বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

শ্রমিক আন্দোলন কোন পথে

শ্রমিক আন্দোলন কোন পথে

অশোক সরকার

photo

প্রথমেই বলি যে 'শ্রমিক আন্দোলন কোন পথে?' এই বিষয়ে কিছু বলার এক্তিয়ার আমার একেবারেই নেই। আমি কখনো কোনও শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিনি, দূর থেকে সমর্থন করেছি, আর দেশ বিদেশের শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে পড়াশোনা করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সুবাদে ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে এই নিয়ে কথোপকথনের চেষ্টা করেছি, তাতে এমন কিছু এক্তিয়ার তৈরি হয় না। তবু যেহেতু আমন্ত্রণ স্বীকার করেছি তাই আপনাদের অনুমতি নিয়ে দু চার কথা বলছি। 
শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস তৈরি হয়েছিল চারটি পিলারকে ঘিরে, এক) ফ্যাক্টরি, দুই) ফ্যাক্টরি-অঙ্গন, আর তিন) ফ্যাক্টরি-র শ্রমিক, আর চার) ফ্যাক্টরি-র মালিক। ভারতের শ্রমিককুলের ৯২  ভাগের মতো অসংগঠিত শ্রমিক যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালিক নিজেই শ্রমিক, নয়ত  পরিবারের শ্রমিক, ফ্যাক্টরি অঙ্গন বলে খুব একটা কিছু নেই, অথবা তার বড়জোর আর দুই কি তিনটি শ্রমিক সঙ্গী আছে,  যেখানে সে কাজ করে করে সেখানে মালিক নিজেই আধা শ্রমিক। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক আন্দোলনের মূল ব্যাকরণটা বদলে যায়, সেখানে আন্দোলনের প্রধান প্রতিপক্ষ হয় রাষ্ট্র। তাকে আবার শ্রেণী শত্রুও বলা কঠিন হয়। এই শ্রমিক বহু ভাগে বিভক্ত— জাতি, ভাষা, মহিলা-পুরুষ, অঞ্চল, ইত্যাদি। এই শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র বহু বিস্তৃত, পরস্পর বিচ্ছিন্ন।  
দ্বিতীয়ত, শ্রমিকের লড়াইটা পাশাপাশি দু’ রকমের— প্রথমত, শ্রম সংক্রান্ত লড়াই, যার মধ্যে মজুরি, বোনাস, ছুটি, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি পড়ে, আর দ্বিতীয়ত, তাদেরর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শুদ্ধ পানীয় জল, সাফাই, সাধারণ নিরাপত্তা ইত্যদি অধিকারগুলির লড়াইও আসে। ইংরেজি বলা যায় labour rights আর civic rights। এমনকি রাস্তায় বসে ব্যবসা করার অধিকারও শ্রমিকের অধিকার বলে দাবি করতে হয়। 
এই শ্রমিকের লড়াইতে সমাজকর্মী, সমাজ সংস্থা এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনকে পাশাপাশি আসতে হবে। বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনে এটা বুঝেছিলেন শংকর গুহ নিয়োগী, আর গান্ধীবাদী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে এটা বুঝেছিলেন ইলা ভাট। শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি তাই হাসপাতাল, স্কুল, ব্যাঙ্ক, সমবায় গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে, এই ধরণের চেষ্টা আরও অনেক দেখা যাচ্ছে। সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা শ্রমিক আন্দোলনের পাশে আসছেন, উল্টোটাও হচ্ছে। 
তবে একটা বিষয় একটা প্রাসঙ্গিক। সমাজকর্মের, সমাজ আন্দোলনের আর শ্রমিক আন্দোলনের নিজস্ব ভাষা আছে। শংকর গুহ নিয়োগীর কথায় বলি 'সংঘর্ষের' আর 'নির্মাণের' ভাষা। এই দুই ভাষা আলাদা। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কাছে আসতে গেলে, এক সঙ্গে কাজ করতে গেলে কথোকথনের একটা ভাষা তৈরি করতে হবে। এই কথোকথনের ভাষা তৈরি করা সহজ কাজ নয়। দুই পক্ষের বিশ্বাসের জগৎ আলাদা, কর্মপন্থা আলাদা, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক আলাদা। তাই এ কাজ সহজ নয়। 
এই প্রসঙ্গে চলে আসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ইংলন্ড আমেরিকার শিক্ষার সংস্কৃতির কাঠামোয় তৈরি, যা বলে যে বিশ্লেষণ করতে গেলে দূরত্ব লাগে, যা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, তার খুব কাছে থাকলে সব দিক দেখা যায় না। আর বলে শিক্ষার সংস্কৃতির মূল কথা হল বিশ্লেষণ ও তত্ত্ব নির্মাণ, বাকি কাজ সেই তত্ত্বের প্রচারের। একটা গভীরে দেখলে দেখি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল গ্রাহক হল রাষ্ট্র। জনতা, বিশেষত শ্রমিক কৃষক আদিবাসী জনতা নয়। এর ফলে একটা ব্যাপক বিপদ ঘটে গেছে। শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে আমজনতার সংযোগ নেই বললেই চলে। ছাত্র আন্দোলন আজ বহু ভাগে বিভক্ত। ল্যাতিন আমেরিকায় কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে আদিবাসী সমাজ ও  শ্রমিক আন্দোলনের নিবিড় যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। আমি মনে করি, উচ্চশিক্ষার সেটাই প্রাসঙ্গিক মডেল। এর রাস্তা খোলা সহজ নয়, তবে আমি এটুকু বলতে পারি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার এই সংস্কৃতির প্রতি কিছুটা হলেও বিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছি। ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রমিক ও সমাজ আন্দোলনের কর্মীদের ও সেই সংগঠনগুলির ক্লাস নেওয়া, আনাগোনা, কর্মশালা, ট্রেনিং, আলোচনাসভা, ইত্যাদি লেগেই থাকে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়, মাস্টার মশাইদের গবেষণার উপাদান বেরোয়, নতুন কোর্সের মশলা বেরোয়, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। আমরা এ ব্যাপারে আদৌ পথিকৃৎ নই, ল্যাতিন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এ ব্যাপারে পথিকৃৎ। কিন্তু এটা এমন রাখতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এলিট তৈরি-র পীঠস্থান। দেশের এলিট শ্রমিক বিরোধী হবে না শ্রমিক দরদী হবে তা অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার-সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে। ভবিষ্যতের এলিট যদি ভারতের শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার লড়াইকে অনুধাবন ও অনুভব করতে পারে, তাহলে এই এলিট শ্রমিক আন্দোলন ও সমাজ আন্দোলনকে কুর্নিশ জানাবে, তার বিরুদ্ধে কামান দাগের আগে হয়ত দু’ বার ভাববে, আর তারই মধ্যে এলিটের কিছু অংশ শ্রমিক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াবে। 

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.