেলায় কখনও দেখেছি বলে মনে পড়েনা। কংগ্রেস মানেই তখন শাসক; মন্ত্রী, মালিক, জোতদার, মজুতদার-কালোবাজারী, এদের দল। সরকার কিম্বা মালিক, জোতদার অথবা মজুতদার, এদের বিরুদ্ধে মিছিল, মিটিং, হরতাল, সবই করে কমিউনিস্টরা। প্রতিবাদের একমাত্র প্রতীকই ছিলো লালঝাণ্ডা। কমিউনিস্টদের মিছিলে টুকটুকে চেহারার বাবু-বিবিদের দেখাই যেতো না। ভাঙাচোরা মানুষরাই ছিলেন তাঁদের প্রধান শক্তি। মিছিল মানেই যেন অবধারিত পুলিশের লাঠি। কল-কারখানায় স্ট্রাইক মানেই মালিকের পোষা কংগ্রেসী গুন্ডাদের হামলা। হরতাল মানেই পুলিশের লাঠি ও গুলি। "পুলিশের লাঠি ঝাঁটার কাঠি/ ভয় করেনা কমিউনিস্ট পার্টি।" কিম্বা "পুলিশ তুমি যতোই মারো/ মাইনে তোমার একশো বারো।" এই সবই ছিলো তখন গণআন্দোলনের শ্লোগান। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কোনও গণআন্দোলন মানেই ছিলো অনিবার্যভাবে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র সহ অসংখ্য মৃত্যুর রক্তাক্ত ইতিহাস রচনা।
কমিউনিস্ট পার্টি এবং কংগ্রেস, একে অপরের বিরোধী ছিলো। কখনও কোথাও মারামারিও হ'তো। কিন্তু দুই পক্ষেরই ছিলো কিছু সততা এবং আদর্শগত ভিত্তি। রাজনীতির হাল এখনকার মতো কদর্য কুৎসিত ছিলোনা। গুন্ডা, লম্পট, মোদো-মাতাল, জালিয়াত, চোরাকারবারীরা রাজনীতির কান্ডারী কখনোই ছিলোনা। বিভিন্ন এলাকার কুখ্যাত গুন্ডাদের বিভিন্ন কাজে লাগাতো কংগ্রেস নেতারা। কমিউনিস্টদের উপর আক্রমণ, উদ্বাস্তুদের উপর হামলাবাজি, কারখানায় স্ট্রাইকরত শ্রমিকদের পেটানো, দাঙ্গা বাধানো, ইত্যাদি সবরকম অপকর্মই করানো হ'তো এইসব গুণ্ডাদের দিয়ে। কিন্তু কখনোই এইসব গুণ্ডা-বদমাসরা কংগ্রেস দলের রাজনৈতিক মোড়ল ছিলোনা। কংগ্রেসে যেমন গুণ্ডা-পোষা নেতা ছিলো, তেমনি অনেক নেতাই আবার সম্মানীয় মানুষ ছিলেন তাঁদের ব্যক্তিগত সততার জন্য। কংগ্রেসী গুণ্ডাদের হামলাবাজী কমিউনিস্টরা নিশ্চয়ই হরিনাম সংকীর্তন ক'রে ঠেকাতে পারতো না। বাহুবলের মোকাবিলা অবশ্যই পেশীশক্তি দিয়েই করা হ'তো। তবে কংগ্রেস দলের মতো ভাড়া করা গুণ্ডা দিয়ে না। কমিউনিস্ট পার্টির পেশীশক্তি ছিলো পার্টিরই অকুতোভয়, আদর্শনিষ্ঠ এবং শক্তিশালী সদস্যরা। আদর্শের দিক থেকে প্রচন্ড কমিউনিস্ট-বিরোধীদেরও তখন দেখেছি, প্রশ্নহীন ব্যক্তিগত সততা এবং আত্মত্যাগের জন্য তাঁরাও কমিউনিস্টদের শ্রদ্ধা করতেন।
এখন মনে হয়, সবই যেন হারিয়ে যাওয়া রূপকথার সময়!
(দুই)
কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টি, দুটো সংগঠনই গঠিত হয়েছিলো পৃথক কিন্তু নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে। এখনকার মতো পরিচিত দুর্ণীতিগ্রস্ত, চরম সুবিধাবাদী, ভয়ঙ্কর অত্যাচারী, রাজনৈতিক ধান্দাবাজ, আপাদমস্তক ক্ষমতালোভী, পারিবারিক স্বার্থান্বেষী, ইত্যাদি - এইসব সামাজিক জঞ্জালদের জটলা হিসাবে কোনও 'দল' যে কখনও গঠন হ'তে পারে, তা ছিলো কল্পনারও বাইরে!
নীতি-নৈতিকতা বিষয়টাই যেন বর্তমানের সংসদীয় রাজনীতিতে অচল। সীমাহীন ও অনর্গল মিথ্যাচার; কথায় কথায় হুমকি-ধমকি, তোলাবাজি, চুরি-জোচ্চূরি, মারদাঙ্গা, ভাঙচুর-আগুন, বোমা-গুলি, খুনখারাপি, - অনেক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরই এখন এ'গুলো নিত্যকর্মপদ্ধতি! তারা সবরকম অপকর্মের 'গণতান্ত্রিক' ছাড়পত্র যেন পেয়েই গেছেন "নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি" হিসাবে! বর্তমানকালে ভারতবর্ষীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে খুনি, ধর্ষক, জালিয়াত, দাঙ্গাবাজ ইত্যাদিদের রমরমার খবর বহুবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা তথা ভারতবর্ষে "গণতান্ত্রিক" পথেই এদের উদয় ঘটে, এবং "আইন আইনের পথেই চলে।" শুধু অত্যাচারিত, নির্যাতীত, লুন্ঠিত মানুষরা বিচার পান না! 'তদন্ত'-র শেষ নেই, 'জিজ্ঞাসাদ'-এর ভড়ং-ও দেখা যায়। শুধু অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে সদর্পেই ঘুরে বেড়ায় বছরের পর বছর! "গণতন্ত্র"!
সংসদীয় রাজনীতির হাল কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তা বোঝা যায় প্রতিদিন নেতা-নেত্রীদের ভাষা ব্যবহারে এবং আচার-আচরণে। এতো নিম্নরুচির কথাবার্তা ও ভাষণ, পারস্পরিক হুমকি-ধমকি এবং খেস্তা-খিস্তির বন্যা, এ'সব দুঃস্বপ্নেও ভাবা যেতো না! মানুষের রোগভোগ এবং মৃত্যু নিয়েও যে ক্ষমতার রাজনীতিতে কামড়াকামড়ি চলতে পারে, তার লজ্জাজনক উদাহরণও তৈরি হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। নির্লজ্জ বেহায়ার মতো বাঘা বাঘা সংসদীয় নেতা-নেত্রীরা কে কতো নীচে নামতে পারে, তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে! এ বলে 'আমারে দ্যাখ', তো ও বলে 'আমারে দ্যাখ'। ''তুই কতো নামবি? আমি আরও নামবো।'' রাজনীতিহীন এই দুঃস্বপ্নময় পরিস্থিতিই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে সংসদীয় রাজনীতির "আইডেন্টিটি মার্কার" হয়ে উঠেছে। কোনও বিবেক নেই, বোধ নেই, বিকার নেই, লজ্জা-শরম কিচ্ছুটি নেই! আগে রাজনীতি কখনও কখনও ক্রিমিনালদের ব্যবহার করতো; এখন ক্রিমিনালরাই নিয়মিত রাজনীতিকে চালায়। তাদের টিকি ছোঁয়ার হিম্মৎ বা ইচ্ছাও রাজনৈতিক মোড়লদের নেই। ফলাফল যা হবার তা-ই হচ্ছে। রাজনীতির অঙ্গন ক্রমশই আরও বেশি বেশি ক'রে আকন্ঠ ধান্দাবাজ, অপরিসীম মূর্খ, আপাদমস্তক জালিয়াত, প্যাথলজিকাল মিথ্যেবাদীদের করায়ত্ত হয়ে পড়ছে।
আগে রাজনীতিকে মানুষ জানতো সমাজসেবার মাধ্যম হিসাবে; এখন দেখছে তা আসলে নিছক ব্যক্তিগত/ পারিবারিক ধান্দাবাজির উপায়। এবং ধান্দাবাজি সর্বস্ব রাজনীতির দাপটে, রাজনীতির অঙ্গন থেকে এইসব কেষ্টবিষ্টু নেতা-নেত্রীদের দৌলতে জনমানসে 'রাজনীতি' হয়ে উঠেছে ঘৃণ্য একটা শব্দ। 'বিদ্বজ্জন'দের, এমনকি 'কমিউনিস্ট' ছাপ্পা গায়ে নিয়ে ঘোরা কিছু মানুষও তাঁদের বিচিত্র প্রগতিশীলতা এবং হাস্যকর পাণ্ডিত্য দেখিয়ে যেভাবে এই কদর্য রাজনীতির শরিক হয়েছেন, তা-ও গভীর শঙ্কার বিষয়! এরপর, বিভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতির শ্রদ্ধেয় মানুষগুলো বোধহয় 'বোকা' হিসাবেই চিহ্নিত হবেন! গতকালের প্রায়-কপর্দকহীন রাজনীতির কারবারি আজ কীভাবে হঠাৎ লাখ লাখ টাকার মালিক হয়ে উঠলেন,- এ'প্রশ্ন কেউ আর করবে না! গতকালের প্রায়-নিঃস্ব পরিবার কোন জাদুমন্ত্রে বিপুল জমি এবং কোটিকোটি টাকার সম্পত্তি করতে পারেন,- সে'প্রশ্নও আর মনে জাগবে না!
(তিন)
সংসদীয় রাজনীতির এই অধঃপতনের আলোচনায়, সাধারণভাবে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক মাতব্বরদের শুধু না, সমগ্র সমাজকেই এই অবক্ষয় যেন গ্রাস করছে! বিচারব্যবস্থার ভূমিকা; বিভিন্ন সাংবিধানিক ও স্বাধীন কমিশন/ কমিটি/ সংস্থা ইত্যাদির কাজকর্ম; মুখ্য আমলাদেরও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের 'জো-হুকুম' চাকরের ভূমিকা; সমাজে ব্যাপক মানুষের মধ্যেও বিবেকহীনতার ব্যাপ্তি; - ভারতব্যাপী সংসদীয় গণতন্ত্রের সুদীর্ঘ অনুশীলনও এইসব অবক্ষয় থেকে সমাজকে রক্ষা করতে চায়নি/ পারেনি। এই অধঃপতিত রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত ঘটে চলেছে কিন্তু তথাকথিত মহান 'সংসদীয় গণতান্ত্রিক পথ'-এর সাথে পাল্লা দিয়েই! সংসদীয় রাজনীতির বয়স যতো বাড়ছে, ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক অধঃপতনও ততোই বাড়ছে।
প্রকৃত কমিউনিস্টদের মূল কাজের জায়গা চিরকালই সরাসরি কল-কারখানা খেত-খামার নদী-বন্দর মাঠ-ময়দান রাস্তা-ঘাটের শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে। আর নানা দলের মধ্যে সংসদীয় বাকবিতণ্ডার মূল রণাঙ্গণ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শাসকশ্রেণীর তৈরি করে দেওয়া আরামদায়ক ঠান্ডাঘর। অসংখ্য কমিউনিস্ট শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে আজীবন লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েও শেষপর্যন্ত থেকে যেতেন অভুক্ত ও নিঃস্ব। আর ঠান্ডাঘরে ঘোরতর কথার লড়াই চালানো হঠাৎ-রাজনীতিবিদরাও আজীবন বিপুল টাকা এবং ফোকোটে নানাধরনের সুবিধা ভোগ করেন শাসকশ্রেণীর বদান্যতায়। চরিত্রগতভাবেই বিপরীতধর্মী এই দুই ধরণের রাজনীতির গুণগত পার্থক্যের এটাও এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
অতি-সন্দেহজনক উৎস থেকে আসা শত-সহস্র কোটি টাকা খরচ ক'রে এবং "মারি অরি পারি যে কৌশলে" নীতি নিয়ে ভোটে লড়া ও 'জেতা'; সকল জনবিরোধী শক্তির আশির্বাদ মাথায় নিয়ে সবধরনের দুর্নীতিতে আকন্ঠ ডুবে থাকা; প্রতিদিন সমাজের বুকে নানারকম ঘৃণ্য কাজকর্মের নজির সৃষ্টি করা; - এই সবকিছুর নিশ্চিন্ত ওনিরুপোদ্রব ময়দান সংসদীয় রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গে কোনওদিন মাথা তুলতে না পারা, আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক, ব্রিটিশ আমলেও মানুষের উপর শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার নিয়ে টুঁ শব্দটিও না ক'রে শুধুমাত্র গরু-গোবর-গোমূত্র নিয়ে মশগুল হয়ে থাকা, উদ্ভট অজ্ঞানতার প্রচারক এবং চরম বর্বর-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিও এখানকার সামাজিক জঞ্জালদের সক্রিয় সহায়তায় রাজনীতিতে অবশেষে কিছুটা দাঁত ফোটাতে পেরেছে! সংসদীয় গণতন্ত্রের নিবিড় অনুশীলনের মাধ্যমে এমন সব দেশভক্ত (!)-দের হাতে এখন ভারতবর্ষের শাসনভার অর্পিত হয়েছে, যারা দীর্ঘকাল ধরে জনগণের পকেটের বিপুল টাকায় গড়ে ওঠা সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিগুলো এখন পেটোয়া লোকদের কাছে জলের দরে বেচেই দিচ্ছে! শুধু গত বছরেই (২০২১) যেখানে ভারতবর্ষের ৮৪% পরিবারের আয় কমেছে, সেখানে লক্ষলক্ষ কোটি টাকা সম্পদের মালিকের সংখ্যা বেড়েছে অন্তত ৪০ জন! ('দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস', ডিজিটাল এডিশনে, ১৭ জানুয়ারি ২০২২ দ্রষ্টব্য।) সবকিছুই "সংসদীয় গণতন্ত্র"-র প্রাপ্তি!
(চার)
লক্ষণীয় বিষয়, সংসদবাদী ঘরানার বাইরে, নানা ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের যা কিছু কর্মকাণ্ড হয়ে চলেছে, তা নিয়ে যতোই বিতর্ক থাক, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থপূরণের কদর্য ক্লেদ তাকে কলুষিত করতে পারেনি। বরং, মহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ আত্মত্যাগের এবং আত্মবলিদানের মহাকাব্য সেই অঙ্গনেই রচিত হয়ে চলেছে নিরন্তর। হাজার ত্রুটি বিচ্যুতি সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, কমিউনিস্ট রাজনীতি যে আসলে মহত্তম সামাজিক লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়েই চলে, সেই মহাসত্য ভারতবর্ষের বুকে একমাত্র সংসদবহির্ভূত রাজনীতিই বাঁচিয়ে রাখছে, আজও।
সংসদীয় রাজনীতিতে ভালো মানুষ অনেকেই ছিলেন এবং আছেন। তাঁরা অনেক চেষ্টাও চালিয়েছেন রাজনীতি ও সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে; ধনীদের শায়েস্তা এবং দরিদ্রদের কল্যাণ করতে। কিন্তু পারেননি। অনেক ভালো মানুষ আজও একে ঘিরে অনেক স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ধুরন্ধর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা আদৌ কোনওরকম ভালো কাজ করার জন্য এই রাজনীতি ভারতবর্ষে আমদানি করেনি। তারা তা করেছিলো নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, লুন্ঠন, দমন-পীড়ন, শাসন ইত্যাদি বজায় রাখার স্বার্থে। সেই 'সংসদীয়' পথে কোনও নেতার মনোগত বাসনা অনুযায়ী "Let there be light", and there was light, (Bible) কিম্বা "বহুকাল পরে হঠাৎ যেন রে অমানিশা গেল ফাটিয়া" ('সুপ্রভাত', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) – কোনওটারই তিলমাত্র সম্ভাবনা নেই। কোন কোন উদাহরণ, কী কী যুক্তি এবং কিসের ভিত্তিতে অনেক কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদও সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে আজও ওকালতি করেন, তা এক মহাবিস্ময়! এই বহূনিনাদিত সংসদীয় রাজনীতির পরিণামেই 'স্বাধীন' ভারতবর্ষ আজও ব্রিটিশ কমনওয়েলথ্-এর দাসত্বপূর্ণ জাল থেকে বেরোতে পারেনি। ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যস্তরের শাসকরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের চালু করা এমন সব আইনকানুন আজও এখানে প্রয়োগ করে, যা ব্রিটিশরা নিজেদের দেশেও খারিজ করে দিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতির এই মূল চরিত্রটুকু আজও উপলব্ধি করতে না পারলে, এবং সর্বদাই 'সংসদীয় গণতন্ত্র' নিয়ে আদিখ্যেতা করতে থাকলে, ভবিষ্যতে আরও বড়ো মুশকিল আছে। সবরকম দুর্ণীতি ও অবক্ষয়ের পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিকে রক্ষা ও লালনপালন করাই সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড়ো অবদান।
দুনিয়াজুড়েই সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান বিকলাঙ্গ, যুদ্ধবাজ, আধিপত্যবাদী ও বাক্যবাগিশ ভূমিকাও আজ প্রকট।
(পাঁচ)
কমিউনিস্টরা শোষণহীন সমাজ গঠনের সৈনিক। কিন্তু সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের মূল শক্তি এখানকার শ্রমজীবী জনগণ। শ্রমজীবীরা যতদিন না সংসদীয় পথের সর্বনাশা মোহ কাটিয়ে উঠে সমাজ পরিবর্তনের যোগ্য কারিগরের ভূমিকা পালন করতে পারবেন, ততদিন সামাজিক দুর্দশার অবসান হওয়া অসম্ভব। সুস্থ ও সুন্দর সমাজ কীভাবে গড়ে উঠবে, তা সমাজের তৃণমূল স্তর থেকে গড়ে ওঠা ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের ময়দান থেকেই সম্ভবত ঠিক হবে। কোনও 'অভিজ্ঞ'/ব্যর্থ নেতৃত্ব, কিম্বা আকাশ থেকে নেমে আসা কোনও দেবদূত সমাজ-উদ্ধারের কাজ ক'রে দেবে না। বারবার ডান-'বাম' বিচ্যুতির অভিঘাতে নিজেরা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হ'লেও, আজও একমাত্র কমিউনিস্ট শক্তিই সর্বদা নিপীড়িত জনগণের অকৃত্রিম ও আমৃত্যু সহযোগী। মহত্তম দার্শনিক আদর্শই তাঁদের এই ঐতিহাসিক ভূমিকা দাবি করে।
সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ অনেকেই করেন। কিন্তু আসল প্রয়োজন শোষণ-ভিত্তিক, ঘুনে ধরা, অন্যায় ও দুর্ণীতির আখড়া এই সমাজব্যবস্থাটাকেই পাল্টানো। সংসদীয় "লড়াই লড়াই খেলা" না। শ্রমজীবী জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, এই সমাজব্যবস্থার বদল ঘটানোই কমিউনিস্টদের মূল কাজ। কমিউনিস্টরা সংসদীয় রাজনীতিকে শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ-দমন-পীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে চালিত করছেন, নাকি কংগ্রেস সহ অন্যান্য বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই, শ্রমজীবীদের শক্তিকে সংসদীয় আসন দখলের লক্ষ্যে বিপথগামী করছেন, সেটাই প্রধান বিচার্য বিষয়।
এগোনো-পিছানো, চড়াই-উৎড়াই, আলো-অন্ধকারের সর্পিল পথ বেয়েই ইতিহাস চিরকাল এগিয়ে চলে। "কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?" ('মেঘনাদ বধ কাব্য', মাইকেল মধুসূদন দত্ত।) কোনও কিছুই চিরকালীন না। অতীত মানেই বর্তমান না; বর্তমান মানেও ভবিষ্যৎ না। আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে ইতিহাসের অজানা এবং সৃজনশীল পথ বেয়েই। সংসদবাদী মাতব্বরদের নির্দেশ না মেনে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.