বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
বুলডোজার ব্যবহারের দৌরাত্মে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ বিজেপি শাসিত রাজ্য ও অন্যান্য রাজ্যগুলিতে তথাকথিত অভিযুক্ত বা অপরাধীদের চটজলদি সাজা দিতে বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটি হিসাবে ২০২২ সাল থেকে দেড় লক্ষ ঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে ৭ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। এই ঘটনা শুধু দানবীয় নয়, সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।
বুলডোজার দৌরাত্ম কতটা দানবীয় ও অসাংবিধানিক এবং এইসব পদক্ষেপের গুড় রহস্যের প্রসঙ্গে আসার আগে কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ জরুরি।
এক, অযোধ্যায় রামপথ নির্মাণের অজুহাতে দোকান, মন্দির ও সাধারণ মানুষের বাসস্থান বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
দুই, “বুলডোজার বাবা” নামে খ্যাত যোগীজির বুলডোজার লক্ষ্নৌতে ৭০০র বেশি বস্তি ধ্বংস করে ৫০,০০০ এর বেশি মানুষের বাসস্থান ও জীবিকা কেড়ে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে।
তিন, লোকসভা নির্বাচনের পরে যোগীর বুলডোজারে ধ্বংস হয়েছে আকবর মহল্লার ১৮০০ পরিবারের বাসস্থান, বেশ কয়েকটি স্কুল, মাদ্রাসা, পাঁচটি বড় মন্দির ও মসজিদ।
চার, রাজস্থান সরকার ১৭ আগস্ট ২০২৪এ উদয়পুরের ফাজ্ঞিপির এলাকায় রশিদ নামে এক অটোরিকশা চালকের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তার অপরাধ, তার এক ভাড়াটের ১৫ বছরের ছেলে নাকি ঘটনার একদিন আগে ক্লাসরুমের বিবাদে এক হিন্দু ছেলেকে ছুরি চালিয়ে দিয়েছিল।
পাঁচ, ২০২২ এর ডিসেম্বরে জমি মাফিয়া ও এক মহিলার দ্বন্দ্বে বিহার পুলিশ বুলডোজার দিয়ে মহিলার বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়।
ছয়, ২৫ জুন, ২০২১ এ দিল্লির শাকারপুরের জেজে বস্তিতে ৩০০ ঝুপড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এই বস্তিতে বসবাসকারীরা ছিলেন মূলত বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত জনমজুর, রিকসাওয়ালা, অটোড্রাইভার ও গৃহ সহায়িকা। অভিযোগ, এরা জবরদখলকারী।
সাত, মধ্যপ্রদেশের পৃথ্বীরাজ চৌহান তো “বুলডোজার মামা” নামে পরিচিত। তাঁর সময়কার কাহিনি এতো বিশাল যে তার বিশদ বিবরণ নিষ্প্রয়োজন।
উপরোক্ত তথ্যগুলি দুষ্কর্মের হিমশৈলের চূড়ামাত্র। হাজার হাজার মানুষের নিরাশ্রয়ের একটা আভাস এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখের প্রয়োজন। বাম জমানায় হকার উচ্ছেদের তীব্র সমালোচক বর্তমান শাসকেরাও এবারের বিধানসভায় বিপুলভাবে জয়ী হয়ে হকার উচ্ছেদে বুলডোজার চালাতে ইতস্তত করেননি। হকারদের আন্দোলন ও জনমতের চাপে সরকার এই তান্ডব স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেও এই ব্যবস্থার যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অন্যদিকে, এই সরকারই বেআইনী বহুতল নির্মাণ ও উপকূল এলাকায় এক বড় সংখ্যক হোটেল ও রেস্তোরাঁ পরিবেশবিধি লঙ্ঘন করে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রমরমিয়ে ব্যবসা করে চলছে। পুরসভার অনুমোদন ছাড়া বহুতল বাড়ি ভেঙে পড়ে নির্মাণ শ্রমিক মৃত্যুর পরেও পুরসভা বাড়িটি গুঁড়িয়ে দিতে বুলডোজার চালায়নি। মন্দারমনির ১৪০টি বেআইনি হোটেল ও লজ জাতীয় পরিবেশ আদালত আড়াই বছরের পুরনো নির্দেশ কার্যকর করার জন্য পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসকের নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর আদেশে প্রত্যাহৃত হয়েছে। হোটেল মালিকেরা এই সুযোগে হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আদায় করে নিয়েছে। আইনের রক্ষাকারীর এমন দ্বিচারিতার ব্যাখ্যা কেবলমাত্র মুখ্যমন্ত্রীই দিতে পারেন।
উপরের ঘটনাক্রম কয়েকটি প্রবণতা পরিষ্কার। এক, বুলডোজারের টার্গেট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলমান। দুই, গৃহহীনেরা মূলত দলিত বা সহায় সম্বলহীন গরিব মানুষ। তিন, বেআইনী ঝুপড়ি ভাঙ্গার অভিযোগে যখন বুলডোজার চলেছে, তখন বেছে বেছে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের টার্গেট করেই তা করা হয়েছে। চার, সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনও ঘটনায় দোষী ব্যক্তির বাড়ি আদালতের অনুমোদন ছাড়াই গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে বসবাসকারী নিরাপরাধ ব্যক্তিরা পথে বসতে বাধ্য হয়েছেন।
স্পষ্টতই সরকার এইসব বেআইনি দুষ্কর্মগুলিকে “বুলডোজার ন্যায়” বলে যে সাফাই দিয়ে থাকে তা স্পষ্টতই শুধু মাত্র আইন-বিরুদ্ধই নয়, সংবিধান সম্মতও নয়। কোনও ব্যক্তির, এমনকি দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিরও বাড়ি শুধুমাত্র সরকারি নির্দেশে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় না। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার বিধান হল “কোন মানুষকে তার জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না”। একজনের জন্য পুরো পরিবারকে শাস্তি দেওয়া চলে না। এই সরল সত্যটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বি. আর. গাভাই এবং কে. ভি. বিশ্বনাথনের বেঞ্চ।
বেঞ্চের মূল বিচার্য্য বিষয় ছিল এই তাণ্ডবে আইনের যথাযথ পদ্ধতিকে (Due process of law) মান্যতা ও মানুষকে কোনও বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে কিনা।
সলিসিটর জেনারেল আদালতকে বলেন যে বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দেওয়া বেশির ভাগই বাড়ি মিউনিসিপাল বা পঞ্চায়েত আইনকে অমান্য করার কারণে ঘটেছে, কিছু কিছু ঘটনায় কাকতালীয়ভাবে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির বাড়িও ভাঙা পড়েছে।
এই “coincidence” ত্বত্ত্বকে মান্যতা দিয়েও ১৪ নভেম্বরের রায়ে বিচারকরা প্রশ্ন রাখেন একই এলাকায় কিছু বাড়িতে বুলডোজিং হলেও অন্য বাড়িগুলি কিভাবে অক্ষত থাকল? স্পষ্টতই বৈষম্য হয়েছে। তাছাড়া সংবিধানের ২১ নম্বর ধারাও লঙ্ঘিত হয়েছে।
সংবিধানের ১৪২ ধারার বিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ ন্যায়ের স্বার্থে বেঞ্চ তাঁদের রায়ে জানান: ১) বাড়ি ভাঙার আগে ১৫ দিনের কারণ দর্শনার নোটিশ ও আক্রান্ত ব্যক্তিকে শুনানির সুযোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। ২) উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের ডিজিটাল পোর্টালে শুনানির ও বাড়ি ভাঙার চূড়ান্ত আদেশনামা প্রকাশ আবশ্যিক। ৩) সমস্ত প্রক্রিয়াটির ভিডিওগ্রাফি থাকবে। ৪) বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার চূড়ান্ত আদেশের ১৫ দিন পরে আদেশ কার্যকর করা যাবে যদি না অভিযুক্ত ব্যক্তি উচ্চ আদালতে আপীল করে। ৫) বুলডোজারে ব্যবহার করা হবে অনন্যোপায় শেষ পন্থা। ৬) আদালতের নির্দেশের অন্যথা হলে কর্তৃপক্ষ আদালত অবমাননার দায়ে পড়বেন এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে ব্যক্তিগতভাবে খেসারতের অর্থ প্রদান করতে হবে।
নিঃসন্দেহে এই রায় দেশের বিচার ব্যবস্থার মাইলফলক হয়ে থাকবে। কর্তৃপক্ষ যে বিচার বিভাগকে উপেক্ষা করে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয় তা এই রায়ে স্পষ্ট।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য আ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষকেরা ২০২২ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছেন যে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলক বুলডোজারে ব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হবে বলে সকলেই আশাবাদী। আরো একটি আলোর ইঙ্গিত দেখাচ্ছে আক্রান্ত মানুষের জোটবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। বামপন্থীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল গনতান্ত্রিক শক্তি “লক্ষ্নৌ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি”র পতাকাতলে ভূমি বাঁচাও সত্যাগ্রহের প্রচার কর্মসূচি জোরকদমে শুরু করেছে। আক্রান্ত এলাকায় লাগাতার সভা ও প্রতিবাদ কর্মসূচির ফলে যোগী সরকার আর কোনও বুলডোজার ব্যবহার করা হবে না বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এক সভায় নদীর ৫০ মিটারের মধ্যে বসতির উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন তা ৩৫ মিটারে কমিয়ে আনার ঘোষণা করেছেন। এই সাফল্য মানুষের মধ্যে নতুন উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছে। অন্যান্য রাজ্যগুলিতেও আক্রান্ত মানুষ ক্রমশ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠছেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায় ও মানুষের জোটবদ্ধ প্রতিবাদে “বুলডোজার ন্যায়ে”র প্রবক্তাদের আস্ফালন একেবারে স্তব্ধ না হলেও বহুলাংশে যে স্তিমিত হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।