বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
মহাভারতের যুদ্ধ শেষে শত পুত্রহারা ধৃতরাষ্ট্রের বজ্র আলিঙ্গনে লোহার ভীমও চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এদেশের পুত্রহারা পিতা ও জননীদের ক্রোধের উত্তাপ নরেন্দ্র মোদির লৌহকঠিন মূর্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করবে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও কালের গর্ভে। তবে লৌহপুরুষের লোহার আস্তরণ যে গলতে শুরু করেছে তাতে সন্দেহ নেই।
নোটবন্দি, কোভিডের প্রথম ঢেউ, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো দেশজুড়ে কয়েক ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন, সব রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের নিলাম, সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সম্পদ অবাধে লুঠ — মোদি শাসনের বিরুদ্ধে একটু একটু করে উত্তাপ সঞ্চিত করছিল। মোদি শাসনের আসল চেহারাটা একেবারে নগ্ন হয়ে গেল কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার সঙ্গে। দ্বিতীয় ঢেউ যে আসবে সে বিষয়ে অবহিতই ছিল না মোদি সরকার। তারপর দেখা গেল হাসপাতাল নেই, থাকলেও বেড নেই, অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই, টিকা নেই, টিকা পেতে গেলে কিনতে হবে চড়া দামে, মড়া পোড়ানোর কাঠ নেই, দেশজুড়ে চুল্লি জ্বলছে তো জ্বলছেই, কবর দেওয়ার মতো মাটি নেই, গঙ্গায় ভাসছে শত শত শব। যেন এক ধাক্কায় ফিরে এল ১০০ বছর আগেকার ঔপনিবেশিক ভারত। মহামারিই মোদি শাসনের আসল চেহারাটাকে এক ধাক্কায় সামনে এনে ফেলল। এমনকি মোদি শাসনের যারা একনিষ্ঠ সমর্থক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্তরাও বলতে শুরু করল, রাজা তোর কাপড় কোথায়।
কৃষক আন্দোলনের শিখা নিভছে না। উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হারের মুখ দেখল বিজেপি। যারা লকডাউনে পরিযায়ী হয়েছিল, যারা মোদির সুখ্যাতি করে কুম্ভমেলায় গিয়েছিল তারাই ফিরে এসে প্রথমে সুপার স্প্রেডার হল। পরে অতিমারির নির্মম রূপ দেখে তাদের মোহ ভঙ্গ হল। পঞ্চায়েতে এমনকি বারাণসী ও মথুরার মতো ঘাঁটিতেও হারল বিজেপি। লজ্জাজনক হার হল পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে, তামিলনাড়ু, কেরালায়। ফলে মোদির লৌহপুরুষের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল।
গদি বাঁচাতে এখন থেকেই তৎপরতা শুরু হয়েছে বিজেপি শিবিরে। যে মোদি সরকার টিকা বেচে কর্পোরেটকে ব্যাপক মুনাফা লোটার সুযোগ করে দিয়ে দেশবাসীর বড় অংশকে ভাইরাসের মুখে ছেড়ে দিয়েছিল, উল্টোরথের পথে হেঁটে তারা বলল, দেশের সবাইকে বিনামূল্যে টিকা দেব। যদিও টিকা ভাঁড়ারে নেই এবং বেশির ভাগ দেশবাসীই যে আগামী কয়েক মাস টিকা পাবেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাই মজুত টিকার তথ্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মোদি সরকার। তবু তো পিছু হঠে বলতে হল, বিনামূল্যে টিকা দেব। ক্ষমতার রক্ষার স্বার্থে জনমুখী সাজতে তো হচ্ছেই, কিছুটা করতেও হচ্ছে।
তবে মোদিকে আতঙ্কে রেখেছে অর্থনীতি। জিডিপি বৃদ্ধির পূর্ভাস কমছে। শুধু মে মাসে বেকার হয়েছেন ১ কোটি বেশি মানুষ। শিল্প কারখানায় উৎপাদন নেই, তাই শিল্পোৎপাদন সূচকের সব তথ্য প্রকাশ করেনি কেন্দ্র। দেখাই যাচ্ছে ২০১৯ এর সঙ্গে তুলনা করলে ২০২১ সালে এসে শিল্পোৎপাদনের গ্রাফটা সমান, অনেকটা হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাওয়া রোগীর মনিটর গ্রাফের মতো। লোকের আয় নেই। তাই বাজারে কেনাকাটা নেই। বাজার নেই তাই উৎপাদন নেই। বন্ধ বড় কল করাখানা। ব্যবসা শুকিয়ে মরছে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ইউনিটগুলি। বাজার নেই তাই বিনিয়োগ নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে টাকার গায়ে ছাতা ধরছে। বিনিয়োগ নেই তাই কাজ নেই। কাজ নেই, অতএব আয় নেই। আয় নেই, তাই বাজার মন্দা। গত দুবছর ধরে এমনই দুষ্টচক্রে ঘুরছে দেশের অর্থনীতি। বাড়ছে বেকারি, আয় কমেই চলেছে লোকের। নতুন করে চাকরি হচ্ছে না। অথচ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। পেট্রোল ডিজেল থেকে ভোজ্য তেল, দাম দিন দিন চড়ছে। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনও লাগাম নেই। বরং এই সঙ্কটে নতুন শ্রমবিধি চালু করে শ্রমিকের মজুরি কমাতে বদ্ধপরিকর মোদি সরকার। অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ। লোকে কর্মহীন, আয়হীন। অন্যদিকে প্রতিদিন মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসছে কোভিডের নিত্যনতুন ভাইরাস, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস, হোয়াইট ফাঙ্গাস। সে সবের ওষুধেও টান। টাকা দিলেও মিলছে না দরকারি ইঞ্জেকশন। ওদিকে টিকার অভাবে দুটি ডোজের ব্যবধান বাড়িয়েই চলেছে সরকার।
অতিমারি ও প্রায় স্তব্ধ অর্থনীতি — এ দুই অচল চাকা মোদি সরকারের রথকে মহাভারতের রণক্ষেত্রে প্রায় নিশ্চল করে ফেলেছে। সেই রথ টেনে তুলে তার পথ সংশোধনের জন্য চেষ্টা শুরু হয়েছে। যোগীর খামখেয়ালিপনায় উত্তরপ্রদেশে বিজেপির মধ্যেই ধূমায়িত হচ্ছে ক্ষোভ। অন্যদিকে, অরাজকতার জেরে ক্ষুব্ধ রাজ্যের বাসিন্দারা। তাই একদিকে যোগীকে বাগে এনে বিনা মূল্যে টিকাকরণের মতো জনমুখী পদক্ষেপ করে উত্তরপ্রদেশে অরাজকতা নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা শুরু হয়েছে। হিন্দু হৃদয়সম্রাট যোগীর বদলে মোদির ভরসা এখন আমলাতন্ত্রই। কারণ যোগী মহারাজের ধর্মীয় খোলস ফেটে গিয়ে ফ্যাশিস্ট চেহারা গত চার বছরে নগ্ন হয়ে গিয়েছে। ধ্বসে পড়ছে মানুষজনের আস্থা। যাতে সুশাসনের কিছু লোক দেখানো নমুনা দেখিয়ে মানুষের আস্থা ফেরানো যায়, সেই লক্ষ্যে নতুন করে জনপ্রিয়তাবাদী সাজতে চাইছে মোদি সরকার। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আর এক বছরও বাকি নেই, মানুষের আস্থা ফেরানো দরকার। যদি উত্তরপ্রদেশ হাতছাড়া হয় তাহলে বিপদ ২০২৪ সালের নির্বাচনে। তাই একদিকে ঘর গোছানো, আরেক দিকে কংগ্রেস ভেঙে রাস্তা তৈরির খেলায় নেমেছেন মোদি। নিজেদের বিশ্বস্ত আমলাকে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে বসিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। এরপর হবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রদবদল। সঙ্গে কিছু জনমোহিনী আর্থিক ঘোষণা। এসব ঘুঁটি দিয়েই গলতে থাকা লৌহপুরুষের ভাবমূর্তিকে ফের চাঙ্গা করতে নেমেছেন মোদি ও অমিত শাহ।
কিন্তু রাজনীতির ঘুঁটি যতই সাজান মোদি পরিযায়ী শ্রমিক ভোলেননি তার দুর্ভাগ্যের কথা। যারা করোনায় প্রিয়জনকে হারিয়েছেন তাঁরা ভোলেননি সার সার জ্বলন্ত চুল্লির দৃশ্য। লোকে ভোলেনি শববাহিনী গঙ্গার ছবিও। সাধারণ মানুষ প্রতিদিন রাস্তায় বেরিয়ে দেখছে অর্থনীতি স্তব্ধ হওয়ার এই বাজারে পেট্রোল আর ডিজেলের দাম ১০০ টাকা ছাপিয়ে গেল। ভোজ্য তেলের দাম ১২০ টাকা থেকে পৌঁছে গেছে ২০০ টাকার কাছাকাছি। সংবাদমাধ্যমকে দিয়ে মোদির নয়া উদ্যোগের খবর লিখিয়ে যতই ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা হোক, জনজীবন কিন্তু প্রতিদিন পুড়ছে করোনার আগুনে, কর্মহীনতার আগুনে, মূল্যবৃদ্ধির আগুনে, জীবন নিযে সামগ্রিক অনিশ্চয়তার আগুনে। এ এক নিঃশব্দ দাবানল যা খাণ্ডববন দাহ করতে পারে। এই পরিস্থিতি নিয়ে দেশের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিন মুখ খুলছেন রাজনীতিক, সাংবাদিক কিংবা সমাজকর্মীরা। আর প্রতিদিনই তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রোদ্রোহিতার অভিযোগ এনে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে। এভাবেই ভারতের নগর-গ্রাম-প্রান্তর জুড়ে চলছে আরেক মহাভারতের যুদ্ধের প্রস্তুতি। মোদির রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে। ভাগ্য ভাল যে ভারতভূমিতে মোদির চেয়ে যোগ্যতর কেউ এখনও উঠে আসেননি। কিন্তু ইতিহাস তো বসে থাকে না। পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী ইতিহাস তার নায়ককে তৈরি করে নেয়। অশ্বারোহীকে চিনে নেয় মহাকালের রথের ঘোড়াই। সেই সময়পর্বের আগে পর্যন্ত বসে যাওয়া রথের চাকা টেনে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাবে মোদি। তারপর একদিন রাত্রির অশ্বারোহীরা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে হাজির হবে ভোরের দিগন্তে। সেদিন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রদের চোখ ফুটবে। ধৃতরাষ্ট্রের রূপকে ভারতভূমির লক্ষ জনতা উঠে দাঁড়িয়ে লোহার ভীমকে চুর চুর করে ফেলবে। তখন পুত্রহারা গান্ধারীদের শোকে স্তব্ধ হবে ভারতভূমি। আর অতিমারিতে বিনা চিকিৎসায় মৃতেরা পারুল কক্করের সেই কবিতার লাইনগুলো চিৎকার করে বলে উঠবে, ‘আগুন লাগিয়ে বাঁশরী বাজায় বাঃ রে বিল্লা রঙ্গা, সাহেব তোমার রামরাজ্যেতে শববাহিনী গঙ্গা।’