বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[খেলা]

[খেলা]

চলে যাওয়া ছাড়া আর কী বা করবার ছিল সুভাষ ভৌমিকের?

চলে যাওয়া ছাড়া আর কী বা করবার ছিল সুভাষ ভৌমিকের?

জয়দীপ বসু

photo

শ্রমজীবী ভাষা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— ২২ জানুয়ারি সকালে ভাল করে আলো ফোটার আগেই চলে গেছেন সুভাষ ভৌমিক। অসাধারণ ফুটবলার, চমৎকার কোচ এবং বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ইন্ডিয়ান সুপার লিগ নামক প্রতিযোগিতাটিকে নিয়ে তাঁর কিছু বিরূপ মন্তব্য ফুটবল মহলে ঝড় তুলেছিল। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে ছাপাও হয়েছিল সেই কাহিনী; একটি বিশেষ সংবাদপত্র তো ব্যাপারটিকে আরও রসালো করে তুলতে গিয়ে এমন কথাও লিখে বসেছিল যে সুভাষ নাকি আইএসএল-এর সপক্ষে এক প্রাক্তন ফুটবলার কথা বলতে এলে তাঁকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেছেন।

এরপর সবকিছু যেন বড় দ্রুত ঘটে গেছে। সুভাষ অসুস্থ থেকে অসুস্থতর হয়েছেন, তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে, এবং চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও নতুন বছরে সপ্তাহ তিনেকের বেশি ধরে রাখা যায়নি তাঁকে। সুভাষের মৃত্যুর সঙ্গেই চিরতরে সমাপ্ত হয়ে গেছে সত্তর দশকের বাঙালি ফুটবলারদের ঘিরে গড়ে ওঠা উজ্জ্বল ইতিহাসের আর একটি চমকপ্রদ পরিচ্ছেদ।

যথারীতি, আবেগের বান ডেকেছে এর পরে। ফুটবলার সুভাষ এবং কোচ সুভাষকে নিয়ে আপ্লুত বক্তব্য রেখেছেন প্রায় সবাই, এমনকি তাঁরাও, যাঁরা ক’দিন আগেও সুভাষের সঙ্গে প্রায় কোনও ব্যাপারেই কোনওদিনই একমত ছিলেন না।
অবাক হবার কিছু নেই, কারণ এটাই দস্তুর, এদেশে তো বটেই। মৃত্যুর সঙ্গে ধুয়ে যায় যাবতীয় মতবিরোধ, সদ্যপ্রয়াত মানুষটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে তাঁর ইতিবাচক দিকটিকে সন্দেহাতীতভাবে উপস্থিত করার প্রয়াসে সোৎসাহে অংশগ্রহণ করি আমরা সবাই।

তবু, একটা কথা আমাদের মানতেই হবে - দেশের বর্তমান ফুটবল নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মৃত্যুর পরেও কিন্তু শেষ হাসি হাসলেন সুভাষই। চলে যাবার ক’দিন আগে সুভাষ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে একটি সভায় পরিষ্কার বলেছিলেন, লাল-হলুদ দলকে আইএসএল খেলতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে! প্রয়োজনে ইস্টবেঙ্গল অন্য যাবতীয় টুর্নামেন্ট খেলুক; বিনিয়োগকারী এবং লিগ কর্তাদের সামনে নতমস্তক হয়ে এই বিপুল অর্থসমৃদ্ধ প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর কোনও সার্থকতা নেই। এই বক্তব্যের জন্য সুভাষ সেদিন ধিক্কৃত হয়েছিলেন, সত্তর দশকের আর এক ফুটবলারের সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় অবধি হয়েছিল।

এরপরেই সুভাষের প্রয়াণ। এবং তার ক’দিন বাদেই ইস্টবেঙ্গলের এক ডজন প্রাক্তন ফুটবলার, যাঁদের সবাই প্রায় একসময় সুভাষের সঙ্গে খেলেছেন, আইএসএল-এ ইস্টবেঙ্গলের ক্রমাগত বিপর্যয়ে আশঙ্কিত হয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। তাঁদের মূল বক্তব্য, ইস্টবেঙ্গলের আইএসএল খেলবার প্রয়োজন কি? এখানেই শেষ নয় - সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রাক্তন ফুটবলাররা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করেন, যাতে সুভাষের নাম করে জানানো হয় তিনিও এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত ছিলেন। সুভাষ থাকলে নির্ঘাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন।

সুভাষ কি সত্যদ্রষ্টা ছিলেন? সম্ভবত নয়। সম্ভবত কেন, একেবারেই নয়। সত্তর দশকের এই অতুলনীয় উইঙ্গার ছিলেন এক মাঠকাঁপানো ফুটবলার, ঘরোয়া ফুটবলে দু’শর ওপর গোল করেছেন, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল দুই দলকেই দু’হাত ভরে ট্রফি এনে দিয়েছেন, দেশের হয়ে খেলে জিতেছেন এশিয়ান গেমস পদক। কিন্তু তিনি আদতে ছিলেন একজন রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ মাত্র, তাঁর উত্থান পতনের যাবতীয় প্রমাণ ছড়িয়ে আছে আমাদের সামনে।

কিন্তু এতকিছুর পরেও সুভাষ নিঃসন্দেহে ছিলেন একজন প্রকৃত ফুটবলবোদ্ধা, স্বতস্ফূর্ত এবং কৃত্রিম উপস্থাপনার মধ্যে তফাৎ বুঝে নিতে তাঁর খুব বেশি সময় লাগত না। তাই বুঝি জীবনের শেষ পর্বে এসে ব্যক্তিগত আলাপের সময় বারবার বলতেন, হবেনা, এই আইএসএল দিয়ে কিছুতেই হবে না। এই ফুটবলে প্রাণ নেই, আছে শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। এদের সমাজের নিম্নস্তর থেকে ফুটবলার তুলে আনবার কোনও পরিকল্পনা নেই, ইচ্ছাও নেই। এরা চায় ভারতীয় ফুটবলকে টাকার জোরে কিনে নিতে, এই অর্থবৃত্তের বাইরে যারা আছে, তারা এদের কাছে ব্রাত্য।

আসলে সুভাষ যাবতীয় চোখধাঁধানো সাফল্য সত্বেও একটা কথা কোনওদিন ভুলতে পারেননি - তিনি ছিলেন এক প্রান্তিক শহর থেকে উঠে আসা ফুটবলার। সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে এসে প্রথমে কলকাতায় স্কুল ফুটবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন, তারপর দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন বড় দলে। শেষদিকে প্রায়ই বলতেন সেই লড়াইয়ের দিনগুলোর গল্প।

তা বলে কি সুভাষ ফুটবলে আধুনিকতার বিরোধী ছিলেন? একেবারেই নয়; আসলে এই তথাকথিত আধুনিকতা তাঁকে আকর্ষণ করতো না। দেশের ফুটবলপ্রেমীরা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না ২০০৩ আশিয়ান কাপের কথা; মহাদেশের যাবতীয় মানুষকে হতবাক করে দিয়ে জাকার্তা থেকে কাপ জিতে ফিরেছিল ইস্টবেঙ্গল, সুভাষের কোচিংয়ে। সেবার প্রথম কলকাতার ফুটবলে সুভাষ নিয়ে আসেন আধুনিক কোচিংয়ের যাবতীয় উপকরণ। তাঁরই কথায় ক্লাবে তৈরি হয় ফুটবলারদের আইস বাথ নেবার আলাদা জায়গা, জ্যাকুচি, এমনকি ফুটবলারদের অনুশীলনের দিনগুলোয় রাখা হয় পাঁচ তারা হোটেলে। জলের মত অর্থব্যয় দেখে তখন চোখ টাটিয়ে ছিল অনেকেরই, বিরূপ মন্তব্য করবার মত লোকের অভাব হয়নি। কিন্তু সেই মরশুমে সুভাষ প্রমাণ করে দেন তিনি ভুল করেননি। ট্রফিতে ভরে যায় ইস্টবেঙ্গলের তাঁবু, সর্বোপরি প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসাবে বিদেশ থেকে আশিয়ান কাপ জয় করে ফেরে সুভাষের লাল-হলুদ ব্রিগেড।

অনেকেই বলেন এক অসাধারণ তারকাখচিত দল নিয়ে সাফল্য পেয়েছিলেন সুভাষ। কে ছিল না সেই দলে? বাইচুং ভুটিয়া, মাইক ওকোরো, ডগলাস, মহেশ গাওলি, দেবজিৎ ঘোষ, সন্দীপ নন্দী, অ্যালভিটো ডিকুনহা...। এই দল যদি না জেতে, তবে জিতবে কারা?

cover

এবার শোনা যাক, কি বলছেন মহেশ গাওলি! তাঁর বক্তব্য, "আমি অনেক তারকাখচিত দলে খেলেছি। এমনকি পরবর্তীকালে যখন ডেমপো স্পোর্টস ক্লাব টানা পাঁচ-ছয় বছর ভারতীয় ফুটবল শাসন করেছে, তখনও সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি। কিন্তু আশিয়ান জয়ী ইস্টবেঙ্গলের মত সংঘবদ্ধ দল আমি আমার কেরিয়ারে দেখিনি। অসাধারণ ছিল আমাদের টিম স্পিরিট, একে অপরের প্রতি আনুগত্য। এবং এর মূলে ছিলেন কোচ সুভাষ ভৌমিক। টিমের প্রতিটি সদস্যের প্রতি ছিল তাঁর সমান মনোযোগ। এমনকি যাঁরা কোনওদিন প্রথম একাদশে স্থান পাবে না, তাঁদের প্রতিও সুভাষের ছিল সজাগ দৃষ্টি। ব্যাপারটা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল, যে দলের দ্বিতীয় একাদশ প্রথম একাদশের সঙ্গে সমান তালে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখত। ভারতীয় ফুটবলে আমার দেখা সেরা কোচদের মধ্যে থাকবেন সুভাষ।"

সুভাষ ভৌমিকের ফুটবলার জীবন এবং কোচিং জীবন, আদতে দুই ছিল বহু ওঠাপড়ার ইতিহাস। ১৯৭৩ সালে কার্টিলেজ ছেঁড়া সুভাষকে যখন মোহনবাগান ছেঁড়া জুতোর মত পরিত্যাগ করে, তখন প্রদীপ বন্দোপাধ্যায়ের কথায় তিনি যোগ দেন ইস্টবেঙ্গলে। পরবর্তী তিন মরশুম ছিল কলকাতার ফুটবলে আদতে সুভাষের মরশুম। তাঁর দাপটের সামনে শুধু মোহনবাগান নয়, ছিন্নভিন্ন হয় দেশের প্রায় প্রতিটি ক্লাব দল। লাইন দিয়ে ট্রফি ঢোকে ইস্টবেঙ্গলের তাঁবুতে - আজও যাকে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা বলেন তাঁদের স্বর্ণযুগ।কি ছিল না ফুটবলার সুভাষের ঝুলিতে? দেশের সবকটি বড় ট্রফি একাধিকবার, সন্তোষ ট্রফিতে দু’বার সেরা ফুটবলারের পুরস্কার, আন্তর্জাতিক ফুটবলে হ্যাটট্রিক, আন্তর্জাতিক আসর থেকে পদক - সবকিছুই পেয়েছেন তিনি। শুধু পাননি কোনও সরকারি স্বীকৃতি। চোখের সামনে দিয়ে অর্জুন পুরস্কার নিয়ে চলে গেছেন মগন সিং, গুরদেব সিংরা, সুভাষের কপালে জোটেনি কিছুই।

ফুটবলার এবং কোচ হিসাবে দুই বিভাগেই ভারতীয় ফুটবলে সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন যে হাতে গোনা কয়েকজন, তাঁদের মধ্যে সুভাষ একজন। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভারতীয় ফুটবলে তাঁর কোনওদিন কোনও জায়গা হলনা। গত কুড়ি বছরে ফুটবল ফেডারেশন কর্তারা তাঁকে কোনওদিন কোচিং করবার জন্য ডাক দিলেন না, এমনকি টেকনিক্যাল কমিটিতেও তাঁর স্থান হল না একবারও। শুধু সুভাষ কেন, দূরে সরিয়ে দেওয়া হল ভারতীয় ফুটবলের ভালমন্দের সঙ্গে এতদিন যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাইকে। পরিবর্তে আসর জাঁকিয়ে বসলেন একদল রাজনীতিক, কিছু কর্পোরেট জগতের আমলা, এবং এঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন গত কিছু বছরে গজিয়ে ওঠা একটি ব্যবসায়ী পরিবার, যাঁরা স্রেফ টাকার জোরে কুক্ষিগত করেছেন দেশের এই জনপ্রিয় খেলাটি। এখন এই ত্রহস্পর্শে দ্রুত নিম্নগামী ভারতীয় ফুটবল, কিন্তু প্রচারের ঢক্কানিনাদে নিয়মিত ডুবে যাচ্ছে তার আর্ত চিৎকার। এই পরিবেশে সারা জীবন ফুটবলকে প্রেমিকার মত ভালবেসে যাওয়া মানুষদের স্থান কোথায়? সুভাষ ভৌমিক মরে বেঁচেছেন, কথাটা রূঢ় শোনাবে; কিন্তু অন্য কিছু বলবার ম ত মানসিক জোরই বা পাওয়া যাচ্ছে কই?

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.