বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[খেলা]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২— বাসে আমার পাশে থাকা ফাঁকা সিটটায় বসলেন এক যুবক। তাঁর মুখে মাস্ক নেই। তাঁকে মুখাবয়ব পরবার স্বাভাবিক অনুরোধ জানালাম। আমার কথা শুনে নিস্পৃহ ভাবে চেয়ে সেই যুবক বললেন, “তা ভাই এই যে মাস্ক ও ভ্যাকসিন আদৌ কি করোনা ঠেকাতে পারে? যদি পারেন তো লিখিত প্রমাণ দিন।” আমি শুনে রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “লিখিত প্রমাণ মানে! এই যে এত প্রচার হচ্ছে, তা মিথ্যা নাকি?” শুনে আবারও শান্ত এক দৃষ্টিতে বলে বসলেন, “কাগজ পড়েন? নিউজ দেখেন? জোকোভিচকে চেনেন? সেও কিন্তু ভ্যাকসিন নেয়নি। অথচ দেখুন কেমন ড্যাংড্যাং করে মেলবোর্ন পৌঁছেছে টেনিস খেলবে বলে। সে তো ভ্যাকসিন নেবে না বলে কলার ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার বেলা?” আমি বললাম, “সে তো দেশের বাইরের ব্যাপার। তাতে আপনার কি? আপনি আমার পাশে বসে আছেন তো মাস্ক পরে নিন। এতে দশজনের ভালো।” ব্যাপারটা অতটা সহজ ছিল না। ওই যুবক মাস্ক তো পরলেনই না, বরং জোকোভিচ প্রসঙ্গ আউড়েই গেলেন। বুঝলাম, এই ভারতের মতো ক্রিকেটপাগল দেশে টেনিস নিয়েও মাতামাতি করারও লোক আছে। আমি ততক্ষণে প্রাণ হাতে করে আমার গন্তব্যে এসে পৌঁছেছি। নইলে আরও কিছুক্ষণ আমার 'ক্লাস' নিতেন সেই মুখাবয়বহীন যুবক।
এভাবেই বিশ্বের এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড় ওই যুবকটির মতো বহু মানুষের জন্যই যেন নিজের অজান্তেই চিত্রনাট্য লিখছিলেন। ঘটনার সূত্রপাত বেশ কিছুদিন আগে। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলতে যেদিন নোভাক জোকোভিচ মেলবোর্ন বিমানবন্দরে পৌঁছলেন, সেদিন থেকে জোকোভিচ ও অস্ট্রেলিয়া সরকারের ভ্যাকসিনের নিয়ম নিয়ে রীতিমতো ধুন্ধুমার লাগে। করোনার টিকা না নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলতে মেলবোর্নে পৌঁছেছিলেন ২০ বারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন জোকোভিচ। এদিকে অস্ট্রেলিয়া তাঁর ভিসা বাতিল করে দেয়। এরপর তাঁকে মেলবোর্নের পার্ক ইন হোটেলে রাখা হয়। এটি এমন এক হোটেল, যাকে অভিবাসন মামলায় আটকে থাকা মানুষের কারাগারও বলা হয়। অর্থাৎ এখানে এমন লোকদের রাখা হয় যাঁরা ভিসা, পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়ে আটকে পড়েছেন বা আশ্রয়ের আশায় অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করেছেন। এককথায় শরণার্থীদের সঙ্গে 'রিফিউজি' হোটেলে রাখা হয় জোকোভিচকে।
তখন হোটেল পার্কে বিভিন্ন দেশের ৩২ জনের মতো অবরুদ্ধ। এর মধ্যে কয়েকজন আবার প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া বাইরে বেরোতে পারেন না। সবসময় পাহারার মধ্যে এঁদের থাকতে হয় একটি ছোট ঘরে। কখনও কখনও যে খাবার তাঁদের খেতে দেওয়া হয়, সেখানে পাওয়া যায় পোকামাকড়। আবার যে কামরায় তাঁদের থাকতে দেওয়া হয়, তাও বেশ অপরিচ্ছন্ন। এমনই অভিযোগ এখানে আটক লোকজনরা বহুবার করেছেন। এমন একটি ইমিগ্রেশন হোটেলে টিকাবিহীন এই টেনিস তারকাকে চার রাত আটকে রাখার পর মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। জোকোভিচ যে ফেডারেল সার্কিট কোর্টে মামলা করেছিলেন, সেই আদালতের বিচারক অ্যান্টনি কেলি জকোভিচের ভিসা ফেরত এবং অবিলম্বে রিফিউজি হোটেল থেকে তাঁর স্থানান্তরের আদেশ দিয়েছিলেন। আইনজীবীরা বলেছিলেন, যেহেতু তিনি সুস্থ, তিনি কোভিড আক্রান্ত নন, তাই 'জোকারে'র (ভক্তরা ভালোবেসে ডাকেন) টিকা নেওয়ার দরকার নেই। যদিও বিতর্ক এখানেই থামেনি।
সরকারি আইনজীবী ক্রিস্টোফার ট্রান বিচারককে বলেছিলেন, “অভিবাসন মন্ত্রী অ্যালেক্স হক ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন কিনা, তা বিবেচনা করবেন।” সুতরাং অর্থটাও মোটামুটি স্পষ্ট ছিল তখন থেকেই যে, ৯ বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন আবার না নির্বাসিত হন! এরপর আদালত ১৩ জানুয়ারি জানায়, অস্ট্রেলিয়া ওপেন খেলবেন জোকোভিচ। তা সত্ত্বেও অভিবাসন মন্ত্রী কী করেন, সেই দিকে নজর ছিল সবার। কারণ, করোনা ভ্যাকসিনেশন নিয়মে চিকিৎসা সংক্রান্ত মানদণ্ড পূরণ না করা (এমনটাই অভিযোগ) জোকোভিচের বিরুদ্ধে অভিবাসন মন্ত্রী অ্যালেক্স হক আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে জোকোভিচের ভিসা প্রত্যাহারের কথা ভাবছেন, কানাঘুসো এমনই চলছিল। শেষমেশ এহেন অ্যালেক্স হকই ১৪ জানুয়ারি, শুক্রবার, অস্ট্রেলিয়ান সংবিধানের ১৩৩সি(৩) ধারা অনুসারে ব্যক্তিগত কর্তৃত্বের ব্যবহার করে জোকোভিচের ভিসা বাতিল করে দিলেন। তাতে বলা হল, স্বাস্থ্য এবং শৃঙ্খলার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ, অস্ট্রেলিয়া সরকার তাদের সীমান্ত রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশেষ করে কোভিড ১৯-এর মতো অতিমারির সঙ্গে আপস করতে কোনও অবস্থাতেই রাজি নন তাঁরা। সুতরাং, অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে ১০ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন আপাতত ভেস্তে গেল জোকোভিচের। এখন তাঁর বয়স ৩৪। এরপর যদি উপযুক্ত নথি না দেখাতে পারেন তিনি, আগামী ৩ বছর অজিভূমে পা রাখতে পারবেন না জোকার। তাহলে ফিটনেস ধরে রাখতে না পারলে আর হয়তো কোনও দিনই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলাও হবে না তাঁর। কারণ, ৩ বছর পর জোকোভিচের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৩৭।
কিন্তু এরজন্য তাঁকে শুনতে হল, তিনি 'ভ্যাকসিন বিরোধী'। অস্ট্রেলিয়া সরকার বলল, কোনও এক ব্যক্তির জন্য নিয়ম পরিবর্তন করা যাবে না। এটা গোটা দেশকে মহামারি থেকে রক্ষা করার ব্যাপার। একদল বলল, জোকোভিচের মতো মানুষরা অ্যান্টি-ভ্যাকসিন প্রচারের অংশ। করোনাকে হারাতে ভ্যাকসিন প্রয়োজন। তাই সেলিব্রেটিরা এ-ধরনের প্রতিবাদ করলে সমাজের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তবে, জেলের মতো হোটেলে জোকোভিচকে রাখার বিরোধিতাও করেছেন অনেকেই। এই বিষয়ে তাঁরা প্রতিবাদ করছেন। শত হলেও একজন টেনিস খেলোয়াড়ের সঙ্গে ভালো আচরণ করা উচিত বলেও সোচ্চার ছিল তাঁরা। জোকারের ফ্যানেরা বলছিলেন, কোনও নিয়মই এত কঠোর হওয়া উচিত নয়। জোকোভিচের যদি করোনা না থাকে এবং তিনি অন্যদের জন্য বিপজ্জনক না হন, তাহলে তাঁর খেলার সুযোগ পাওয়া উচিত। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন তিনি খেলবেন না। সুতরাং টিকা না নিয়েই খেলার ব্যাপারে যে চিত্রনাট্য তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ করে উঠতে পারলেন না তিনি।
বাসের সেই যুবকটিকে আজ পেলে হয়তো এই ঘটনাই আউড়াতাম। তবুও খারাপ একটু লাগছেই জোকোভিচের মতো খেলোয়াড়ের জন্য। অস্ট্রেলিয়া সরকারের সঙ্গে জকোভিচের চলমান বিতর্ক যখন মধ্যগগনে, তখন টেনিস তারকার ভাই জর্দজে জোকোভিচ সার্বিয়ার বেলগ্রেডে টেলিভিশন পরভা-কে বলেছিলেন, “অবশ্যই এটা রাজনীতি। এসবই ছিল একটা রাজনীতিই।” স্প্যানিশ টেনিস তারকা রাফায়েল নাদাল এই বিতর্কটিকে 'একটি সার্কাস' আখ্যা দিয়েছিলেন। নাদাল ১০ জানুয়ারি স্পেনের ওন্ডা সিরো রেডিয়ো-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ-কথা বলে জোকোভিচের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে খেলার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়ের যে টেনিস কোর্টে নামার পূর্ণ অধিকার আছে, সে-কথাও বলেছিলেন নাদাল। আসলে, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের রক্ষণশীল সরকার আগামী মে মাসের মধ্যে চতুর্থ মেয়াদে পুনরায় নির্বাচন করতে চাইছে। জোকোভিচের সঙ্গে এমন আচরণ সেই নির্বাচন কর্মসূচির অঙ্গ নয় তো? প্রশ্নটা কিন্তু উঠেই গেল।