বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
গর্বিত প্রধানমন্ত্রী ২৮ জানুয়ারি দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভায় বলেছিলেন, পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল ভারতে করোনা সংক্রমণের সুনামি হবে। কিন্তু, ভারত হতাশ হয়ে পড়েনি, বরং সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে এগিয়ে গিয়েছিল। কোভিড চিকিৎসার পরিকাঠামো শক্তপোক্ত করে গড়ে তোলার কাজ করেছি আমরা। দিকে দিকে তাঁর স্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে বিজেপির জাতীয় পদাধিকারীদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সক্ষম, সহানুভূতিশীল, দায়বদ্ধ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের জন্য কোভিড যুদ্ধ জয় সম্ভব হয়েছে, বলে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। তার ঠিক তিন মাস পর, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় সংক্রমিতের সংখ্যা ৩ কোটি ছুঁতে চলেছে আর মৃত্যু ৩.৫ লক্ষের অধিক। দেশের সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যা ছিল তাও ভেঙে পড়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারের টীকাকরণ কর্মসুচি। মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছে পুরো দেশ।
শুধু দেশের নাগরিক নয়, সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে এক পরিবারভুক্ত মনে করাটা সরকারের নীতি। তাই, ১৭ই মার্চ পর্যন্ত ৫.৯৬ কোটি টীকা বিদেশে সহায়তা পাঠানো হয়েছে বলে রাজ্যসভায় জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী অশ্বিনীকুমার চৌবে। মহানুভব প্রধানমন্ত্রীও দাভোসের সভায় বলেছিলেন, ভারত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টীকা সরবরাহ করে। দেশের নাগরিকদের বাঁচানোর ব্যবস্থা না করে, দেশের ক্ষয়প্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে নজর না দিয়ে তিনি মহানুভবতা দেখানোর চেষ্টা করলেন কেন— এ প্রশ্নে জেরবার হয়ে দলের মুখপাত্রের সওয়াল, বিদেশে পাঠানো টীকা সবই নাকি উৎপাদক সংস্থার ব্যবসায়িক বাধ্যবাধকতা ছিল।
ফেব্রুয়ারিতে বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ৩৫০০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করেছিলেন টীকাকরণের জন্য। সরকারি বক্তব্য, এই টাকায় ৫০ কোটি ভারতীয়ের টীকাকরণ সম্ভব হবে। যদিও গত বছর সংক্রমণ শুরু হতেই কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ও পেন্সনারদের মহার্ঘভাতা জানুয়ারি থেকে বন্ধ করে দিয়ে ২০২০-২১ বছরে অতিরিক্ত অন্তত ১ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করেছিল সরকার। সরকারের সাম্প্রতিক প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যাচ্ছে, সরকার ২৮শে এপ্রিল ১১ কোটি ডোজের কোভিশিল্ড আর ৫ কোটি ডোজের কোভ্যাকসিন টীকার নতুন বরাত দেওয়া হয়েছে। আগে ১০ কোটি কোভিশিল্ড ও ২ কোটি কোভ্যাকসিনের বরাত দেওয়া হয়েছিল। বাজেট বরাদ্দের ৩৫০০০ কোটি টাকার মধ্যে এখনও পর্যন্ত ৪৪১০ কোটি টাকা খরচ করে কেনা হয়েছে ২৮ কোটি ডোজ টীকা। এসবই জুলাই–এর মধ্যে সরবরাহ হবে। তবু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নাকি ২১৬ কোটি ডোজ টীকা পাওয়া যাবে। ব্যক্তি প্রতি দুটি টীকা ধরে, আজ পর্যন্ত মাত্র ৪.৫৯ কোটি মানুষের (জনসংখ্যার ৩.৫৩%) সম্পূর্ণ টীকাকরণ সম্ভব হয়েছে। এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী টীকা উৎসবের আহ্বান জানিয়ে নির্বাচনী জনসভায় হাততালি কুড়িয়েছেন। বছরের গোড়ার দিকে কেন্দ্রীয় সরকার টীকাকরণের কর্মসূচি ঘোষণা করে। তখন টীকা সংগ্রহে রাজ্য সরকারের কোনও এক্তিয়ার ছিল না।
ভাইরাস হানার দ্বিতীয় পর্বে দেশ জুড়ে সংক্রমণ ভয়াবহ হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার তড়িঘড়ি এপ্রিল থেকে ৪৫ বছরের উপর এবং মে থেকে ১৮ বছরের উপরের নাগরিকদের টীকাকরণের আওতায় আনার ঘোষণা করলেন। অথচ, মধ্য এপ্রিল থেকেই টীকার হাহাকার, বহু স্থানে সরকারি টীকাকরণ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে, সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষারত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বন্ধ হয়ে গেছে বেসরকারি হাসপাতালে টীকার দ্বিতীয় ডোজ। বেগতিক বুঝে নিজেদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে অবলীলায় রাজ্য সরকারগুলোর উপরে টীকা সংগ্রহের দায় চাপানো হল। এর ফলে প্রতিটি রাজ্যসরকারের বাৎসরিক রাজকোষে টান পড়বেই, যা প্রতিফলিত হবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায়। তবে দায় না থাকলেও, টীকা শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর শ্রীমুখচ্ছবি থাকছে। আপাতত তিনি অন্তরালে। জানা গেল তিনি নাকি আড়ালে থেকে বেজায় পরিশ্রম করছেন। হঠাৎ ১৪ মে আবির্ভূত হয়ে জানালেন, তিনি নাকি দেশের মানুষের বিপদে সমব্যথী, মনোবল বাড়াতে দেশবাসীকে বিলোলেন নানান উপদেশামৃত। কিন্তু অতিমারি মোকাবিলায় তাঁর পরিকল্পনা জানালেন না, কোন দিশাও দেখালেন না, দায় নেওয়া তো দুরস্থান। নাগরিক মৃত্যুর বেদনায় ২১ মে কেঁদে ভাসালেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু দেশে নয় বিশ্ব জুড়েই ধিক্কার জুটেছে তাঁর এই কুম্ভিরাশ্রুতে। অন্যদিকে, অতিমারি রুখতে পৃথিবীর এগিয়ে থাকা প্রায় প্রতিটি দেশই যথাসাধ্য ব্যবস্থা নিয়েছে। আমেরিকা তাদের ৩৯ কোটি নাগরিকদের জন্য ১২১ কোটি, ব্রিটেন তার ৭ কোটি নাগরিকের জন্য ৩৫ কোটি টীকা সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছে, কানাডা তার নাগরিকদের জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত টীকার বরাত দিয়ে রেখেছে, সরকারি ওয়েবসাইটে কোন সংস্থাকে কত বরাত দেওয়া হয়েছে তাও প্রকাশিত। চীন তার বিপুল জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বেশি (৪৯.৭ কোটি) টীকাদান ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করে ফেলেছে। অবশেষে দেশে-বিদেশে সমালোচনা ও শীর্ষ আদালতের তিক্ত সমালোচনার প্রবল চাপে প্রধানমন্ত্রী ১৮ বছরের বেশি বয়েসের মানুষদের বিনা মূল্যে টীকা দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। তবে টীকাকরণের শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেওয়ার প্রলোভন সম্বরণ করা সম্ভব হয়নি।
শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। স্তম্ভিত হয়েছে বিশ্ব। গত বছরের তুলনায় ২০২০-২১ সালে ভারত দ্বিগুণেরও বেশি অক্সিজেন রফতানি করেছে। এ খবরের প্রতিবাদে সরকার জানিয়েছে, চিকিৎসার অক্সিজেন নয়, শিল্পের অক্সিজেন প্রয়োজনের বেশি উৎপাদন হওয়ায় রফতানি করা হয়েছে। শেষে চিকিৎসার অক্সিজেনের চাহিদা ভয়াবহ হওয়ায়, দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশে সরকার শিল্পে অক্সিজেন ব্যবহার বন্ধ করার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। উৎপাদিত অক্সিজেন চিকিৎসার প্রয়োজনে ব্যবহার ও সুষ্ঠু বন্টনের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। দিল্লি রাজ্য সরকারের অভিযোগ ছিল, তাদের বরাদ্দ অক্সিজেন পার্শ্ববর্তী একটি বৃহৎ রাজ্যে পাঠানো হচ্ছে। এই বিপন্ন সময়েও কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারে থাকা অক্সিজেন বন্টনেও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা দেখা গেছে। দিল্লি হাইকোর্ট রূঢ় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, এজন্য আপনাদের হাত রক্তে রাঙানো থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পীযুষ গয়ালের হৃদয়হীন মন্তব্য, রাজ্য সরকারগুলিকে অক্সিজেনের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ক্ষিপ্ত মানুষ সমাজমাধ্যমে জানতে চেয়েছেন, রোগী কতটা অক্সিজেন নেবেন তাও কি মোদি সরকার ঠিক দেবে? অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় পিএম কেয়ার ফান্ড থেকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন উৎপাদন করতে ৫৫১টি পিএসএ মেসিন বসানো হবে। বরাত দেওয়ার পর যন্ত্র থেকে অক্সিজেন পেতে কতদিন লাগবে? জানা নেই।
গত বছর ভারতের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়েছে জিডিপির ১.৮ শতাংশ। অন্যদিকে পড়শী দুই দরিদ্র দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশ। নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় জিডিপির ৯ শতাংশ, জাপান, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডে, ব্রিটেনে ১০ শতাংশ এবং আমেরিকার স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১৭.৭ শতাংশ। দেশের ভেঙে পড়া সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কঙ্কালসার চেহারাটি উন্মুক্ত করে দিয়েছে অতিমারি। যদিও, এদেশে গণ টীকাকরণ, গণচিকিৎসা ব্যবস্থায় অর্থাভাব হলেও, প্রধানমন্ত্রীর সাধের বিলাসবহুল সেন্ট্রাল ভিস্তা গড়তে ২০০০ কোটি, কুম্ভ মেলায় ১০০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করা যেতে পারে।
মৃতদেহ সৎকার করার সুযোগটুকুও মানুষের কাছে এখন অনেক পাওয়া। দিল্লির চারটি পৌরনিগমের শ্মশানে উপচে পড়ছে মৃতদেহের সারি, পার্ক, গাড়ী রাখার চত্বরে তৈরি হয়েছে অস্থায়ী শ্মশান। পোড়ানোর কাঠও অপ্রতুল, জোগাড় করতে হচ্ছে মৃতের পরিজনকেই। উত্তরপ্রদেশের অবস্থা আরো ভয়াবহ। রাজ্যের শাসক দলের দুই বিধায়ক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন চূড়ান্ত অব্যবস্থার জন্য।দলেরই আর এক বিধায়ক রাকেশ রাঠোর আতঙ্কিত হয়ে জানিয়েছেন, দেশদ্রোহিতার মামলার ভয়ে তিনি মুখ খুলতে পারছেন না। গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে বহু অর্ধদগ্ধ লাশ, বহু মৃতদেহ দাহ করতে না পেরে গঙ্গার চরে পুঁতে দিচ্ছেন মৃতের আত্মীয়জন। শাসক দলের প্রচারকরা বোঝাতে চেষ্টা করছেন, মৃতদেহ গঙ্গা ভাসিয়ে দেওয়াটা নাকি কিছু মানুষের প্রাচীন প্রথা। আপৎকালে সামাজিক সংগঠন হিসেবে দাবি করা আরএসএসকে সেবামূলক উদ্যোগ নিতে দেখা যায় নি। গণপিটুনি, গণহত্যা, অহিন্দুদের ধর্মস্থান ভাঙায় প্রবল উদ্যমী বজরঙ দল, হিন্দু জাগরণ মঞ্চের মতো তাদের লুম্পেন বাহিনীগুলো এই বিপন্ন সময়ে বেপাত্তা। বরং বামপন্থী ছাত্র-যুব, কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন এবং নানান সামাজিক সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক ও আন্তরিক উদ্যোগ ভরসা যোগাচ্ছে অসহায় মানুষকে।

বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেটে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, আগামী ১ অগষ্টের মধ্যে ভারতে ১০ লক্ষ ছোঁবে মৃত্যু। এদেশের সংক্রমণ প্রকোপে আতঙ্কিত বিশ্ব, কারণ ভাইরাসের বর্তমান ভ্যারিয়ান্টটি (বি.১.১.৭) অনেক বেশি সংক্রামক, মারণ ক্ষমতাও মারাত্মক। এই ভাইরাসের নিত্যনতুন ভ্যারিয়ান্ট এবং তার সংক্রমণ সম্ভাবনা নিয়ে গত বছরে গঠিত জিনোম সিকোয়েন্সিঙ কনসোর্টিয়ামের অ্যাবভাইসরি কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহিদ জামিল পদত্যাগ করেছেন গত ১৭ মে। নিউইয়র্ক টাইমসে সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর একটি নিবন্ধ থেকে মনে করা হচ্ছে সরকারি দপ্তর থেকে সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য না পাওয়াতে গবেষণা চালানো দুঃসাধ্য হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করলেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী মৃত্যু ৩.৭ লক্ষ, যদিও সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে প্রকৃত সংখ্যাটি তার বহু গুণ হতে পারে।
অতিমারি মোকাবিলায় কোনওরকম পরিকল্পনা, উদ্যোগ নেওয়া দূরে থাক, সুরক্ষাবিধি এড়িয়ে কুম্ভমেলাকে আরো জাঁকজমকপূর্ণ করতে অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদের ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতকে রাতারাতি সরিয়ে নিয়ে আসা হয় তিরথ সিং রাওয়াতকে। কারণ, ত্রিবেন্দ্র এই মেলা আয়োজন করতে চেয়েছিলেন যথাসম্ভব স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে। আর আগামী বছর উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে এই পরিষদের সাধুরা বিজেপির ভোট বাক্স ভরার অন্যতম ঘুঁটি। সারা দেশে বহু কোটি টাকা খরচ করে প্রধানমন্ত্রী ও তিরথ সিং রাওয়াতের ছবিসহ নানান ভাষার সংবাদপত্রে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নিরন্তর আপত্তি সত্ত্বেও, প্রধানমন্ত্রী ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনী জনসভা করে গেছেন, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই ১৮টি। অন্য রাজ্যে একদফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও, অবিজেপি সব কয়টি দলের আপত্তি সত্ত্বেও আটটি দফায় নির্বাচন করা হয় পশ্চিমবঙ্গে।
প্রধানমন্ত্রীকে সুপার স্প্রেডার বলে দুষেছেন আইএমএ-এর সহসভাপতি ড. নভজ্যোত দাহিয়া। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আশীষ ঝা, মহামারি বিশেষজ্ঞ ড. ললিত কান্ত কুম্ভ জমায়েতকে ভয়াবহ সংক্রমণের অন্যতম উৎস বলে মনে করছেন। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৩ মে-এর সম্পাদকীয়তে এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই পুরোপুরি দায়ী করা হয়েছে। রূঢ় সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে বিবিসি, দ্য টাইমস্, দ্য অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকায়। সরকারি ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করায় দেশ বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রের তত্ব আউরেছেন আরএসএস-এর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দত্তাত্রেয় হোশবলে।
১৮৯৬ সালের ভয়াবহ প্লেগ মহামারিতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের হৃদয়হীনতাও ম্লান হয়ে গেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অমানবিক আচরণ ও চূড়ান্ত ব্যর্থতায়। অতিমারির ধাক্কায় ভারতের অর্থব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। বেকারত্ব পৌঁছেছে ১২.৮ শতাংশে। আইএমএফ-এর সমীক্ষায় জিডিপির নিরিখে ভারতের অবস্থান এখন বিশ্বে ১৪৮তম; বাংলাদেশ, কেনিয়া, অ্যাঙ্গোলারও পিছনে। বিশেষজ্ঞদের বারংবার সতর্কবার্তা, বৈজ্ঞানিকদের কাজে অসহযোগিতা, তথ্য লুকোনো ইত্যাদির ফলশ্রুতিতে এই দীর্ঘ মৃত্যু মিছিল, পরিজনদের চূড়ান্ত অসহায়ত্ব, জনসমাজে তীব্র আতঙ্ক, কাজ হারানো আর প্রশ্ন করা নাগরিক তথা বিরোধীদের উপর নেমে আসা রাষ্ট্রীয় দমন। এসব কিছুর জন্য দায়ী আত্মগর্বী প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর স্বৈরশাসনতন্ত্র। বিশ্বের বহু দেশেই অতিমারি মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায় নিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ৬ জনের মৃত্যু হওয়ায় মার্চে জর্ডনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। আর্জেন্টিনার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সরে দাঁড়িয়েছেন টীকাকরণে অনিয়মের অভিযোগে। অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, পেরুর স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন টীকাকরণ কর্মসূচি সাফল্যের সঙ্গে চালাতে না পারায়। অথচ সে লোকলজ্জার বালাই এদেশের রাষ্ট্রনায়কদের নেই।
রাষ্ট্রসংঘের ১৯৪৮-এর জেনোসাইড কনভেনশনে গণহত্যাকে স্বতন্ত্র, সুনির্দিষ্ট এবং আন্তর্জাতিকভাবে সংজ্ঞায়িত অপরাধ হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়। এযাবৎ ১৪৮টি দেশ এটি অনুমোদন করেছে। ইন্টারন্যাশানাল কোর্ট অব জাস্টিস পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে, এই কনভেনশনের নীতিমালা আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত আইন। যার অর্থ, কোনও রাষ্ট্র যদি জেনোসাইড কনভেনশন নাও অনুমোদন করে তা সত্ত্বেও এই নীতিমালা তথা আইন মেনে চলতে বাধ্য। ইন্টারন্যাশানাল ক্রিমিনাল কোর্টের রোম স্ট্যাট্যুটের ৬ নম্বর ধারায় সংজ্ঞায়িত হয়েছে গণহত্যা বা জেনোসাইড। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী এই দীর্ঘ মৃত্যু মিছিল, বিধ্বস্ত, ক্রমহ্রাসমান চিকিৎসা ব্যবস্থায় নাগরিকদের চূড়ান্ত অসহায়ত্ব, গভীর আতঙ্ক, চরমতম দুর্দশা পুরোটাই ঘটেছে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের সচেতন উপেক্ষায়, নিদারুন অসংবেদনশীলতায়, ব্যর্থতায়। এ অপরাধ গণহত্যার সামিল।