বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

সরকারি শ্রমিক কল্যাণের হাল হকিকত

সরকারি শ্রমিক কল্যাণের হাল হকিকত

অশোক সরকার

photo

ফোন এসেছিল আমার দপ্তরে, ওপারে কর্ণাটকের শ্রম কমিশনার। “আপনার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আমার একটা কাজ আছে। গরমের ছুটিতে তারা কি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন নির্মাণ সাইট থেকে নির্মাণ কর্মীদের পঞ্জিভুক্ত করতে পারবে? ৯০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছে কিন্তু যাদের জন্য এই তহবিল তারা কোনও সুবিধা পাচ্ছে না।” অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর। সেটা ২০১৮ সাল। ১৯৯৬ সালে আইন হয়েছিল। নির্মাণ সংস্থাগুলি রাজ্য সরকারকে ১% সেস দেবে, সেই টাকা জমা হবে একটা সরকারি সংস্থায়, তারা নির্মাণ কর্মীদের একগুচ্ছ সুবিধে দেবে। সংস্থার পোশাকি নাম বিল্ডিং ও কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড। সারা দেশে ২০২৪ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জমেছে ১ লক্ষ ১৭ হাজার কোটি টাকা। খরচা হয়েছে ৬৭ হাজার কোটি। দেশে কত নির্মাণ কর্মী আছে সঠিক তথ্য নেই, অনুমান ৭ থেকে ৯ কোটি। সরকারের ই-শ্রম পোর্টালে নথিভুক্ত হয়েছেন ২ কোটি ৮০ লক্ষ। সবচেয়ে বেশি উত্তরপ্রদেশে ৬০ লক্ষ, তার পরেই পশ্চিমবঙ্গে ২২ লক্ষ, রাজস্থান আছে তিন নম্বরে ২১ লক্ষ। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি নথিভুক্ত হতেই বাকি আছে। অবশ্য ২০২৪-এর অগস্ট মাসে রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা তথ্য অনুযায়ী নথিভুক্ত হওয়া মোট নির্মাণ কর্মীর সংখ্যা ৫ কোটি ৬৫ লক্ষ, উত্তরপ্রদেশ প্রথম, ১ কোটি ৬৪ লক্ষ, পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয়, ৩২ লক্ষ।
রাজ্যসভাকে জানানো তথ্যের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের তথ্যই অস্পষ্ট। তবে রাজ্য শ্রম দপ্তরের ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হচ্ছে ২০২৩ এর জুন পর্যন্ত নির্মাণ কর্মীদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে সেস সংগৃহীত হয়েছে ৪১৭০ কোটি টাকা। ৪৪ লক্ষ নির্মাণ কর্মীকে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ৩১ মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত ২৫৭০৬ জনকে পেনশন দিতে খরচা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা, অন্যান্য নানা সহায়তা দিতে খরচা হয়েছে ১২২৮ কোটি টাকা। এছাড়া ৩২ কোটি টাকা খরচা করে ৭১টি ক্রেশ বানানো হচ্ছে, সবই চা বাগান এলাকায়। আরও বলা হচ্ছে ৪৪টা স্বাস্থ্য কেন্দ্র বানানো হবে, সেগুলিও প্রায় সবই চা বাগানে। শিল্পাঞ্চল ও বড় শহরে ২৫টি হস্টেল কাম ট্রানজিট সেন্টার বানানো হবে।
বার্ষিক রিপোর্টটি খুঁটিয়ে দেখলে বেশ কিছু ব্যাপারে ধন্দ তৈরি হয়। ক্রেশের দরকার আছে ঠিকই, কিন্তু চা বাগান এলাকায়? সেখানে এত মহিলা নির্মাণ কর্মী আছেন? রাজ্যের নির্মাণ কর্মী কল্যাণ বোর্ডের সদস্য সিটুর নেতা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, এই সরকার চা বাগান এলাকায় মহিলা কর্মীদের নির্মাণ কর্মী বলে নথিভুক্ত করেছে। বলা হয়েছে চা বাগানে আর কাজ নেই, তাই এরা এখন সবাই নির্মাণ কর্মী। তিনি এও জানাচ্ছেন যে, সরকার এই তহবিল থেকে ১২০০ কোটি টাকা রাজকোষে পাঠিয়ে দিয়েছে, মানে সেই টাকা নির্মাণ কর্মীদের জন্য খরচা হবে না। তৃতীয়ত যে ৪১ রকম সহায়তা দিতে গিয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১২২৮ কোটি টাকা খরচা হয়েছে, তার ৩২টি ক্ষেত্রেই ২০২২-২৩ সালে কোনও সহায়তাই দেওয়া হয় নি। মাতৃত্ব সহায়তা, দুর্ঘটনা সহায়তা, শিক্ষা সংক্রান্ত সহায়তা, যন্ত্রপাতি সহায়তা, সাইকেল সহায়তা ওই সালে একজনকেও দেওয়া হয়নি। চতুর্থত, হস্টেল কাম ট্রানজিট সেন্টারগুলি বেশির ভাগই মাত্র ২৫ জন থাকার জন্য। এই হিসেবটা কি করে তৈরি হল? হোস্টেলগুলি সবই শিল্পাঞ্চলে নয়ত বড় শহরে (কলকাতা, শিলিগুড়ি)। সব জায়গাতেই কি সমান প্রয়োজন? পঞ্চমত, স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিও সবই চা বাগানে কেন? ষষ্ঠত, বার্ষিক রিপোর্ট বলছে এ পর্যন্ত ২৪ লক্ষ ৩৩ হাজার কর্মীকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত উপকৃতদের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছিল, সে বছর ৫ লক্ষ ৮৩ হাজার জন এই সহায়তা পেয়েছিলেন, তারপরে ধারাবাহিকভাবে কমে কমে ২০২২-২৩ সালে মাত্র ৩৮৬৬ জনকে সেই সহায়তা দেওয়া হয়েছে। উপকৃতদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমছে কেন?
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকারের ২০০৭ সালে তৈরি একটি আইন আছে। কিন্তু সেই আইনকে কার্যকর করার জন্য কোনও বাজেট নেই। ২০১৭ সালে রাজ্য সরকার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য একটি প্রকল্প এনেছিল যার নাম সামাজিক সুরক্ষা যোজনা, ২০২০ সালে তার নাম বদলে হয় বিনা মূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা। বার্ষিক রিপোর্টে দেখছি এই যোজনায় নির্মাণ শ্রমিক ছাড়াও ১ কোটি ৮ লক্ষ অন্য শ্রমিক এবং ৪ লক্ষ পরিবহন শ্রমিক বলে দুই ধরনের শ্রমিককে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এই শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা আছে, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ২ লক্ষ টাকা, স্বাভাবিক মৃত্যু হলে ৫০ হাজার টাকা, ৪০% বা তার বেশি পঙ্গু হলে ৫০,০০০ টাকা, দুর্ঘটনায় দুটি চোখ, পা বা হাত কাটা গেলে দুই লক্ষ আর একটি চোখ, হাত বা পা কাটা গেলে ১ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। এর জন্য সরকারের বাজেট আছে। বার্ষিক রিপোর্টে দেখছি ওই সাল পর্যন্ত ৮৮ হাজার পরিবহন কর্মী এবং ৭ লক্ষ ৬৭ হাজার অন্যান্য শ্রমিক সহায়তা পেয়েছেন যথাক্রমে ৯৮ লক্ষ আর ৮৮৯ কোটি টাকা। গড়ে ব্যক্তি প্রতি ১১০০০ টাকার সামান্য বেশি। প্রকল্পের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবকে মেলানো যাচ্ছে না।
পশ্চিমবঙ্গের কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৭ কোটি ৮০ লক্ষের মতো। তার ৮৫ ভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত, তার মধ্যে এত বছরের চেষ্টায় দেড় কোটি শ্রমিককে নথিভুক্ত করতে পারা গেছে। সেইখান থেকে কিছু মূল প্রশ্ন তৈরি হয়।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কি অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কল্যাণের জন্য তৈরি? আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি হয়েছিল শহরে-মফস্বলে-গ্রামে-মহানগরে স্থায়ী অধিবাসীদের জন্য বুথ ভিত্তিক ভোট, ডোমিসাইল ভিত্তিক জমি-মালিকানা, ঠিকানা ভিত্তিক রেশন কার্ড, পঞ্চায়েত ভিত্তিক জব কার্ড, ইত্যাদি অনেক কিছুই ধরে নেয়, আমাদের বাঁচা মরা সবই একই জায়গায়।
সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। আজকে বাসস্থান আর কর্মস্থলের মধ্যে ভৌগলিক ফারাক অনেক। অন্য গ্রাম, অন্য টাউন, অন্য শহর, অন্য রাজ্য। কাজের সূত্রে সপ্তাহে ৫ দিন শহরে থাকতে হয়, হপ্তা শেষে দেড় দিন গ্রামে ফেরে, এক জেলার কৃষি বা বাগান শ্রমিক বছরে ৪-৫ বার অন্য জেলায় কাজ করতে যায়, এক রাজ্যের শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজ করতে যায়, বিভিন্ন বছর বিভিন্ন রাজ্যে যায়, কেউ বা গ্রাম থেকে কাছের মফস্বল শহরে সপ্তাহে তিন দিন কাজ পায়, অন্য তিনদিন অন্য কোথাও কাজ পায়, এমনকি এক দিনে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়, এটাই এখন কর্ম সংস্থানের চরিত্র।
কাজের স্থান, রোজগার দেবার মালিক, কাজের চরিত্র, দূরত্ব, সময়, কোনওটাই এখন স্থায়ী বা নিশ্চিত নয়। এ এক নতুন শিকার–সংগ্রহকারী (hunter-gatherer) সমাজ; ফলমূল-পশুপাখির খোঁজে নয়, কাজের খোঁজে দৌড়চ্ছে।
শ্রমিক কল্যাণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিয়ে নতুন ভাবনার সময় এসে গেছে। শ্রমিককুলের ৯০%ই অসংগঠিত, ক্রমশ এরা স্থানীয় শ্রমিক থেকে ভ্রাম্যমাণ ও সর্বভারতীয় শ্রমিক হয়ে উঠছে, তাই তাদের নথিভুক্ত করা, রেশন, পেনশন, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, মাতৃত্ব, তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা, শুধু তাদের নামে তহবিল করলেই হবে না। শুরু করার জন্য কয়েকটা পদক্ষেপ খুবই জরুরি। যেমন রেশন কার্ডের দেশব্যাপী ব্যবহার। এর জন্য সারা দেশের রাজ্য, মিউনিসিপ্যাল প্রশাসন ও নগর পঞ্চায়েতগুলির ওয়ার্ড স্তরে এবং রেশন পরিকাঠামোর মধ্যে সমন্বয়কারী ব্যবস্থা লাগবে। তেমনি, নির্মাণকাজ যেখানে হচ্ছে, মিউনিসিপ্যালিটির সেই ওয়ার্ডে অথবা গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্মাণ কর্মীদের পরিষেবা দেবার জন্য অস্থায়ী অথবা সাব-ওয়ার্ড অফিস লাগবে, যারা তৎকাল নথিভুক্ত করতে পারবে। এই সাবওয়ার্ড অফিসেই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রেশন দেবার ব্যবস্থা করা সম্ভব। নির্মাণকর্মীদের যে ৪১ রকম সহায়তার কথা বার্ষিক রিপোর্টে আছে, তার প্রতিটির জন্যই নানা রকম কাগজ পত্র লাগবে, সেগুলি এই ওয়ার্ড অফিসগুলিতেই পাওয়া এবং জমা দেওয়া সম্ভব। এমনকি অন লাইনে সেখান থেকেই আবেদনগুলি process করে দেওয়া সম্ভব। দেশের প্রায় ৪০ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের ৪৫ ভাগ স্বনিযুক্ত। মিউনিসিপ্যালিটি বা নগর পঞ্চায়েতের ওয়ার্ড কমিটি থেকে সহজেই এদের স্ব-নিযুক্ত শ্রমিক পরিচয় পত্র দেওয়া যায়। রাজ্যের দেওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স যদি সারা দেশে গণ্য হতে পারে, মিউনিসিপ্যালিটির দেওয়া পরিচয়পত্রই বা গণ্য হবে না কেন? সংবিধান তো এদের স্থানীয় সরকার বলে স্বীকার করেছে। এই পরিচয়পত্র দেখিয়ে সারা দেশের যে কোনও শহরে, তারা রেশন, ভাতা বা বীমা পাবে না কেন? ভারতের ১৪-১৫টি রাজ্যে কাজের কারণে আন্তজেলা পরিযান দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা প্রশাসনগুলির সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিককে ন্যূনতম সুবিধাগুলি দেওয়া সম্ভব। যে কোনও শহরে, হাজারো লাখো গৃহ শ্রমিক কাজ করেন, যার প্রায় সবাই মহিলা। প্রতিটি পাড়ায়, এবং বড় হাউসিংগুলিতে এই গৃহ শ্রমিকদের জন্য মিউনিসিপ্যাল প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে মালটি-পারপাস সেবা কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব।
বর্তমানের সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতান্তই বিল্ডিং, অফিস, টেবিল, ফাইল, নোটিং, গাইডলাইন জাতীয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জর্জরিত। দ্বিতীয়ত, মানুষের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠানগুলি – গ্রাম পঞ্চায়েত, গ্রাম সভা, মিউনিসিপালিটি, ওয়ার্ড কমিটি, পঞ্চায়েত সমিতি ইত্যাদি – প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবচেয়ে দুর্বল, সরকারের সব শক্তি দেশের আর রাজ্যের রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত। তৃতীয়ত, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিকেরা সদা চলনশীল, তুলনায় সরকারি ব্যবস্থা বড়ই স্থবির। এই শ্রমিকদের সবাইকে সহায়তা পৌঁছতে গেলে সরকারি ব্যবস্থাকেও চলনশীল হতে হবে, সেই জন্য প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ও প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিক প্রশিক্ষিত সোশাল ওয়ার্কারের দরকার হবে। সহায়তা শুধু নিয়ম গাইডলাইন ফর্ম, কাগজ সম্বলিত আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, সেটি একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, যেখানে যত্ন, মর্যাদা, সহমর্মিতা, তৎপরতা একই রকম জরুরি। শ্রমিকের প্রতি অবহেলা অযত্ন, অমর্যাদা আমাদের সমাজের অত্যন্ত গভীরে, সরকার যদি সত্যিই তা পাল্টাতে চায় তাহলে সহায়তার ভাবনা-কাঠামোটাই পাল্টানো দরকার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.