বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
নরেন্দ্র মোদির গর্ব তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বে ভারত এখন বিশ্বের চতুর্থ অর্থনীতি। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের প্রশ্ন তাতে দেশবাসীর কি উপকার হল। তাঁর শাসনের ১১ বছরে শ্রমজীবী মানুষের জীবন যন্ত্রণা কমেনি বরং বেড়েছে। শ্রমজীবী মানুষের অবস্থার অবনতি হয়ে চলেছে। দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়ে চলেছে। অথচ দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের সম্পদের অংশ মাত্র ৩ শতাংশ। দেশের প্রধানমন্ত্রীর গর্ব নিতান্তই হাস্যকর।
দেশের শাসক ও মালিক শ্রেণীর কর্ণকুহরে মানুষের জীবন যন্ত্রণা প্রবেশ করাতে আপাতত ধর্মঘটের আঘাত হানা হল। সমস্ত মৌলিক ক্ষেত্রগুলি ধর্মঘটে স্তব্ধ ছিল। বিহারের মতো রাজ্যে আরও প্রসারিত ক্ষেত্র ধর্মঘটে অচল হয়েছে। দেশের খনি, উৎপাদন শিল্প, ব্যাঙ্ক-বীমা, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি দপ্তর অচল হয়ে পড়েছিল। গুজরাট, মেঘালয়ের মতো গণ সংগ্রামে পশ্চাদপদ রাজ্য ও ধর্মঘট উপলক্ষ্যে বিপুল সমাবেশ ঘটেছে। শ্রমিক কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংযুক্ত কিসান মোর্চা। তারাও ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ধর্মঘটে মিলেছে বিপুল সারা।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমগুলি বনধের সংবাদ এড়িয়ে গেলেও এত বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের ধর্মঘটে অংশগ্রহণ চেপে রাখা যায়নি। ধর্মঘটের দেশব্যাপী সাফল্য প্রমাণ করে শ্রমজীবী মানুষের তীব্র ক্ষোভ।
একদিকে, বৃহৎ পুঁজির সীমাহীন লুঠে তাদের সম্পদের স্ফীতি। বিপরীতে, শ্রমজীবী মানুষের জন্য মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি সহায়তায় প্রবল অবহেলা অসহনীয় অবস্থা তৈরি করেছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা প্রত্যাহার করে মানুষের উপর আঘাত হানা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে বিভক্ত করে বিভিন্ন রাজ্যে বেসরকারিকরণের ফলে সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের ব্যয় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি অর্থ ব্যয়ে তৈরি পরিকাঠামো ব্যবহার করেই বৃহৎ মালিকেরা বিপুল মুনাফা করে নিচ্ছে। ব্যাঙ্ক, বীমা খনি সর্বত্র মানুষের সর্বনাশ করা হচ্ছে।
শাসকের নীতির ফলে মানুষ যতই যন্ত্রণাকাতর হোন, ক্ষোভ প্রকাশ করা চলবে না। মানুষ যেন রাষ্ট্র ও মালিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে না দেয়। কষ্ট, যন্ত্রণার অসহনীয়তা যেন প্রকাশ পায় অপর মানুষের বিরুদ্ধে। তার জন্য সাম্প্রদায়িক বিরোধ বাধানোর পরিকল্পিত উদ্যোগ চলছে। ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করা হচ্ছে। বিজেপি চালিত বিভিন্ন রাজ্যে বাংলা ভাষা বলার জন্য বাংলাদেশী বলে নির্যাতন শুরু হয়েছে। আটক করা হচ্ছে। এতেও না হলে প্রয়োজনে যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি করার রাস্তাও খোলা আছে। মানুষের বিক্ষোভ বিপথে চালানোর জন্য নানা পন্থা আছে। শাসকরা এসব ব্যবস্থার উপর সম্পূর্ণ ভরসা না করে দমনের আইনগুলিকে আরো কঠোর করে তুলেছে। রাজ্যে রাজ্যে পীড়নের জন্য তৈরি হচ্ছে কঠোর আইন। আইনকে অপব্যবহার করেও দমন করা হচ্ছে। পশ্চিমবাংলার শাসকরা এবিষয়ে অগ্রণী। শাসকরা অভিযোগকারীকে শাস্তি দিয়ে অপরাধীদের আড়াল করার কাজে ব্যস্ত।
বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলি ধর্মঘটের বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যখন ধর্মঘটের বিরুদ্ধে দাঁড়ান তখন বিস্মিত হতে হয়। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, ধর্মঘট করে কি হবে? এরপরে কি? বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে কতজন ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করবেন। ধর্মঘটে শ্রমজীবী মানুষের যদি কোনও লাভ না হয় তাহলে রাষ্ট্র চালকরা কেন ধর্মঘটকে বানচাল করতে এত তৎপরতা দেখায়।
ধর্মঘটের দিনে কলকাতার জনজীবন অনেকটা স্বাভাবিক বলে মনে হলেও পশ্চিমবাংলার বাস্তবতা ঠিক তেমনটা ছিল না। এ রাজ্যের পুলিশ ধর্মঘট ভাঙ্গার জন্য রাস্তায় নামে। ধর্মঘট কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে হলেও এ রাজ্যের সরকার ধর্মঘট ব্যর্থ করতে বিশ্বস্ত ভূমিকা পালন করেছে।
দমননীতি সত্ত্বেও এই রাজ্যে শ্রমজীবী কৃষিজীবীদের ব্যাপক অংশ এই ধর্মঘটের সমর্থনে রাস্তায় নামেন। ধর্মঘটের দিনে ও তার প্রস্তুতিতে শ্রমিক কৃষক ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত উদ্যোগ চোখে পড়ার মতন ছিল। ব্যাঙ্ক-বীমা থেকে আরম্ভ করে চা বাগান, জুটমিলে ধর্মঘট হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। গ্রামাঞ্চলে বনধের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। অসংখ্য জায়গায় রাস্তা অবরোধ, রেল অবরোধ, পিকেটিং হয়েছে। ধর্মঘট ভাঙতে পুলিশ তত্পর থাকলেও, সাম্প্রতিক অতীতের মতো শাসকের ধর্মঘট ভাঙ্গার দলের তত্পরতা দেখা যায়নি।
নানা মত-পথের শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘট বৃহত্তর অংশের শ্রমজীবী, অসংগঠিত শ্রমিক, আশা, অঙ্গনওয়ারি কর্মী, কৃষিজীবী, ক্ষেতমজুর, কৃষি শ্রমিককে আশার আলো দেখিয়েছে।