বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

শ্রমের সময় ও শিল্পের বিকাশ

শ্রমের সময় ও শিল্পের বিকাশ

বিশ্বজিৎ ধর

photo

সম্প্রতি ইনফোসিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এন আর নারায়ণমূর্তি ভারতের যুবসমাজের উদ্দেশ্যে একটি চমকপ্রদ বক্তব্য রেখেছেন। নারায়ণমূর্তির বয়ান অনুযায়ী দেশের প্রতিযোগিতামূলক সংস্কৃতি বজায় রাখতে যুবসমাজের শপথের ভঙ্গিতে বলা উচিত, ‘এই দেশ আমার। আমি সপ্তাহে সত্তর ঘন্টা কাজ করতে চাই।’ তাঁর এই বক্তব্য ভারতীয় শিল্প ও বাণিজ্য মহলে যেমন সাদর সমর্থন পেয়েছে, তা থেকে অনুমান করা যায় যে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যের কান্ডারীরা শ্রমজীবীদের ছদ্ম পুণ্য অর্জনের কথায় ভুলিয়ে নিজেদের মুনাফা বাড়ানোর লোভ ধামাচাপা দিতে চান। নারায়ণমূর্তির এই কুযুক্তিকে খন্ডন করার জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা দরকার।
প্রথমত, নারায়ণমূর্তি মহাশয় ভ্রান্ত তথ্যকে ভিত্তি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কাজের বর্ধিত সময় জার্মানি ও জাপান-এর মতো উন্নত দেশগুলির বিকাশে সহায়তা করেছে। দ্বিতীয়ত, তিনি উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির দায় শ্রমিকের কাঁধে চাপিয়েছেন। বাস্তব হল, ভারতের শিল্পপতিরা উৎপাদন শক্তির উদ্ভাবনে প্রায় বিনিয়োগ করেনই না, যা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চাবিকাঠি। তৃতীয়ত, নারায়ণমূর্তি মহাশয়ের সপ্তাহে সত্তর ঘন্টা কাজের নিদান লঙ্ঘন করছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক মানদণ্ড (আইএলএস)। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) কাজের সীমা পরিমিত করে ওই মানদণ্ড স্থির করেছে, যা শ্রমজীবী নারী-পুরুষের উৎপাদনশীলতা ও অধিকারকে সম্মান দেয়। উন্নত দেশগুলির বাজারে প্রবেশের জন্য, ও আন্তর্জাতিক ‘সাপ্লাই চেনের’ অংশীদার হওয়ার জন্য আইএলএস বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের জন্যে আরও জায়গা করতে হলে ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে আইএলএস মানতে হবে। তার উলঙ্ঘন করা অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে।
উন্নত দেশগুলিতে কাজের সময়
অতীতের বিচার করলে দেখা যায়, নারায়ণমূর্তির যুক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র মিলছে উন্নত দেশগুলিতে। গত দেড়শো বছরে ওই দেশগুলিতে শ্রমিক-প্রতি কাজের ঘন্টা ক্রমাগত কমেছে। ১৮৭০ সালে জার্মানিতে সাপ্তাহিক কাজের সময় ছিল আটষট্টি ঘণ্টা, ২০১৭ সালে তা কমে হয়েছে সাপ্তাহিক আঠাশ ঘন্টার কম — প্রায় ৬৯ শতাংশ হ্রাস। জাপানে ১৯৬১ সালে কাজের গড় সময় ছিল সাপ্তাহিক চুয়াল্লিশ ঘন্টা, যা ১৯৫০ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় পঁয়ত্রিশ ঘন্টা। কর্ম-ঘন্টা হ্রাস তখনই ঘটে যখন জনতার আয় বৃদ্ধি পায়, এবং আমোদপ্রমোদ ও অবকাশের জন্য খরচ করার মতো টাকা হাতে আসে। আদতে উচ্চ উৎপাদনশীল অর্থনীতিতে শ্রমিক কাজ করেন কম — আর নিম্ন উৎপাদনশীল গরীব অর্থনীতিতে শ্রমজীবীকে বেশি খেটে নিম্ন উৎপাদনশীলতার খেসারত দিতে হয়।
এই প্রসঙ্গে আইএলও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে ‘কর্ম-ঘন্টা, কাজের পরিকাঠামো এবং বিশ্রামের সময় শ্রমিকের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থ থাকার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে’ – এবং এই ‘কর্ম-ঘন্টা বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলি সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। ভারতের ক্ষেত্রে বিপুল নব্য প্রজন্মের শ্রমশক্তি রয়েছে, যা এ দেশের ভবিষ্যতের সম্পদ রূপে গণ্য করা হয়। সপ্তাহে সত্তর ঘন্টা কাজের জন্য নারায়ণমূর্তি মহাশয়ের ওকালতি আসলে এই সম্ভাবনাময় শ্রমশক্তিকে শোষণ করে ছিবড়ে করে আহ্বান।
নারায়ণমূর্তির এই বিতর্কিত বক্তব্যে যে ভারতীয় শিল্পসংস্থাগুলির অগ্রণী অংশ সায় দিয়েছেন তাদের মনে রাখা উচিত যে দেশের উৎপাদনশীলতার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভাবেই দেশের উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। নীতি আয়োগের ইন্ডিয়া ইনোভেশন ইনডেক্স ২০২১ এর রিপোর্ট থেকে ভারতের উদ্ভাবনী ক্ষেত্রে একটা বাস্তব চিত্র মেলে। ওই রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল ভারতে গবেষণা খাতে ব্যয় হয়েছে জিডিপির শূন্য দশমিক ছয় পাঁচ (০.৬৫ %) শতাংশ, আন্তর্জাতিক নিরিখে যা সর্বনিম্ন দেশগুলির মধ্যে রেখেছে ভারতকে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে সেটা আরো কমে হয়েছে ০.৬৪ শতাংশ। এই তথ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের।
ওই বিভাগ জানিয়েছে যে ২০২০-২১ সালে গবেষণা খাতে প্রাইভেট সেক্টরের লগ্নির অংশীদারিত্ব ছিল একচল্লিশ শতাংশ, যা ২০১২-১৩ সালের পঁয়তাল্লিশ শতাংশের চেয়ে অনেকটাই কম। লক্ষ্যণীয়, যে সব দেশ ভারতের চেয়ে উন্নত উদ্ভাবনী শক্তির নমুনা রেখেছে, সেই সব দেশে গবেষণা ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরের লগ্নির অংশীদারিত্ব অনেক বেশি। যেমন, ২০২০ অর্থবর্ষে জাপান ও কোরিয়ায় গবেষণা ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরের লগ্নির অংশীদারিত্ব ছিল উনআশি শতাংশ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ছিল পঁচাত্তর শতাংশ এবং জার্মানি ও ব্রিটেনে ছিল সাতষট্টি শতাংশ। আমাদের ‘প্রিয় শত্রু’ চীনের ক্ষেত্রেও এই হার সাতাত্তর শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট হয়, কেন ভারতীয় সংস্থাগুলি বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় খাবি খায়।
সপ্তাহে সত্তর ঘন্টা কাজের বিদঘুটে নিদান আন্তর্জাতিক শ্রমিক বিধিকেও লঙ্ঘন করে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) ১৯৩০ সালে ‘ফোর্সড লেবার কনভেনশন’ বা বাধ্যতামূলক শ্রম বিষয়ক চুক্তি গ্রহণ করে। সেখানে বলা হয়, বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ব্যতীত কোনও ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে বা জোর করে কাজ করতে বাধ্য করা হল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশ্ববাণিজ্যে শ্রমিকদের প্রতি এই অঙ্গীকার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। এই চুক্তি দৈনিক আট ঘন্টা কাজকে মান্যতা দেয়। উন্নত দেশগুলি দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্যের চুক্তি (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) করার সময়ে সর্বদাই আন্তর্জাতিক শ্রমিক মানদণ্ডকে (আইএলএস) বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় রেখেছে, যার মধ্যে আট ঘণ্টা কাজের সীমাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ভারত যে চুক্তি দ্বারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য করছে, সেই চুক্তির শর্তানুযায়ী ভারত আইএলএস মানতে বাধ্য।
কেবল ইউরোপই নয়। ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি (আইপিইএফ) হল চোদ্দোটি দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি জোট, যাতে রয়েছে ভারতও। ছয় মাস আগে, আইপিইএফ-এর সদস্য দেশগুলি নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে ‘সাপ্লাই চেন’ শক্তিশালী করতে চুক্তি সাক্ষর করেছে। চুক্তির শর্তগুলির মধ্যে শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা ও সম্মান বজায় রাখার কথাটিও বলা হয়েছে। এই চুক্তি আইএলও-স্বীকৃত শ্রমিক অধিকারকে মানতেই হবে, যে অধিকারের মূলমন্ত্র হল ‘শ্রমের উপযুক্ত পরিসর ও পরিবেশ, যথোপযুক্ত মজুরি ও শ্রম-ঘন্টা বজায় রাখা’। অর্থাৎ ভারতীয় শিল্পগুলির আইপিইএফ-এর সাপ্লাই চেন-এর অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে লেনদেনে যুক্ত থাকা নির্ভর করছে শ্রমিক অধিকারগুলিকে সম্মান করার উপরে। দুর্ভাগ্য, শিল্পপতির একটা অংশ চুক্তির শর্তগুলি বিস্মৃত হয়েছেন। এবং শ্রমিককে আরও খাটিয়ে মুনাফা বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.