বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[খেলা]
শ্রমজীবী ভাষা ১ জানুয়ারি, ২০২২— ধরুন আপনি ১৯১১-র আইএফএ শিল্ডের উপর নির্মিত একটি সিনেমা দেখতে বসলেন। সেখানে কেবলমাত্র ‘সিনেমার স্বার্থে’ দেখানো হল, শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান হেরে গেল। অথবা ধরুন, আপনি ১৯৮৩-র ক্রিকেট বিশ্বকাপের উপর নির্মিত একটি সিনেমা দেখছেন। সেখানেও সিনেমারই স্বার্থে ফাইনালে ভারতকে নয়, বিজয়ী দেখানো হল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক প্রয়োজনে কল্পিত কাহিনির আশ্রয় নিতে পারেন, এমন যুক্তিতে আপনি কি মেনে নেবেন উপরোক্ত দু’টি ‘কল্পিত’ ঘটনাকে? খুব স্বাভাবিকভাবেই মানবেন না। কিন্তু এমনই ‘গল্পের গরুকে গাছে তুলে দেওয়ার’ মতো ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমা ‘গোলন্দাজ’-এ। কেবল এটুকুই নয়, এমন তথ্য বিকৃতি
ঘটছে খোদ অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএ)-এর ওয়েবসাইটেও। সিনেমা তথা এআইএফএ-র ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১৮৯২-এ প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কলকাতার শোভাবাজার ক্লাব। এমন ‘হারকাত’ একজন ক্রীড়াপ্রেমী হিসাবে বেশ কাহিল করেছে আমাকে। কারণ, কোথাও গিয়ে মনে হয়েছে, মোহনবাগানের ১৯১১-র আইএফএ শিল্ড জয়ের গরিমা এই আজগুবি ইতিহাসের মাধ্যমে খর্ব করা হয়েছে। মনে হয়েছে, আজব রকম কল করেছেন চণ্ডীদাসের খুড়ো। আর তা শুনে সবাই শাবাশিও দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল চণ্ডীদাসের খুড়োটিকে, তা হয়তো কেউ জানে না।
সিনেমার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ধ্রুব ব্যানার্জি পরিচালিত সিনেমা ‘গোলন্দাজ’ দেখে জানতে পারলাম ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধকারী মৃত মানুষ (বন্ধু)-এর দেহ তুলে এনে ড্রেসিংরুমে (তখনকার দিনে তাঁবু) রেখে দ্বিতীয়ার্ধে ফাইনালে খেলতে নেমেছিলেন! তারপর দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে নেমে সেন্টার লাইনে গানও গেয়েছিলেন! এমন ভয়াবহ তথ্য কোথা থেকে তিনি পেলেন? তাছাড়াও ইতিহাসের দিক থেকে দু’-দু’টি বড় বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। প্রথমত, সেই সময় (১৮৯২) ট্রেডস কাপ ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর টুর্নামেন্ট। এবং শোভাবাজার ক্লাব প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে ব্রিটিশ ক্লাব ইস্টসারে রেজিমেন্টকে হারিয়েছিল বটে, কিন্তু তা ছিল সেই বছর ওই টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ। দ্বিতীয় রাউন্ডেই পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল শোভাবাজার। তাই শোভাবাজার ক্লাবের ট্রফি জয়ের কোনও প্রশ্নই ছিল না। সাফল্যের প্রশ্নে শোভাবাজার ক্লাবের সাফল্যের ভাঁড়ার ছিল শূন্য। তাই চিত্রনাট্যকার কল্পিত ইতিহাসের সাহায্যে শোভাবাজারের এই জয়কে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থাপন করার এক হাস্যকর প্রয়াস করেছেন মাত্র।
দ্বিতীয়ত, সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর হয়ে কেস লড়েছিলেন ১৮৯২-এর ট্রেডস কাপের ফাইনালের ঠিক আগে। চিত্তরঞ্জন ১৮৭০-এ জন্মেছিলেন। নগেন্দ্রপ্রসাদ জন্মান ১৮৬৯-এ। ১৮৯২-এ ট্রেডস কাপের সময় চিত্তরঞ্জনের বয়স ছিল বাইশ বছর। দেশবন্ধুর জীবনী অনুযায়ী, সেই সময় (১৮৯০-১৮৯৪) ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করছিলেন চিত্তরঞ্জন। বিলেত থেকে ছুটিতে এসে নগেন্দ্রপ্রসাদের হয়ে কেস লড়েছিলেন তিনি! ভাবুন একবার, যে মানুষটা ১৮৯৪-এ কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসাবে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেছিলেন, ঠিক সেই মানুষটাই অদৃশ্য কোনও জাদুবলে এর ঠিক দু’বছর আগে নগেন্দ্রপ্রসাদের হয়ে কেস লড়ছেন। ভয় হয়, তরুণ ক্রীড়াপ্রেমী এবং সাধারণ মানুষের কাছে এই কল্পিত ইতিহাসই সত্যিকারের ইতিহাস রূপে ধরা দেবে না তো?
‘স্টেটসম্যান’-এর প্ৰথম অশ্বেতাঙ্গ ক্রীড়া সম্পাদক রাখাল ভট্টাচার্যের বিখ্যাত এক গ্রন্থের নাম ‘কলকাতার ফুটবল’। বইটিকে কলকাতার ফুটবলের ধর্মগ্রন্থ বলা হয়ে থাকে। বইটির ৯৯-১০০ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে― “১৮৮৯ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে খাঁটি স্বদেশী ট্রেডস-বিজয়ী দল বলতে শুধু মোহনবাগান আর ন্যাশনাল। প্রথম দশ বছরে কোচবিহার কাপ ওরাই জেতে ছ’বার। ১৯১২ সালে শেষবার ট্রেডস কাপ পায়। এর পরই ন্যাশনাল দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯১৫ সালে মোহনবাগান এসে তাদের মাঠ দখল করে। ন্যাশনালের অবশ্য মাঠই ছিল, নিজস্ব তাঁবু তারা তৈরি করেনি। র্যা লি ব্রাদার্স ক্লাবের তাঁবু ব্যবহার করেছে। ১৯২৪ সালে শোভাবাজারের সঙ্গে একই সঙ্গে আইএফএ-র সদস্য তালিকা থেকে ন্যাশনালের নাম কাটা যায়।”
যে-বছর কলকাতার বুকে মোহনবাগান ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে-বছরই শুরু হয়েছিল ট্রেডস কাপ। এই প্রতিযোগিতার প্রথম পাঁচ বছরের খেতাব অর্জনকারী দলগুলি যথাক্রমে― ডালহৌসি (১৮৮৯), দি বাফ্স রেজিমেন্ট (১৮৯০), সেকেন্ড কিংস লিভারপুল রেজিমেন্ট (১৮৯১), ফার্স্ট ইস্ট ল্যাঙ্কাশায়ার রেজিমেন্ট (১৮৯২) এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ (১৮৯৩)। এর পরের ছ’বছরও ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি কোনও ভারতীয় ক্লাব। ততদিনে অবশ্য নগেন্দ্রপ্রাসাদ সর্বাধিকারীর শোভাবাজার ক্লাব ২-১ গোলে ব্রিটিশ ক্লাব ইস্ট সারে রেজিমেন্টকে হারিয়ে ভারতীয় ফুটবলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু যদি প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন কারা হয়েছিল, এই প্রশ্ন করা হয়, উত্তর হবে, মন্মথ গাঙ্গুলির ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন। ১৯০০ সালে ব্রিটিশ ছাত্রদের নিয়ে গড়া ১৮৯৬-এর ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন শিবপুর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে হারিয়ে প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন।
কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘Scoring Off the Field’ গ্রন্থের ‘‘Culture of a ‘Masculine’ English Game”-এ জে. এন. বসুর ‘My Reminiscences’, in Pankaj Kumar Gupta, ed, IFA Golden Jublee Souvenir, Calcutta: IFA, 1943 থেকে উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, “The win of Sovabazar Club over the military team, the East Surrey Regiment, by 2–1 in the 1892 Trades Cup was the first prominent victory of an Indian team at competitive level. Newspapers in England gave prominence to the result, and some concern was expressed at the win of an Indian team against a team representing a British Regiment!” (Pg. 38). অর্থাৎ ১৮৯২-এর ট্রেডস কাপে ব্রিটিশ সামরিক দল ইস্ট সারে রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে শোভাবাজার ক্লাবের ২-১ ব্যবধানে জয় ছিল প্রতিযোগিতামূলক স্তরে কোনও ভারতীয় দলের প্রথম জয়। ইংল্যান্ডের সংবাদপত্রগুলিও এই ফলাফলকে গুরুত্ব দিয়েছিল। যদিও ব্রিটিশ রেজিমেন্টের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দলের বিরুদ্ধে ভারতীয় দলের এই জয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছিল। ইতিহাস বলছে, এরপর ট্রেডস কাপ দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইউরোপীয়, ভারতীয়, আর্মেনিয়ান এবং ছাত্র-সহ সমস্ত কমিউনিটি ও ক্যাটিগরির ক্লাবগুলিই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। তাছাড়াও ১৮৯২-এ ভারতীয় ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) গঠন হয়েছিল। যা ছিল নিছক আনুষ্ঠানিকতা। নগেন্দ্রপ্রসাদ ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তিই এই বিষয়ে উদ্যোগী হননি। তিনি ১৮৯২-এ ফুটবল মরশুমের শেষের দিকে শোভাবাজার ক্লাবের তাঁবুতে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে দু’টি শীর্ষস্থানীয় সমসাময়িক ইউরোপীয় ক্লাব— কলকাতা ফুটবল ক্লাব এবং ডালহৌসি ক্লাবের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের আমন্ত্রণ জানান। ডালহৌসি ক্লাবের অনারারি সেক্রেটারি মি. এআর ব্রাউন, একই ক্লাবের বিশিষ্ট খেলোয়াড় মি. বিআরসি লিন্ডসে, কলকাতা এফসি-র মি. ওয়াটসন সেই বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন। ভারতীয় ফুটবলের সমস্ত স্ট্যান্ডার্ড ক্রনিকেল এই সময়েরই সাক্ষ্য করে। একে যথাক্রমে ১৯৪৩ এবং ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের গোল্ডেন জুবিলি এবং ডায়মন্ড জুবিলি স্যুভেনিরও সমর্থন করে। এছাড়াও ৮ জুলাই ১৯৩৪ সালের স্টেটসম্যান-ও এই যুক্তিকেই অটল রাখে। আধুনিক ক্রীড়া সংস্কৃতির জনপ্রিয় সাধনায় বাঙালি সমাজকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টায় নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী অবশ্যই অগ্রণী ছিলেন। বাঙালির শারীরিক ও ক্রীড়া দক্ষতা বাড়াতে নগেন্দ্রপ্রসাদের আজীবন প্রচেষ্টাকে ভারতে সামাজিক সংস্কার ও নবজাগরণের বিস্তৃত পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করা যেতে পারে, যা রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোত্থাও উল্লেখ নেই যে, শোভাবাজার ক্লাব ১৮৯২ সালে ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তাছাড়াও ফুটবল গবেষক শুভ্রাংশু রায়, সৌমেন মিত্রের গবেষণাও আমাদের সামনে এমন তথ্য তুলে ধরে না, যেখানে শোভাবাজার ক্লাবকে ১৮৯২-এর ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন বলা হয়েছে। তাই এত বড় একজন প্রবাদপ্রতিম মানুষকে নিয়ে ‘গোলন্দাজ’ নামক সিনেমাটি নির্মাণের আগে আরও চর্চার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, ‘চর্চাই শ্রেষ্ঠ বিকল্প’— সবার আগে একথা মেনে চলা বা ভাবার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। ঠিক যেমনটা মানা হয়নি অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের ওয়েবসাইটেও। সিনেমা হলে হোক মন্মথ গাঙ্গুলির ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনকে নিয়েও। কারণ, প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারাই।