বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[খেলা]
‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর একটা প্রতিবেদন পড়ছিলাম। লিখেছেন মহম্মদ ইজাজ। তাঁর পরিচয়, তিনি পাকিস্তানি কিংবদন্তি স্প্রিন্টার আব্দুল খালেকের ছেলে। ইজাজ মিলখার মৃত্যুতে মর্মাহত। ইজাজ লিখেছেন, মিলখা সিংয়ের মৃত্যু ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশের পক্ষেই ক্ষতি। ট্র্যাক অন ফিল্ডে মিলখা সিং এবং আব্দুল খালেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এই দুই অ্যাথলেটের মধ্যে অনেক মিলও ছিল। রাওয়ালপিন্ডির জিন্দ আওয়ান গ্রামে বেড়ে ওঠা খালেকও প্রবল দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত মানব হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন। মিলখা সিংয়ের মতো তিনিও সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সেটি ছিল আর্মি ট্রেনিং। এই ট্রেনিং এবং দৌড়ের প্রতি অনুরাগই ইজাজের কিংবদন্তি বাবাকে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত এশিয়ার দ্রুততম মানুষ হতে সাহায্য করেছিল। মিলখা সিংয়ের জীবনটাও অনেকটা এরকম। স্বাধীনতার দু’বছর পর সেনায় যান তিনি। ব্যর্থ হন। এর পরের বছর আবারও ব্যর্থ হন। কিন্তু মাকড়সার সেই গল্পের মতোই ১৯৫২-তে ব্যর্থতার সিঁড়ি টপকে ৩৯ টাকা ৮ আনা মাইনের চাকরি মেলে তাঁর ভারতীয় সেনায়। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর যেন শৃঙ্খলাপরায়ণতার তালিম হয় মিলখার। যা দৌড়ের ট্র্যাকেও তাঁকে করে তুলেছিল ব্যতিক্রমী।

এ লেখা মিলখা সিংকে নিয়ে। তবে, এ লেখা যে পাকিস্তানি অ্যাথলেট আব্দুল খালেককে নিয়ে নয়, তাও কিন্তু নয়। উপমহাদেশের অন্যতম ট্র্যাজিক ঘটনা দেশভাগের পর প্রায় দেড় কোটি মানুষ এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হন। বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম মানব অভিবাসন বলা হয়ে থাকে একে। সেই সময়কার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত গোবিন্দপুরা গ্রামে মিলখার পরিবার রক্তাক্ত হয়েছিল। এই সময় তাঁর মা-বাবা সহ সাত ভাইবোনকে মিলখার চোখের সামনে হত্যা করা হয়, যাঁরা রাজপুত পরিবারভুক্ত। এমন ঘটনা তাড়িয়ে বেড়াত মিলখাকে। এর পরবর্তীতে সেনায় যোগ এবং ১৯৫৬-র অলিম্পিকে ব্যর্থতাও ছিল। ব্যর্থতার পরেই বদল আসে মিলখার জীবনে। ১৯৫৮-র কমনওয়েলথ গেমসে সোনা পান। পরিচিতি বাড়তে থাকে। ১৯৬০-এর অলিম্পিকে অল্পের জন্য পদক হাতছাড়া হওয়া এবং মিলখার সেই ‘টার্ন ব্যাক’ তো মিথের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কেমন ছিল, অলিম্পিকের সেই ফাইনালের পরিবেশ? একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ইতালির সমস্ত ম্যাগাজিনের পাতা জুড়ে রীতিমতো তাঁর বন্দনা। গোটা ভারত তাঁর দিকে তাকিয়েছিল। প্রথম ২০০ মিটার এতটাই জোরে দৌড়েছিলেন যে, তাঁর আশপাশে কেউ ছিলেন না। কিন্তু রেসটা ছিল ৪০০ মিটারের। তাই স্পিড কমিয়েছিলেন, কারণ মিলখা ভেবেছিলেন, এমন গতিতে দৌড়লে হাঁফ ধরতে পারে। হয়তো এটাই কাল হয়েছিল। তাই শেষ একশো মিটার প্রাণপণ চেষ্টাতেও পদক ঝোলেনি তাঁর গলায়। ফোটো ফিনিশিংয়ে হাতছাড়া হয় পদক। কিন্তু এ-কথা অনেকেই জানেন না যে, এই রোম অলিম্পিকে সোনা জিতেছিলেন যিনি, সেই ওটিস ডেভিসও চিন্তায় ছিলেন মিলখাকে নিয়ে। ওটিস ডেভিস এখন থাকেন নিউ জার্সিতে। তাঁর বয়স ৮৮। রোম অলিম্পিকে মিলখা ছিল ডেভিসের পছন্দের অ্যাথলেট। তাই চিন্তায় রাখা মিলখাকে হারানোর জন্য তাঁর কাছে একটাই দাওয়াই ছিল, আর তা হল― মিলখার চেয়ে জোরে দৌড়নো। আজও তিনি বলেন, “ওহ ম্যান, মিলখা খুবই দ্রুত ছিলেন।” এ যেন এক কিংবদন্তির আর এক কিংবদন্তিকে দেওয়া অপূর্ব এক শ্রদ্ধার্ঘ।
“যাঁরা কেবল ভাগ্যের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকেন, তাঁরা কখনোই সাফল্য পেতে পারেন না।” এক সাক্ষাত্কারে মিলখা সিংহের এই কথাগুলি বলেন, তাঁর সংগ্রামের দিনগুলি থেকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছনোর গল্প বলতে গিয়ে। মিলখা সিং ৯১ বছর বয়সে ১৯ জুন রাতে চণ্ডীগড়ের এক হাসপাতালে প্রয়াত হন। পাকিস্তানের গোবিন্দপুরায় জন্ম নেওয়া, মিলখা সিংকে দেশভাগের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। তৎকালীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রিয়জন হারানোর দুঃখ সারাজীবন বয়ে বেড়ানো মিলখা ট্রেনের মহিলা বগির সিটের নিচে লুকিয়ে দিল্লি পৌঁছেছিলেন। এরপর শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করে, ধাবায় বাসন মেজে জীবন ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এমন কী দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে জুতো পর্যন্ত পালিশ করতে হয়েছিল তাঁকে। এই সময়েই পুরনো দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনের সামনের ফুটপাথে নির্মিত ধাবাগুলিতে বাসন মাজার কাজও করতেন তিনি। বিনিময়ে মিলত কিছু খাবার। অভাবের তাড়নায় একটা সময় তো মালগাড়ির কয়লা কিংবা চাল চুরি করে দিল্লির খোলা বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের জালে ধরাও পড়েছিলেন তিনি। রাত কাটাতে হয়েছিল তিহার জেলে। কারাগারে তাঁর পাশে সেই সময় ছিল দাগি ডাকাতরা। তাঁর বোন গয়না বিক্রি করে ২৫ টাকা জরিমানা দিয়ে মিলখাকে জেল থেকে মুক্ত করেছিলেন।
বিপথে বইতেই পারত মিলখার জীবন। কিন্তু যাঁর লক্ষ্য আকাশে, তিনি উড়বেনই। সেনায় যোগ, সেখান থেকে অলিম্পিক, ব্যর্থতা... আবার ১৯৫৮-র কমনওয়েথ গেমসে সোনা জিতে দেশে ফেরার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যখন মিলখাকে পুরস্কার চাইতে বলেন, তখন তিনি পুরস্কার হিসাবে কি চেয়েছিলেন জানেন? একদিনের জাতীয় ছুটি। এরপর এলো সেই ১৯৬০। অলিম্পিকে অল্পের জন্য পদক হাতছাড়া হওয়ার আপশোস এবং তারই মধ্যে এলো পাকিস্তানে গুডউইল গেমসে অংশগ্রহণ করার সুযোগ। প্রথমে রাজি ছিলেন না তিনি। অবশেষে নেহরুর অনুরোধে পাকিস্তানে গিয়ে সে দেশের সেরা দৌড়বীর আব্দুল খালেককে ৪০০ মিটার দৌড়ে পরাজিত করেন। রেস শেষে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান মিলখা সিংকে ‘ফ্লাইং শিখ’ বা ‘উড়ন্ত শিখ’ নামে অভিহিত করেন। মিলখা সিংকে জেনারেল আয়ুব খান যেমন ‘ফ্লাইং শিখ’ বলে অভিহিত করেছিলেন, অনেকেই জানেন না যে, ১৯৫৪ সালের ম্যানিলায় এশিয়ান গেমসের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আব্দুল খালেককে বলেছিলেন ‘ফ্লাইং বার্ড অব এশিয়া’ বা ‘এশিয়ার উড়ন্ত পাখি’। এই আব্দুল-পুত্রের লেখা পড়তে পড়তে জেনেছি যে, ৪০০ মিটারের দৌড়ে পরাজিত হওয়ার পর তাঁরা নেমেছিলেন রিলে রেসে, যেখানে পরাজিত হয়েছিলেন মিলখারা। সেই রেসে নামার আগে মিলখা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন আব্দুল খালেক। মিলখা সিংকে দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘‘মিলখা সাহাব, আব জোর লাগানা।’’ তাঁরা এমনই সম্মান করতেন একে অপরকে। আর আব্দুল-পুত্র মহম্মদ ইজাজের সঙ্গে মিলখা সিংয়ের প্রথম দেখা হয় ২০০৯ সালে, ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ বায়োপিক তৈরি সময়। ইজাজকে দেখে মিলখা সিং বলেছিলেন, ‘‘পুত্তর, তেরা বাপু বহত ওড়দা অ্যাথলিট থা (ছেলে, তোমার বাবা দুর্দান্ত অ্যাথলেট ছিলেন)। আমি তাঁকে পরাজিত করে ফ্লাইং শিখ হয়েছি। আমার খ্যাতি তাঁর কারণেই।” হৃদয় সোনার না হলে এমন কথা কে বলতে পারেন? জানা যায় যে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যুদ্ধবন্দি ছিলেন খালেক। জেলে সেই সময় মিলখা সিং গিয়ে জেল আধিকারিকদের বলে এসেছিলেন, যেন বাড়তি যত্ন নেওয়া হয় ‘এশিয়ার উড়ন্ত পাখি’কে।
কেমন ছিল এই পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতা? পাকিস্তানের ক্রীড়া সাংবাদিক সাদ সাদিক লিখেছিলেন যে, ‘‘মিলখা সিং তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমরা ৫০ জন অ্যাথলেট বাসে করে পাকিস্তানে পৌঁছেছি। ওয়াঘা সীমান্ত থেকে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা তাঁকে একটি খোলা জিপে রেখেছিলেন, আমি কখনোই ভুলব না যে, কয়েক হাজার পাকিস্তানি আমাকে স্বাগত জানিয়েছিল। এ থেকে এটা পরিষ্কার ছিল যে, ভারত ও পাকিস্তানের মানুষ একে অপরকে ঘৃণা করে না।’...’’ মিলখার মৃত্যুর পর আব্দুল খালেকের স্ত্রী ভালাওয়াত বেগম গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে শুধু ভারত নয়, শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে পাকিস্তানেও। অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের যে গ্রামে মিলখা সিং জন্মেছিলেন, সেই গোবিন্দপুরা গ্রামের বাসিন্দারা শোকবার্তা পাঠিয়েছেন মিলখার প্রয়াণে। মিলখা সিংহের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পাকিস্তানের গোবিন্দপুরা (বর্তমান নাম বস্তি বুখারিয়া)-র কোট আদ্দু গ্রামের তহসীন কাসিম টুইট করে একটি ভিডিয়ো শেয়ার করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, ‘‘মিলখা সিং কোট আদ্দুতে আসতে চেয়েছিলেন, যেখানে তাঁর জন্ম হয়েছিল। এটিই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা।’’ ইংরেজরা মানচিত্রের ওপর দিয়ে রেখা টেনে দিলেও মনের মানচিত্র যে ভাগ হয়নি, এই ঘটনাগুলিই তার প্রমাণ।