বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

শ্রমকোড এবং শ্রেণী সংলাপের নতুন ব্যাকরণ

শ্রমকোড এবং শ্রেণী সংলাপের নতুন ব্যাকরণ

উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়

photo

আমি, মিঠু বোস আর শম্ভু ঘোষ। গড়িয়া মোড় থেকে একবার শীতলা মন্দির মোড়, আবার ওখান থেকে বাঘাযতীন মোড় ... বেলা গড়িয়ে চলে ... দুপুর বারোটা।
এক বই দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম ... ক্রেতা কোথায়?
বললেন, নেই। কিন্তু দোকান না খুললে দাদারা টিকতে দেবে?
শীতলা মন্দিরের কাছে ব্যাঙ্কের গেটে লাল ঝান্ডা নিয়ে কিছু কমরেড। কর্মচারীররা বিক্ষোভ করছেন ... রাস্তায় অবরোধ, টায়ার পোড়ানো হল। ...
এখন প্রশ্ন, যাঁরা পথে আজ নেই, তাঁরা কি বন্ধের সমর্থক?
অথবা, যাঁরা পথে বেরিয়েছেন, তাঁরা কি বন্ধের সমর্থক নন?
প্রশ্নটা ভীষণ জটিল। সাধারণ মানুষ ভীষণ নীরব। পেটের দায়, মার খাবার ভয়, লাঞ্ছিত হবার ভয়। ফালতু প্রশাসনিক ঝামেলা এড়াতে, কিংবা খুব জরুরি কিছু কাজে মানুষ আজকের দিনেও পথে। তবে সংখ্যায় ভীষণ কম।
এদের সকলেই কিন্তু এই দেশের আর্থিক অব্যবস্থায় জর্জরিত।
কে চায় বলুন, ১২ ঘন্টা কাজ করতে?
কে চায় বলুন, ৩৬৫ দিন কাজ না পেতে?
কে চায় বলুন, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মাসে হাজার দশ বা তার থেকেও কম টাকা ঘরে নিয়ে যেতে?
কোন শ্রমিক চায় বলুন ‘লেবার’শব্দটি তুলে দিয়ে লেবারের নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হতে?
কে চায় এই উচ্চগতির দ্রব্যমূল্য?
কে চান না, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শেষে চাকরি পাক?
সেকারণে বনধের ইস্যু জ্বলন্ত। সাধারণ মানুষ নীরবে প্রতিটি ইস্যুর সমর্থক।
বনধ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে।
অথচ, এই রাজ্যের প্রশাসন, তৃণমূল সরকার পুরো দমে নেমেছে বনধ ভাঙতে। ফ্যাসিবাদী কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগী রাজ্য সরকার! গাঙ্গুলিবাগান থেকে ধর্মঘটী ১৯ জনকে গ্রেফতার করল।
ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, ডান্ডা মেরে হেনস্থা করছে ...।
মানুষের অধিকারকে নস্যাৎ করতে চায় এই তৃণমূল সরকার।
আমরা যে স্বাধীন দেশের নাগরিক, এটা ভুলে যেতে হয় আজকাল ... ।
****
ভারতের সর্বত্র শ্রম কোড চালু করা হয়েছে ১ এপ্রিল, ২০২৫। নাগরিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, এ সবের খোলনলচে বদলে দেওয়ার জন্য যে পরিবর্তনগুলি আনছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার, শ্রম কোড তার অন্যতম। ভারতে রাজ্যের এবং কেন্দ্রের শ্রম-সংক্রান্ত আইন রয়েছে দেড়শোরও বেশি। এগুলির মধ্যে ঊনত্রিশটি শ্রম আইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চারটি শ্রমিক কোড তৈরি করেছে। সেগুলির বিষয়: মজুরি, শিল্পে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, শ্রমিকের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশ এবং শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা। ২০১৯ সালে করোনা অতিমারির সময় কোনও আলোচনা ছাড়াই সংসদে এই কোডগুলি পেশ করা হয় এবং মজুরি সংক্রান্ত কোডটি কার্যত চালু হয়ে যায়। বাকি তিনটি শ্রমিক কোড সংসদের স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ২০২০ সালে সেগুলিকে পাশ করিয়ে নেয় কেন্দ্র। অথচ, এই আইনগুলির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেমন, মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে চালু রয়েছে ‘টাইম রেট’ ও ‘পিস রেট’ — যা শ্রমিকের দক্ষতার মাপকাঠিকে গণ্য করে না। বিভিন্ন পেশায় এত দিন মজুরি নির্ধারণ হতো কয়েকটি শর্ত মেনে, যার মধ্যে ধরা থাকত খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, সন্তান পালন, পেনশন, সঞ্চয় ইত্যাদি। এগুলো শ্রম কোডে বাদ পড়ে গেল। নির্দিষ্ট সময় পর পর মজুরি সংশোধনের দায় রইল না নিয়োগকারীর। কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা আট ঘণ্টা তুলে দেওয়া হল। এমন আইন কি সংবিধানের ধারাকে লঙ্ঘন করে না? মজুরি নির্ধারণ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন নির্দেশকে অমান্য করে না?
কেন্দ্র সর্বনিম্ন (ফ্লোর লেভেল) মজুরি নির্ধারণ করেছে দৈনিক ১৭৮ টাকা বা মাসে ৪৬২৮ টাকা। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত কমিটিই সুপারিশ করেছিল যে মজুরি হোক দৈনিক ৩৭৫-৪৪৭ টাকা। তা গ্রহণ করা হয়নি। কাজের জায়গায় স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পানীয় জল, শৌচাগার, ক্রেশ, ক্যান্টিন ইত্যাদির ব্যবস্থা করার আইনি দায় থেকেও কার্যত মুক্তি দেওয়া হয়েছে নিয়োগকারীকে। এগুলি তাঁর সদিচ্ছার উপর ছাড়া হয়েছে। সর্বোপরি, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিক, যাঁরা শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ, তাঁদের অধিকার শ্রম কোডে সুরক্ষিত হয়নি।
৯ জুলাই ছিল শ্রমকোড আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ধর্মঘট।
এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুগতদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য এই বাংলায় তাঁর প্রধান পূজারি ও মুখ্য স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কথা হয়েছিল শ্রীমান অধিকারীবাবুর সঙ্গে। যথারীতি শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে ‘তৈলমর্দন’ করেই শুরু করেছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, শ্রমকোড চালু হলে সর্বত্রই ডবল ইঞ্জিন সরকারের সার্থক রূপায়ণ হবে। তাঁর আশা, এই রাজ্যেও বিজেপির সরকার হবে, আর তাঁরা সর্বপ্রকারে শ্রমজীবীদের ওই আইনে ‘সহায়তা’ দিতে প্রস্তুত।
প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই শ্রমকোডের বার্তা কী? শ্রমজীবীদের নির্ধারিত মজুরি পাওয়ার নিশ্চয়তা, সর্বত্র আট ঘণ্টার অতিরিক্ত শ্রম দেওয়ার থেকে রেহাই, জীবিকা ক্ষেত্রে প্রাণরক্ষার একশো শতাংশ নিশ্চয়তা অথবা যদি কোনও দুর্ঘটনা হয়ও তাহলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চয়তা?
শ্রীমান অধিকারীর জবাব, শ্রমকোডের অন্তস্থলে যা আছে, তার ফলে ওই আইন চালুর পর আর শ্রম বিরোধ দৃশ্যমান হবে না। ফলে ট্রেড ইউনিয়নগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তার আর কোনও প্রাসঙ্গিকতাই থাকবে না।
বললাম, আচ্ছা শ্রীমান অধিকারীবাবু, আপনারা ওই শ্রমকোড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ থেকে এমন কী কী বার্তা পেয়েছেন যে, যার জন্য আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে এতটা কনসেশন দিতে রাজি হচ্ছেন?
শ্রীমান অধিকারীর উত্তর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ‘মন কি বাত’-এর বিবৃতি জাতীয় স্তরে শ্রমজীবীদের চেতনায় সরকারের উপর ভরসা বাড়িয়ে তুলেছে। ভারতীয় শ্রমজীবীদের মনোভাব বিজেপির প্রতি অনুকুল হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে সনাতনী হিন্দু শ্রমজীবীদের। আমাদের সুচিন্তিত মত, মোদিজি শ্রমজীবী হিন্দুদের তাঁর রাইট সাইডে আনার চেষ্টা করছেন।’
শ্রীমান অধিকারীবাবু আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেছেন, প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয় গণতন্ত্রে নির্বাচিতদেরই থাকবে সবচেয়ে বেশি অধিকার ও সুযোগ। গত ১৫০ বছর ধরে শ্রমজীবীরা আন্দোলন, ধর্মঘট করে শ্রমের বিনিময়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বা অধিকার অর্জন করেছিলেন — তার আইনি সংস্থানও করা হয়েছিল। সময় সুযোগে মালিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেই অধিকার শুধু তারাই নয়, ব্যবহার করতে পারবে তাদের উত্তরসূরিরাও। এই নতুন ৪টি শ্রমবিধিতে তা আর চলবে না।
শ্রীমান অধিকারীর কথায়, মাননীয় মোদিজি ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে তৈরি করেছেন ৪টি শ্রমকোড। আইনের আপডেট আর কী! যেখানে আগের আইনের পঁচাত্তর শতাংশ অংশই ছিল অপ্রাসঙ্গিক, ওইসব ঝাড়াই-বাঝাই করে বাতিল করা হয়েছে। এই মুহূর্তে খারাপ মনে হলেও আখেরে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর মন্ত্র হয়ে এটাই সার্থক হয়ে উঠবে সংগঠিত ও অসংগঠিত সমগ্র শ্রমজীবীদের কাছে।
শ্রীমান অধিকারীর জবাব, এত অসহিষ্ণু হওয়ার কিছু নেই। মনে রাখবেন শ্রমিক কাজের জন্য মজুরি পায়। মালিক পুঁজি বিনিয়োগ করে মুনাফা পায়। কিন্ত গত কয়েক দশক ধরে কেন্দ্রীয় সরকারগুলির সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার ফলে এবং দেশব্যাপী শ্রমিকশ্রেণীর এই শ্রম আইন সংস্কারে বা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ১৯৯১ সাল থেকে ধারাবাহিক সংগ্রাম ও ১৯টি সাধারণ ধর্মঘট করে বাধা দিয়েছিল।
তার মানে! কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করা, নতুন ইউনিয়ন গঠন করা, রেজিস্ট্রেশন করা, মিছিল মিটিং থেকে ধর্মঘট করার অধিকার হরণ করা এসবই শ্রমজীবীদের স্বার্থে! এই শ্রমকোডের শক্তিতেই তো আগামীদিনে মালিক, শ্রম বিভাগ ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব ও কর্মীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১১১ ধারায় কেস করলে জেল জরিমানা করার স্বেচ্ছাচারী অধিকার অর্জন করবে? এইসবে লাভ হবে শ্রমিকশ্রেণীর?
****
আমি, সৌগত, প্রদীপ, গৌতম— আমরা ধর্মঘটীরা হাঁটছি। সেদিন মোদিজির ‘অচ্ছে দিন’এর বিরোধিতায় রাস্তার দখল নিয়েছিলেন শ্রমজীবীরা। দিনভর টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে ... রাস্তা কেউ ছাড়েননি ...
মনে পড়ছিল, রাশিয়ার এক কঠিন সময়ে উচ্চারিত লেনিনের সেই কথাটি: ‘লোক নেই, তবু অসংখ্য লোক আছে’। লোক নেই মানে, আমাদের রাজনৈতিক নেতা নেই, কাজ করার কর্মী নেই, জনগণের প্রভাবশালী সংগঠন নেই। আর লোক আছে মানে, প্রতিবাদী মানুষ আছেন, তারা যন্ত্রণাক্লিষ্ট, অত্যাচারিত, নিপীড়িত। তারা লড়াই করতে চান। স্বৈরশাসনের অবসান চান।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.