বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
লড়াইটা ছিল দুটো ফ্রন্টে। একদিকে পরিবেশবাদীরা তুলে ধরেছিলেন বাঁধ নির্মাণের অসারতা এবং একই সঙ্গে বিপদের দিক। আশির দশকে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো হয়েছিল যে বাঁধের অর্থনৈতিক জীবৎকাল হবে ৬১.৪ বছর কিন্তু পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে বাঁধ থেকে কোনও সুফল আসবেনা। আবার, এই সময়ের মধ্যে বাঁধ সংলগ্ন জলাশয়ে পলি জমে সেটার সঞ্চয় ক্ষমতা কমবে অনেকটাই। বাঁধের নকশাও বিপজ্জনক বলে জানানো হয়। গাড়োয়ালের স্থানীয় অধিবাসীদের আশঙ্কা ছিল যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভেঙে পড়ে বড় মাপের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে ওই বাঁধ। বিদেশি আক্রমণে বাঁধের ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনাও তুলে ধরেন অনেকে। জন জাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক রাজেন্দ্র সিং ধোতিয়াল বলেন যে দেশের নিরাপত্তার দিক থেকে বিপজ্জনক এই বাঁধ। বায়ু পথে চীন থেকে এর দূরত্ব মাত্র একশো কিলোমিটার। ইন্দো-চীন যুদ্ধ বাধলে চীনা ক্ষেপণাস্ত্র সহজেই ভেঙে দিতে পারবে এই নির্মাণ!
আবেগের কাছে আবেদন
এইভাবে তথ্য দিয়ে যখন শিক্ষিত মনে তেহরি বাঁধের বিরুদ্ধে চেতনা জাগানোর চেষ্টা চলছে তখন মানুষের চিরাচরিত আবেগের কাছে আবেদন রাখছেন সুন্দরলাল বহুগুণা ও তাঁর সহযোগীরা। হিমালয় অঞ্চল এবং সেখান থেকে নেমে আসা গঙ্গা নদী দৈবশক্তির প্রকাশ বলে মানে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা। বহুগুণা নিজে তাঁর বহু রচনায় এই ভাবনার উল্লেখকরেছেন। ‘তেহরিড্যাম: আ ব্লুপ্রিন্ট ফর ডিজাস্টার’ রচনায় তিনি লেখেন, ‘একটা উপকথা আছে যে ভাগীরথীর প্রবাহকে ধারণ করতে পারে একমাত্র ভগবান শিবের মাথার জটা। হিমালয়ের প্রাকৃতিক অরণ্য হল এই জটা। সেটা মাটিতে জল ধরে রাখে এবং ভূমিকে রক্ষা করে বন্যা থেকে। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করে যে এই পুণ্যপ্রবাহে যদি বাধা দেওয়ার কোনওরকম চেষ্টা হয় তবে মারাত্মক প্রতিশোধ নেবে ভাগীরথী। যে পিপোলা গ্রাম জলাধারের কারণে অর্ধেক জমিহারা তার একজন বাসিন্দা গুণানন্দ দেখিয়েছেন যে সেই জটা অর্থাৎ অরণ্যের নির্বিচার লুট কীভাবে পাহাড়কে ন্যাড়া করে দিয়েছে। গ্রামসংলগ্ন অরণ্যের কিছু অংশ সংরক্ষণ করেছে গ্রামবাসীরা কিন্তু বাকি অংশে মাটির উপরে কেবল একটা ঘাসের আস্তরণ আছে।’ উন্নয়নের কুঠারকে ঠেকাতে প্রচারের এই অভিমুখ গ্রহণ নিঃসন্দেহে কার্যকরী কিন্তু এর ফলে অন্য একটা মাত্রা পেল বাঁধ বিরোধী আন্দোলন। ধীরে ধীরে ধর্মীয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে থাকল এই লড়াই। দক্ষিণপন্থী, ধর্মভিত্তিক সংগঠনের হাতে চলে গেল তেহরি বাঁধ বিরোধিতার রাশ। পরবর্তীকালে তাদের উদ্যোগে যেমন তেহরি গাড়োয়ালে তেমনি দিল্লীতেও অনুষ্ঠিত হল গঙ্গাকে বাঁচানোর, বাঁধ আটকানোর জন্য অবস্থান। বাঁধকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কারও উঠল সেইসব সভা থেকে। সুন্দরলাল বহগুণা কি সচেতনভাবে আন্দোলনের এই রূপান্তরে সায় দিয়েছিলেন? বিশেষজ্ঞরা হয়ত দিতে পারবেন সঠিক উত্তরটা। তবে বহুগুণাকে সঙ্গে না পেলে কোনও গোষ্ঠীর পক্ষেই বোধ হয় তেহরি বাঁধের বিরোধিতাকে জোরদার করা সম্ভব ছিল না।
তেহরির ইতিহাস
স্বাধীন ভারতবর্ষ ভালোবেসে ফেলেছিল পাশ্চাত্যের উন্নয়নের মডেলকে। পণ্ডিত নেহরু বড় কারখানার মতো বড় বাঁধকেও সমর্থন করেছিলেন। মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীরা মার্কিন মুলুকে দৈত্যাকার বাঁধ ও জলাশয় দেখে এসে ভূয়সী প্রশংসা করেন। নদীকে বাঁধার কর্মসূচি গৃহীত হল দেশের প্রকৃতি ও ভূমিসন্তানদের ভাল মন্দের খেয়াল না রেখে। সব রাজ্যের নদীই এল পরিকল্পনার আওতায়। উত্তরপ্রদেশের কথা ধরা যাক। ১৯০০ সালের আগে সে রাজ্যে ছিল একটা বাঁধ, ১৯০১ থেকে ১৯৫১র মধ্যে ছিল বাইশটা। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৯র মধ্যে উনপঞ্চাশটা বাঁধ গড়ে ওঠে এবং রাজ্যের মোট চুরাশিটা বাঁধের মধ্যে বারোটা ছিল নির্মাণের অধীন। নির্মীয়মাণ বাঁধের মধ্যে তেহরি ছিল সব থেকে খরচ সাপেক্ষ এবং পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে উঁচু বাঁধগুলোর মধ্যে একটা। হিমালয় থেকে প্রবাহিত দুটো নদী, ভাগীরথী ও ভিলাঙ্গনা, নিয়ে এই বাঁধের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া এই বাঁধের পরিকল্পনা করে কিন্তু অনুমতি মেলে (commissioned) ১৯৭২ সালে। কাজ শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। দু’ লক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনবে ২৬০.৫ মিটার উচ্চতার এই বাঁধ, এমনই ছিল পরিকল্পনা। ৩৪৬ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও ছিল এই বাঁধের সাহায্যে। কিন্তু যে পরিমাণ এলাকা জলমগ্ন করবে এই বাঁধ তা বিরাট। তেহরি শহর এবং তেইশটা গ্রাম পুরোপুরি ডুবে যাবে এমনই ছিল পরিকল্পনার অঙ্গ। সঙ্গে আরও বাহাত্তরটা গ্রাম আংশিকভাবে ডুবে যাওয়ার কথা ছিল।
বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পালা শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকের শুরুতেই। সাফল্যের নিরিখে এগিয়েছিল কেরালার পালাক্কড় জেলার সায়লেন্ট ভালি ঘিরে আন্দোলন। ১৯৭৩ সালে শুরু হয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। নানারকম স্বার্থ এবং রাজনীতির টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে আন্দোলন। অবশেষে জনরোষের তীব্রতা দেখে ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে সায়লেন্ট ভ্যালিকে সংরক্ষণ করা হবে। দু’ বছর পরে সরকারি কমিটির সুপারিশে বাতিল হয় সায়লেন্ট ভ্যালি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ১৯৮৬ সালে সায়লেন্ট ভ্যালি পায় ন্যাশনাল পার্কের মর্যাদা। তেহরির ক্ষেত্রে তেমন কোনও সাফল্য ধরা দেয়নি আন্দোলনকারীদের হাতে। কিন্তু লড়াইটা হয়েছিল তীব্র। স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরেন্দ্র দত্ত শাকলানির নেতৃত্বে বাঁধ নির্মাণ শুরু হওয়ার আগেই তৈরি হয় ‘তেহরি বাঁধ বিরোধী সঙ্ঘর্ষ সমিতি’। ১৯৭৮ সালে নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের জন্য ইঞ্জিনীয়ার ও আধিকারিকরা পৌঁছলে সমিতির হাজার-হাজার নারী-পুরুষ-শিশু তাঁদের পথ আটকায়। বহুগুণাও যুক্ত হন এদের সঙ্গে। বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সংগৃহীত হয় দশ হাজার স্বাক্ষর। সুপ্রীম কোর্টে জমা পড়ে রিট পিটিশন। শাকলানি, বহুগুণা এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইণ্ডিয়ার সচিব বিদ্যাসাগর সই করেন অন্যান্যদের সঙ্গে। এই সংগ্রামের ফলে সরকার বিভিন্ন কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়, বাধা পড়ে নির্মাণে। ১৯৮৬ সালে রায় কমিটি বাঁধের বিরুদ্ধে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানায়। হনুমন্ত রাও প্যানেল পুনর্বাসনের ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করে। পাশাপাশি সুন্দরলাল বহুগুণা ১৯৮৯, ১৯৯২, ১৯৯৫, ১৯৯৭ এবং ২০০১ সালে একাধিকবার অনশনে বসে এই নির্মাণ আটকানোর চেষ্টা করেন। বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রী নানারকম আশ্বাস দেন এ ব্যাপারে। এদিকে প্রকৃতির সতর্কবাণীও সম্ভবত বাঁধের পক্ষে বার্তা দেয়নি। ১৯৯৯ সালে চামোলি জেলার ভয়াবহ ভূমিকম্প জানিয়ে দেয় প্রকৃতির বিপর্যয়ের ব্যাপকতা সম্পর্কে। কিন্তু বাঁধের কাজ থামেনি পাকাপাকিভাবে। এদিকে বহুগুণার তৈরি ছড়া ঘুরতে লাগল লোকের মুখে-মুখে:
তেহরি বাঁধ কি দেনেই চার
অত্যাচার, বেঘরবার, ভ্রষ্টাচার, নরসংহার।
২০০৫ সালে শেষ হয় তেহরি বাঁধের প্রথম পর্বের নির্মাণ। পরের বছর এটা কমিশনড হয়। ইতিমধ্যে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। এই উৎস থেকেই পরিশুদ্ধ পানীয় জল যায় দিল্লীর চল্লিশ লক্ষ মানুষ এবং উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের তিরিশ লক্ষ মানুষের কাছে। ঘনবসতির শহর আজ তেহরির উপর নির্ভরশীল। হিমালয়ের অরণ্য ও সংলগ্ন গ্রামের মানুষদের জন্য ভাবার সময় নেই তাদের। কিন্তু বহুগুণার কী হল? ২০০৪ সাল থেকে ভরে উঠতে লাগল বাঁধ সংলগ্ন জলাধার। বহুগুণাকে প্রশাসন সরিয়ে নিয়ে গেল কোটি নামে একটা জায়গায় এবং সেখান থেকে রাজ্যের রাজধানী দেরাদুনে। ২০০৯ সালে পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে এটা সম্মাননা পরাজয়ের সূচক?
বহুগুণার আদর্শ, তাঁর জীবন
১৯২৭ সালে জন্মে ছিলেন বহুগুণা, আপাত অর্থে শান্ত, স্নিগ্ধ হিমালয়ের কোলে। কিন্তু তেহরির রাজার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হচ্ছিল ওই এলাকার মানুষ। ১৯৩০ সালে বিক্ষোভ জানাতে গিয়ে রাজার প্রহরীদের গুলিতে মারা যান অনেকে। কিন্তু তাতে বিক্ষোভ থামেনি। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন আর রাজার অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ – এই দুটো কোনও আলাদা বিষয় ছিল না। তেরো বছর বয়সে সেই বিক্ষোভে দেখা যায় বহুগুণাকেও। পরে তিনি লাহোরে পালিয়ে যান। সেখানে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করেন। স্বাধীনতার পরে গান্ধীজির আদর্শে, তাঁরই শিষ্য বিনোবাভাবের ভূদান ও সর্বোদয় আন্দোলনে যোগ দেন। তেহরি-গাড়োয়াল জেলার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রী বিমলার কথা শুনে ইস্তফা দেন সেই পদে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন সংসদীয় রাজনীতির ধারা থেকে। দু’জনে মিলে সিলিয়ারা গ্রামে ‘পার্বতীয়ন বজীবনমণ্ডল’ নামে আশ্রম স্থাপন করেন। এই সময়েই তাঁরা যুক্ত হলেন মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনে।

ব্রিটিশের সেনা নিয়োগকে কেন্দ্র করে উত্তরাখণ্ড অঞ্চলে গড়ে উঠল ক্যান্টনমেন্ট বা সেনাশিবির। বেড়ে গেল মদের আমদানি এবং মদ্যপানের অভ্যাস। এমনিতে গ্রামের মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে আসক্তি ছিল না। বাইরে থেকে বাণিজ্য করতে আসা কিছু মানুষ নিজেরা নেশার পানীয় তৈরি করত বটে কিন্তু প্রথম দিকে তারা বিক্রি করত না সেই পানীয়। বাইরে থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের অবশ্য মদের প্রতি টানছিল। যাইহোক, মদ্যপানের বিরুদ্ধে লড়াইতে বহুগুণা ও তাঁর স্ত্রী যুক্ত হলেন ১৯৬৫ সালে। তাঁদের উদ্যোগে তেহরি জেলায় ছড়িয়ে পড়ল আন্দোলন। পাশের জেলাতেও আঁচ পৌঁছল। এক সময় গান্ধীবাদী নেতা সরলা দেবী বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে সাক্ষাৎ করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সুচেতা কৃপালনীর সঙ্গে। ফল মিলল, বন্ধ করা হল বহু মদউৎপাদন কেন্দ্র। ১৯৬৯ সালে গান্ধীজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সীমান্তবর্তী পিথোরাগড়, চামোলি ও উত্তরকাশীকে ‘ড্রাই’ বলে ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। এই সময় মহিলা ও তরুণরা যুক্ত হলেন মদ বিরোধী আন্দোলনে। বহু দোকান পুড়িয়েও দেওয়া হল। ১৯৭০ সালে তেহরি ও পৌরি জেলাকেও মদ মুক্ত বলে ঘোষণা করা হল।
চিপকো
সাময়িক প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও মদ্যপান এবং মদের বিপণন কিন্তু বন্ধ হয়নি এই সব আন্দোলনের ফলে। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ঢুকে মদ্যপানকে একটা ইস্যু করে তোলার আগ্রহ ছিল না বহুগুণার মতো সর্বোদয়ীদের। আর্থসামাজিক কারণকে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁরা কেবল নৈতিক স্খলনকে দায়ী করলেন মদ্যপানের আসক্তির জন্য। ফলে স্থায়ী প্রতিকার ঘটল না। আত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলে ধরলেন সমাজসেবীরা আর অন্যদিকে মদ ঢুকতে লাগল রাজনীতিকদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে। এই সময়েই জঙ্গলের কাঠ সংগ্রহকে কেন্দ্র করে বচসা শুরু হল চামোলি জেলায়। গ্রামবাসীদের কিছু কাঠ দরকার চাষের ক্ষেতে কাজ করার জন্য। সরকারি বনদপ্তর সেটুকু দিতে রাজি নয়। শক্তপোক্ত গাছের কাঠ চাইলে বনআধিকারিক শুনিয়ে দিলেন যে ওসব বাণিজ্যের জন্য। জমা হতে লাগল বিক্ষোভ। ব্রিটিশের অধীনে গ্রামের মানুষ দেখেছে যে কীভাবে প্রশাসন নিয়ে যায় সব কাঠ আর তারা কিছু সংগ্রহ করতে গেলেই দাগিয়ে দেওয়া হয় অপরাধী হিসাবে। স্বাধীনতার পরে অবস্থার বদল দেখতে পেল না তারা। সরকার কাঠ বিক্রি করতে লাগল বড় কোম্পানির কাছে।
১৯৭৩ সালের এপ্রিলে চামোলি জেলায় গাছ কাটতে এসেছিল এলাহাবাদের এক কোম্পানি যারা খেলাধুলোর সরঞ্জাম বানায়। সাইমণ্ডস নামে সেই কোম্পানির কাছে চোদ্দটা বড় গাছ কাটার অনুমতি ছিল। কিন্তু চণ্ডীপ্রসাদ ভাট ও দশোলি গ্রাম স্বরাজ্য মণ্ডলের অধিবাসীরা আটকে দিল সেই রুটিন কাজটা। গাছেদের জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর প্রচেষ্টা থেকে এই আন্দোলনের নাম হয় ‘চিপকো’। ১৯৭৭ সালের মে মাসে হেনওয়াল উপত্যকায় গাছ কাটা বন্ধ করতে গ্রামবাসীদের সংগঠিত করলেন বহুগুণা। প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়ল আশেপাশের অঞ্চলে, পরের বছর তেইশ জন স্বেচ্ছাসেবক গ্রেপ্তার হল গাছ কাটার বিরোধিতার জন্য। বহুগুণার লড়াই থামল না। তিনি প্রথম বার গ্রেপ্তার হলেন ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে। ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরলেন ইন্দিরা গান্ধী। যে কোনও কারণেই হোক না কেন, তিনি গুরুত্ব দিলেন এই আন্দোলনকে। পনেরো বছরের জন্য উত্তরাখণ্ড হিমালয়ের অরণ্যে গাছকাটা বন্ধ করার নির্দেশ দেন তিনি। এক্ষেত্রে বহুগুণার সংগ্রাম ও অনশনের প্রভাব কেউ অস্বীকার করতে পারবে ননা।
গান্ধীজির অনুসারী বহুগুণা তাঁর মতো করেই পদব্রজে ঘুরে বেড়াতেন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সংগ্রহ করতেন পাহাড়ের প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের কাহিনী। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে তিনি কাশ্মীর থেকে কোহিমা পদব্রজে ঘোরেন চিপকো আন্দোলনের বার্তা প্রচার করতে। ‘চিপকো’ হয়ে ওঠে এক বিশ্বজনীন নাম। আজও এই আন্দোলনের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় বহুগুণার নাম। চিপকো এবং তেহরির সংগ্রাম জীবিতি অবস্থাতেই তাঁকে পরিণত করেছিল এক কিংবদন্তীতে। মৃত্যু তাঁর দেহটুকু সরিয়ে নিয়েছে মাত্র। প্রকৃতিকে রক্ষা করার, প্রতিবাদে মুখর হওয়ার যে ধারা তিনি তৈরি করে দিয়েছেন তার কোনও ক্ষয় কখনই সম্ভব নয়।