বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
এক সময় বাড়ি গড়তে গৃহস্থকে দামি ধাতু সোনা-রুপো বাস্তুভিটের তলায় গচ্ছা দিতে হত। এখান গাড়ির যুগ। আমার-আপনার সেই গাড়ি গড়তে বহু শ্রমিক গচ্ছা দিচ্ছে নিজেদের হাতের আঙ্গুল! ক’জন আমরা সে খবর রাখি?
দ্য সেফ ইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন (এসআইআই)-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা ‘ক্রাশড ২০২৩’ জানাচ্ছে এ হেন ভয়াবহ তথ্য। ভারতের প্রথম ১০টি দু’ বা চার চাকার গাড়ির যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে বহু ছোট ছোট কারখানা। কাজ করতে গিয়ে সে সব সংস্থায় বহু শ্রমিক হাতের আঙ্গুল খোয়াচ্ছেন। এ পর্যন্ত সংখ্যাটি ৬০০০ ছাড়িয়েছে। ভারতের ছ’টি রাজ্যের সর্বত্র ছবিটা কমবেশি একই রকম।
এসব সংস্থার ৮০% শ্রমিক পরিযায়ী। নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত এই শ্রমিকদের বয়স কুড়ি-তিরিশের কোঠায়। ২৭ বছরের অমরেন্দ্র বিহার থেকে এসেছিলেন ফরিদাবাদে। নামী এক গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির সংস্থায় কাজ শুরু করেছিলেন। বছর না ঘুরতেই ডান হাতের দুই আঙ্গুল হারিয়ে এখন বেকার।
মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। স্বামীর স্বল্প আয়। সংসারের সুরাহা করতে মুঙ্গেরের ইন্দু হরিয়ানার এক অটো হাব-এ কাজে যোগ দেন। মাইনে ৮০০০। সামান্য বুঝিয়ে ইন্দুকে পাওয়ার প্রেস মেশিন চালাতে বলা হয়। তিন মাসের মাথায় এক সকালে ইন্দুর মনে হয় মেশিনটি খারাপ। কর্তৃপক্ষকে জানান। কিন্তু কাজ বন্ধ করা যাবে না। কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়। কিছু পরেই চোখের পলকে ইন্দুর দুটো আঙ্গুল কাটা পরে মেশিনের ডাবল স্ট্রোকে।
সুচিতা, রেখা, নীতু, মমতা, কবিতা ও আরও অনেক মহিলার অবস্থা একই রকম। কিছু দিন কাজের পর আঙ্গুল হারিয়ে ওরা গ্রামেই ফিরে আসেন। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে সাধারণ ঘরের কাজটুকু করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন। ব্যাপারটা যেন খুবই স্বাভাবিক। কর্তৃপক্ষ পত্রপাঠ এই সব আহত শ্রমিকদের বিদেয় করে। এদিকে পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে হাজির হয় এসব কারখানায় কাজের আশায়। জুটে যায় নতুন শ্রমিক।
কেন এমন দুর্ঘটনা? পাওয়ার প্রেস মেশিন চালাতে লাগে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক। তাদের সাহায্য করে অদক্ষ শ্রমিক। অতিরিক্ত লাভের আশায় বেশি উৎপাদানের জন্য সহকারী অদক্ষ শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় মেশিন চালাতে। তাতেই ঘটে দুর্ঘটনা। তাছাড়া এ সব মেশিন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। ত্রুটিপূর্ণ মেশিনে কাজ করতে গিয়ে অনেকে আঙ্গুল হারিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের সে দিকে হেলদোল নেই। উত্তরপ্রদেশের আহত শ্রমিক সাতাশ বছরের সন্দীপকুমার এসআইআই-এর সমীক্ষায় জানিয়েছেন, একমাত্র মেশিন কাজ বন্ধ করলেই তা সারাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তার ওপর অত্যধিক কাজের চাপ। সপ্তাহে ষাট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। বিশ্রামের সুযোগ মেলে না। তাতেও দুর্ঘটনা হয়। উপরন্তু কোনও সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। মেশিনের সুরক্ষা সেনসর কাজ করে না। কর্মীদের উপযুক্ত গ্লাভস দিলেই কিন্তু এই ধরনের দুর্ঘটনা অনেকটা আটকানো যায়। সেটুকুতেও অনীহা সংস্থার।
নিয়ম অনুযায়ী কাজে যোগ দেওয়ার সময় শ্রমিকদের এমপ্লয়ি স্টেট ইনসুওরেন্স মেডিক্যাল (ই-পেহেচান) কার্ড দেওয়ার কথা। যেটি তাদের দুর্ঘটনায় চিকিৎসার সুবিধে দেবে। ই-পেহেচান কার্ড না থাকায় এদের নিয়ে যাওয়া হয় বেসরকারি হাসপাতালে। ফলত ধারাবাহিক চিকিৎসায় ছেদ পড়ে। বহু শ্রমিক এই কার্ড পেয়েছেন দুর্ঘটনার পর। কার্ডের অভাবে ক্ষতিপূরণ পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।
গত বছর গুরগাঁওতে একটি সম্মেলনে এসআইআই তাদের সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে বহু আঙ্গুল ও হাত হারানো শ্রমিক শুনিয়েছেন তাদের দুর্ভাগ্যের কথা। মেয়েরা বলেছেন তাদের বঞ্চনার কথা। উত্তরপ্রদেশের ৩১ বছরের সায়রা বানো একই বছরে দুটো হাত হারিয়েছেন। স্বামী ছেড়ে দেওয়ার পর বাচ্চাদের জন্য কাজ করতে এসেছিলেন হেল্পার হিসেবে। প্রথম দফায় বাম হাতের দুই আঙ্গুল যায়। হাতে প্লাস্টিক বেঁধে লোকের বাড়ি কাজ করেছিলেন। পরে আবার মেশিন চালানোর ডাক পান। দ্বিতীয় দফায় ডান হাতের তিনটে আঙ্গুল চলে যায়। পুরুষদের সমান কাজ করলেও যথারীতি মেয়েদের বেতন কম। কাজের চাপে জল খাওয়া বা বাথরুম যাওয়ারও অনুমতি পেতেন না। হাত খোয়ানোর পর অনেকের স্বামী ছেড়ে চলে গেছে।
জীবনের শুরুতেই পথে বসছেন শ্রমিকরা। নিদারুণ শারীরিক ও মানসিক আঘাত আর চাকরি হারিয়ে রীতিমতো অকেজো হয়ে গ্রামে ফিরছেন। এরা কোনও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন। যাদের পাকা চাকরি ছিল, তাদের কখনও সংস্থা রাখে, ঘটনার রেশ যতদিন থাকে। পরে বিদেয় করে দেয়।
সরকারি রির্পোটে এই মারাত্মক ঘটনা যথারীতি অনেক কম! বহু ক্ষেত্রে এগুলোকে পথ দুর্ঘটনা বলে দাবি করা হয়। আরও দুভার্গ্যজনক সংশ্লিষ্ট সংস্থা এসব অঘটনের দায় চাপায় আহতদের ওপরই। সাতাশ বছরের রাজস্থানের রাহুল ছিপা তিনটে আঙ্গলু হারিয়েছেন। সংস্থার রিপোর্ট বলছে, পরিষ্কার করার সময় মেশিন বন্ধ করেনি। অন্যমনস্ক ছিল। বাস্তবে ত্রুটিপূর্ণ মেশিনে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন রাহুল। উত্তরপ্রদেশের মহেশ দুটো হাতই খুইয়েছেন। রিপোর্টে বলছে অন্যমনস্কতার গল্প। মহেশ হেল্পার। তার মেশিন চালানোর কথাই নয়।
এরা একমাত্র পাশে পেয়েছে এসআইআই-কে। ২০১৬ থেকে এসআইআই ৪৭১৪ জন (৮০%) আঙ্গুল হারানো শ্রমিকের পাশে দাঁড়িয়েছে। আরও বহু শ্রমিকের আঙ্গুল বাঁচাতে মারুতি, টাটা, মহীন্দ্রা, হুন্ডাই-এর মতো গাড়ি সংস্থাগুলোর উদ্যোগী হওয়ার সময় এসেছে। তাদের যন্ত্রাংশ তৈরিতে ক’জন শ্রমিকের আঙ্গুল কাটা পড়ছে, সে ব্যাপারে তাদের সচেতন হওয়া দরকার। দুর্ঘটনা এড়াতে শ্রমিকদের কথা শোনা খুবই দরকার। শ্রমিক মেশিন নিয়ে অভিযোগ জানালে, সঙ্গে সঙ্গে সেটি পরীক্ষা করা দরকার। সময় এসেছে প্রতিটি গাড়ির বিক্রির সঙ্গে সার্টিফিকেট দেওয়া যে গাড়িটি তৈরির সময় কোনও শ্রমিক হাত খোয়াননি। ক্রেতারাও তা যাচাই করে নেবেন। তবেই শ্রমিকরা বাঁচবেন।