বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

আরব সাগরে সাইক্লোন

আরব সাগরে সাইক্লোন

মানস প্রতিম দাস

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২১— রাজারাজড়াদের বিয়ে তো কেবল বয়স হলে কিংবা প্রেম-ভালোবাসা হলেই হয় না, তাতে অনেক সূক্ষ্ণ বিচার থাকে। কূটনীতি, রাজনীতির মিশেলে ঠিক হয় কে বিয়ে করবেন কাকে! এমনভাবেই রাজা দ্বিতীয় চার্লস ১৬৬১ সালে বিয়ে করলেন পর্তুগালের রাজকন্যা ক্যাথারিনকে। বিয়েতে নিমন্ত্রিত কতজন ছিলেন কিংবা কতদিন ধরে চলেছিল উৎসব তার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর না থাকলেও একটা ব্যাপার নিয়ে ইতিহাসকাররা নিশ্চিত। সেটা হল বরপণ। পর্তুগালের রাজবংশ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অর্পণ করা হল দ্বিতীয় চার্লসের হাতে। এর মধ্যে ছিল পর্তুগীজ অধিকৃত বম্বে এলাকা। ভারত তখন উপনিবেশ বিস্তারকারীদের হাতের পুতুল, যারা যে অংশটা পারে দখল করে নিয়ে ভোগ করে। আবার একজনের ভোগদখলের উপর নজর পড়ে যায় অন্য এক দেশের। বাধে লড়াই, তিক্ত হয় সম্পর্ক। বম্বে নিয়েও হয়েছিল এমনটাই। পর্তুগীজদের অধীনে থাকা বম্বে বন্দরে ১৬২৬ সালে হামলা চালিয়ে অগ্নি সংযোগ করল ইংরেজ দস্যুরা। তিলে-তিলে গড়ে তোলা পর্তুগীজ বাণিজ্য কেন্দ্রে ব্যাপক লুটতরাজ চালাল তারা। বলা বাহুল্য, এমন কাজে দুটো স্বাধীন দেশের মধ্যে ‘মিত্রতা’ তৈরি হয় না। এর পরে কোনও একটা সময়, মন্দ সম্পর্ককে শুধরে নিতে ক্যাথারিন অফ বার্গ্যাঞ্জাকে বিবাহ করেন দ্বিতীয় চার্লস। পর্তুগালও দরাজ হয়ে বম্বে এলাকা তুলে দিল পণ হিসাবে। বর বাবাজির বম্বে শাসনের মাথাব্যথা পোহানোর ইচ্ছে ছিল না বিন্দুমাত্র। তিনি করলেন কী, সুরাত শহরে সদর দপ্তর খুলে বসে থাকা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে বললেন এলাকার দখল নিতে। বিনিময়ে প্রতি বছর রাজাকে তাদের দিতে হবে স্বর্ণমুদ্রায় মাত্র দশ পাউণ্ড। কিন্তু গোল বাধল বরপণে দেওয়া বম্বে সমর্পণের সময়। সাত দ্বীপ নিয়ে গড়া বম্বের চারটে দ্বীপ ইংরেজদের হাতে দিতে অস্বীকার করল পর্তুগীজরা। ভাবল, নিজেদের তৈরি শক্ত ঘাঁটি থেকে বাকি এলাকার উপর সুখে রাজত্ব করবে তারা। কিন্তু ইংরেজদের কঠিন শ্রমের আগ্রহ আর অধ্যবসায়কে সম্ভবত খাটো করে দেখেছিল ভিনদেশে আসা পর্তুগীজরা। ইংরেজ রাজদরবার থেকে নিযুক্ত গভর্নর জেরাল্ড অঙ্গিয়ের বম্বে এলাকাকে উন্নত করার পরিকল্পনা নিলেন। জাহাজ থেকে মাল খালাস করার জন্য প্রসারিত প্ল্যাটফর্ম, গুদামঘর, শুল্ক আদায়ের দপ্তর বানালেন তিনি। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সমর্থনে বিভিন্ন দ্বীপের মধ্যে তৈরি করলেন যোগাযোগের সেতু। পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক রাজধানী তথা মায়ানগরী হওয়ার পথে পা বাড়াল বম্বে।

যে পর্বে এই নির্মাণের কাজ চলছে, সেই সময়ে সম্ভবত আরব সাগরে খুব বেশি সাইক্লোনের খবর পাওয়া যায় না। নথিতে যা পাওয়া যায় তাতে বম্বের উপর প্রথম জোরদার ঝড় আছড়ে পড়ে ১৬১৮ সালের ১৫ মে। ইউরোপীয় ইতিহাসকারদের বয়ানে জানা যায় যে ঘূর্ণাবর্ত আছড়ে পড়ল রাতের বেলায়, ঢেউ এত উঁচু হয়ে ধেয়ে এল যে মানুষ ভয়েই আধমরা হয়ে গেল! মহাপ্রলয়ের আগমনে অনেকেই ভাবল যে শেষের সে দিন বোধহয় শিয়রে উপস্থিত। চার্চগুলোর উপরের অংশ গেল উড়ে, মৃত্যু হল অন্তত দু’ হাজার মানুষের। এই ঐতিহাসিক বয়ান যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে যে দ্বীপগুলোতে বাস করা মানুষের এক-পঞ্চমাংশ মারা গিয়েছিল সে দিন। এর পর ১৭৮৩ সালে আর এক বিধ্বংসী ঝড়ের কথা জানা যায়। সেই দুর্যোগের পথে যে ক’টা জাহাজ পড়েছিল সেগুলোর কোনওটাই রক্ষা পায় নি। বম্বে বন্দরে অন্তত চারশো লোক মারা পড়ে। উনবিংশ শতকে ১৮৫৪ সালের সাইক্লোন সম্ভবত ছিল সবথেকে বেশি ধ্বংসাত্মক। চার ঘন্টায় নষ্ট হয়েছিল পাঁচ লক্ষ পাউণ্ড স্টার্লিং মূল্যের সম্পত্তি, মারা পড়েছিল এক হাজার মানুষ। উনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকে সাইক্লোনের দাপট কমতে লাগল আরব সাগরে, সংখ্যা এবং তীব্রতা উভয় অর্থেই। প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা থেকে বম্বে ছিল নিরাপদ। ইতিমধ্যে বম্বে হয়েছে মুম্বাই। ২০০৯ সালে মুম্বাই শহরে হানা দিল সাইক্লোন কিন্তু তার সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় পঁচাশি কিলোমিটার ছাড়ায় নি। অনেক সময় এই গতিবেগ শুনে ঝড়ের বিধ্বংসী ক্ষমতা বুঝে ওঠা যায় না। তাই সাহায্য নিতে হয় কিছু পরিমাপক সারণির। এমনই একটা সহায়ক স্কেল হল সাফির-সিম্পসন হারিকেন উইণ্ড স্কেল। এতে পাঁচটা ক্যাটেগরি আছে। প্রথম ক্যাটেগরির ঝড়ের গতি ঘন্টায় ১১৯ থেকে ১৫৩ কিলোমিটারের মধ্যে। সর্বোচ্চ অর্থাৎ পঞ্চম ক্যাটেগরির ঝড়ের বেগ ঘন্টায় ২৫২ কিলোমিটার বা তার থেকে বেশি। সুতরাং ২০০৯ সালের সাইক্লোন মোটামুটিভাবে প্রথম ক্যাটেগরির বলেই ধরা যায়। কিন্তু এর ঠিক দু’বছর আগে আরব সাগরে তৈরি হয়েছিল সাইক্লোন গোনু, এই এলাকার প্রথম পঞ্চম ক্যাটেগরির সাইক্লোন। মুম্বাই হয়ত আঁচ পায় নি এর ক্ষমতার; কিন্তু একই সাগরতীরের দেশ ওমানে অভূতপূর্ব ধ্বংসলীলা চালায় সে ঝড়। ওমানের ইতিহাসে এত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় আগে কখনও দেখা যায় নি।

২০১২ সালের জুন মাসে ‘ক্লাইমেট ডাইনামিক্স’ জার্নালে জাপানের তিন জন গবেষক উত্তর ভারত মহাসাগরে ঝড়ঝঞ্ঝার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে এক গবেষণাপত্র ছাপেন। তাঁরা আক্ষেপ করেন যে এই এলাকার সাইক্লোন সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এতদসত্ত্বেও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অন্য বিজ্ঞানীদের এবং নিজেদের ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করেন তাঁরা। ২০১১ সালে ইভান এবং কামারগো বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে ১৯৭৯ থেকে ১৯৯১, এই পর্বের তুলনায় ১৯৯২ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে আরব সাগরে ঝঞ্ঝার পরিমাণ বেড়েছে। আসলে তাঁরা পরিমাপটা দিয়েছিলেন এভাবে – বছরের কতগুলো দিন সাগরের উপরে নিরক্ষীয় ঝঞ্ঝা থাকছে। একইসঙ্গে ঝড়ের শক্তি বেড়েছে বলেও জানিয়েছিলেন তাঁরা। জাপানি গবেষকরা দুটো তথ্য দিলেন। এক, জাপানের মিটিওরোলজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা বললেন যে আরব সাগরে নিরক্ষীয় ঝঞ্ঝা বাড়বে ৪৬ শতাংশের মত। একইসঙ্গে তাঁরা এও বললেন যে বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের পরিমাণ কমবে প্রায় ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ এত দিন আরব সাগরের তীরে যে আপাত: শান্তি বিরাজ করত তা আর থাকছে না। মুম্বাইয়ের মানুষ যে বিশ্বাস করত, ঝড় তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে না, সাইক্লোনের তাণ্ডবে জলমগ্ন হতে হবে না তাদের - তার মোটামুটি সমাপ্তি ঘোষিত হল গবেষণাপত্রে। ঝড়বাদলের এলোমেলো আচরণ এবং তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে আজ সঙ্গত কারণেই যুক্ত হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। পৃথিবীর এই উষ্ণ বিপন্নতা যে কাউকেই রেহাই দেবে না তা বোঝা যাচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রাকৃতিক বন্দর হওয়ার সুবাদে মুম্বাইয়ের যে সমৃদ্ধি, সমুদ্রের তীরে মানুষের যে সুবিশাল সব অট্টালিকা নির্মাণ তা এখন ঘোর বিপদের সম্মুখীন। তাহলে সমুদ্রের তীরে এমন বাণিজ্য নগরী গড়ে কি ভুল করেছিল ইংরেজরা?

জল্পনা ছেড়ে ফিরে যাওয়া যাক কয়েকটা বছর আগের ঘটনায়। না কোনও উগ্রপন্থী আক্রমণের বর্ণনা নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আচমকা এবং অভূতপূর্ব এক আঘাত। সেটা ছিল ২০০৫ সালের ২৬ জুলাই। দুপুরে শুরু হল প্রলয়, চলল পরের দিন সকাল সাড়ে আটটা অবধি। মুম্বাইয়ের সান্তাক্রুজ বিমানবন্দরের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ৯৪.৪ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করল। এক দিনে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার মত ধারাপাত। পরের কয়েক দিনে বৃষ্টিপাত কমে এলেও এক সপ্তাহের জন্য যাবতীয় পরিবহণ পরিষেবা বন্ধ হয়ে রইল শহরে। মুম্বাইয়ের প্রাণ, সে শহরের রেলপথ ডুবে রইল অনেক দিন, ক্ষতিগ্রস্ত হল বহু জায়গায়। মহারাষ্ট্রের অন্যত্রও বৃষ্টি এবং বন্যা হয়েছিল সে সময় কিন্তু মুম্বাইয়ের দুরবস্থা বুঝতে হলে একটা তুলনাই যথেষ্ট হবে। মুম্বাইয়ে যখন এক দিনে ৯৪.৪ সেন্টিমিটার বৃষ্টি হচ্ছে তখন সাতাশ কিলোমিটার দূরে কোলাবা আবহাওয়া কেন্দ্রে মাত্র ৭.৪ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হচ্ছে। সেই বন্যায় মহারাষ্ট্রে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় এক হাজার মানুষের। তার মধ্যে শুধু মুম্বাইতেই মারা গেল ৪০৯ জন। রাজ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হল এবং মুম্বাই গুনল তার অর্ধেক। শহরের বহু এলাকাতে পাঁচ দিন ধরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার চিহ্ন রইল না। উষ্ণায়নের এমনই ভেলকি!

জনবহুল শহর মুম্বাই। জনসংখ্যার বিচারে টোকিও, নিউইয়র্ক এবং সিওলের পরেই তার অবস্থান। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শহরে ঢুকেছে পরিযায়ী শ্রমিক। ১৯৮১ সালে ৯৯ লক্ষ থেকে ২০০১ সালে ১ কোটি ৭৭ লক্ষে পৌঁছে যায় জনসংখ্যা। আরও কুড়ি বছর পরে, ২০২১ সালে সংখ্যাটা ছাড়িয়ে গিয়েছে দু’ কোটি। এমন একটা শহর যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বেশি-বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে তা বলাই বাহুল্য। গত ১৯ মে আর একটা গম্ভীর সতর্কবাণী দিয়ে গেল সাইক্লোন টটকে (tautkae)। ঘন্টায় ১৬০ কিলোমিটার গতিবেগে পৌঁছে যাওয়া ঝড় মুম্বাইকে রেহাই দিয়ে গিয়ে পড়ল গুজরাতের উপকূলে। কিন্তু সমুদ্রে থাকা বার্জগুলো রেহাই পেল না। ভারতের অয়েল অ্যাণ্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশনের বার্জে যখন আঘাত করল ঝড় তখন ভেঙে পড়ল সমুদ্রের তলদেশে সেটাকে আটকে রাখা নোঙরগুলো। অন্যান্য বেসরকারি বার্জেরও সঙ্গীণ অবস্থা হল। বার্জে থাকা মানুষজনকে উদ্ধার করতে গিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনী কুড়ি থেকে পঁচিশ ফিট উচ্চতার ঢেউয়ের সামনে পড়ল। ঝড়বৃষ্টির কারণে দৃশ্যমানতাও তখন কম। তবু তার মধ্যেও প্রাণপণ চেষ্টায় উদ্ধার করা গেল অধিকাংশ মানুষকে। উড়ল হেলিকপ্টার, সক্রিয় হল সেনাবাহিনী। জলে যেমন, জমিনেও তেমন দুরবস্থা। উদ্ধারকাজে রত সেনাবাহিনী এবং ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স। একটা সময় কাটল দুর্যোগ।

এর পর কী? বৈজ্ঞানিক তথ্যের তোয়াক্কা না করে অনেকেই হয়ত বলবেন, যখন আবার হবে তখন দেখা যাবে। মাঝে মাঝে কিছু সরকারি অর্থ বরাদ্দ হবে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর জন্য। ব্যাস, এইটুকুই। আমরা এখনও কি বিশ্বাস করতে পারছি না যে আবহাওয়া বদলে গিয়েছে? বিপদ এলে তখন মোকাবিলা করা যাবে, এই মানসিকতা ছেড়ে অন্য পথে কবে হাঁটব আমরা?

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.