বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ মার্চ, ২০২২— নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টি অনেকদিন ধরেই সারা পৃথিবী জুড়ে একটি চর্চা বা আলোচনার বিষয়। অতি সাম্প্রতিককালে শোনা গেল যে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে আরও নাকি দেড়শ-দুশো বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। খবরটা আশাব্যঞ্জক কিছু নয়। বর্তমানের বিশ্ব অর্থনৈতিক রাজনীতি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সমগ্র পৃথিবীতে নানাবিধ বৈষম্যের চোরা স্রোত যেরকম অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে লিঙ্গবৈষম্যের অবসান সত্যিই একদিন হবে বলে ভাবতে দ্বিধান্বিত হতে হয়। সমগ্র বিশ্বের কথা ছেড়ে দিয়ে আমরা যদি আমাদের দেশ ভারতবর্ষের কথা ভাবি তাহলে আজকে এই ২০২২ সালে এসে সত্যিই শঙ্কিত হতে হয় কোনদিকে চলেছি আমরা! গত ১০-১২ বছর ধরে নারীর অর্জিত সমস্ত অধিকারকে লঙ্ঘন করা হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়নের সমস্ত প্রচেষ্ঠাগুলোকে ফেরৎ পাঠান হয়েছে গৃহাভিমুখে। ন্যূনতম সাংবিধানিক বা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে মহিলাদের। নারীর পোষাক-আশাক, আচার-আচরণ, ধর্মাধর্ম, প্রেম–প্রীতি সমস্তই রাষ্ট্রশক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। নারীর প্রাপ্য সম্মান-মর্যাদা, নাগরিক অধিকার সমূহ, কাজের অধিকার, ভাতা-মজুরি সর্বত্রই প্রকট হয়েছে বৈষম্যজনিত অবহেলা। ‘বেটী পঢ়াও, বেটী বাচাও’ শ্লোগান উচ্চারিত হলেও নারীর আলোকপ্রাপ্তি ঘটেনি সুষ্পষ্টভাবে। শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে নারী। জোটেনি সমকাজে সমমজুরির ন্যূনতম অধিকারটুকুও।
ইন্টারন্য়াশানাল লেবার অর্গানাইজেশন জানাচ্ছে যে, সমগ্র বিশ্বে মহিলারা জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ, শ্রমশক্তির ৩০ শতাংশ, কাজের ঘন্টার ৬০ শতাংশে নিয়োজিত, আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ গ্রহণ করেন এবং সম্পত্তির মাত্র ১ শতাংশ ভোগ করেন। সারা পৃথিবী জুড়ে বৈষম্যের এই বাতাবরণে ভারতবর্ষ এগিয়ে আছে অনেকটাই। ভারতবর্ষে কর্মরত জনসমষ্ঠির ৯৩ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, কেবলমাত্র ৭ শতাংশ কাজ করেন সংগঠিত ক্ষেত্রে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রাণাতিপাত পরিশ্রমের যোগ্য প্রতিদান— ন্যূনতম দৈনিক মজুরি বা সামাজিক সুরক্ষার কোনও আশ্বাস স্বাধীনতা উত্তর ৭৫ বছরে ভারতীয় নারী অর্জন করে উঠতে পারে নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, নগরায়ণের সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে রাস্তা, ব্রীজ, অট্টালিকা গৃহ ইত্যাদি নির্মাণ কার্য। সমীক্ষায় প্রকাশ যে, নির্মাণকার্যের অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় ৫ কোটি নারীপুরুষ কর্মরত এবং এই বৃহৎ কর্মসংস্থানের অনেকটাই পূর্ণ করছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। সমীক্ষায় আরও জানা যাচ্ছে যে নির্মাণশিল্পে কর্মরত নারী— পুরুষ কর্মীর ১০ ভাগের একভাগ মাত্র এবং মহিলা কর্মীরা পুরুষ কর্মীদের থেকে ৩০-৪০ শতাংশ কম মজুরি পান। নির্মাণশিল্পে যদিও প্রভূত পরিমাণে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, নারীশ্রমিকের চাহিদা কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম। লিঙ্গবৈষম্য এবং দক্ষতার অভাবকে এখানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, নারী বিবেচিত হয় অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে। মিস্ত্রীর কাজ পুরুষই করে, পুরুষ শিশু রাজমিস্ত্রীর সঙ্গে কাজ করে ক্রমে দক্ষ মিস্ত্রী হয়ে ওঠে, নারী থেকে যায় তার জোগানদার হয়ে। নির্মাণকার্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহিলাদের কাজ হল কাজের জায়গায় ঝাড়ু দেওয়া, জল আনা, ইঁট এবং নির্মাণকাজে প্রয়োজনীয় সিমেন্ট–বালি বয়ে আনা ইত্যাদি। নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও কৃষিক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত অদক্ষ শ্রমজীবী মানুষকে এই কাজে যুক্ত করা হচ্ছে এবং প্রাধান্য পাচ্ছেন পরিযায়ী পুরুষেরাই। হতদরিদ্র, স্বামী মদ্যপ অথবা পরিত্যাগ করে চলে গেছে, একাকী সন্তান প্রতিপালনে বাধ্য মহিলারাই নির্মাণশিল্পে অদক্ষ শ্রমিকের একটি বৃহৎ অংশ। কর্মক্ষেত্রের কোনও সুযোগ-সুবিধাই তাঁদের জোটে না বরং ধারাবাহিক কাজের অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থা, অনিয়মিত মজুরি তাঁদের অদক্ষ শ্রমিক হিসাবেই কেবলমাত্র মান্যতা দেয়, দক্ষতা অর্জনের কোনও সুযোগই তাঁরা পায় না। হয়ে উঠতে পারে না একজন পরিপূর্ণ মিস্ত্রী। নির্মাণশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজ যেমন রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রী বা ইলেকট্রিক মিস্ত্রী কোনও ক্ষেত্রেই তারা কোনও প্রশিক্ষণ পায় না। প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে নির্মাণশিল্পে তারা ‘যোগাড়ে’ হিসেবে থেকে যায়। যে সকল ঠিকাদারের অধীনে তাঁরা কাজ করে তাদের শোষণ, অত্যাচার এবং যৌননিগ্রহ এই সকল নারীদের একপ্রকার বন্ডেড লেবারার-এ পরিণত করে।
পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং অন্য কয়েকটি রাজ্যের মহিলা নির্মাণকর্মীদের নিয়ে একটি সমীক্ষায় তাঁদের দাবি সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়েছিল— দেশের সরকার এবং সাধারণ জনসমাজের কাছে তাঁরা কি প্রত্যাশা করেন। তাঁরা জানান: ১) সরকার এবং জনসাধারণের কাছে তাঁরা নিয়মিত, নিরাপদ ও সুস্থ কাজের পরিবেশ প্রত্যাশা করেন, ২) নারীবান্ধব পরিবেশে তাঁরা নিরাপদে ও সন্তোষজনক পরিস্থিতিতে কাজ করতে চান, ৩) তাঁরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক এবং শারীরিক মুক্তি চান, ৪) রেশন কার্ড ও ভোটার কার্ড না থাকার জন্য তাঁরা বিভিন্ন সরকারি অনুদান বা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন, তাই তাদের দাবি যে রেশন কার্ড এবং ভোটার কার্ড তাদের প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ হোক।
নারীনির্মাণকর্মীরা যে পরিবেশে কাজ করে সেখানে পরিষ্কার শৌচালয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই, নেই পরিস্রুত পানীয় জলের কোনও সুবন্দোবস্ত। তাঁদের প্রয়োজন নিজের এবং সন্তানসন্ততিদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও পরিস্রুত জল, পুত্রকন্যাদের শিক্ষার ব্যবস্থা, বসবাসের নিরাপদ স্থান এবং অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা যা তাঁদের একটি স্বাধীন দেশের সুস্থ নাগরিক হিসাবে মর্যাদা দেবে। স্বল্প আয়ের কারণে তাঁরা গভীরভাবে ঋণগ্রস্থ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঠিকাদারেরাই ঋণদাতা। সুতরাং ঋণজালে আবদ্ধ এই সব নারীর প্রতি অত্যাচার ও যৌননিগ্রহের কোনও অবধি থাকে না। তাঁরা মূলত পরিযায়ী শ্রমিক, জন্মতারিখের নথিভুক্ত কোনও শংসাপত্র তাঁদের কাছে মজুত না থাকায় রেশন কার্ড বা ভোটার কার্ডও তাঁদের নামে তৈরি করা হয় না। ‘বিল্ডিং এন্ড আদার কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট, ১৯৯৬’ নামক যে আইনটি দেশে চালু আছে এই সমস্ত স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত নারীগোষ্ঠী তার কোনও খবর রাখে না। এভাবেই দেশের একটি বৃহৎ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন রুটিরুজির লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাঁদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করা, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুদানের ব্যবস্থা করা সরকারের
বিবেচ্য হওয়া উচিত। অতিমারির সময়ে নারীনির্মাণকর্মীদের অবস্থা হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। মূলত পরিযায়ী শ্রমিকরাই যেহেতু নির্মাণশিল্পে সংখ্যাগরিষ্ঠ, এক জায়গা থেকে অন্যত্র চলাচলে বিধিনিষেধ থাকার কারণে অনেকেই এই সময় কাজ হারান। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কিন্তু তাঁদের কাজ পুনরুদ্ধার করতে পারনে নি। কোনও কোনও স্থানে লকডাউনের সময় খাদ্য এবং পরিচ্ছন্ন কাজের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই সামান্য। গোদরেজ রিয়েল এস্টেটের করা একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অতিমারি কেটে গেলে ভারতবর্ষের নির্মাণশিল্পকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন শ্রমজীবী নারীপুরুষ প্রয়োজন এবং উৎসাহের সঙ্গে এই কাজে যোগদান করেন, নিজেদের দুর্দশার কারণে বাধ্য হয়ে নয়। অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় নারীনির্মাণকর্মীরা এইরকম একটা কাজের পরিবেশ খুঁজে পান এটাই আমরা প্রত্যাশা করব।
ইউনিসেফ জানাচ্ছে, “সমানাধিকার মানে নারী এবং পুরুষ, পুত্রশিশু এবং কন্যাশিশু একই অধিকারসমূহ, সম্পদ, সুযোগ এবং সুরক্ষা ভোগ করবে”। লিঙ্গসাম্য এ কথাই বলে যে, সর্বস্তরের জনসাধারণের স্বার্থ, প্রয়োজন এবং অগ্রাধিকার বিবেচনায় এনে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যের কথা আলোচনার টেবিলে উত্থাপন করা উচিত। ইউনাইটেড নেশনস–এর দাবি সনদ অনুসারে লিঙ্গসাম্য বা সমানাধিকার কেবলমাত্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর অন্যতম একটি দাবি নয়, স্থায়ী, শান্তিপূর্ণ এবং উন্নয়নমুখী পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি আবশ্যিক শর্ত। লিঙ্গবৈষম্যজনিত মজুরির বিভেদ রদ করা— সম কাজ, অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষার নিরিখে সমমজুরি সমস্ত সংগঠনের নিয়ম ও পদ্ধতি হওয়া উচিত। মজুরিবিধিতে স্বচ্ছতা আনা এবং সমমজুরির আইনি প্রয়োগ ক্রমবর্ধমান শ্রমনিবিড় নির্মাণশিল্পে কর্মরত হাজার হাজার নারী শ্রমিকের জন্য সুস্থ কাজের পরিবেশ আনয়ন করবে বলেই বিশ্বাস— যদি আইন গঠন ও প্রণয়নে সরকারের প্রকৃত সদিচ্ছা থাকে।