বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

সাম্প্রতিক ভারতে কাজের বাজার

সাম্প্রতিক ভারতে কাজের বাজার

মনোজ চট্টোপাধ্যায়

photo

ভারতে কাজের বাজারের হালহকিকৎ বরাবরই বেশ খারাপ। সাম্প্রতিককালে হয়েছে আরও খারাপ। দিনেদিনে অবস্হাটা ক্রমশ খারাপের দিকেই যাচ্ছে। দুই অঙ্কের বেকারত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দেশ।
২০২০র মার্চ-এপ্রিল মাসে কোভিড অতিমারির প্রথম তরঙ্গ যখন আছড়ে পড়েছিল দেশে, তখন একটানা অনেকদিন জাতীয় অর্থনীতির তালা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। তুলনায় সাম্প্রতিককালে, দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার সময়, বিধিনিষেধগুলি চালু করা হয়েছে অনেকটা শিথিলতার সঙ্গে এবং বেশ কিছুটা স্থানীয়ভাবে। কিন্তু তা সত্বেও, সমগ্র মে মাস জুড়ে, কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় এক শতাংশ হারে, অর্থাৎ প্রায় এক কোটি মানুষ, নতুন করে, কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, এই সময়কালে। সিএমআইই-এর নিরীক্ষণে ধরা পড়েছে এই তথ্য।
২০২১ সালে মে মাসের ২৩ তারিখে ৩০ দিনের গড় বেকারত্বের হার ছিল ১০.৩ শতাংশ। উদ্বেগজনকভাবে, গ্রামাঞ্চল এবং শহরাঞ্চল, দু’ জায়গাতেই বেকারত্বের হার বেড়েছে, একই সময়ে, যদিও সাধারণ ভাবে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি হয়। গ্রামীণ বেকারত্বের হার বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক ঘটনা।
কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলির সাম্প্রতিক নিয়োগ-হার অত্যন্ত কম। এটি অবশ্যই অর্থনীতিতে অতিমারির প্রভাবেরই একটি ফলশ্রুতি। ২০২০-২১ সালে নিয়োগ হয়েছে বিগত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। কেন্দ্রে নিয়োগ কমেছে ২৭ শতাংশ, এবং সম্মিলিতভাবে রাজ্যগুলিতে নিয়োগ কমেছে ২১ শতাংশ। নয়া পেনসন স্কীমে বহাল কর্মীদের তালিকাসূত্র উল্লেখ করে মিন্ট পরিবেশন করেছে এই তথ্য।
২০২২ অর্থবর্ষে দুই অঙ্কের বৃদ্ধিহার আশা করেছিলেন অনেক বিশ্লেষক। অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ সেই প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করবে কিনা, তাতে এখন থেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে।
অনুপ সতপতির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, একজন শ্রমিকের ন্যূনতম জাতীয় দৈনিক মজুরি হতে হবে ৩৭০ টাকা। যাঁরা এই ন্যূনতম মজুরিটাও পান না তাঁদের সংখ্যাটা করোনাকালে বেড়ছে প্রায় ২৩ কোটি।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা “কর্মরত ভারতের অবস্থা সম্পর্কিত দলিল, ২০২১” এ বলা হয়েছে, প্রথম পর্যায়ের কোভিডে নতুন করে প্রায় ২৩ কোটি ভারতীয় চূড়ান্তভাবে দারিদ্র কবলিত হয়েছেন।
দিনে অন্তত এক ঘন্টা যাঁরা কাজের সুযোগ পান, অথবা সপ্তাহে অন্তত একদিন, তাঁদের কর্মহীন বা বেকার বলে গণ্য করা হয় না। এখানেই আলোচনাটিকে শেষ করাটা ঠিক হবে না। সেক্ষেত্রে মনে হতে পারে, ভারতে বেকার সমস্যা নিতান্তই একটি সাময়িক ও সাম্প্রতিক সমস্যা, এটি একান্তভাবে করোনা অতিমারিরই সৃষ্টি।
তা কিন্তু নয়। আসলে সমস্যাটি অনেকটাই কঠামোগত, এবং কিছুটা মরসুমি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগেও ছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সাড়ে তিন দশকেও যায়নি, তীব্রতা পেয়েছে ১৯৯১এ নয়া উদারবাদ ভারত রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক নীতির অঙ্গীভূত হওয়ার পরিণতিতে।
এই ধারাবাহিক বেকারত্বের মূলে রয়েছে ভারতীয় অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোগত সমস্যা: জাতীয় আয় কম বলেই জাতীয় সঞ্চয় কম, জাতীয় সঞ্চয় কম বলে জাতীয় বিনিয়োগও কম, জাতীয় বিনিয়োগ কম বলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারও কম; তাই কর্মসংস্থানের হারটাও কম, বেকারত্বের সমস্যাটাও তীব্র।
আয়-সঞ্চয়-বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান কম হওয়ার কারণে দারিদ্রও তীব্র।
আর সেই কারণেই ভারতীয় অর্থনীতির রেটিং খারাপ হওয়ায় এদেশে প্রত্যক্ষ এবং পোর্টফোলিও- দু’ ধরনের বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহটাও তেমন যুতসই নয়। সুতরাং কম আয়-সঞ্চয়- বিনিয়োগ-আয়জনিত বেশি দারিদ্র এবং কম বিদেশি মূলধন অন্তর্প্রবাহের মিলিত কাঠামোগত কারণেই ভারতে বেকারত্বের এ হেন তীব্রতা।
কিছু কিছু কর্মনিয়োগ ঘটে নির্দিষ্ট মরসুমে। কৃষিকাজ শুরু হয় বর্ষায়, ফসল ওঠে হেমন্তে। রবিমরসুম শুরু ও শেষ হয় যথাক্রমে হেমন্ত ও শীতে। এদেশে কৃষিনির্ভর শতকরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগ মানুষেরই কিছুটা ক্রমসংস্থান হয় এইসব নির্দিষ্ট মরসুমগুলিতেই; বাকি সময় তারা বেকার থাকতে বাধ্য হয়। একেই বলে মরসুমি বেকারত্ব।
আর এক ধরনের বেকারত্ব আছে— ছদ্ম বেকারত্ব— দেখে মনে হয় কাজে নিযুক্ত আছে, আসলে বেকার।
কৃষিক্ষেত্রে যত মানুষকে কাজে নিযুক্ত থাকতে দেখা যায় চর্মচক্ষুতে, তত মানুষ কিন্তু বাস্তবে নিযুক্ত থাকেন না। কারণ, বেশ কিছু মানুষকে কৃষিকর্ম থেকে সরিয়ে নিলেও উৎপাদন হ্রাস পায় না মোটেই। এদের প্রান্তিক উৎপাদন শূন্য। তাই এরা ছদ্মবেশী বেকার।
ভারতে গ্রামীণ যৌথপরিবারগুলি এখনও সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যায় নি। তাই পারিবারিক কৃষিকাজে নিযুক্ত যৌথপরিবারের অনেকেই ছদ্মবেশী বেকার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.