বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
একটু সদর্থক সুরেই করতে চাইছি – এই কবিপক্ষে – অতীতের একটি ঘটনাকে আশ্রয় করে। ১৯৪১ সাল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবর্ষ । এই বছর যুদ্ধের বছরও বটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানী বনাম সোভিয়েত বাহিনী। মৃত্যুশয্যায় কবি প্রায়ই সংজ্ঞা হারাচ্ছেন। তাঁর তদানীন্তন সেক্রেটারী প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশ স্মৃতিকথনে লিখছেন – যখনই কবির সংজ্ঞা ফিরছে, কবি উতলা হয়ে জানতে চাইছেন যুদ্ধের সংবাদ। যদি জার্মানী অগ্রসর হয় – কবির মুখ পাণ্ডুর হয়ে যাচ্ছে আর যখন শুনছেন সোভিয়েত বাহিনী এগিয়েছে – কবির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে – অস্ফুটে বলে উঠছেন – “পারবে, পারবে – পারলে ওরাই পারবে।” কবি তো কখনোই সোভিয়েত ক্যাম্পের লোক ছিলেন না বরং ‘রাশিয়ার চিঠি’তে আমরা দেখেছি তাঁর তীব্র সমালোচনা – ‘ছাঁচ একদিন ভেঙ্গে পড়বেই।’ আবার প্রশংসাও কী অপরিসীম – ‘শ্রীনিকেতনকে আমি এভাবেই গড়তে চেয়েছিলাম।’ হ্যাঁ, শ্রমিক–কৃষকের যৌথ শক্তি যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে তখন সে পৃথিবীর যে কোনও শক্তিকে পরাস্ত করতে পারে। আমাদের দেশের শ্রমিক আন্দোলন কোন পথে ভাবতে হলে প্রথমেই তাদের সমস্যা ও বিপদগুলি আলোচনা করতে হবে । আজকের শ্রমিক শ্রেণীর সামনে সমস্যা মূলত দুটি। অংসগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে প্রায় শ্রমশক্তির ৯৪ শতাংশে পৌঁছেছে। ১৯৯১ সালের উদারিকরণের পর থেকেই এই সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে কারণ স্থায়ী চাকরী কমেছে। এদের সমস্যা মূলত দুটি – এক, মজুরি ও দুই, সামাজিক সুরক্ষা। ৪৪টি শ্রম আইনকে ৪টি শ্রমকোডে রূপান্তরিত করায় রাষ্ট্রের সম্বন্ধে পুরানো সব রকমের শুভ ধারণা নস্যাৎ হয়েছে। লেবার কনফারেন্স ও সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধার্য্য ন্যূনতম মজুরির ধারণাও বদলে গেছে। জাতীয় ফ্লোর লেভেল মজুরি ধার্য্য করা হয়েছে মাত্র ১৭৮ টাকা। এর থেকে বেশি নৃশংস নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে! সরকারি ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি হয়েছে মাসিক ১৮০০০ টাকা কিন্তু কোডিফিকেশন-এর সময় সরকার এটিকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। এছাড়া সামাজিক সুরক্ষা হিসাবে যা এযাবৎকাল পর্যন্ত অর্জন করা হয়েছিল– সব উপেক্ষা করা হয়েছে। একজন নির্মাণ শ্রমিক আজ যদি হঠাৎ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মারা যান – তার পরিবার পুরোপুরিভাবে ভেসে যাবে। সংগঠিত ক্ষেত্রের অসংগঠিত অংশটিও বাড়ছে। ফলে তাদের ক্ষেত্রেও সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নটি জ্বলন্ত হয়ে উঠছে। যত চুক্তিঠিকাপ্রথা এবং অস্থায়ীকরণ বাড়ছে ততো এই সমস্যাও বাড়ছে। এনপিএস-এর ফলে পেনশনও আর সুরক্ষিত নেই। তাই দাবি উঠেছে পুরানো পেনশন প্রকল্পে ফেরতের। উন্নত দেশগুলি শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষার পিছনে জিডিপি-র প্রায় ১১-১২% খরচ করে – ফ্রান্স খরচ করে ১১%। ভারতের খরচ এই খাতে মাত্র ০.০৭ %। এছাড়াও চারটি শ্রমকোড চালু হলে প্রায় ৭০% শ্রমিক শ্রম আইনের আওতার বাইরে বেড়িয়ে যাবে। গৃহকর্মী, খাদ্যসংক্রান্ত কর্মস্থান, আইটি, আইটিইএস ইত্যাদিকে শ্রম আইনের বাইরে রাখা হয়েছে। বেতন ১৫০০০ টাকার
বেশি হলেই সুপারভাইজারের পদ দিয়ে শ্রম আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শ্রমিককে ক্রীতদাসে পরিণত করছে। কর্পোরেটদের ‘ease of doing business’ বাড়ানোর জন্য ‘ease of living of workers’ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ‘ease of doing business’ সূচকে ভারত যত উপরে উঠছে, তত ‘Global Hunger Index’এ ভারত নেমে চলেছে। এহেন পরিস্থিতিতে ঐক্য একটি বৃহৎ প্রশ্ন। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের পারস্পরিক সাযুজ্য, একই সেক্টরে বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকের ঐক্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ঐক্য, সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকদের ঐক্য একান্ত প্রয়োজন। এই ঐক্য হয়তো কিছুটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে – কিন্তু সেই ঐক্যকে তৃণমূল স্তরে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু শাসক শ্রেণী সাম্প্রদায়িকতা ও পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে বিভাজন ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছে। নয়া উদারবাদের এটাই কৌশল— বাজার মৌলবাদ আর ধর্মীয় মৌলবাদের ভয়ঙ্কর সংমিশ্রণ ঘটেছে এই নয়া উদারবাদী রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে। রাষ্ট্রই এখন বাজার মৌলবাদের ধারক ও বাহক রবীন্দ্রনাথের নাটক ‘রক্তকরবী’তে গোঁসাই – যে কিনা ধর্মীয় পুরোহিত – সর্দার অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বলে – ‘ণ’ পাড়া কানে শান্তিমন্ত্র নিতে প্রায় প্রস্তুত – মাত্র কয়েক দিন সময় লাগবে কান তৈরি হতে। কয়েক সপ্তাহ কেবল আরো ফৌজ বসিয়ে রাখতে হবে। অর্থাৎ ঐ পাড়ার শ্রমিকদের বশীভূত করতে ধর্মীয় মৌলবাদই সাহায্য করে বাজার মৌলবাদকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। নাটকের শেষে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইতে নামে শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তি। উল্লেখ্য, এ নাটক লেখা হয়েছিল সোভিয়েত বিপ্লব (১৯১৭)এর কয়েক বছর বাদেই ১৯২৩-২৪এ। অর্থাৎ এখানেও কবির ভরসা কোনদিকে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ঐক্য গঠনের সঙ্গে সঙ্গে দরকার বিকল্প রাজনীতির গঠন। তা না করতে পারলে যে কোনও শ্রমিক আন্দোলনই ধাক্কা খাবে— যেমন অকুপাই ওয়ালস্ট্রীট আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। বিকল্প রাজনীতি গঠনের ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যদিও এটা ট্রেড ইউনিয়নের একার কাজ নয় – এটা রাজনৈতিক লড়াই। কিন্তু তার জমি তৈরিতে ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা আছে। ট্রেড ইউনিয়নের দুটি লক্ষ্য থাকে— একটি আশু লক্ষ্য এবং আরেকটি দূরের লক্ষ্য। প্রথমটি মালিকের থেকে শ্রমিকের অধিকার রক্ষার লড়াই – তার অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া পূরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ - একেবারেই উপেক্ষণীয় নয়। এই কাজকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। মার্কস এটিকে শ্রম ও পুঁজির মধ্যের প্রতিদিনকার গেরিলা যুদ্ধ বলেছেন। কিন্তু এটি ছাড়াও দূরের লক্ষ্য হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক সচেতনতা প্রাপ্ত হয়ে ব্যবস্থা বদলে ভূমিকা নেওয়া। দ্বিতীয়টি ভুলে শুধুমাত্র প্রথমটিতে অভিনিবেশ করলে – ট্রেড ইউনিয়নের লক্ষ্য অশ্লীল অর্থনীতিবাদ হয়ে উঠবে। এর দ্বারা কোনওভাবেই ব্যবস্থাকে উল্টোপথে নেওয়া যাবে না শুধুমাত্র ব্যবস্থার নীতিগুলিকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা ছাড়া। কিন্তু কাঠামো বদল করতে হলে সংগঠনকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করে রাজনৈতিক সচেতনতায় উদ্বুদ্ধ করতে। লেনিন তাঁর ‘কী করিতে হইবে’ গ্রন্থে সামগ্রিক রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলার কথা বলেছেন। বলেছেন যে এই চেতনা শুধুমাত্র বই পড়ে হবে না। প্রতিটি বিষয়ের অনুপুঙ্খ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দ্বারাই তা সম্ভব। হতাশ হওয়ার জায়গা নেই কারণ যে চিলিকে বলা হতো নয়া উদারনীতির ল্যাবোরেটরি যেখানে Milton Friedman-এর সবরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতো, সেখানেও মানুষ রাস্তায় নেমে গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল করেছেন। আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম সংস্থা অ্যামাজন স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে অ্যামাজন লেবার ইউনিয়নকে। গত এক বছরে কৃষক আন্দোলনের সময় থেকে শ্রমিক-কৃষকের এক অসামান্য ঐক্য গড়ে উঠছে বটে তবে তাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন। অর্থাৎ সর্বস্তরের ঐক্য গঠন এবং শ্রমজীবী আন্দোলনকে শ্রেণী দিশা দেওয়াই শ্রমিকের লক্ষ হতে হবে। এর জন্য সংগঠনের ভূমিকা অপরিসীম। সংগঠন না থাকলে এ কাজ করবে কে? কোন মশীহার ভরসায় বসে থেকে লাভ নেই। শ্রমিক-কৃষকের যৌথ শক্তিই পারবে শাসকের জয়রথের চাকাকে উল্টোদিকে ঘোরাতে। হ্যাঁ, পারলে আমরাই পারবো শ্রমিক আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে বৃহত্তর শ্রেণী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক বদল করতে। সত্যদ্রষ্টা, যুগদ্রষ্টা কবির ভরসা তো আমরাই।
— ১৬ মে, ২০২২ শ্রমজীবী ভাষা আয়োজিত আলোচনা সভা।