বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[খেলা]

[খেলা]

গতিময় ঊষার প্রতিকূলতাকে জয় করার গল্প

গতিময় ঊষার প্রতিকূলতাকে জয় করার গল্প

প্রসেনজিৎ দত্ত

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মার্চ, ২০২২— ঊষা তাঁর অটোবায়োগ্রাফি ‘গোল্ডেন গার্ল’-এ বলছেন, “আমাদের কম্পাউন্ডের ভেতরে একটা আম গাছ ছিল। আমি আর আমার চার বোন আম পড়ার অপেক্ষায় থাকতাম। সেই আম ছিল আমাদের একমাত্র নিয়মিত খাবার। আম ঝরে পড়ত। এটি আমাদের জন্য গাছের দিকে ছুটে যাওয়ার স্টার্টারের সিগনাল ছিল। তাতে কোনও সান্ত্বনা পুরস্কার ছিল না। কেবলমাত্র প্রথম পুরস্কার হিসাবে ছিল ফলটি সবার আগে কুড়িয়ে ওখানেই খেয়ে নেওয়া।” এক বছর পর জয়ের পুরস্কার বদলে গেল। আম হয়ে গেল মেটালের চকচকে মেডেল। মেলাডি থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে পৌরোমেরির উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বদাগাড়া সব জেলা মিটিংয়ে ১০০ মিটার, লং জাম্প এবং ২০০ মিটার ইভেন্টে জয়ী হয়ে এই মেটাল পদক অর্জন করেছিলেন পি টি ঊষা। এটি ছিল অ্যাথলেটিক্সে তাঁর প্রথম উপস্থিতি। সেই সময় মেয়েদের প্রশিক্ষণের জন্য বছরব্যাপী কোনও পরিকল্পনা ছিল না। তখনকার দিনে হত দ্বি-সাপ্তাহিক মিট। সেখানে যখন বিরতি হত, ঊষারা নিজেদের মধ্যে খেলতেন। একটা ছোট গোলাকার পাথর কুড়িয়ে নিয়ে তাঁরা দেখতেন, কে সবচেয়ে দূরে পাথরটি ছুড়তে পারেন। আর উপজেলা মিটিংয়ের অংশগ্রহণ ছিল শুধুমাত্র টোকেন প্রতিনিধিত্ব। ঊষা যখন সপ্তম শ্রেণীতে, দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে কোনও সিলেকশন ট্রায়াল ছিল না। তবে, ঊষা সেই ট্রায়ালে সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। কারণ তিনি ইংরেজি শিক্ষকের ভাগ্নী। তার উপর আবার শারীরিক প্রশিক্ষক ভেবেছিলেন, প্রতিভায় ভরপুর ঊষা। ওই যে দ্বি-সাপ্তাহিক মিটে বিরতি হত, সেই সময় হয়তো শারীরিক প্রশিক্ষক ঊষাকে দৌড়তে দেখেছিলেন। তাই সিলেকশনে কোনও বাধা হয়নি। স্কুল দলে সুযোগ পাওয়ার পর ঊষার পরিবার তাঁদের কন্যাকে কেরালা স্টেট স্পনসর্ড স্পোর্টস ডিভিশন স্কিমের সিলেকশন ট্রায়ালের জন্য পাঠায়। এই স্কিমটি ১৯৭৬-অ্যাথলেটিক্স বাস্কেটবল এবং ভলিবলে প্রতিশ্রুতিবান জুনিয়রদের প্রশিক্ষণের জন্য শুরু হয়েছিল। এই স্কিমে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সি ৪০ জন মেয়ে সুযোগ পেয়েছিল। এর মধ্যে ঊষাও ছিলেন। প্রত্যেককে নিয়ে অষ্টম শ্রেণীর সমতুল্য বিশেষ ক্লাস শুরু হয়েছিল কোট্টায়াম কান্নুর এবং ত্রিবান্দ্রমের স্কুলে।
ঊষা তাঁর কেরিয়ার হিসেবে যে অ্যাথলেটিক্সকেই বেছে নেবেন, এমনটা ভাবেননি পরিবারের কেউই। পরিবারের কাছে ঊষা ছিলেন আর পাঁচটা মেয়ের মতোই। আসলে যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি জাতীয় স্তরে সাফল্য আনা শুরু করছেন, ততক্ষণ এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে এই অনিশ্চয়তার মাঝেই ঊষার পরিবার স্পোর্টস ডিভিশনে পাঠিয়েছিল তাদের কন্যাকে। পরিবারের সদস্যদের আশা ছিল, ঊষা অন্ততপক্ষে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক হবেন। নিদেনপক্ষে জুটবে একটা চাকরি। যা বিয়েতেও সাহায্য করবে। “আমরা ওর প্রতিভাকে বুঝতে পারিনি”— বলেছেন খোদ তাঁর বাবা ই পি এম পৈথল। এমনকী ঊষা নিজেও কখনও ভাবেননি যে, তিনি অ্যাথলিট হয়ে উঠবেন। কারণ অ্যাথলেটিক্সের সঠিক অর্থ জানতেন না তিনি। আগে কখনও দেখেননি অ্যাথলেটিক ট্র্যাক। তাঁর কাছে দৌড়ানোর অর্থ ছিল কেবলমাত্র আমগাছের দিকে ছুটে যাওয়া। স্কুল দলে যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত অ্যাথলেটিক্স ফর্মের সঙ্গে পরিচিত হননি তিনি। তাছাড়া তাঁদের মতো পরিবারের কাছে অ্যাথলেটিক্সের জন্য এই মনোভাব আশ্চর্যজনক নয়। তাঁর বাবার ছিল একচিলতে কাপড়ের দোকান। সেখান থেকেই যেটুকু আয় হত, পরিবার চলত মোটামুটি। ঊষার মা টি ভি লক্ষ্মীকেও একসময় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তাছাড়াও মেলাডি ঠিক সেই ধরনের জায়গা নয়, যেখানে কোনও স্পোর্টসম্যানের জন্য সাফল্য আশা করা যেত। মেলাডি-পায়োলি গ্রামে পৈথল-লক্ষ্মীর দরিদ্র ঘরে ১৯৬৪-র ২৭ জুন জন্মান ঊষা। মালাবার উপকূলের পায়োলি গ্রাম প্রাকৃতিক দিক দিয়ে কিন্তু খুবই রূপসি। কেরলের বাণিজ্য শহর কালিকট থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরে একটা ছোট্ট গ্রাম মেলাডি। এরই অদূরে ছিল পি টি ঊষার দীনহীন ঘর। তবু ঊষা হয়তো মনে মনে প্রত্যয় করেছিলেন, খেলাধুলাকেই বেছে নেবেন। একসময় তাঁর মনে হয়েছিল, খেলাধুলাই পারবে গরিবির মেঘ সরিয়ে দিতে। ঊষা শৈশব থেকেই স্প্রিন্টিংয়ের প্রতি অনুরাগী ছিলেন, কিন্তু দারিদ্র্য এবং অসুস্থতা তাঁর স্বপ্নকে ভেঙেও দিয়েছিল একসময়। ঊষার ভাগ্যেও আলো ফুটল। তাঁর প্রতিভা দেখে সবে মাত্র ক্রীড়া বিভাগ স্থাপন করা কেরালা সরকার ২৫০ টাকার বৃত্তি দিল ঊষাকে।
১৯৭৬-এ কেরালা সরকার কান্নুর জেলায় একটা মহিলা ক্রীড়াকেন্দ্র চালু করেছিল। এখানে ঊষার প্রথম কোচ ছিলেন প্রবাদপ্রতিম ও এম নাম্বিয়ার। এখানেই তাঁর অ্যাথলেটিক কেরিয়ার শুরু হয়েছিল। স্কুলপড়ুয়ারা কিন্তু ঊষাকে 'কিংবদন্তি' হওয়ার আগে তখনই তাদের আদর্শ মনে করত। ইন্ডিয়া টুডে-তে প্রকাশিত শ্রীধর পিল্লাই অমরনাথ কে মেননের একটা রিপোর্ট অনুযায়ী, তখন স্কুলে শারীরিক প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক ছিলেন বালাকৃষ্ণান নায়ার। তাঁর মুখ কখনও ভোলার নয়। তিনি মাত্র ৯ বছর বয়সে স্কুলের একটা টুর্নামেন্টে ঊষাকে প্রথম দেখেছিলেন বলে কৃতিত্ব দাবি করেন। পরে তিনিই ঊষাকে ১৯৭৭-এ কান্নুরের স্পোর্টস স্কুলে পাঠান। এরপর ঊষাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বালাকৃষ্ণান নায়ারের স্মৃতিচারণ থেকে জানতে পারি, মাত্র নয় বছর বয়সি চতুর্থ শ্রেণীর ঊষা ১০০ মিটার দৌড়ে হেলায় হারিয়ে দিয়েছিলেন ১৪ বছর বয়সি এক মেয়েকে। কান্নুরে ঊষার কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট আসে যখন তিনি কোচ নাম্বিয়ারের সঙ্গে দেখা করেন। এটি ছিল দীর্ঘ এবং ফলপ্রসূ সম্পর্কের একটা সূচনা, যা ভারতীয় ক্রীড়া জগতে খুব কমই দেখা যায়। নাম্বিয়ারের সঙ্গে ঊষার সম্পর্ক ছিল বাবা-মেয়ের মতোই। 'হার্ডেল কুইনে'র বাবা পৈথলও সেই কথাই বলতেন। নদীর ওপারে ৫ কিমি দূরে থাকতেন নাম্বিয়ার। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় নাম্বিয়ারের মোটরসাইকেলের আওয়াজ শুনলেই ঊষা এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে হাইস্কুলের মাঠে বা সমুদ্র সৈকতে দৌড়তে চলে যেতেন। দুই ঘণ্টা হাড়ভাঙা 'প্র্যাক্টিস প্র্যাক্টিস অ্যান্ড প্র্যাক্টিসে'র পর ফিরে আসতেন ঊষা। এরপর তাঁর ক্লান্ত শরীরটা সিমেন্টের মেঝেতে সটান শুয়ে পড়ত। ঊষার বোন পুষ্পা একবার বলেছিলেন: “নাম্বিয়ার স্যার প্রতিদিনের ব্যায়ামের ব্যাপারে খুবই কড়া ছিলেন। কারণ ওনার বিশ্বাস ছিল, দিদিকে তা ট্র্যাকে দৌড়ের শেষ মুহূর্তে বাজি জেতার ব্যাপারে জন্য যথেষ্ট সহনশীলতা এবং শক্তি দেবে।” কিন্তু কালিকট রেলওয়ে স্টেশনের প্রদীপ নিলয়ম নামে একটা সাধারণ বাড়িতে সেদিন প্রদীপ জ্বলেনি। ১৯৮৪-তে বিজিত হয়েছেন ঊষা। তবুও তাঁর মা লক্ষ্মী আম্মা মেয়ের বিজয়ের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করে দীর্ঘ রাত কাটিয়ে বলছেন: “আমি নিশ্চিত ১৯৮৮-র সিউল অলিম্পিকে ভগবান কৃষ্ণ তাকে একটা পদক দিয়ে আশীর্বাদ করবেন।”
১৯৮৬ পর্যন্ত ঊষা সাধারণত তিনদিন ট্রেনে করে মেলাডি থেকে পাতিয়ালা যেতেন, যেখানে জাতীয় প্রশিক্ষণ শিবির অনুষ্ঠিত হয়। মেলাডি হল পেয়োলি পঞ্চায়েতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম গ্রাম। পুরো পঞ্চায়েতে রয়েছে একটাই হাইস্কুল। যদিও আটটি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৩টি নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে। গ্রামটি বুনো ঝোপঝাড়ে ঘেরা। একবুক উচ্চতায় ছোট ছোট দেওয়ালের গোলকধাঁধা পেরিয়ে যেতে হয় পি টি ঊষার বাড়ি। ঘরগুলি সুন্দরভাবে সাজানো। কুঁড়েঘর ছাড়াও রয়েছে ছাদ-সহ ছোট বাড়িও। চারপাশে রয়েছে নারকেলগাছ। বাড়ি সংলগ্ন বাগানগুলি বেশিরভাগ পরিবারের মৌলিক দৈনিক সবজির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করত। আর ছিল তাজা সামুদ্রিক মাছ। কালিকট এবং কান্নুরের সঙ্গে সংযোগকারী রাস্তা থেকে তিনবার বাঁক নিলেই একটা সামান্য উঁচু জমির উপর অবস্থিত প্রদীপ নিলয়ম। ঊষার একমাত্র ভাই প্রদীপের নামে নামকরণ করা হয়েছে প্রদীপ নিলয়ম। গ্রামের অন্যান্য বাড়ির থেকে এই বাড়িটি আলাদা নয়। এর প্রধান প্রবেশদ্বারের দু’ পাশে ধাতব রুপোলি রঙে আঁকা 'অপ্পু'— সুর ঝাঁকানো হাতি। যা ছিল ১৯৮২-র নয়াদিল্লি এশিয়ান গেমসের মাস্কট। সেবার ঊষা যে দু'টি পদক জিতেছিলেন, তার রং ছিল রুপোলিই।
এ সবই সম্ভব হয়েছিল পিতৃতুল্য গুরু নাম্বিয়ারের জন্য। জানা যায় যে, ঊষার মা তাঁকে বলতেন ‘ছেলেধরা’। তাই টুপি পরা স্যার নাম্বিয়ারকে দেখে প্রথমে ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন ঊষা। তখন ১৯৭৭। সূর্য ওঠার অনেক আগেই ১৪ বছরের ঊষা সজাগ হয়ে যেতেন নাম্বিয়ারের সাইকেলের ক্রিং-ক্রিং শব্দে। কান্নুরে স্পোর্টস ডিভিশনে কোচিং করাতেন তিনি। নাম্বিয়ারই ঊষাতে আগুন দেখে ডেকে নিয়েছিলেন ঊষাকে। নাম্বিয়ার তখন তাঁরই সাইকেলে চড়িয়ে ঊষাকে ট্র্যাকে নিয়ে যেতেন। ঊষা এবং নাম্বিয়ারের বাড়ির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে থুরাসেরি কাদাভু নদী। ঊষা বলছেন, “সেই নদী পেরিয়ে সাইকেল নিয়ে এসে তিনি যখন আমাদের বাড়ির সামনে থামতেন, গোটাকয়েক কাক আর মোরগ ছাড়া সম্ভবত গোটা পৃথিবীই তখন নিদ্রামগ্ন।” এরপর তিনি ঊষাকে সাইকেলে চড়িয়ে ওই কাকভোরে ট্র্যাকে নিয়ে যেতেন। কিন্তু সাধারণ গ্রাম্যসমাজ তা কি সহজে মেনে নিয়েছিল? গ্রাম্যসমাজ তো দূর কি বাত, ঊষার পরিবারেরও ব্যাপারটা প্রথমে ঠিক হজম হয়নি। ঊষার মা ছিলেন সাধারণ গ্রাম্যমহিলা। ‘স্যার’কে মোটেও পছন্দ করতেন না তিনি। তবে অনর্গল কথা বলে লক্ষ্মী দেবীকে বোঝাতেন নাম্বিয়ার। বলতেন, “একদিন আপনার মেয়ের নাম বিশ্বের ঘরে ঘরে মুখে মুখে ফিরবে।” তেমনটাই হয়েছিল। ১৯৭৮-এ কোল্লামে জুনিয়রদের আন্তঃরাজ্য প্রতিযোগিতায় তিনি ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৬০ মিটার হার্ডল এবং হাই জাম্পে চারটি সোনার পদক, লং জাম্পে রুপো এবং ৪x১০০ মিটার রিলেতে ব্রোঞ্জ পদক-সহ মোট ৬টি পদক জয় করেছিলেন। ওই বছরেই কেরালা রাজ্য কলেজ মিটে তিনি ১৪টি পদক জেতেন। ১৯৭৯-এ জাতীয় গেম এবং ১৯৮০-র জাতীয় আন্তঃরাজ্য মিটে অনেক রেকর্ড তৈরি করে একাধিক পদক জয় করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৮০ মস্কো অলিম্পিকে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ঊষা। যদিও ফলাফল তাঁর অনুকূলে ছিল না। ১০০ মিটার দৌড়ের হিটে পঞ্চম হয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু না-ছোড়-বান্দী তিনি। ১৯৮১-তে বেঙ্গালুরুর সিনিয়র আন্তঃরাজ্য মিটে ১০০ মিটারে ১১.৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে এবং ২৪.৬ সেকেন্ডে ২০০ মিটার দৌড়ে জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেন। ১৯৮২-এ নতুন দিল্লি এশিয়ান গেমসে তিনি ১০০ মিটার এবং ২০০ মিটারে রুপোর পদক জেতেন, ১১.৯৫ সেকেন্ড এবং ২৫.৩২ সেকেন্ড সময় নিয়ে। জামশেদপুরে ১৯৮৩ সালের ওপেন ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি আবার ২০০ মিটারে জাতীয় রেকর্ড গড়েন ২৩.৯ সেকেন্ডের এবং ৫৩.৬ সেকেন্ডে ৪০০ মিটারের নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেন। ওই বছরে মাদিনাত আল-কুয়েতে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ৪০০ মিটারে স্বর্ণপদক জেতেন।
আটাত্তরে আন্তঃজেলা স্কুল প্রতিযোগিতায় যখন তিনি নামালেন, তখন বড়জোর ছয়-সাত মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। প্রতিযোগিতায় সোনা জেতেন ঊষা। তারপর? গুরু নাম্বিয়ারই তাঁকে ততদিনে হার্ডলারে পরিণত করেছেন। ১৯৮৪-র লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে গোটা দেশ তাকিয়েছিল ঊষার দিকে। সবাই প্রত্যাশা করেছিল তাঁর কাছ থেকে একটা পদকের। কিন্তু ৪০০ মিটার হার্ডলসে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে পদক ফসকে গিয়েছিল ঊষার। কান্নায় লুটিয়ে পড়েছিলেন পি টি ঊষা। পূর্ণেন্দু পত্রীর ভাষায় ‘ভিকট্রির প্রতিমূর্তি’ ঊষাকে সেদিন তাঁর ‘পিতা’ গুরু নাম্বিয়ার বলেছিলেন— “ঊষা, অন্য তিনজন তোমার চেয়েও ভালো দৌড়েছে। এই সহজ সত্যটা মেনে নিতে শেখো।” ঊষা সেদিন নিজেকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। প্র্যাকটিসে তাঁর সময় ছিল ৫৬.৫৯ সেকেন্ড। অলিম্পিক ফাইনালে তিনি দৌড় শেষ করেছিলেন ৫৫.৪২ সেকেন্ডে। তবু অল্পের জন্য, খুব অল্পের জন্য ফসকে গিয়েছিল অলিম্পিক পদক।
১৯৮৪-তে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার ছেড়ে একেবারে ৪০০ মিটারের ট্র্যাকে নেমেছিলেন কেন ঊষা? এর পিছনেও ছিল তাঁর নাম্বিয়ার স্যারের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। সেবারের অলিম্পিকে মেয়েদের ৪০০ মিটার হার্ডলস প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাই নতুন ইভেন্ট বলে কোনও দেশেরই অ্যাথলিটের তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। নাম্বিয়ার তাঁর প্রিয় ‘কন্যা ঊষাকে বলেছিলেন— “চমক যদি দিতেই হয়, এটায় নামো। বলা যায় না মেয়ে হলেও তুমি হয়তো হয়ে যাবে রঙের টেক্কা।”গোটা দুনিয়া দেখেছিল কতটা সঠিক ছিলেন গুরু নাম্বিয়ার। এই নাম্বিয়ারের জন্যই ১৯৮৬-তে সিওল এশিয়ান গেমসে ছয়টি ইভেন্টে নামতে বাধ্য হয়েছিলেন পি টি ঊষা। সেবারের এশিয়ান গেমস থেকে চারটি সোনা জিততে পারতেন না ঊষা। ৪০০ মিটারে জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন ঊষা এবং জিতেও ছিলেন। তবে খারাপ স্টার্ট নিয়েও লিডিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ২০০ মিটারে জিতলেও ১০০ মিটারে পরাস্ত হয়ে দ্বিতীয় হলেন। ’৮৭-তে সিঙ্গাপুরে আয়োজিত এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে পেলেন তিনটি সোনা, দু’টি রুপো। তবে একই বছরে রোম এবং ইতালিতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ৪০০ মিটার হার্ডলসে সেমিফাইনালে উঠলেও ৪x৪০০ মিটার রিলে রেসে হিটে অষ্টম হয়ে ছিটকে গেলেন। এরপর লক্ষ্য ছিল ১৯৮৮-র সিওল অলিম্পিক। কিন্তু সেখানেও প্রবল হতাশ করলেন। ৪০০ মিটার হার্ডল রেস ৫৯.৫৫ সেকেন্ডে শেষ করে হিটে সপ্তম স্থান অর্জন করে ছিটকে গেলেন সেবারের অলিম্পিক থেকে। হয়তো প্রত্যাশার চাপ ঊষার ‘সিওল শো’-কে ফ্লপ করে দিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস কেবলমাত্র বিজয়ীদের জন্যই লেখা হয়, এমন চিরাচরিত ধারণা বদলে দিয়েছিলেন ‘পায়োলি এক্সপ্রেস’ পি টি ঊষা। মিলখা সিং অলিম্পিক থেকে পদক না এনেও কিংবদন্তি। ঊষাও তেমন। বর্তমানে তিনি কেরলে তাঁর ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে স্বপ্ন বুনছেন। তরুণ অ্যাথলিটদের গড়েপিঠে নিচ্ছেন। তিনি তৈরি করেছেন টিন্টু লুকার মতো অ্যাথলিটকে। যিনি ২০১২-র লন্ডন অলিম্পিকে মহিলাদের ৮০০ মিটারের সেমিফাইনালে পৌঁছেছিলেন। বারবার গলা ফাটিয়েছেন এই বলে যে, উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পেলেই অলিম্পিকে আরও ভালো ফলাফল আসবে। কারণ তিনি জানেন কেবলমাত্র আচার সহযোগে ‘রাইস পরিজ’ বা ফেনা ভাত খেয়ে অলিম্পিকে ট্র্যাকে নামার ফল। হ্যাঁ, ’৮৪-র লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেম ভিলেজে এটাই খাদ্য ছিল ঊষার। যার পুষ্টিগুণ প্রায় ছিল না। হয়তো এই কারণেই রোমানিয়ার ক্রিস্টিয়েনো কোরোকারুর কাছে হেরে ব্রোঞ্জ হারিয়েছিলেন ঊষা। অপুষ্টিকর খাবারের জন্যই হয়তো শেষ ৩৫ মিটারে এনার্জি লেভেল এক রাখতে পারেননি ঊষা। তিনি তাই জানেন এত কাছে এসেও পদক হারানোর যন্ত্রণাটা। সেই কারণেই নাম্বিয়ার-বিহীন ঊষা একটা মৃত গাছ হলেও অলিম্পিক পদকবিহীন ঊষা কিন্তু মহিরুহ। তার ছায়ায় বাড়ছে তাঁরই ছাত্রছাত্রীরা। এভাবেই হয়তো পি টি ঊষার পুনর্জন্ম হবে। এইভাবেই হয়তো আরেক পি টি ঊষাকে আমরা খুঁজে পাব।
ঋণ:
১) অভিজিৎ ভট্টাচার্য। ২) শুভ্রাংশু রায়।
৩) পি টি ঊষাকে দীর্ঘদিন কভার করা সাংবাদিক নির্মল কুমার সাহা।
৪) Golden Girl: The Autobiography of P.T. Usha.
৫) আমি নাম্বিয়ার কন্যা: পি টি ঊষা। প্রকাশিত: 'খেলা' পত্রিকা, ১৯৮৬, ৭ নভেম্বর।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.