বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২১— “এটা যে শুধু আমার সঙ্গেই করা হচ্ছে, তাতো নয়। সারা দেশ জুড়েই এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। আমরা তো জানি, কেমনভাবে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, লেখক, কবি, সমাজকর্মী ও ছাত্রনেতাদের জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। তাদের অপরাধ এই যে, তারা ভারতের ক্ষমতাসীন শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, বা তাদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।” কথাগুলো ফাদার স্ট্যান স্বামীর। বলেছিলেন মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, মহারাষ্ট্রের তাজোলা জেল থেকে, যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগগুলোও তাঁর জোটেনি, সেগুলো পেতেও তাঁকে আইনি লড়াই লড়তে হয়েছিল।
ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (এনআইএ) কোর্ট তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। এনআইএ কোর্টের বিচারপতির মতে, ফাদার স্ট্যান স্বামীর “ব্যক্তিগত স্বাধিকার, বা তাঁর বৃদ্ধাবস্থা, কিম্বা তিনি যে-সব অসুস্থতায় ভুগছেন, সেগুলোর কোনওটাই ওজনের দিক দিয়ে কমিউনিটির সামূহিক স্বার্থের তুলনায় কিছুই নয়।” কমিউনিটি বলতে বিচারপতি কী বোঝাতে চাইছিলেন তা স্পষ্ট নয়, সম্ভবত কমিউনিটি তাঁর কাছে রাষ্ট্র। ফাদার স্ট্যান স্বামী দেশের মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এবং সেটা তিনি করেছিলেন দেশের বিদ্যমান আইনব্যবস্থার মধ্যেই। শত শত আদিবাসী মানুষকে তাঁদের ভূমি থেকে উৎখাত করার বিরুদ্ধে, তাঁদের পরম্পরাগত জীবনযাত্রা ধ্বংস করার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। অধিকারের দাবিতে আন্দোলনে নামা আদিবাসী ও অন্যান্যদের অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলা চাপিয়ে জেলে পুরে রাখার বিরুদ্ধে আইনী সহায়তার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি পার্সিকিউটেড প্রিসনার্স সলিডারিটি কমিটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। এই সংগঠন বিভিন্ন রাজ্যে বিনা বিচারে আটক বন্দীদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়, এবং তাঁদের আইনী সাহায্য ও ন্যায় দেওয়ার চেষ্টা করে। “জেলে পচতে থাকা তিন হাজার আদিবাসী যুবকের পক্ষে আমি ঝাড়খণ্ড হাইকোর্টে ঝাড়খণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করি। এটাই আসলে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ক্রোধের কারণ। তাদের পথের কাঁটা সরানোর জন্য সব চেয়ে সহজ রাস্তা হল, আমার বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু অভিযোগ এনে জেলে ভরে দেওয়া।”
সোজা কথাটা সহজ ভাষায় বলাটা ঘোর অপরাধ। তুমি যদি ন্যায় চাও, তাহলে তুমি রাষ্ট্রদ্রোহী। তুমি যদি রাষ্ট্রের কাছে দাবি কর, দেশের মানুষের বেঁচে থাকার এবং নিজের মতো বিকশিত হবার অধিকার তাহলে তুমি দেশদ্রোহী। তুমি যদি বল, দেশের অরণ্য, খনি, নদী, মৃত্তিকা, দেশের মানুষের, তাহলে তুমি দেশদ্রোহী। তুমি যদি বল দেশের মানুষের শ্রমের ফসল গুটিকয় পুঁজিমালিকের নিরঙ্কুশ এক্তিয়ারে তুলে দেওয়া চলবে না, তাহলে তুমি রাষ্ট্রের ঘোর শত্রু। আর সব চেয়ে বড় ব্যাপার, তুমি যদি নিজের বুদ্ধিকে লোকহিতের কাজে লাগাও, নিজের চিন্তা করার শক্তিকে পুঁজির সেবায় নিযুক্ত করতে অস্বীকার করো, তাহলে তোমার চেয়ে বিপজ্জনক রাষ্ট্রদ্রোহী আর কেউ না। ফাদার স্ট্যান স্বামী, অতএব, ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁর সহ-অভিযুক্তরাও তাই। পাশাপাশি, ফাদার স্ট্যান স্বামীর আর এক পরিচয় তিনি জেসুইট পাদ্রী। এবং ওয়াকিবহাল সকলেই জানে, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের যেহেতু হিন্দুত্বের মধ্যে আনাটা মতাদর্শগতভাবেই আনা সম্ভব নয়, তাই এরা জন্মজাতভাবে রাষ্ট্রের শত্রু! স্ট্যান স্বামীর মানবাধিকার কেড়ে নিয়ে, তাঁকে কার্যত হত্যা করাটা তাই, একাধারে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তা ও অন্যপক্ষে পুঁজির উপাসক ভারত সরকারের কাছে একটি দ্বিমুখী “কর্তব্য” হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবাদী বুদ্ধিকে শায়েস্তা করার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের প্রতি ঘোর ভীতির ও খ্রিস্টান ও মুসলমানদের “চক্ষুশূল” মনে করা হিন্দুত্বের ধজাধারীদের কাছে উল্লাসের বার্তা পৌঁছে দেওয়া।
২০১৮র পয়লা জানুয়ারি মহারষ্ট্রের ভীমা কোরাগাঁওয়ে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে, তা ঘটানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার যে অভিযোগ ফাদার স্ট্যান ও তাঁর সহ-অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল, এতদিন পরেও তার পক্ষে সামান্যতম কোনও প্রমাণও এনআইএ হাজির করতে পারেনি। এনআইএ’র কাজ, দেখেশুনে যা মনে হয়, প্রমাণ পেশ করা নয়, তার কাজ গ্রেপ্তার করা। সরকারের কাজ এনআইএ-কে আরো শক্তিশালী করা। সংসদের কাজ ইউএপিএ-র মতো নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যা-খুশি-করার অধিকার আরো পাকাপোক্ত করা। আর গণতন্ত্রের তথাকথিত স্তম্ভ, বিরোধীপক্ষের কাজ যতক্ষণ সম্ভব চুপ করে থাকা, এবং শাসকপক্ষ একান্তই দৃষ্টিকটু ভাবে আইন বা এনআইএ’র মতো সংস্থাকে ব্যবহার করলে, তার সমালোচনা করে একটা বিবৃতি দিয়ে দেওয়া। এটা অকারণ নয়। আজ যারা বিরোধীপক্ষ, তারাই কাল শাসক ছিলেন, অথবা আগামীকাল শাসক হবার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে। এরাই বিভিন্ন সময়ে দেশবাসীর বিরুদ্ধে বীভৎসতম আক্রমণ নামানোর হাতিয়ারে ইউএপিএ-র মতো আইন ও এনআইএ-র মতো সংস্থাকে কাজে লাগিয়েছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে শাসনক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো ইউএপিএ বলবত করতে কুন্ঠিত হয়নি।
সারা পৃথিবী জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠছে, ভারত সরকারের তাতে কিছু যায় আসে না। ছলে বা বলে, ক্ষমতা বিনিয়োগ করে ক্ষমতা কব্জা করে রাখার যতরকম পদ্ধতি আছে তার প্রত্যেকটাই তার অধীত। বিরোধীদের বিবৃতি, আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ, দেশের ভিতরকার বুদ্ধি অনুশীলক সম্প্রদায়ের প্রশ্নকে তোয়াক্কা না করে কীভাবে শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়, তাও তার জানা। কিন্তু, যেটা জানা নেই, তা হল, কীভাবে দেশবাসীর সামূহিক ক্রোধের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ দেশবাসীর মন তার জানা নেই। যে দেশবাসীকে মনে হয় নিরীহ, নির্বিরোধ, অনুগত, সেই দেশবাসীর মনে ফাদার স্ট্যান স্বামীরা কীভাবে একটা বিপুল পরিসর গড়ে নেন, রাষ্ট্রের সেটা জানা নেই। ন্যায়ের চেতনায় উজ্জ্বল, প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে বিশিষ্ট, মানুষের মর্যাদার বোধে ক্ষমতার বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী ফাদার স্ট্যান স্বামীর মতো মানুষের তাই মৃত্যু নেই। তাঁরা মানব-সভ্যতার অভিজ্ঞান।