বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

শ্রমজীবীর সংহতি কেন জরুরি

শ্রমজীবীর সংহতি কেন জরুরি

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২২— গত ১১ জুলাই, বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে, রাষ্ট্রপুঞ্জ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্টস’ (২০২২) রিপোর্টটি প্রকাশ করে। বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা এবং তার বিন্যাস সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের এই নথি তারা নিয়মিত তৈরি করে আসছে, এ-বারের রিপোর্টটি ২৭তম। এটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে পত্রপত্রিকায় ও সংবাদমাধ্যমে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে শিরোনাম হয় একটি খবর: আগামী বছরে ভারতের জনসংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। ভারত যে অচিরেই জনসংখ্যায় প্রথম হবে সেটা নতুন খবর নয়, কিন্তু এর আগে পর্যন্ত হিসেব ছিল— শিরোপাটি পেতে তাকে ২০২৭ অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এখন সংশোধিত অঙ্ক বলছে, সেই সময়ের চার বছর আগেই ক্রমাঙ্ক বদলাতে চলেছে। সংবাদের দুনিয়ায় এমন তথ্যের মার নেই। কিন্তু এটা কি সত্যিই বড় খবর?
সোজা উত্তর: না, এটা নিতান্তই একটা মামুলি পরিসংখ্যান। ভারতের পক্ষে প্রকৃত বড় খবর অন্যত্র। সেটা অধিবাসীদের সংখ্যায় নয়, সেই সংখ্যার বিন্যাসে। কোন বয়সের লোক কত, তার আনুপাতিক বিন্যাসে। বিশেষ করে যাঁদের বয়স স্বাভাবিক কর্মজীবনের উপযোগী, তাঁদের সংখ্যা বাকিদের— অর্থাৎ শিশু ও বৃদ্ধদের— তুলনায় কত, সেই অনুপাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যায় ‘কর্মক্ষম’-এর অনুপাত যত বেশি, বা অন্য দিক থেকে দেখলে তাঁদের উপর নির্ভরশীল শিশু ও বৃদ্ধদের অনুপাত যত কম, আপাতদৃষ্টিতে জনবিন্যাস তত সুবিধেজনক। উল্টোটা হলে, শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যা আনুপাতিক ভাবে খুব বেশি হলে কর্মক্ষমদের উপর বড় রকমের চাপ পড়ে। জন্ম এবং মৃত্যুর হারের গতিপ্রকৃতির উপর নির্ভর করে দেশে দেশে এই বিন্যাসে তারতম্য ঘটে। যেমন, জাপানে বা ইউরোপের অনেক দেশে সেই চাপটা বিরাট আকার নিয়েছে, কারণ দেশগুলোয় বয়স্ক নাগরিকের অনুপাত ইতিমধ্যেই খুব বেশি, এবং ক্রমশ বাড়ছে।
এখানেই ভারতের ‘সুযোগ’। কেন? সেটা বোঝার আগে বলে নেওয়া দরকার, ‘ওয়ার্কিং এজ’ বা কর্মজীবনের বয়স-সীমা এ দেশে সাধারণত ধরা হয় ১৫ থেকে ৬৪। বলা বাহুল্য, বাস্তবের ছবিটা এর থেকে অনেকখানি আলাদা। পনেরোর চেয়ে কমবয়সি অনেক শিশুই কাজ করে, কারণ তারা কাজ করতে বাধ্য হয়; আবার ৬৪ পার করেও বহু লোক কাজ করেন, তাঁদেরও অধিকাংশেরই কাজ না করলে চলে না। কিন্তু পরিসংখ্যান সচরাচর নিয়মতন্ত্রকে মেনে নিয়ে সংগ্রহ করা হয়, তাই আমরাও সেই হিসেবই দেখব। এখন, ২০১১ সালে এ-দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সিদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। অনুপাতটি বাড়ছে এবং, রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, আরও দু’দশক ধরে বাড়বে। ১৯৪১ সালে সেটা পৌঁছবে ৬০ শতাংশে। অর্থাৎ, শতকরা ৬০ জন ভারতবাসী তখন প্রচলিত অর্থে কর্মক্ষম; নির্ধারিত বয়স অনুসারে যাঁদের আসন কর্মজীবনের বাইরে— আগে বা পরে— তাঁদের অনুপাত মাত্র ৪০ শতাংশ। এটা বড় খবর। এবং, আদর্শ অবস্থায়, সুখবর। কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় বেশি, সেটা তো সুখবরই হওয়ার কথা। প্রচলিত পরিভাষা ব্যবহার করে বলা যায়, ভারত আরও অনেক দিন ‘ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড’ তুলতে পারে— জনবিন্যাসের গতিপ্রকৃতি তাকে বিরাটসংখ্যক নাগরিকের কর্মশক্তি ব্যবহার করে সমৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে তরুণ ভারতের সামনে কর্মের প্রভায় উজ্জ্বল এক দৃপ্ত ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমরা কি দেখতে পারি না? স্লোগান তুলতে পারি না— কর্মক্ষমতা আমাদের ভিত্তি, সমৃদ্ধি আমাদের ভবিষ্যৎ?
না, পারি না। স্লোগানটি শুনতে খাসা, কিন্তু এই স্লোগানকে সত্য করে তুলতে হলে কর্মক্ষমতাকে ঠিক ভাবে কাজে লাগানো আবশ্যক। তা যদি না হয়, যাঁরা কাজ করতে পারেন তাঁদের যদি যথাযথ কাজের সুযোগ না-দেওয়া যায়, তা হলে জনবিন্যাসের সুযোগ আর সুযোগ থাকে না, তা পরিণত হয় সমস্যায়, সঙ্কটে, এমনকি বিপর্যয়ে। বস্তুত, ‘ডেমোগ্র্যাফিক ডিজাস্টার’ কথাটাও এখন সুপ্রচলিত, বাস্তবের তাড়নাতেই তার প্রচলন ঘটেছে। যদি বলি, ভারত সেই বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তা হলে ভুল বলা হবে, কারণ ভারত এখন সেই বিপর্যয়ের ভিতরে গিয়ে পড়েছে। এক কথায় বললে সমস্যাটি এই যে, বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম ভারতবাসীর কাজের যথাযথ সুযোগ নেই, এবং কর্মক্ষমের সংখ্যা যত বাড়ছে, কাজের সুযোগ সৃষ্টির অনুপাত তার ধারেকাছে নেই, বরং অনেক ক্ষেত্রেই সেই সুযোগ সঙ্কুচিত হচ্ছে। অদূর বা দূরতর ভবিষ্যতে এই ছবিটা পাল্টাবে, বিপর্যয় থেকে আমরা উদ্ধার পাব, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ বললে কম বলা হয়। এটাই এক কথায় কর্মী ভারতের স্বাধীনতা ৭৫। কর্মহীনতার অন্ধকারে আকীর্ণ বর্তমান এবং ভবিষ্যৎই তার বাস্তব।
কাজের সুযোগের অভাব কতটা, তার পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনায় প্রধানত বেকারত্বের মাত্রা নিয়েই কথা বলা হয়। আপাতদৃষ্টিতে সেটাই স্বাভাবিক। বেকারের সংখ্যা ও অনুপাত বেশি হলে এবং বাড়তে থাকলে বোঝা যায়, কাজের চাহিদার তুলনায় জোগান কম, এবং ক্রমশ দুইয়ের ফারাক বাড়ছে। এই নিয়ে সমালোচনার ভয়ে সরকার অনেক সময় বেকারত্বের পরিসংখ্যান ‘সংশোধন’ করতে তৎপর হয়ে ওঠে, কখনও বা চেপে রাখতেও। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সাড়ে তিন বছর আগে দ্বিতীয় পথটি অনুসরণের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল, তথ্য চেপে দেওয়ার ‘খবর’ ফাঁস হলে দৃশ্যত বেইজ্জতও হয়েছিল। তার পরেও বেকারের সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর জন্য নানা চেষ্টা চলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমশই আমাদের নির্ভরশীলতা বেড়েছে অ-সরকারি তথ্যের উপর। বিশেষত, সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) নামক প্রতিষ্ঠানটি অর্থনীতি সংক্রান্ত অন্য বিভিন্ন পরিসংখ্যানের পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও বেকারত্বের যে তথ্য সংগ্রহ করেন, তা এখন বিশেষভাবে কাজে লাগে। তাঁদের সর্বশেষ প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্ট অনুসারে, জুন মাসে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৭.৮ শতাংশ। এই অনুপাত তার আগের মাসের (৭.১২ শতাংশ) থেকে বেশ কিছুটা উপরে, যদিও তার আগের মাসেই হারটি এই একই স্তরে উঠেছিল। মাসে মাসে অনুপাতের ওঠানামা দিয়ে বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। বেকারত্বের অনুপাত থেকে বেকার সমস্যার যে ছবি পাওয়া যায়, নানা দিক থেকে তার অসম্পূর্ণতাও বহু-আলোচিত। কিন্তু যে বড় ছবিটা এই পরিসংখ্যান থেকে বেরিয়ে আসে, সেটা উদ্বেগজনক, কারণ এ-দেশের অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে ৮ শতাংশ বেকারত্ব, বিরল না হলেও, অ-স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, আমাদের মতো দেশে যাঁরা কাজ খোঁজেন তাঁদের পক্ষে সম্পূর্ণ বেকার থাকা অত্যন্ত কঠিন, কারণ পেট চলবে না। কেবলমাত্র টিকে থাকার তাগিদেই কিছু না কিছু করতে হয়, সামান্যতম রোজগারেও। সেই কারণেই ৮ শতাংশ সংখ্যাটা দেখতে কম মনে হলেও আসলে বিপুল।
কিন্তু আসলে কর্ম-সঙ্কট এর চেয়ে বহুগুণ বেশি বিপুল। কেন? প্রথম উত্তরটি লুকিয়ে আছে বেকারত্বের পরিমাপের মধ্যেই। কর্মক্ষম (প্রচলিত অর্থে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি) লোকেদের কত শতাংশ কাজ করছেন না, সেই অনুপাত দিয়ে বেকারত্ব মাপা হয় না, যাঁরা কর্মক্ষম এবং কাজ খুঁজছেন তাঁদের কত শতাংশ বেকার, বেকারত্বের হার নির্ধারণের সময় সেই অনুপাতটিই ধরা হয়। অর্থাৎ কর্মজীবনের উপযোগী বয়সের লোক হয়েও কেউ যদি কাজ না খোঁজেন, তা হলে তাঁকে বেকার বলে গণ্য করা হয় না। এই নিয়মের যুক্তি আছে, সেটা অনস্বীকার্য— যে কাজ খুঁজছেই না তার ক্ষেত্রে বেকারত্ব ব্যাপারটা সাধারণভাবে ঐচ্ছিক বলেই গণ্য করতে হয়, সেখানে ‘বেকার সমস্যা’ ব্যাপারটা দাঁড়ায় না। কিন্তু এই যুক্তির সীমাবদ্ধতাও আছে। গুরুতর সীমাবদ্ধতা। প্রথম কথা হল, কর্মক্ষম নাগরিকদের একটা বড় অংশ যদি কাজ না খোঁজেন এবং কর্মহীন থাকেন, সুতরাং উপার্জন না করেন, তা হলে তাঁরাও কার্যত শিশু বা বয়স্কদের গোত্রে পড়ে যান, অর্থাৎ কর্মীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সে ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের জনসংখ্যা বেশি হলেও ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড এমনিতেই কমে যায়— কাজের বাজার যেমনই হোক না কেন। প্রশ্ন উঠবে, কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কেন লোকে কাজ খোঁজে না? নানা কারণেই তো সেটা হতে পারে, হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, নানা ধরনের কারণেই অনেকে স্বেচ্ছায় কাজের বাজার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেন। কিন্তু যদি এমন হয় যে, একটা ন্যূনতম মানের কাজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকে কাজ খুঁজছেন না? কিংবা, তেমন কাজ খুঁজে খুঁজে বহু মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে কাজের বাজার থেকে সরে গেছেন? তা হলে? এখান থেকেই সীমাবদ্ধতার দ্বিতীয় মাত্রাটি বেরিয়ে আসে। ভারতে এই মুহূর্তেই সেটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি মাত্রা।
কেন, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা সংজ্ঞা পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল। ‘কাজ খোঁজা’ কথাটা এখানে খুব নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। যিনি মজুরি, বেতন বা অন্য ধরনের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতে ইচ্ছুক, তাঁকেই ‘কর্মপ্রার্থী’ বলে গণ্য করা হবে। তাঁদের মধ্যে একটি অংশ কাজ পেয়েছেন, তাঁরা কর্মী; অন্য একটি অংশ পাননি, তাঁরা বেকার। এর বাইরে আছেন একটা বিরাট সংখ্যার মানুষ যাঁরা কাজ করতে চান কিন্তু নিজেদের কর্মপ্রার্থী বলে ঘোষণা করতে নারাজ। এই কথাগুলো মাথায় রেখে এ-বার দু’একটি প্রাসঙ্গিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যেতে পারে। সিএমআইই-র একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এ দেশে ২০১৬ সালে কর্মজীবনের পরিধিতে থাকা নাগরিকদের ৪৭ শতাংশ লোক কাজ করছিলেন অথবা কাজ খুঁজছিলেন। ২০২২ সালে সেই অনুপাত নেমে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ। উল্টো দিক থেকে দেখলে মানেটা আরও স্পষ্ট হয়— বয়স অনুসারে যাঁদের কাজ করার কথা তাঁদের মধ্যে শতকরা ৫৩ জন ছ’বছর আগে কাজের বাজারের বাইরে ছিলেন, এখন এই গোত্রের লোকের অনুপাত দাঁড়িয়েছে শতকরা ৬০। সংখ্যার হিসেবে এর অর্থ: প্রায় ৪৫ কোটি কর্মক্ষম ভারতবাসী ‘কর্মপ্রার্থী’ নন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা স্বেচ্ছায় কাজ খোঁজা বন্ধ করেছেন, কিন্তু সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞানই বলে দেবে, এই ‘স্বেচ্ছা’ স্বাভাবিক হতে পারে না। বিশেষত, অতিমারি নামক বিপদ আর তার সঙ্গে সরকারের ভুল এবং অপদার্থ আর্থিক নীতি গত দু’বছরে অগণন মানুষের জীবনে যে তীব্র সঙ্কট ডেকে এনেছে, তার পরে কোটি কোটি নাগরিক ঘরে বসে সুখভোগ করার জন্য কাজ খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছেন, এমন তত্ত্ব শুনলে প্রধানমন্ত্রীর ভক্তবৃন্দ অচ্ছে দিন-এর বন্দনা গাইতে পারেন, কিন্তু অতি বড় আহাম্মকও তাতে যোগ দিতে পারবেন না।
কেন এত লোক কাজ খোঁজেন না এবং কেন তাঁদের সংখ্যাটা হু হু করে বাড়ছে? এর প্রথম এবং প্রধান কারণ: তাঁরা জানেন যে করবার মতো কাজ নেই, যে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে সেটা তাঁরা করতে পারবেন না বা করতে চান না। হয় তার পারিশ্রমিক অত্যন্ত কম, নয়তো পরিশ্রম এবং অন্য সমস্যা অত্যন্ত বেশি, অথবা সে-কাজ এতটাই অনিশ্চিত যে তার চেয়ে নিজের মতো দু’চার পয়সা রোজগারের চেষ্টা করা শ্রেয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যোগ হয় দুটো ব্যাপার: এক দিকে কাজের জায়গায় যাওয়ার এবং সেখানে নিরাপদে কাজ করবার সমস্যা, অন্য দিকে কাজ না করে ঘর সামলানোর দায়, যে দায় থেকে নিতান্ত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কারও রেহাই নেই। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে ভারতে কর্মক্ষম মেয়েদের কাজ খোঁজার অনুপাত ছেলেদের তুলনায় অনেক কম, এবং সেই ফারাক গত কয়েক বছরে আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যানেও তার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে— ২০১৬ থেকে ছ’বছরে প্রায় দু’কোটি কর্মক্ষম নারী কাজের বাজার থেকে সরে গেছেন, এখন যাঁরা সেই বাজারে আছেন তাঁদের অনুপাত দশ শতাংশের নীচে, অর্থাৎ শতকরা নব্বই জন কর্মক্ষম মেয়ে কাজ খুঁজছেন না। সিএমআইই-র কর্ণধার এবং দেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতি বিষয়ে অগ্রণী বিশেষজ্ঞ মহেশ ব্যাসের তীক্ষ্ণ মন্তব্য: “মেয়েরা যথেষ্ট সংখ্যায় কাজ করতে আসেন না, কারণ অনেক সময়েই কর্মক্ষেত্র তাঁদের প্রতি সদয় নয়।” মোদ্দা কথা হল, কর্মক্ষমদের একটা বিরাট এবং ক্রমবর্ধমান অংশ যে কাজের বাজারে আসছেন না, সেটাও কর্মসংস্থানের দৈন্যেরই প্রমাণ। তাঁদের কাজ না খোঁজার ফলে বেকারত্বের অনুপাতটা কম দেখাতে পারে, কিন্তু তাতে আহ্লাদের কোনও কারণ নেই, গভীর দুশ্চিন্তার হেতু আছে।
এই আলোচনা থেকে একটা সাধারণ সত্য বোধহয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যাঁরা কাজ করছেন এবং যাঁরা কাজ করছেন না, তাঁদের এক বিরাট অংশ একই পরিস্থিতির শিকার, একই সঙ্কটে জর্জরিত। পরিস্থিতিটা, এক কথায় বললে, অতলান্ত শোষণের, শ্রমজীবী মানুষকে তাঁর বেঁচে থাকার শেষ সীমায় ঠেলে দিয়ে যে শোষণের ব্যবস্থাটি নিজেকে ক্রমাগত পরিপুষ্ট করে চলে। যাঁরা সেই ব্যবস্থার বলয়ে কাজ পেয়েছেন এবং কাজ করছেন, তাঁদের কাজের কোনও নিরাপত্তা নেই, সেই কাজের বিনিময়ে যেটুকু না দিলে নয় সেটুকুই তাঁরা হাতে পান, যথার্থ সামাজিক নিরাপত্তার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, চিকিৎসা বা আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর জন্য যেটুকু বরাদ্দ থাকে তা-ও ঠিকঠাক পাওয়া দুষ্কর, এবং ছলে বলে কৌশলে সেই বরাদ্দও ছেঁটে দেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি যৌথ তৎপরতার শেষ নেই। কর্মীদের মধ্যে নানা বর্গবিভাজন এখনও আছে, কিন্তু একেবারে উপরতলার মুষ্টিমেয় কিছু বর্গকে বাদ দিলে কার্যত সমস্ত কর্মীর ক্ষেত্রেই শ্রমের অমর্যাদা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে— অধিকারহীনতা এবং সুযোগবঞ্চনার নিরিখে দুনিয়ার মজদুর প্রায় পুরোপুরি এক হয়ে গিয়েছেন, অন্তত আমাদের দেশে। অন্য দিকে, যাঁরা কাজ খুঁজেও পাচ্ছেন না এবং যাঁরা কাজ খুঁজছেনই না, এই দু’দলের প্রথম বর্গকে বেকার বলা হয়, দ্বিতীয় বর্গ সে-নামে বঞ্চিত, কিন্তু তাঁদের সমস্যা বহুলাংশে একই, এবং সেটা ওই অধিকারহীন ও সুযোগবঞ্চিত কর্মীদের সঙ্গেও অনেক দূর অবধি মিলে যায়। কর্মী এবং বেকারদের এক করে দেখার প্রশ্ন উঠছে না, কিন্তু তাঁদের দুর্দশা, অনিশ্চিতি এবং উদ্বেগের মূল চরিত্র একই। যাকে কাজের বাজার বলা হয়, সেই বাজার তাঁদের প্রায় কাউকেই সুস্থ জীবনের রসদ জোগায় না। এই বাস্তবই আজকের শ্রমজীবীর সঙ্কটের মূলে।
সঙ্কটের মোকাবিলার পথটাও খুঁজতে হবে এই বাস্তবের ভিত্তিতেই। পথ বলতে অবশ্যই সংগ্রামের পথ। সংগ্রাম ভিন্ন অন্য পথ কেন হতে পারে না, সেটা বহুচর্চিত, তবে দেড়শো বছরের বেশি আগে কার্ল মার্ক্স তাঁর ক্যাপিটাল, প্রথম খণ্ডের ‘কর্মদিবস’ শীর্ষক দশম অধ্যায়ে মোদ্দা কথাটি সংক্ষিপ্ততম বাক্যে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলায় যার অর্থ: (দু’পক্ষের) অধিকার যেখানে সমান, সেখানে ক্ষমতাই (সিদ্ধান্ত) নির্ধারণ করে দেয়। (ইংরেজি অনুবাদে: Between equal rights, force decides.) আপাত-রহস্যময় বাক্যটির তাৎপর্য সুগভীর এবং সুদূরপ্রসারী: কাজের বাজারে শ্রমিক এবং মালিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, শ্রমশক্তির বিক্রেতা এবং ক্রেতা হিসেবে তাঁদের অবস্থান সমান, কারণ দু’জনেরই সমান অধিকার— এক জনের বেচার অধিকার, আর এক জনের কেনার। কিন্তু এই আপাত-সমতার ভিত্তিমূলে যে বিপুল অসাম্য, সেটা ক্ষমতার অসাম্য। সুতরাং আপাত-সমানাধিকারের মোহে আবিষ্ট না থেকে শ্রমজীবীকে আপন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে, এবং সেই ক্ষমতা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। সমবেত ও সংগঠিত সংগ্রামই তার একমাত্র উপায়।
কিন্তু কেমন সেই সংগ্রাম? কারা তা লড়বে? সেখানেই বাস্তবের গুরুত্ব। যে বাস্তবের মধ্যে আমরা আছি, তার ভিত্তিতেই সংগ্রামের পথ সন্ধান করতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলা দরকার— কর্মী, বেকার এবং (বেকার হিসেবে চিহ্নিত না হলেও) কর্মহীন, সমস্ত বর্গের শ্রমজীবী মানুষের জীবনসঙ্কট যদি অনেকাংশে এক হয়ে যায়, তবে সেই সঙ্কটের মোকাবিলায় স্বাভাবিকভাবেই জরুরি হয়ে পড়ে একযোগে পথ খোঁজা। অর্থাৎ, শ্রমজীবী আন্দোলনকে এখন আর নিছক শ্রমিক আন্দোলন হিসেবে দেখলে চলবে না, তাকে হয়ে উঠতে হবে প্রায় সমস্ত বর্গের কর্মী এবং (স্বীকৃত অর্থে বেকার সহ) সমস্ত বর্গের কর্মহীন মানুষের সমবেত প্রয়াস। কীভাবে সেটা সম্ভব করে তোলা যায়, তা নিয়ে ভাববার দায়িত্ব আমাদের সকলের, কিন্তু শ্রমিক সংগঠন তথা শ্রমিক-স্বার্থের পক্ষে কর্মরত রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীগুলিকে এ বিষয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে। নিরন্তর আলোচনা সেই কর্তব্য সম্পাদনের এক অপরিহার্য অঙ্গ। এই লেখা একটা দিক থেকে— শ্রমজীবীর বাস্তবতার দিক থেকে— সেই আলোচনার সূত্রটুকু ধরিয়ে দেওয়ার সামান্য চেষ্টা, তার বেশি কিছু নয়।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.