বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২১— একুশ শতকের প্রথম দু’দশকে বিশ্ববাসী দেখেছে মহামারি ও অতিমারির তীব্র দাপট। কখনও বা স্থানীয় স্তরে একটি দেশে অথবা অঞ্চল জুড়ে, কখনও বা সব দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভুবনব্যাপী। নানা প্রজাতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বজুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। মেক্সিকোর এইচ ওয়ান এন ওয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, পশ্চিম আফ্রিকার এবোলা, ব্রাজিলের জিকা, মালয়েশিয়া এবং কেরালার নিপা, বহু দেশ জুড়ে সার্স, পশ্চিম এশিয়ার মার্স, সর্বোপরি কোভিড-১৯ ভাইরাস আছড়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে— প্রাণ নিয়েছে বহু মানুষের। এর সঙ্গে আছে গত শতাব্দির মারণ রোগ এইচআইভি-এডস আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু মিছিল। এ যাবৎ একটা ধারণা পোষণ করা হতো, আঞ্চলিক স্তরে ঘটে চলা ভাইরাসের আক্রমণ দক্ষিণ গোলার্ধের দরিদ্র দেশসমূহের সমস্যা। উত্তর গোলার্ধের ধনী দেশগুলোর উন্নতমানের জীবনযাত্রা এবং উৎকর্ষ ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট। ধারণাটা কতোটা অলীক অচিরেই তার প্রমাণ মিললো। কোভিড অতিমারির বিভীষিকাময় আক্রমণ ধনী ও দরিদ্র দেশের সীমারেখা ঘুচিয়ে বিশ্বের বিশাল সংখ্যক মানুষকে সংক্রামিত করে প্রমাণ করল অতিমারির মারণ রোগের কাছে ধনী-গরীব সকলেই কতোটা অসহায়। ধনী দেশগুলোর তথাকথিত উৎকর্ষ স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বেআব্রু কঙ্কালসার কাঠামো লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠলো। দরিদ্র দেশগুলোর দুরবস্থা না বলাই ভালো। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মুনাফালোভী ব্যবসাদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সেখানে জনস্বাস্থ্য সমর্পিত হবে মুনাফার যূপকাষ্ঠে এটাই স্বাভাবিক। স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন দেশের সরকারি বরাদ্দ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের শতাংশে দু-অঙ্কেরও কম আর ভারতবর্ষে তা ১.২ শতাংশ মাত্র।
মারণ রোগবাহী এই অণুজীবগুলো কেন এতোটা সক্রিয় হয়ে উঠছে তার কারণ খোঁজা হচ্ছে গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই। বিভিন্ন গবেষণায় জানা গিয়েছে ১৯৬৬ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ৩৫৫টি নতুন ব্যাধি দেখা গিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আর তার ৬০ শতাংশের উৎপত্তি বিভিন্ন বন্যপ্রাণী থেকে। মানুষ ও জীবজগতের মধ্যে সংক্রামিত ব্যাধির শুরু প্লেগ ও র্যাবিসের মাধ্যমে। বর্তমান শতকের ভাইরাস জনিত সংক্রমণে জীবজন্তুর উদাহরণ— এবোলা (বাঁদর ও বাদুড়), নিপা (শুকর), মার্স (উট), জিকা (বাঁদর), সার্স (বাদুড়)। বাস্তব ঘটনা হলো, এক প্রজাতির দেহের আপাত নিরীহ, নিষ্ক্রিয় জীবাণু অন্যান্য প্রজাতির দেহে প্রবেশ করলে তা ভয়ানক ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে এমন উদাহরণ প্রচুর। নির্বিচার প্রকৃতি-বিধ্বংসী আগ্রাসী উন্নয়নের মডেল বিশ্বের অরণ্য, জলাভূমি, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক ধ্বংসসাধন করে চলেছে। ফলত মানুষ এবং অন্য জীব জন্তুর নৈকট্য ক্রমশ বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বভাবতই বিভিন্ন জীবজন্তুর মধ্যে ব্যাধির আদানপ্রদানও বাড়ছে, পরিণামে মহামারির প্রাদুর্ভাবও ঘটে চলেছে। ভাইরাসের এহেন সৃষ্টিছাড়া আচরণ আসলে বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থার কাঠামোগত সমস্যা।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জন্মলগ্ন থেকেই আর্থিক বৈষম্য সহ বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্যও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি যেখানে পুঁজি তথা লগ্নি পুঁজির অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে বৈষম্য বেড়েছে দুরন্ত গতিতে। লগ্নি পুঁজি তার নিজস্ব নিয়মেই আয় বণ্টনে অসাম্য তৈরি করে। সমাজ তৈরি করে অপার ঐশ্বর্যের এক মেরু, বিপ্রতীপে দারিদ্র্যময় অন্ধকারাচ্ছন্ন আরেক মেরু। বিশ্বায়িত পুঁজিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় আজকের পৃথিবী অসাম্যময়। আয় বৈষম্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানব উন্নয়ন সূচকের বৈষম্য। অসাম্য তৈরি হচ্ছে দেশগুলোর মধ্যে, আবার একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে। সম্পদের মালিকানার চেহারাটা উদ্বেগজনক। ২০০৬ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছ, পৃথিবীর ৬ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে পৃথিবীর মোট সম্পদের ৫২ শতাংশ। আবার ৫০ শতাংশ পৃথিবীবাসীর হাতে আছে মোট সম্পদের ৬ শতাংশ। অতিমারির দরুণ এই বৈষম্য আরো তীব্র হয়েছে। আমাদের দেশের অবস্থাও অনুরূপ। অক্সফামের রিপোর্ট অনুসারে ১০ শতাংশ ভারতবাসীর কব্জায় জমা হয়েছে জাতীয় সম্পদের ৭৭ শতাংশ। ২০১৭ সালে উৎপাদিত দেশের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ ধনী ভারতবাসীর করায়ত্ত। অতিমারির সময়কালে দেশে লকডাউন চলাকালে ভারতীয় বিলিওনিয়ারদের সম্পদ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ অথচ করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় এক কোটি মানুষ চাকুরিচ্যুত হয়েছে, ৯৭ শতাংশ পরিবারের আয় করোনাকালে কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক টিকা বা ভ্যাকসিন ঘিরে নানা বিতর্ক আছে। টিকার দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন, ছাড়পত্র পাওয়া টিকাগুলির ক্ষেত্রে সে সময় দেওয়া হয়নি। এ সত্ত্বেও অতিমারির দাপট, সংক্রামিত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ, চিকিৎসার প্রথাগত পরীক্ষিত প্রত্যক্ষ হাতিয়ারের অভাব— সব মিলিয়ে বিপন্ন বিপর্যস্ত বিশ্বে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী টিকা সমূহ আপৎকালীন ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে। স্থির হয়েছে, দ্রুত টিকাকরণের মাধ্যমে পৃথিবীর ৭৮০ কোটি মানুষের বৃহৎ অংশের মধ্যে এক ধরণের হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হলে তা রোগের তীব্রতা ও মৃত্যু কমাতে সাহায্য করবে। তবে এটাও বাস্তব যে কোভিড ভাইরাসের দ্রুত প্রতিরূপ গঠনের ও ভোল বদলের (মিউটেশন) ক্ষমতার দরুণ টিকাগুলো কতোটা কার্যকরী হবে তা পরীক্ষণীয়।
প্রধান সমস্যা টিকার চাহিদা ও যোগানের অসমতা। এ যাবৎ ছাড়পত্র পাওয়া ব্যবহৃত টিকাগুলো সহজ প্রাপ্য নয়। কারণ এটা নির্ভর করবে মুষ্টিমেয় বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার মর্জির উপর যারা আবিষ্কারক হিসাবে টিকাগুলোর পেটেন্টের অধিকারি। পেটেন্টের রক্ষাকবচ হাতে নিয়ে অতিমারি জনিত ত্রাসকে হাতিয়ার করে যত শীঘ্র মুনাফা তোলা যায়— সেটাই একমাত্র লক্ষ্য টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর। তারা অগ্রিম টাকা নিয়ে বিভিন্ন দেশের কাছে টিকা বিক্রি করছে নিজস্ব শর্তে। যোগান যেখানে সীমিত সেখানে ইতিমধ্যে ধনী দেশগুলো নিছক অর্থের জোরে উৎপাদিত টিকার সিংহভাগ দখল করে ফেলেছে। টিকার অভাবে নিম্ন এবং মাঝারি আয়ের দেশগুলোয় হাহাকার চলছে। এই সমস্যা মাথায় রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘কোভাক্স’ নামে বিশ্বব্যাপী এক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যার উদ্দেশ্য বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে টিকা বণ্টনে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে এক সুষমতা বজায় রাখা। এই উদ্যোগের অভীষ্ট লক্ষ্য জনসংখ্যার নিরিখে ৯২টি দরিদ্র দেশের মধ্যে বর্তমান বছরের বাকি দিনগুলোতে ২ বিলিয়ন অনুমোদিত টিকা বণ্টন করা হবে। যদিও বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই উদ্যোগটি যথেষ্ট নয়। এর হেফাজতে মজুত থাকবে আরও কিছু টিকা যা জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হবে। অবশ্য টিকাকরণের সাফল্য নির্ভর করবে টিকা কেনার জন্য বিভিন্ন ধনী দেশের আর্থিক সাহায্য এবং দেশগুলোর নিজস্ব সংগ্রহে টিকার অংশভাগ। সর্বোপরি টিকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকার উপর, টিকা ব্যবসায় বিপুল মুনাফা সংগ্রহ যাদের উদ্দেশ্য। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সোরগোল ওঠায় সম্প্রতি বিশ্বের ধনী সাতটি দেশের প্রধানরা অঙ্গীকার করেছে যে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য তারা ১০০ কোটি টিকার ডোজ দেবে। এর মধ্যে আমেরিকা ও ব্রিটেন দেবে যথাক্রমে ৫০ কোটি ও ১০ কোটি ডোজ। কিছু দেশ আর্থিক সাহায্য দেবে টিকা কেনার জন্য।
বিভিন্ন দেশের প্রকাশিত রিপোর্টের সূত্রে বলা হয়েছে এ বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মোট টিকাকরণের ৪৬ শতাংশ পেয়েছে ১৬ শতাংশ মানুষ যারা মূলত ধনী দেশসমূহের বাসিন্দা। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ধনী দেশগুলোর অগ্রিম টিকা কেনার জন্য কোভাক্সের মাধ্যমে গরীব দেশে টিকা বণ্টনের উদ্যোগ বহুলাংশে বাধা পেয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে টিকা ব্যবহার করা হয়েছে ৩০৮ কোটি ডোজ। বিশ্বে টিকাকরণ যোগ্য মানুষের ২১.৫ শতাংশ অন্তত দুটি ডোজ পেয়েছে যার সিংহভাগ ধনী দেশের মানুষ। সেখানে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মাত্র ০.৯ শতাংশ মানুষ পেয়েছে টিকার অন্তত একটি ডোজ। বিস্ময়কর ঘটনা ধনী দেশ কানাডা যার মোট জনসংখ্যা ৩.৮ কোটি, তার সংগ্রহে রয়েছে প্রতিটি কানাডাবাসীর জন্য পাঁচটি করে টিকার ডোজ।
একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাস যা বিশ্ব জুড়ে সকল মানুষকে সংক্রমিত করে চলেছে অতি দ্রুত— তার মোকাবিলা কেবল একটি দেশের সমস্যা নয়। তাই অতিমারির শুরুতে এর বিধ্বংসী চেহারা দেখে সব দেশই এক যোগে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল— ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার রয়েছে ভাইরাসের আবিষ্কৃত প্রতিষেধকের সমান সুযোগ পাওয়ার।
উগ্র জাতীয়তাবাদের যূপকাষ্ঠে অচিরেই মহান অঙ্গীকারটির মৃত্যু ঘটেছে। টিকা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু হয় টিকার দখল নেওয়ার। কতিপয় ধনী দেশ এ ব্যাপারে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশসমূহের চাইতে শতেক যোজন এগিয়ে থাকে। সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা সহ ১০০টি দেশ এক যোগে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় আবেদন জানায়— টিকার যোগান বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আবিষ্কৃত টিকাগুলো সাময়িকভাবে পেটেন্ট আইনের আওতার বাইরে আনা হোক যাতে এই টিকা অন্যান্য সক্ষম দেশগুলো উৎপাদন করতে পারে। নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন দেশের ট্রেড ইউনিয়ন এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের চারশতাধিক জনপ্রতিনিধিও এই আবেদনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলে। যদিও ধনী দেশসমূহ এবং সেই দেশের টিকা আবিষ্কারক বহুজাতিক ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলো এক যোগে এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করে চলেছে, শুধুমাত্র মুনাফার স্বার্থে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এই আবেদনের স্বপক্ষে থাকলেও (দলের বামপন্থী জনপ্রতিনিধিদের চাপে) দেশের বৃহৎ পুঁজির ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রবল বিরোধিতায় প্রশাসন এ ব্যাপারে আপাতত চুপ। শুধুমাত্র মুনাফা নিশ্চিত করতেই আবিষ্কৃত টিকার প্রযুক্তি কৌশল ও পেটেন্টের অধিকার অন্য কোনও কোম্পানির সঙ্গে ভাগ করে নিতে এরা রাজি নয়। বহুজাতিক, অতিকায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর করোনা টিকার স্বল্পকালীন ব্যবসায় মুনাফার বহর দেখলে বোঝা যায় কেন এই প্রতিরোধ।
ফাইজার-বায়োএনটেকের যৌথ উদ্যোগে তৈরি টিকা বিক্রি করে এই বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ফাইজার কোম্পানির আয় হয়েছে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার। এবং বায়োএনটেক কোম্পানির আশা ২০২১ সালে টিকা বাবদ কোম্পানির আয় হবে ২৬ বিলিয়ন ডলার। এই বিক্রি থেকে মুনাফার পরিমাণ জানাতে আগ্রহী নয় কোনও কোম্পানি। যদিও আর্থিক সংস্থাগুলোর বক্তব্য ফাইজার কোম্পানির মুনাফার হার বিক্রির ২০ শতাংশ — অর্থাৎ টিকা বাবদ ঐ সময় লাভ হয়েছে ৯০ কোটি ডলার। একই সময়ে আমেরিকার মডার্না কোম্পানির টিকা বিক্রির পরিমাণ ১.৭৩ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকার অপর একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসন প্রথম ত্রৈমাসিকে টিকা বাবদ আয় করেছে ১০ কোটি ডলার। প্রসঙ্গত এই টিকা বাজারজাত করার ছাড়পত্র পেয়েছে অনেক পরে। আর একটি বহুজাতিক কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ত্রৈমাসিকে টিকা বাবদ আয় ২৭৫ মিলিয়ন ডলার। অবশ্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অধীনে জেনার ইন্সটিটিউটের সঙ্গে এক যোগে আবিষ্কৃত এই টিকা থেকে কোন মুনাফাই কোম্পানি আদায় করবেনা — এমনটাই কোম্পানির প্রতিশ্রুতি।
পেটেন্ট এক কথায় মেধাসত্ত্বের অধিকার যার দ্বারা আবিষ্কারক পেটেন্টকৃত পণ্য বা পরিষেবা দীর্ঘ দু’দশক ধরে বাজারজাত এবং মুনাফা করার একচেটিয়া অধিকার অর্জন করে। এক কথায় পেটেন্ট, কোম্পানির মেধাসত্ত্ব ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের দ্বন্দ্ব। পেটেন্টের স্বপক্ষে দেওয়া যুক্তি, আবিষ্কারের পিছনে বিপুল খরচ ফেরত পাওয়া ও নতুন আবিষ্কারের প্রণোদনা যোগানো। বাস্তবে এই টিকা আবিষ্কারের অন্যতম সহায়ক শক্তি ছিল সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগার সমূহ। অথচ পেটেন্টের অধিকারি বহুজাতিক ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলো উসুল করে চলেছে বিপুল মুনাফা। স্মরণ রাখা দরকার দুটি মারণ রোগ স্মল পক্স (গুটি বসন্ত) ও পোলিওর প্রতিষেধক টিকা এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার আধুনিক অস্ত্র অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কারক যথাক্রমে ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার, ডাক্তার জেনাস সাল্ক এবং ডাক্তার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের সুযোগকে অবহেলায় পরিত্যাগ করে আবিষ্কারের সুফল তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বের সকল মানুষের স্বার্থে।
মুনাফা কেন্দ্রিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার গর্ভে বিপুল বৈষম্যের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। এই সমাজ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে উন্নততর সমাজ গড়ে বৈষম্যের অবসান করাই সময়ের দাবি।