বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

সংবিধান রক্ষার লড়াই

সংবিধান রক্ষার লড়াই

রতন গায়েন

photo

তীব্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার শহিদের রক্তের বিনিময়ে বৃটিশ শাসনের জোয়াল থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। শত চেষ্টা সত্বেও স্বাধীনতা প্রাপ্তির শেষ লগ্নে নিদারুণ ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি, অকারণ রক্তপাত, দেশবিভাগজনিত বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও অসীম দুর্দশা এড়ানো যায়নি। তাহলেও ‘নিয়তির সঙ্গে ভারতের অভিসার’বিষয়ে পণ্ডিত নেহেরুর মধ্যরাতের ভাষণ শুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ পুলকিত হয়েছিলেন। বৃটিশ শাসনের সূর্য কখনও অস্তমিত না হওয়ার মিথ ভেঙে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। দেশ কোনও বৃহৎ শক্তির পুতুল তো হলই না, বরং জোটনিরপেক্ষ, সমাজবাদী দেশ ও উদীয়মান তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে পণ্ডিত নেহেরুর নেতৃত্বে ধীরে ধীরে স্বাধীন ভারত গড়ে তুলল এক মিশ্র অর্থনীতি ও স্বাধীন বিদেশনীতি। সংবিধান সভা দীর্ঘ আলোচনা করে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর প্রণয়ণ করলেন ভারতের সংবিধান যা ২৬শে জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশিকা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের যে চারিত্রিক কাঠামো ঘোষিত হল তাতে শুধু মানুষের জয়গান ছিল না, ছিল এক সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বার্তা। ছিল ১৯৩১ সালের করাচি কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সকলের জন্য সমান সুবিধা ও মর্যাদা এবং দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সংবিধানে তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটল। ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এবিষয়ে ফিরে দেখা একারণে জরুরি যে স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারায় গড়ে ওঠা সংবিধানের নির্দেশিকা, যা জরুরি অবস্থার সময়কাল ছাড়া বড়সড় বিচ্যুতির মুখে পড়েনি, ২০১৪ সালের বর্তমান সরকারের সময়কাল থেকে সংবিধানের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ শুরু হয়েছে।
সংবিধানের ‘সেকুলার’ও ‘সোসালিস্ট’শব্দ দুটি বর্তমানের শাসক ও আরএসএস এর কাছে একেবারেই অচ্ছুৎ। অথচ ভারতের মতো বহু ভাষা বহুধর্মের বৈচিত্র্যময় দেশের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যতীত ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসাবে অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ভাবনার দ্যোতনা প্রস্তাবনা ছাড়াও সংবিধানের ছত্রে ছত্রে প্রতিফলিত। সংবিধানের সব মানুষের বিশ্বাস মতো ধর্মাচরণ, ধর্ম প্রচার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত (২২, ২৫, ২৬, ২৯ ধারা)। সর্বোপরি এইসব অধিকার হরণ হলে আদালতের সুরক্ষার বিধান আছে (ধারা ৩০)। এইসব মৌলিক অধিকার দেশের বহুত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার চাবিকাঠি। রাষ্ট্রের প্রতি নির্দেশাত্মক নীতি সমূহে রাষ্ট্রেকে যে জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া আছে তা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বার্তাবাহী (৩৬-৫১ ধারা)। ভারত যে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র সেই সত্য কি বর্তমান শাসক বা আরএসএস অস্বীকার করেন? দুর্ভ্যাগ্যজনক হল, সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত থেকে দেশের পদত্যাগীউপ-রাষ্ট্রপতি ইতিপূর্বে কোনও উচ্যবাচ্য না করে যখন শব্দ দুটিকে ‘দুর্গন্ধময় বা গভীর ক্ষত’বলে চিহ্নিত করেন এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও অন্যান্য দলীয় পদাধিকারীদের সঙ্গে আরএসএস এর সাধারণ সম্পাদক গলা মেলান, তখন তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত হয় না। উল্লেখ্য যে, ২০২৪ সালের ২৪শে নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ সেকুলার শব্দের সংযোজনে হস্তক্ষেপ করাকে অপ্রয়োজনীয় বলে মামলা খারিজ করে দেন। আরও উল্লেখ করা জরুরি যে ৪২তম সংশোধনীতে শব্দ দুটি সংযোজনের আগে ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় ১৩ জন বিচারপতির বেঞ্চ সেকুলারিজমকে সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করে রায়ে উল্লেখ করেন যে ‘রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্রের মূল কথা হল রাষ্ট্র কোনও নাগরিককের ওপর কেবল ধর্মীয় কারণে বৈষম্য করতে পারে না।’সংবিধান সভায় ড. আম্বেদকার শব্দ দুটিকে পৃথকভাবে অন্তর্ভুক্তিকে নিরর্থক বলে অভিহিত করে বলেন যে ‘শব্দ দুটি সংবিধানের আত্মা’। আজ যাঁরা একে ‘সনাতন আত্মার বিরোধী’ বলে অভিহিত করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এর বিলোপ চান, তাঁরা যে আসলে সংবিধানেরই বিনাশ চান সে বিষয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রসঙ্গত শাসক দলের বা হিন্দু মহাসভার সংবিধানে কিন্তু শব্দ দুটির বিলোপ করা হয়নি।
সংবিধান ধ্বংসের অপচেষ্টার অন্যতম প্রকল্প হল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির ধ্বংসসাধন। ২০১৪ সালে বর্তমান শাসকেরা ক্ষমতা দখলের পর শাসক দল ও আরএসএস উদ্দাম গতিতে প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের অপচেষ্টা শুরু করেছে।
প্রথম লক্ষ্য হল, সংসদীয় ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বিপর্যস্ত করে তোলা। লোকসভায় সংবিধান প্রণয়নের ৭৫ বছর পূর্তির উদযাপনের বিতর্কের সময়ে এক সঙ্গে লোকসভা, বিধানসভা ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ভোট গ্রহণের জন্য দুটি বিল — দি কনস্টিটিউসন (১২৯ তম সংশোধনী) বিল এবং দি ইউনিয়ন টেরিটোরিরজ লজ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল পেশ করা হয়েছে। এই সংশোধনীগুলি আইন হয়ে যাওয়ার পর লোকসভার মেয়াদ শেষ হলে একসঙ্গে নির্বাচনের জন্য কিছু রাজ্য বিধানসভার মেয়াদ সংবিধান নির্দিষ্ট পাঁচ বছরের আগেই শেষ হবে। এটি সংবিধান বিরুদ্ধ। আবার লোকসভা বা বিধানসভা যদি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ভেঙে যায় তবে মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে অবশিষ্ট সময়ের জন্য। অর্থাৎ তিন বছরের পর ভেঙে গেলে ভোট হবে বাকি দুবছরে জন্য। কাজেই একজন সাংসদ বা বিধায়ক মধ্যবর্তী নির্বাচনে জয়ী হলে সংবিধান নির্দিষ্ট পাঁচ বছরের আগেই তাঁদের কার্যকালের সমাপ্তি ঘটবে যা সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌল নীতি বিরুদ্ধ। এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপরেও আঘাত। লোকসভার সঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে করার অর্থ রাজ্যগুলিকে সমসত্ত্বভাবে এক কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আনা যা বৈচিত্র্যময় ভাষা ও সামাজিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। ‘এক দেশ এক নির্বাচন’এর সপক্ষে ব্যয় সংকোচের যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক। পাঁচ বছরের মেয়াদে বহু মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রয়োজন হবে।
দ্বিতীয়ত, তামিলনাড়ু রাজ্যপালের বিধানসভার অনুমোদিত বিলগুলিকে অসাংবিধানিকভাবে সম্মতি না দিয়ে আটক রাখা ও ওয়াকফ সংশোধনী আইনে অন্তর্বতী আদেশে ভয়ানক ক্ষিপ্ত পদত্যাগী উপরাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টকে দায়বদ্ধতাহীন ‘সুপার পার্লামেন্ট’আখ্যা দিয়েছেন। কারণ দেশের আইন তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আরও একধাপ এগিয়ে পূর্ণাঙ্গ ন্যায়ের স্বার্থে সংবিধানের ১৪২ ধারায় সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ ক্ষমতাকে ‘গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র’বলে চিহ্নিত করেছেন। আরও এক বিজেপি সাংসদ সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকে দেশের সব গৃহযুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন। পদত্যাগী উপরাষ্ট্রপতি ও তাঁর অনুগামীরা বিচার ব্যবস্থাকে পার্লামেন্টের অধীনস্থ হিসাবে দেখতে চান যা সাংবিধানিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আইনসভায় অনুমোদিত যে কোনও আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের আছে।
আসলে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক নির্দেশ পালন করতে শাসকের ঘোর অনীহা। সেকারণেই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কমিটিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ আটকাতে সরকার কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী, একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতাকে নিয়ে কমিটি গঠন করেছেন। সরকারি এই কমিটি যে অনুগত আমলাদের নিয়ে কমিশনারদের নিয়োগ করবেন তা বলাই বাহুল্য। যে নির্বাচন কমিশন দেশের আপামর প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটার তালিকাভুক্ত করে সুচারুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেই সাংবিধানিক সংস্থার প্রশ্নাতীত নিরপেক্ষতা ও সততা আবশ্যিক। সেই শর্ত ইচ্ছাকৃত লঙ্ঘনের ফলশ্রুতিতেই বিহারের আসন্ন বিধানসভার নির্বাচনে নির্বাচক তালিকার স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিসন নিয়ে কমিশনের অভূতপূর্ব নির্দেশনামা। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সংশোধনে যেসব নথির আবশ্যিকতা ছিল না সেইসব নথি, বিশেষ করে জন্ম তারিখ ও জন্মস্থানের নথি না থাকলে নতুন অন্তর্ভুক্তি না করা নিয়ে কমিশনের নির্দেশ, কার্যত বিতর্কিত নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুতির নির্দেশনা। এই নির্দশনা ক্রমে সারা দেশে কার্যকর হবে। সুপ্রিম কোর্ট গত ১০ জুলাই যেসব নথিকে মান্যতা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তা গৃহীত হলে সমস্যা অনেকাংশে দূর হবে বলে আশা করা যায়। ২৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে যে শুনানি আছে তার উপর নির্ভর করবে বিহারে কয় কোটি নাগরিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন এবং সারা দেশে কত কোটি নাগরিককে সাংবিধানিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনূকূল হলেও নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগের ধরন ভবিষ্যতে নাগরিকদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয় হল ইডি, সিবিআই এর মতো শীর্ষ তদন্তকারী এবং নজরদারি সংস্থা ভিজিলান্স কমিশনের শাসকের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হওয়ার রেওয়াজ। অপরাধ, দুর্নীতি দূরীকরণ ও অন্যায়ের প্রতিবিধানকারী ‘নিরপেক্ষ’এই প্রতিষ্ঠানগুলি নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে তদন্ত শুরু করে, নির্বাচনের শেষে তার আর কোনও তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। এই সংস্থাগুলি শাসকের আজ্ঞাবাহী হিসেবে কাজ করে। সেই কারণে মানুষের অধিকার রক্ষিত না হওয়ায় নাগরিকেরা সাংবিধানিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন।
সংবিধানের এই বিপন্নতা প্রতিহত হওয়া জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন বাম শক্তির সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন। সর্বভারতীয় স্তরে ইন্ডিয়া জোট এই আন্দোলনে সামিল হলে প্রতিরোধ জোরদার হবে। কিন্তু এই আন্দোলনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক শক্তি যুক্ত না হলে গণতন্ত্র ও সংবিধান ধ্বংসকারী দৈত্যেদের বিনাশ সম্ভব হবে না। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংবিধান রক্ষার আন্দোলনে সামিল হওয়া তাই ভীষণ জরুরি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.