বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২১— রাষ্ট্রের হেফাজতে হত্যা করা হয়েছে ফাদার স্ট্যান স্বামীকে। আদালত কিছুতেই এই হত্যার দায় এড়াতে পারে না। তাদের বিবেকহীন, চূড়ান্ত অসংবেদনশীল আচরণ মনে করিয়ে দিচ্ছে নাৎসি জমানায় হিটলার পরিকল্পিত কুখ্যাত স্পেশাল কোর্ট (যন্দাগেরিস্তা) আর পিপলস কোর্ট (ভক্সগেরিস্থফ)-এর ভয়ঙ্কর স্মৃতি।
কুখ্যাত ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় ২০১৮-র ২৮ আগস্টে ভারত জুড়ে মহারাষ্ট্র পুলিশ ৫ অগ্রণী সমাজকর্মীর বাড়িতে তল্লাসি চালিয়ে গ্রেফতার করে। সেদিন রাঁচিতে স্ট্যানের বাড়িতেও তল্লাসি চালানো হয়েছিল। অভিযোগ করার মতো কিছুই খুঁজে পায় নি পুলিশ। ফের ১২ জুন, ২০১৯-এ তল্লাসি চালানো হয়। এবারেও মহারাষ্ট্র পুলিশ ব্যর্থ হয়। মহারাষ্ট্রে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কৌশলে মামলাটি তাদের নিয়ন্ত্রিত তদন্তকারী সংস্থা জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)-র অধীনে নিয়ে আসার পর ফের স্ট্যানের বাড়িতে তল্লাসি অভিযান শুরু হয়। গত বছর জুলাই-আগস্টে স্ট্যানকে ধারাবাহিক এবং দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সুবিধে করতে না পেরে এনআইএ-র মুম্বাই অফিসে ৫ আগস্ট প্রবল সংক্রমণ সময়ে ডেকে পাঠানো হয় ৮৩ বছরের এক বৃদ্ধকে। তিনি অপারগ হওয়ায়, ৮ আগস্ট এনআইএ রাঁচিতে বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করে তাঁকে মুম্বাই নিয়ে যায় এবং তালোজা জেলে ঠাই হয় তাঁর। আশ্চর্যজনক হলেও, জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে এনআইএ কিন্তু তাঁকে একদিনের জন্যেও হেফাজতে চায় নি। পারকিন্সনস সহ একাধিক বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত, দুর্বল, অশক্ত বৃদ্ধ রাষ্ট্রের পক্ষে এত ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক যে তাঁকে দ্রুততার সঙ্গে আটক করতে হয়েছিল রাষ্ট্রকে।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, তথ্যপ্রমাণ, বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই শুধুমাত্র নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অভিযুক্তকে তার বাড়ির অঞ্চল বা পরিবেশ বহির্ভূত দূরবর্তী স্থানের জেলে রাখা যাবে না। তার বাসস্থানের অঞ্চল থেকে দূরবর্তী স্থানে রাখলে তার স্বজন, বন্ধুরাও তার সঙ্গে দেখা করতে সমস্যায় পড়বে (এ. কে. রায় বনাম ভারত সরকার, ১৯৮১)। এ বছর মে মাসে, প্রবল সংক্রমণ এবং জেলে বন্দী আধিক্যের জন্য শীর্ষ আদালতের বিচারপতি উমেশ ললিত ও বিচারপতি কে. এম. জোসেফের বেঞ্চ গৃহবন্দীর পক্ষে নিদান দিয়ে তাঁদের পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিলেন, অভিযুক্তের বয়স, শারীরিক পরিস্থিতি এবং অভিযুক্তের অপরাধ সংক্রান্ত পূর্ব ইতিহাস বিচার করে তাকে তারই গৃহে বন্দী রাখা যাবে (গৌতম নওলাখা বনাম এনআইএ, ২০২১)। একজন অসুস্থ, অশক্ত অতিবৃদ্ধের প্রতি আদালত কোনও রকম সহৃদয়তা দেখায় নি, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে নি এনআইএ।
গ্রেফতারের সময় থেকেই স্ট্যানের উপর অমাবিক আচরণ শুরু করে এনআইএ। চশমা বিনা প্রায় অন্ধ যে মানুষটি, তাঁর চশমাটি কেড়ে নেওয়া হয়। চশমা যে কোন অস্ত্র বা বিস্ফোরক বস্তু হতে পারে এমন ধারণা কোনও মানসিক সুস্থ মানুষের আছে কিনা জানি না। জেরা নয়, এনআইএর উদ্দেশ্য ছিল এক অসুস্থ, অশক্ত বৃদ্ধকে তাঁর শহর থেকে বহুদূরে বান্ধবহীন অমানবিক পরিবেশে আটকে রেখে সুচিন্তিত উপায়ে অত্যাচার করা। ফলে তারা একদিনের জন্যেও তাদের হেফাজতে নেয় নি। তাঁর ঠাই জুটল তালোজা জেলে। এরপর শুরু হল ধারাবাহিক নিপীড়নের পর্ব। অত্যন্ত অসুস্থ, দুর্বল বৃদ্ধের তরল খাবার, তাও সিপার বা স্ট্র বিনা খাওয়া সম্ভব নয় জেনেও সেটি থেকে খুব পরিকল্পিতভাবে তাঁকে বঞ্চিত করল জেল কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে এনআইএ বিচারপতি স্বাস্থ্যের কারণে তাঁর জামিন প্রত্যখ্যান করেছে ২২ অক্টোবর। জামিন প্রত্যখ্যান করতে বিচারপতি তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি জেনেছিলেন কিনা বা হাসপাতালের চিকিৎসকের মেডিক্যাল রিপোর্ট যাচাই করেছিলেন কিনা এবং জামিন হলে তাঁর পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, পূর্ব অপরাধের গুরুতর ইতিহাস আছে কিনা ইত্যাদি কি কি কারণ ছিল তা আজ জনগণের জানা জরুরি। দিনের পর দিন খাদ্য, পানীয় না পেয়ে, শুধুমাত্র সিপার দেওয়ার আবেদন নিয়ে স্ট্যানকে বিচারালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। বিচারপতি এজন্য ২০ দিন সময় দিলেন এনআইএ’কে তাদের বক্তব্য জানাতে। বিচারপতি, জেল আধিকারিক, এনআইএ-র আইনজীবী কেউই তো অভুক্ত ছিলেন না একদিনও। শুধু সিপারের অনুমোদনটুকু দিতে প্রায় এক মাস সময় লাগল বিবেকহীন বিচারপতির। এরপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা অসুস্থতা এবং অতিমারি পীড়িত সংকটকালীন সময়ে বন্দী আধিক্যের জন্য এক অতিবৃদ্ধের সংক্রমণ সম্ভাবনা ইত্যাদি সঙ্গত কারণে ২৬ নভেম্বরে (২০২০) ফের জামিনের আবেদন জানালেন স্ট্যান। এনআইএর আইনজীবী অমানবিক প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিল, বন্দী নাকি অতিমারির সঙ্কটের সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে। এনআইএ বিচারপতি ডি. ই. কোথলিকর সেই বক্তব্যে আস্থা রেখে জামিন প্রত্যখ্যান করলেন। অসংবেদনশীল বিচারপতি ভুলে গেলেন সুপ্রিমকোর্টে বহু মামলায় বার বার উচ্চারিত বিচারপতির অ্যাপ্লিকেশন অফ জুডিশিয়াল মাইন্ডের নির্দেশিকা। এভাবে উপযুক্ত খাদ্য, পানীয়, ওষুধের অভাবে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে স্ট্যানের জীবনদীপ। নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন উঠবে, বিচারবিভাগীয় হেফাজতে থাকা একজন অতিবৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তির জামিন সিদ্ধান্ত নিতে ৪ মাস সময় লাগার কারণ কি। সংশ্লিষ্ট বিচারপতি এবং আদালত কি এই নারকীয় হত্যার দায় এড়াতে পারেন?
অবশেষে মুম্বাই হাইকোর্ট ৪ জুন শুনানি শুরু করে। মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখে বিচারপতিরা অভিযুক্তের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলে স্তম্ভিত হয়ে যান। মৃত্যু পথযাত্রী স্ট্যান তাঁদের করজোড়ে আবেদন জানিয়ে বলেন, তাঁর অন্তিম সময় হয়ে এসেছে, তাঁকে যেন রাঁচিতে তাঁর স্বজনদের মাঝে শেষ নিশ্বাসটুকু ফেলতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আরও জানান, যখন তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন, তখন নিজে খাওয়ার, স্নান করার ও অন্যান্য দৈনন্দিন কাজকর্ম করার ক্ষমতা ছিল, এই ক’মাসের মধ্যে তিনি তা হারিয়েছেন। এমন শেষ অবস্থায়ও জামিনের বদলে মুম্বাই হাইকোর্ট ২৮ মে তাঁকে হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করার আদেশ দেন। ৬ জুলাই তাঁর ফের জেলে প্রত্যাবর্তনের কথা ছিল, কিন্তু এবার আর হাইকোর্ট নয়, বিচার চলাকালীনই স্ট্যান তাঁর ঈশ্বরের আদালত থেকে জামিন পেয়ে গেলেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জে ২০১৫ সালে স্ট্যান্ডার্ড মিনিমাম রুলস ফর দ্য ট্রিটমেনট অফ প্রিজনারস (যা নেলসন ম্যানন্ডেলা রুলস বলে পরিচিত) সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। সেখানে বন্দীর স্বাস্থ্য, মর্যাদা, মানবিক সম্মান, উপযুক্ত চিকিৎসা এবং সর্বোপরি সঠিক ও প্রয়োজনীয় খাদ্যের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ভারতসহ সদস্য রাষ্ট্রগুলো অঙ্গীকার করেছিল তারা বন্দীদের প্রতি আচরণে দেশের কারা-ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে নিয়ম-কানুনগুলো লাগু করবে। কিন্তু, ছয় বছর কেটে গেলেও ভারতের বর্বর সরকার সেসব কাজের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি। সভ্য সমাজে, গণতান্ত্রিক দেশে মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়ে এসব নীতিনৈতিকতা নিয়ে আলোচনা চলতে পারে কিন্তু ফ্যাসিস্ত শক্তি শাসিত কোনও দেশে এসবের কিই বা দাম থাকতে পারে। নাৎসি জমানায় যেসব আইনে দেশের ঘোষিত শত্রু ইহুদি, কম্যুনিস্ট এবং বিরোধীদের আটক, নির্যাতন, হত্যা বৈধ ছিল, সেই আইনেই নাৎসি কর্মী-সমর্থকদের রেহাই মিলতো। সিক্রেট সার্ভিস, গেস্টাপো অফিসাররা বৈধ কানুনেই ইহুদিদের উপর নারকীয় নির্যাতন চালাতো। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে নির্দ্বিধায় একথা জানিয়েছিলেন কুখ্যাত গেস্টাপো কমান্ডান্ট রুডলফ হোসে, অ্যাডলফ আইখম্যান। এদেশে তাই, শারীরিক অজুহাতে অনায়াসে জামিন পায় গুজরাতে কয়েক ঘণ্টায় অন্তত দুই শতাধিক মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে নারকীয় হত্যার নায়ক বাবু বজরঙ্গি, মায়া কোডনানি, মালেগাঁও, সমঝোতা এক্সপ্রেস, আজমের শরীফ বিস্ফোরণে চার্জশিট প্রাপ্ত সাধ্বী প্রজ্ঞা, স্বামী অসীমানন্দরা। কিন্তু জামিন পান না স্ট্যান স্বামী, ভারভারা রাও ( তিন বছর কারাবাসের পর গত মার্চ মাসে জামিন পেয়েছেন), প্রতিবন্ধী জি. এন. সাঁইবাবা, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, অরুণ ফেরেইরা, ভারনন গনজালভেস, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, হানী বাবু, সুরেন্দ্র গ্যাডলিঙ, সুধীর ধাওয়ালে, রোনা উইলসনরা।
আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে।
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা।
(সবিনয় নিবেদন, শঙ্খ ঘোষ)