বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[খেলা]

[খেলা]

কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল

কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল

উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়

photo

বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু একটা খেলা তো নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে সমাজ, সভ্যতা, আনন্দ ও যন্ত্রণা। তাই বিশ্বকাপ শেষ হলেও এখনও চর্চা চলছে। ১৯৮২ সাল থেকে সরাসরি দূরদর্শনে খেলা দেখলেও এবারের মতো এতো সুন্দর বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দেখিনি। ৮০ মিনিট ধরে একপেশে খেলার পর মাত্র ৯৭ সেকেন্ডে খেলার রঙের বদল হয়ে গেল। ১৯৬৬ সালে জিওফ হান্টের পর ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে, কিলিয়ান এমবাপের হ্যাটট্রিক। পর পর ২টি বিশ্বকাপ ফাইনালে ৪ গোল।
গোটা বিশ্বের মানুষ দেখলো, ট্রাইবেকার এবং বিশ্বকাপের খেলা শেষ। বিশ্বকাপ মেসির হাতে। এছাড়া সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপে যে সব ছবি সামনে এসেছে তার মধ্যে মূলত আলোচনা করতে চাই, মানবাধিকার, কুসংস্কার, দুর্নীতি, শরনার্থী সমস্যা নিয়ে।

মানবাধিকার


সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাশোগির তার দেশের অমানবিক ও মহিলাদের প্রতি নিম্নস্তরের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করার জন্য তার ওপর নেমে এসেছিল রাষ্ট্রের আক্রমণ। তাই সে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। একদিন তিনি জরুরী কাজে ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের দূতাবাসে এসেছিলেন। সেখানেই তাঁকে গলাটিপে খুনের পর এসিডে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে খুনের কথা সৌদি অস্বীকার করলেও অনেক টালবাহানা করে পরে তারা এই সাংবাদিক যে খুন হয়েছেন তা মেনে নেয়। অবশ্য তারা বলে, খুনের ঘটনা ঘটলেও যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন কিছুই জানত না। তদন্ত এগোলে বিশ্ববাসী জানতে পারে, আসলে যুবরাজরের নির্দেশ মেনেই খুন করা হয়েছিল ওই সাংবাদিকে। এই সৌদি আরবই আগামী ২০৩০এর বিশ্বকাপের আয়োজনে ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ করে ভোট দিয়েছে আমেরিকার পক্ষে। তারা বিবৃতিতে বলেছে, আমেরিকা সৌদির পরম মিত্র। এরপর যখন দেখলাম ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের সমাপ্তি হওয়ার পরেই পর্তুগাল দলের এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনান্ডো বিশাল অর্থের বিনিময়ে খেলতে গেলেন, ওই মানবতার শত্রু সৌদি আরবে ক্লাব ফুটবল (আল নাসের ক্লাবে)। না আমি ফুটবল প্রেমিক হিসেবে কিছুতেই মানতে পারিনি, যন্ত্রণা পেয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি। বুঝতে পারছি আধুনিক ফুটবলের চালিকাশক্তি বৃহৎ দখলে চলে গেছে।
আমি কি শুধুই এই সৌদি আরবে অর্থের খোঁজে খেলতে আসা প্রিয় ফুটবলারকে দেখতে চাই। ফুটবল কি শুধুই খেলোয়াড়দের পায়ের শৈলী বা শিল্পের উচ্চ মানে মজে থাকা। এটাই কি হবে আমার তাদের প্রতি সমর্থনের ভিত্তি!
কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের পরিকাঠামো নির্মাণেও উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল নির্মাণ শ্রমিকরা গিয়েছিলেন হাজার হাজার। কাজ চলছে ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত। এই বিশাল কর্মকাণ্ড সার্থক হয়েছে তাদেরই শ্রমে ঘামে। মৃত্যু হয়েছে উপমহাদেশের অনেক শ্রমিক, মজুর পেশাজীবীদের। “দ্য গার্ডিয়ান” পত্রিকা নির্দিষ্ট করে লিখেছে, ওই নির্মাণের সময়ে ২০২০ পর্যন্ত এখানে ছয় হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য ও আধুনিকতার জন্য আমরা উচ্ছসিত হয়েছি। কিন্তু কেউ কি মনে রেখেছি ওই নিহত শ্রমিকদের কথা। প্রশ্ন তুলেছি, ফিফা কেন নিরব! ২০২১ থেকে ২০২২ পরের দিকের তথ্য কেন গোপন করা হল!

দুর্নীতি


এই বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ কাতার। এখানে দেশের শাসনভার রয়েছে পেট্রো ডলারের মালিকদের হাতে। যারা আবার একই সঙ্গে তারা সামন্তপ্রভুও বটে। আর তারই জোরে এই শাসকরা ধরাকে সরা দেখে। যতদূর জানা যায়, দেশটার জনসংখ্যা কমবেশী ৩০ লক্ষ হলেও প্রকৃতপক্ষে ওই দেশের নাগরিক নাকি তিন লক্ষ, বাকিরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ভাষাভাষী মানুষ। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করতে শাসকরা ব্যবহার করেছে তাদের বিপুল অর্থশক্তি। পারিপার্শ্বিক প্রমাণ স্পষ্ট করে দিয়েছে, কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করতে ছাড়পত্র পেয়েছে লক্ষ লক্ষ ডলার উৎকোচের বিনিময়ে। আর বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের ছাড়পত্র পেয়েই তারা কুৎসিত মন্তব্য করেছিল, সমকামিতা নিয়ে। উৎকোচ কান্ডের জন্যই তো উয়েফা প্রেসিডেন্ট কিংবদন্তী ফুটবলার মিশেল প্লাতিনিকে গ্রেফতার হতে হয়েছে। সরতে হয়েছে ফিফা প্রেসিডেন্ট শেপ ব্লাটারকে। এখনও চ্যাপ্টার ক্লোজড হয়নি। ইউরোপ পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট গ্রিসের ইভা কাইলিকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
কাতারে বিশ্বকাপে খরচ হয়েছে বিগত সাতটি বিশ্বকাপ ফুটবলের মোট খরচের অঙ্কের চারগুণ বেশি। ২২২ বিলিয়ন ডলার। তারপরও উঠেছে ওই মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ। একেই বোধহয় বলে “বড় লোকের খেয়াল, আর ভাঙ্গা দেয়াল”!
আপনারা কেউ যদি এই সব কথাকে, ইউরোর সঙ্গে পেট্রো ডলারের দ্বন্দ বলে মনে কর, তবে তাঁকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা কিন্তু রাশিয়া ও আফ্রিকার বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন ও ঘুষকান্ডে অতীতেও সরব হয়েছিলাম। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থাকবে অথচ দুর্নীতি থাকবে না তা তো অসম্ভব। তবুও যারা এই অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ব ফুটবলের দুর্নীতিকেই ভুলে থাকতে চান তাদের কথা ভিন্ন।

কুসংস্কার


ইরানের চলেছে হিজাব বিরোধী গণসংগ্রাম। কাতারে আসার সময় বিশ্বকাপে ইরানের নির্বাচিত জাতীয় ফুটবল দল দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে। ব্যাস দেশের চারিদিকে হই হই পড়ে গেল, ফুটবল দলের সরকারের প্রতি আনুগত্যের জন্য। অথচ বিশ্বকাপে ইরানের প্রথম খেলায় ফুটবলারা কেউই জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলালেন না। তারপর আবার দ্বিতীয় ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলালেন। এরপর পরাজিত হয়ে দেশে ফেরার পর দেখা গেল ইরানের রাস্তায় আনন্দ মিছিল করেছে অনেক মানুষ। অনুসন্ধানে জানা গেল, এটা জাতীয় দলের হেরে যাওয়ার আনন্দে। কারণ তারা মনে করেন, জাতীয় দল জয় পেলে তাদের দেশের স্বৈরাচারী সরকার নিজেদের স্বার্থে ফুটবলারদের কৃতিত্বকে ব্যবহার করতো।
বর্তমানে ইরানের চলছে হিজাব বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় দুজন ফুটবলারের ইতিমধ্যেই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে জনসমক্ষে। আমির নাসের আজাদানিও নামে ২৬ বছরের আরেকজন ফুটবলারের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়েছে। সেই জন্য বিশ্বকাপে দলের পরাজয়ে তারা আনন্দিত। ফিফা নিরব।
শোনা যায়, মেসির ব্যক্তিগত চিকিৎসক (তাঁর চোখে আর্জেন্টিনার সরকার প্রতিক্রিয়াশীল) বলেছিলেন, আমি মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখতে চাই না, কারণ এই জয়কে আর্জেন্টিনার সরকার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে।
কাতারের শাসকদের কুসংস্কারের আরেক দৃষ্টান্ত সমকামিতা নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও তার পরিপ্রেক্ষিতে ফিফা আত্মসমর্পণ করা। এটাকেও কিন্তু ফুটবল বিশ্ব মেনে নেয়নি। একাধিক দলের অধিনায়করা চেয়েছিলেন সমকামিতার পক্ষে আর্মব্যান্ড পরে খেলতে। ফিফা ওই প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ করায় জার্মান দল ফোটোসেশনে মুখে হাত ঢেকে প্রতিবাদ জানান এবং জার্মান ও বেলজিয়াম সরকারের দু’জন মন্ত্রী ফিফা প্রেসিডেন্টের পাশে বসে খেলা দেখেন ওই আর্মব্যান্ড পরে।
এবারে গত সাতটি বিশ্বকাপ ফুটবলের খরচের অঙ্কের চারগুণ খরচের বহর নিয়ে বিতর্কে অনেকেই বলছেন, এবারের মতো ভাল বিশ্বকাপ অতীতে কোনও দিন আয়োজন করা হয়নি। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, এই কথাটার যথার্থতা প্রমাণ পেতে আপনাকে অবশ্যই একজন সাংবাদিক পেশাজীবী হতেই হবে। অবশ্য যারা নিজেদের সুবিধা নিয়ে আপ্লুত। কারণ কাতারে তারাই এবার ভোগ করতে পেরেছেন ফ্রি পরিবহনসহ বেশ কিছু পরিষেবা। তারা বলছেন, এই সমগ্র বিশ্বকাপ ফুটবলের মহাযজ্ঞে একটিও ক্রাইম হয়নি। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপে অমানবিকতা, দুর্নীতি, কুসংস্কারের মতো ক্রাইম প্রাতিষ্ঠানিক পেয়েছি।
বিশ্বকাপের অন্তিমে দেখা গেল, মেসি এলেন বিশ্বকাপ নিতে। ফিফা প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে ওই দেশের রাজা শেখ তামিম বিন হামাদ! তিনি আরবের ঐতিহ্যের আলখাল্লা “বিশত” পরিয়ে দিলেন মেসিকে ফিফা প্রেসিডেন্টের সামনেই। অথচ ফিফার নিয়ম জার্সি গায়ে দিয়েই বিশ্বকাপ নেওয়ার কথা। এই আমির শেখ তামিম বিন হামাদই জয়ী ও পরাজিত উভয় নায়কেরই (দু’জনেরই) ক্লাবের মালিক। প্যারিস এর "পিএসজি" ক্লাবের ফুটবলার আর্জেন্টিনার মেসি, সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড কিলিয়ান এমবাপে এবং ব্রাজিলের প্রতিভাধর লেফট উইঙ্গার নেইমার জুনিয়র। আর এই ক্লাবের মালিক কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ।

উদ্বাস্তু বা শরণার্থী ও অভিবাসী


কাতার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর অনেকেই অভিবাসীদের নিয়ে জাতীয় টিম গঠন করেছে। বিশ্বকাপে বিশ্ব জুড়ে অভিবাসী সমস্যার ছাপ পড়েছে সুস্পষ্টভাবে। বিশ্বের সব অভিবাসী জড় করে একটা দেশ গঠিত করা হলে, জনসংখ্যার নিরিখে তার স্থান হবে চীন, ভারত, আমেরিকার পরেই। এই অভিবাসীরা বিশ্বকাপ ফুটবলে অনেক সুযোগ তৈরি করেছে, যেমন, লারবি বেনবারেক, ইউসোবিও, মিলোস্লাভ ক্লোসে, পেপে, নানি, ইমব্রামোভিচ, লুকা মডরিচ ইত্যাদি...
কাতারের বিশ্ব ফুটবলে অংশগ্রহণ করেছিল মোট ৮৩২ জন ফুটবলার। আর তার মধ্যে ১৩৭ জন অন্য দেশের হয়ে খেলেছেন। শতাংশের হিসেবে ১৬.৩% খেলোয়াড়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ কোরিয়া ও সৌদি আরব ছাড়া আর কোনও দেশই জন্মসূত্রে নিজের দেশের ফুটবলদের নিয়ে টিম গড়েনি।
সুইজারল্যান্ড ক্যামেরুন ম্যাচে ব্রিল এমবোলো গোল করার পরে উচ্ছাস প্রকাশ না করে শুধু হাত তুললেন কেন? ওর বাবা এখনও ওই দেশেই থাকে এবং তার জন্মও ওই দেশেই। তাকে এই গোল করায় এসিস্ট করেছিল জেবদেন সাকিরি। এই ফুটবলার যুগোস্লাভিয়া অধুনা কাসোভার শরণার্থী।
কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে কানাডার হয়ে প্রথম গোল করেছিল আলফোনসো ডেভিস। এই ফুটবলারের জন্ম কিন্তু ঘানার অভিবাসী শিবিরে। কেন মনে নেই, বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের হয়ে নেমে রঙ বদলে দেয়া এদুয়ার্দো কামাডিঙ্গার নাম! তার জন্ম কিন্তু অ্যঙ্গোলার শরণার্থীদের পরিবারে। তারই আরেক সহযোগী ছিল মার্কাস থুরামও (লিলিয়ানের ছেলে), তিনিও শরণার্থী পরিবারের সন্তান।
বিশ্বকাপ, ইউরোপ ও আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলার ও ব্যালন ডি'ওর বিজয়ী আফ্রিকার একমাত্র খেলোয়াড় কিংবদন্তী জর্জ উইয়া এখন লাইব্রেরিয়ার প্রেসিডেন্ট। তার ছেলে টিমেথি উইয়া খেলেছেন আমেরিকার হয়ে। তিনিই ওয়েলেসের বিরুদ্ধে প্রথম গোল করেছে আমেরিকার হয়ে।
১৯৯৮ সালে ফুটবল ফাইনালে ফ্রান্সের হয়ে তিনটি গোল করেছিল জিদান ও ইমানুয়েল পেটিট। জিদান হলেন আলজেরিয়ার অভিবাসী। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে তিন গোল করেছিল দু’জনই অভিবাসী পরিবারের সন্তান।
২০১৮ তে গোল করেছিল কিলিয়ান এমবাপে, আন্টন গ্রিজম্যান এবং পল পোগবার। এরা প্রত্যেকেই শরণার্থী পরিবারের। শরণার্থী সমস্যা মোটেই সাম্প্রতিক নয়। যেটা বিপদজনক তা হল, সমস্যাটা বাড়ছে। ১৯৩৮ সাল থেকে আপনি যদি দেখেন তবে দেখতে পাবেন, মিশেল প্লাতিনি, করিম বেঞ্জেমা, হুগো লাবিস, লিলিয়ান থুরাস, থিয়েরি আরি, ওসুমানে ডেমবেলে, এনগোলো কান্তে...।
২০১৪ সালে ফুটবল বিশ্বকাপে শরণার্থী পরিবারের সন্তান ফুটবলার ছিল ৮৫ জন এবং ২০১৮তে এই সংখ্যা ছিল ৮৪। এবার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিল ফ্রান্সের বংশোদ্ভূত ৫৯ জন ফুটবলার। যাদের মধ্যে মাত্র ৩৭% খেলেছে নিজের দেশ ফ্রান্সের হয়ে। বাকিরা খেলেছে তিউনেশিয়া, মরক্কো, সেনেগাল, ঘানা, ক্যামেরুন, স্পেন, পর্তুগাল এবং কাতারের হয়ে। মরক্কো দলের রেজিস্ট্রেশন করা ২৬ জনের মধ্যে আচরাফ হাকিমি সহ ১৬ জনের জন্মই অন্য দেশে! আফ্রিকার ৫টি দেশেকে বাদ দিয়ে বাকি ১৪টি দলে ন্যূনতম একজন করে আফ্রিকার ফুটবলার ছিল।
আভিজাত্যের স্বর্গরাজ্য গ্রেট ব্রিটেনের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেখানে হ্যারি কেন, রহিম স্টার্লিং, বুকায়ো সাকা, ডেকলাম রাইস, হ্যারি মাগুইরে, কাইল ওয়াকার, কালভিন ফিলিপস, মারকাস রাসফোর্ড, জুড বেলিহাম, এরিক ডায়াররা। এরই মধ্যে এবার বিশ্বকাপে বার বার দাবি উঠেছে প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পরে তাদের প্রায় ৭০ লক্ষের বেশি, তারা দিন কাটাচ্ছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কাতারের বিশ্বকাপ শেষের ১০ দিনের মধ্যে প্যালেস্তাইন দলের একজন অলিম্পিয়ান ফুটবলারকে গুলি করে মেরেছে ইজরায়েল সেনা। ফিফা কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তথ্য বলছে পৃথিবীতে বর্তমানে অভিবাসী সংখ্যা ২৮ কোটি। যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৩.৫% !
বিশ্বকাপ শেষ। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক মেসির হাতে বিশ্বকাপ, এমবাপে নিজের হাতে মুখ ঢেকে মাঠের মধ্যে বসে আছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এসে তার পিঠে হাত রাখলেন! কেন! এটা হল রাজনৈতিক বিবৃতি। দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটছে। ফ্রান্সে শেষ নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট পক্ষে ৫৮.৮% জনমত থাকলেও প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী লুই পেনের পক্ষে গেছে ৪১.২% জনমত। এরাই ১৯৯৬ সালে বলেছিল, দেশের জাতীয় ফুটবল দলে অশ্বেতাঙ্গদের ভিড়! লুই পেনের পক্ষে জনমত বাড়ছে। তাই এমবাপের পিঠে হাত শুধুমাত্র তাকে শান্তনা নয়। বার্তা।
ইতিমধ্যে দক্ষিণপন্থার অগ্রগতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, অষ্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামে। ইতালিতে মুসোলিনির পর আবার ক্ষমতায় এসেছে দক্ষিণপন্থীরা। এখানে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জর্জিয়া মেলোনি।
আমাদের দেশের দক্ষিণপন্থী শাসক বিজেপি ও তাদের মতাদর্শের অনুগামীরাও শরণার্থী রোহিঙ্গাদের, এমনকি বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের প্রতি আজও ঘৃণা নির্মাণ করছে জনমনে।
অন্য দেশের দক্ষিণপন্থীদেরই এদেরও একই পথ।
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল জয়ী হয় জার্মানি। সুপার স্টার হন মেসুট ওজিল। পরের বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে ছিটকে যায় জার্মানি। প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল ওজিলের দেশপ্রেম নিয়ে! ক্ষুব্ধ হয়ে ওজিল ফুটবল থেকেই অবসর নেন এবং বলেন, জিতলে আমি জার্মানি, হারলে অভিবাসী! ফ্রান্সেও এই চক্রের অনুগামীরা চক্রান্ত করেছিল। ওই দেশের ফুটবল পান্ডারা। সেই অডিও প্রকাশিত হয়ে পড়ায় করিম বেঞ্জেমা বলেন, গোল করলে ফ্রান্সের, না হলে আরবের।
বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু খেলা নয়, দুনিয়ায় রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। অভিবাসীদের লড়াই আসলে বসে খাওয়াদের সঙ্গে, লুটে খাওয়াদের সঙ্গে শ্রমজীবীদের লড়াই। এই অসমযুদ্ধ চলছে ফুটবল মাঠে। বিশ্বকাপে। কখন পেলে, কখনও সক্রেটিস, কখনও মারাদোনা, কখনও গ্যারি লিনেকার আবার কখনও কিলিয়ান এমবাপে'র মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

বিশ্বকাপে ভারত


ভারতের বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ?
আমাদের দেশ থেকে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ও সচিব উভয়েই গিয়েছিলেন বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে। তারপর... ২০২২ বছরের শেষ দিনে উভয়ের পক্ষ থেকে প্রেস মিট করে ঘোষণা করা হয়েছে “ভিসন ২০৪৭: আগামী ২৫ বছরের ভারতীয় ফুটবলের রোডম্যাপ”। প্রেস মিটের সূচনায় সভাপতি কল্যাণ চৌবে বললেন,”গত ১২৫ দিনে আমরা একাধিক জায়গায় গিয়েছি, যেখানে ভারতীয় ফুটবলের কর্তারা পূর্বে যায়নি। আমরা উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলি সহ ঝাড়খণ্ড ও গুজরাটেও গিয়েছি।” আর সচিব শাজি প্রভাকরণ বললেন, “২০৪৭ লক্ষ্য করে আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি কারণ এটা স্বাধীনতার ১০০ বছর। ওই সময়ে আমরা দেশের ফুটবলকে শীর্ষে নিয়ে যেতে চাই।”
কি আছে তাদের রোডম্যাপে?
ভাষণে যতই তাদের দক্ষতা থাক পরিকল্পনায় নজর দিলেই যে কোন দেশপ্রেমিক বিষম খাবেন একথা নিশ্চিত।
সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের “ভিসন ২০৪৭”-এ আছে এগারো দফা কর্মসূচি। (১) পরিচালনা, (২) পরিকাঠামো, (৩) ডিজিটালাইজেশন, (৪) রেফারিং, (৫) ক্লাব, (৬) কোচ প্রশিক্ষণ, (৭) গ্রাসরুট, (৮) মার্কেটিং ও বাণিজ্যিকরণ, (৯) প্রতিভা অন্বেষণ, (১০) প্রতিযোগিতা এবং (১১) জাতীয় দল। আশু লক্ষ্য আগামী ২০২৬ এর মধ্যে এশিয়ার শীর্ষ দেশের মধ্যে পৌঁছাবে এবং আর চুড়ান্ত লক্ষ্য ২০৪৭ এর মধ্যে এশিয়ার শীর্ষ চারের মধ্যে পৌঁছাবে। এছাড়াও আছে নানা কথাবার্তা। যেমন ধরুন, ওখানে বলা হয়েছে অনুর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপে পুরুষ ও মহিলা দলকে যোগ্য করে তোলা হবে। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনে আলাদা মহিলা বিভাগ হবে। মহিলা ফুটবলারদের জন্য বেতন মূল্য ধার্য করা হবে। কর্মকর্তাদের জন্য ইনসেনটিভের ব্যবস্থা করা হবে। ১৩টি বিশ্ব মানের স্টেডিয়াম ও ১২টি স্মার্ট স্টেডিয়াম গড়া হবে। আগামী ২০৪৭ সালের মধ্যে ২০হাজার ফুটবল ক্লাব গঠন করা হবে এবং ৭০০টি ফুটবল উন্নয়ন ক্লাব গঠন করা হবে। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের উদ্যোগে দশ লক্ষ নথিভুক্ত ফুটবলারকে সই করানোর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। স্কুল শিক্ষকদের ফুটবল জ্ঞান বাড়াতে হবে। বাণিজ্যিকরণের জন্য ফুটবল ফেডারেশনের রাজস্ব ৫০০ শতাংশ বাড়াতে উদ্যোগী হবে। দূরদর্শনের ৩টি চ্যানেল ২০২৬ সালের মধ্যেই সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সম্পত্তিতে পরিণত হবে।
কিন্তু বিশ্বের ফুটবল মাঠে দেখা দৃশ্যগুলো কোথাও নেই তাদের এই পরিকল্পনায়। নেইমার ও মেসির জার্সি গায়ে একই গ্যালেরিতে বসে খেলা দেখার পরিবেশ গড়ে তোলার বার্তা নেই। আইএসএল খেলা একশো বছরের পুরনো দলের নিজস্ব মাঠ, স্টেডিয়াম, খেলোয়াড়দের থাকার জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থা বা দলগুলোর বয়স ভিত্তিক একাডমির করা। কোচিং কোর্সে প্রশিক্ষণ ফি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার কোনও পরিকল্পনা আছে! রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের থেকে খেলাধুলার জগতকে মুক্ত রাখার প্রয়াস কোথায়!
সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের “ভিসন ২০৪৭”। এতো সস্তা কিছু কথা যে বলা যায় তা জানা ছিল না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ফুটবল বিকাশের জন্য যে প্রচেষ্টা চলছে সেখান থেকেই শেখার কোনও চেষ্টাই নেই।
তাই এখনও আমরা শুধুমাত্র ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক হিসেবে মোহনবাগানের পরাজয় কামনা করি বা মোহনবাগানের সমর্থক হিসেবে ইস্টবেঙ্গলের পরাজয় কামনা করছি। আমি নিশ্চিত এই পথ কিছুতেই ভারতের ফুটবলকে বিশ্বকাপে আঙ্গিনায় পৌঁছে দিতে পারে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.