বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

এ এক কৃষক জাগরণ

এ এক কৃষক জাগরণ

ডা. আশিস মিত্তাল

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অক্টোবর, ২০২১— [সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের নানা বৈশিষ্ট্য বিষয়ে সারা ভারত কিসান মজদুর সভার (এআইকেএমএস) সাধারণ সম্পাদক এবং সংযুক্ত কিসান মোর্চার অন্যতম নেতা ডা. আশিস মিত্তাল গাজিপুর সীমান্ত থেকে ইউটিউবে যে বার্তা সারা দেশের উদ্দেশ্যে রেখেছিলেন, সেটি আমরা বাংলা অনুবাদ করে প্রকাশ করলাম।]


এই কৃষক আন্দোলন মূলত একটি ধারাবাহিক আন্দোলন। এটা শিল্প ধর্মঘট বা ছাত্র ধর্মঘটের মতো বিষয় নয়। ধর্মঘটে লোকে কাজ বন্ধ করে প্রতিবাদ অবস্থানে বসে পড়ে। কিন্তু এখানে কৃষকেরা তাঁদের পেশাগত কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রতিবাদও চলছে।

বিষয়টি কী ভাবে সম্ভব হচ্ছে?

কৃষকদের বযস্ক প্রজন্মের লোকেরা মাঠে কাজ করছেন। অন্য প্রজন্ম শামিল মোর্চায়। এটা মনে রাখতে হবে যে, কৃষিতে শ্রমের মেয়াদ খুবই স্বল্প কালপর্বের। এবং আমার মনে হয়, সেই কাজের সময়টাও এখন সংক্ষিপ্ততর হয়ে আসছে। সেকারণে এখানে অন্য কাজ করার মতো বাড়তি সময় অনেকটা পাওয়া যায়। একদিকে ওঁরা নিজেদের কাজ সেরে বাকি সময়ে চলে আসছেন আন্দোলনের কাজে। আর আমরা আমাদের কাজ ছেড়ে চলে আসছি মোর্চায়। এভাবে গড়ে উঠছে একটা সমন্বয় বা তালমিল। এভাবে যে সহযোগিতামূলক সমন্বয় গড়ে উঠছে তার জেরে বহু মানুষ আন্দোলনে যুক্ত হতে পারছেন। আবার কৃষিকাজের ক্ষতিও হচ্ছে না। সেকারণেই আন্দোলনটা কয়েক বছর ধরে চলবে। কোনও সমস্যা হবে না।

দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আন্দোলন শুরু হয়েছিল পাঞ্জাব থেকে। ক্রমশ তা শিকড় ছড়িয়েছে হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানে। এখন এটা ছড়াচ্ছে পূর্ব উত্তরপ্রদেশে। আন্দোলন আরও ছড়াতে থাকবে। আন্দোলন বেড়েই চলবে, আদৌ থিতোবে না।

ভারতে কৃষির সঙ্গে শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নই জড়িত নয়। আরও বড় বিষয় হল জীবনজীবিকার প্রশ্ন, বড় বিষয় হল আত্মপরিচিতির প্রশ্ন। আপনার গ্রামটাই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আপনার সামাজিক সম্পর্ক, আপনার পরিবার সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। সরকারের এই নতুন কৃষি আইন গোটা গ্রামীণ জীবনকেই ধ্বংস করে দিতে চাইছে। এই আইন ভারতীয় সমাজে একটা গভীরতর বদল এনে দিতে চাইছে। এই সার কথাটা বুঝতে পেরেছেন চাষিরা, বুঝতে পেরেছে গোটা কৃষক সমাজ। সুতরাং, ধরে নিতেই পারেন যে এই আন্দোলন চলবে দীর্ঘ সময় ধরে।

যেমন ধরুন, এখন মানুষের জীবনধারণের মূল ভিত্তি হল জ্বালানি। সরকার জ্বালানিতে এখন কোনও ভরতুকি দিচ্ছে না। উল্টে বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করছে এবং দাম বাড়িয়ে চলেছে। অথচ সরকার ভোডাফোনকে ভরতুকি দিচ্ছে। এয়ারটেলকে ভরতুকি দিচ্ছে। সরকারের এয়ারওয়েজ ব্যবহার করায় যে টাকা এয়ারটেলের কাছে কেন্দ্রের প্রাপ্য এখন বলা হচ্ছে সেটা আগামী ৫ বছর দিতে হবে না। ওদের কেন্দ্র সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। অথচ কৃষকদের জন্য এমন কোনও ঘোষণা হয়নি। হয়নি ভাগচাষি, মৎস্যজীবী কিম্বা আদিবাসীদের জন্য। সেকারণে প্রশ্ন উঠছে, এই সরকার কাদের সরকার? প্রতিদিন এটা ঘটছে। মানুষ জীবিকাচ্যুত হচ্ছেন। এই বঞ্চনা বোধ ক্রমশ সমাজের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে।

এখনকার এই আন্দোলনের সঙ্গে আমরা একমাত্র তুলনা টানতে পারি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের, যখন একই রকম ক্রোধ ও জমায়েত দেখা গিয়েছিল। তখন কৃষকেরা একাধিক কারণে জেগে উঠেছিলেন। তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় কৃষির কাঠামোটাকেই বদলে দিতে চাইছিল। আপনি কী চাষ করবেন, কীভাবে চাষ করবেন, কাকে বিক্রি করবেন— তখন সব কিছুই বদলে ফেলা হচ্ছিল। ঋণ কাঠামো বদল করা হয়েছিল। ঋণ শোধ করতে না পারলে জমি থেকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৭৯৪ সালে কর্নওয়ালিসের সংস্কার কার্যকর হওয়ার আগে এ ধরনের উচ্ছেদের ব্যবস্থা ছিল না। এর আগে ঋণ শোধ না করতে পারলেও কখনই কৃষকের জমির মালিকানা যেত না। জমিতে তার অধিকার বজায় থাকতো। কৃষককে উচ্ছেদের ব্যবস্থাসহ ভারতীয় কৃষিতে বিরাট সব পরিবর্তন কার্যকর করা হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। এই রকম বড় বড় পরিবর্তনের সঙ্গে এল আরও একটা জিনিস। যে সব রাজা প্রজাদের পক্ষে দাঁড়ালেন তাঁদের উচ্ছেদ করল ব্রিটিশ। এই রকম বড়সড় কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছিল সেই সময়।

একই রকম কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে এখন। কৃষকেরাও দেখছেন, উদারিকরণ করা বাজারে তাদের কিছু পাওয়ার নেই। মেক ইন ইন্ডিয়ার নামে তৈরি করে বিদেশে বিক্রির কথা আসলে একটা ভাঁওতা। তাতে অর্থনীতির কোনও বিকাশ হচ্ছে না। এখন ভারতের অর্থনীতিতে যে সেক্টর সবচেয়ে বেশি বাড়ছে সেটা হল শেয়ার বাজার। উৎপাদন, ম্যানুফ্যাকচারিং, পরিষেবা ক্ষেত্র কোনও কিছুই বাড়ছে না। কৃষিতেও কোনও বিকাশ হচ্ছে না।

মানুষ কিন্তু জানে শেষ পর্যন্ত কৃষিকাজই তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। মনে রাখা দরকার, যখন কোভিড সংক্রমণ ও লকডাউন হল, তখন ২ কোটি লোক গ্রামের বাড়িতে ফিরেছে। কোথায় আসল নিরাপত্তা লোকেরা নিজেরাই সেটা জানে।

এখন যে অভ্যুত্থানটা সামনে আসছে সেটার ব্যাপ্তি হবে বিশাল। কৃষকের সঙ্গে থাকবেন ট্রেডাররা, বিশেষ করে পাঞ্জাবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্যান্য অংশও কৃষকদের সঙ্গে থাকবেন, বিশেষ করে পাঞ্জাবে। মিডিয়া, আরএসএস, কর্পোরেটরা যে গিমিকই করুক, লোকে ক্রমশ এটা বুঝতে পারছে যে এই আইন তাদের সম্পূর্ণ জীবনচক্রকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। সেকারণেই এই আন্দোলন টিকবে এবং দীর্ঘ সময় চলবে। আমার মনে হয়, এই আন্দোলন চাইছে একটা ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক নীতি–কাঠামো যেখানে সরকারের কাছে দাবি থাকবে সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র এবং শ্রমজীবীদের জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি। সস্তা শ্রম, সস্তা সম্পদ ও নিশ্চিত বাজারের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্পোরেটের কাঠামো। তার মানে কর্পোরেট কোনও শিল্প নয়। কর্পোরেট হল স্বার্থসন্ধানী এক আপদ যেখানে ম্যানুফ্যাকচারিং, ব্যাঙ্কিং এবং সরকারের স্বার্থগুলি গিয়ে মিশেছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে ফিনান্স পুঁজি। সব কর্পোরেটের মিলের জায়গা একটাই, তাদের ন্যূনতম স্বার্থ মূল্য আদায় করতেই হবে। এটা সম্ভব একমাত্র অসহায় মানুষকে লুঠ করেই। এর জন্যই তৈরি হয়েছে রাস্তা নির্মাণ শিল্প যে রাস্তার জন্য সকলকে টোল দিতে হবে। অথচ টোল থেকে আদায় করা অর্থ দেশের উন্নয়নের কাজে লাগবে না। গরিবের জন্য চালু হয়েছে উজ্জ্বলা যোজনা। অথচ গ্যাসের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। আধুনিক কৃষিকাজ করতে হলে বিদ্যুৎ, সার, জ্বালানির বাড়তি দাম দিতে হবে। আধুনিক জীবন মানেই হল কর্পোরেটের দ্বারা পরিচালিত পরিষেবা যা কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হবে। এবং চাষিকে তা কিনতেই হবে। এটা এড়ানোর কোনও উপায় নেই। যদি চুক্তি আইনের ১৬ ধারা পড়েন তাহলে দেখবেন, তাতে লেখা আছে, রাজ্য সরকারগুলি যাতে এই আইন কঠোর ভাবে প্রয়োগ করে সেজন্য নির্দেশ দেবে কেন্দ্র। এই নির্দেশ রাজ্যগুলিকে মেনে চলতেই হবে। এমন নয় যে মানা বা না মানাটা আপনার ইচ্ছে। আপনাকে এই আইন মানতে বাধ্য করা হবে।

গান্ধীজী সবসময় বলতেন, পুলিশ মারলে আপনি চুপ করে থাকুন। আমরা একথা বলছি না। কারণ এখন দেশে যে সরকার আছে তাতো ব্রিটিশ সরকার নয়, আমাদের সরকার। তাই আমরা সীমানায় বসে আছি। সরকারের উচিত আমাদের কথা শোনা। না যদি শুনতে চায় ঠিক আছে, আমরাও শান্তিপূর্ণবাবে বসে থাকব। আসলে এই সরকার বোঝে না কোথায় তারা হাত দিয়েছে। কৃষকের চাইছেন সরকারকে ধাক্কা দিতে। আমরা সেই ধাক্কা দেব। এটা আমাদের কমিটমেন্ট। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে গোটা বিশ্বের জিডিপির ২৬ শতাংশই আসত ভারতের কৃষি ও হস্তশিল্প থেকে। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের জিডিপির ২ শতাংশেরও কম।

কীভাবে ভারতীয় কৃষি ঘুরে দাঁড়াতে পারে? রাস্তাটা কি? একথা মানুষ জানতে চায়। কৃষি মানে খাদ্যপণ্য এবং খাদ্যপণ্য নয় এমন বহুতর পণ্য। ভারতের কৃষিপণ্য এবং ভারতীয় হস্তশিল্প বিপুল বৈচিত্রে ভরা। ভারতে যত রন্ধনপ্রণালী রয়েছে তার ১০ বা ২০ শতাংশের বেশি আমরা জানি না। এই প্রণালী তৈরি করেন সাধারণ মানুষ। এটা তাঁদের রোজগারের একটা উৎস। এই সব কৌশল জানতে ক্রাফট মেলা বা দিল্লিতে আর্ট মেলা করার দরকার পড়ে না। সাধারণ মানুষই এগুলো তৈরি করেন, উন্নত করেন এবং বাজারে বিক্রি করেন। সরকারের উচিত তাঁদের সাহায্য করা। দেখুন ভারতের কৃষকেরা কত বড় উদ্যোগী। দেশজুড়ে তারা কয়েকশ জাতের আম ফলান। এক জায়গার আম অন্যত্র নিয়ে গিয়ে পুঁতে দেন। দেশের সর্বত্র আপনি নানা জাতের আম পাবেন। এটাই তো সাধারণ মানুষের সৃজনী শক্তি। এটাই মানুষের ক্ষমতার উৎস হতে পারে। আবার এ থেকেই দেশ আয় করতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার নীতি হতে হবে এটাই যে — এই সব জিনিষের উৎপাদন, বণ্টন ও বিক্রির ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন সাধারণ মানুষই। এসব তৈরি করতে হবে গ্রামে যাতে গ্রামের মানুষের জীবন উন্নত হয়। আপনি রাস্তা তৈরি করতে হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ারকে কাজে লাগাচ্ছেন। একইভাবে গ্রামীণ মানুষের উপকারে লাগে এমন ল্যান্ডস্কেপ তৈরির জন্য ইঞ্জিনিয়ারদের কাজে লাগাতে পারেন। এতে গ্রামের উপকার হবে। এরকম আরও অনেক বিষয় রয়েছে।

দিল্লির বাসিন্দাদের উচিত ধর্নায় বসা লোকজনের কাছে আসা। এসে তাঁরা আলোচনা করুন, মতামত দিন। বিশেষ এগিয়ে আসুন বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের উচিত নিজেদের মতামত জানানো এবং কৃষকদের মতামত শোনা। এটা হবে একেবারে নতুন বিষয়। দলবল নিয়ে, অনেক লোকজন নিয়ে তাঁরা আসুন। ডেলিগেশন নিয়ে আসুন। মতামত বিনিময় করুন কৃষকদের সঙ্গে। কৃষকে, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবীরা ভিন্ন ভিন্ন জগতে আটকে রয়েছেন। একদিকে রয়েছে ফ্লাইওভারের ভারত, অন্যদিকে ঝুপড়ি–ঝুগ্গির ভারত। আমাদের বার্তা হল, সব বিশ্ববিদ্যালয়, সব ইনটেলেকচুয়াল সেন্টার থেকে প্রতিনিধিরা নিয়ম করে আসুন। এটা একটা বড় সুযোগ। শনি ও রবিবার তাঁরা যাতে আলোচনা করতে পারেন আমরা সেই ব্যবস্থা করছি। নেতারা সেই আলোচনায় কোনও কথাই বলব না। শুধু শুনব। এখন কৃষকেরা সামনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। এখনই দেশকে নতুন করে গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.