বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[খেলা]

[খেলা]

ভারতীয় কুস্তি সংস্থা নির্বাসিত

পদকজয়ী কুস্তিগিররা প্রতিযোগিতায় নামবেন দেশের নাম ছাড়াই

ভারতীয় কুস্তি সংস্থা নির্বাসিত

পদকজয়ী কুস্তিগিররা প্রতিযোগিতায় নামবেন দেশের নাম ছাড়াই

নিলয় ঘোষাল

photo

বিশ্ব কুস্তি সংস্থা শেষপর্যন্ত ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনকে নির্বাসন দিল।
সাম্প্রতিক কুস্তিগিরদের আন্দোলন কিছু নগ্নসত্যকে সামনে এনেছে। সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া বা ভিনেশ ফোগটের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক জয়ী কুস্তিগিররা ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের (WFI) প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগে প্রতিবাদ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
আসলে পরিকাঠামো ছাড়াই যে অমানুষিক অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে খেলয়ার দের এগোতে হয় তা উপলব্ধি করতে পারেন না বেশির ভাগ মানুষ। দোষ নেই, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থার স্পনসরসিপের এবং চাকচিক্কময় উপস্থাপনা জনমানসে খেলা বলতে ‘ক্রিকেট’কেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কারণ সেখানে আছে আর্থিক লাভ। অবশ্য মেয়েদের ক্রিকেট অতটা সম্মান পায়নি।
পরের স্তরে আছে ফুটবল, হকি ইত্যাদি দু’ একটা খেলা। বাকি যেসব খেলার ফুটেজ টিভি’তে দেখানো হয় বা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হয়, তার বেশির ভাগই মিডিয়া বা চ্যানেলকে টাকা দিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। অন্যান্য খেলার খেলোয়াড়দের ‘স্পন্সর’ পেতে কালঘাম ছোটে, প্রত্যাখ্যান শুনতে হয় বারবার। কোনও কোনও রাজ্যে ক্রীড়াক্ষেত্রে রাজ্য সরকারি ভুমিকা কিছুটা ভালো, কিন্তু তাও অপ্রতুল। কিছু রাজ্যের প্রাইভেট কলেজ, ইউনিভার্সিটি ক্রীড়াক্ষেত্রে অনেকটাই বিনিয়োগ করে। শুধু আর্থিক কারণে বেশিরভাগ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় অকালে হারিয়ে যায়।
প্রতিটি ক্রীড়া সংস্থার মাথায় বসে আছে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে অর্থবান, ক্ষমতাবান, অসৎ, নষ্টচরিত্রের কিছু মানুষ। যাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আমলা, নেতা-মন্ত্রী মহলে। যার ফলে, প্রতিটি খেলায় উপযুক্ত ছেলে-মেয়েরা হয় বঞ্চিত, আর মেয়েরা সেখানে চূড়ান্ত অরক্ষিত। তাদের নানান প্রকার যৌন হেনস্তার শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত। ক্রীড়া সংস্থাগুলির মাথায় বসে থাকা কদর্য মানুষগুলির লালসা মেটাতে পারলে উন্নতি সহজ।
বেশ কয়েক মাস আগেও কুস্তিগিররা ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের (WFI) প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগে আনেন। সরকার সেই সময়ে তাদের আশ্বস্ত করেছিল যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এইভাবে কালক্ষেপ করে ব্যপারটা ধামাচাপা দেবার প্রচেষ্টা হয়।
কিন্তু কোনও শাস্তি না হওয়ায় তারা ২৩ এপ্রিল থেকে ফেডারেশন প্রধানের পদত্যাগ এবং গ্রেপ্তারির দাবিতে আবার ধর্নায় বসেন।
প্রসঙ্গত জানাই, ব্রিজভূষণ শরণ সিং WFI প্রধান ছাড়াও বিজেপির একজন সংসদ সদস্য, নিজে কিন্তু মোটেই কুস্তিগির নয়। আর বিজেপি সরকার প্রথমে এই আন্দোলনের সম্পর্কে উদাসীন থেকেছে, আর তারপরই পুলিশ নাবিয়ে নির্মম ভাবে মাটিতে ফেলে লাঠিচার্জ করেছে। বিবিসি সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা নিন্দায় মুখর হয়েছে। ভারতেও বহু খ্যাতনামা খেলোয়াড় ও বিশিষ্ট ব্যক্তি ঐ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করেছেন।
ফেডারেশন প্রধান যে নারী কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা করেছিলেন বলে অভিযোগ, তাদের সবার বয়ান এখনও পুলিশ রেকর্ড করে নি বলেও জানিয়েছেন প্রতিবাদী কুস্তিগিররা।
এক সাংবাদিক সন্মেলনে কুস্তিগির ভিনেশ ফোগট অশ্রুসিক্ত অবস্থায় বলেন, “এই ব্যবহার পাওয়ার জন্যই কি দেশের জন্য পদক নিয়ে এসেছিলাম?“
তিনি তার জেতা সব পদক ফিরিয়ে দেওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এর আগেই পুলিশ ধর্নার এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়েছে।
এরই মধ্যে পুলিশের লাঠি চার্জের ঘটনা নিয়ে দিল্লি পুলিশের উপকমিশনার প্রণব তায়েল বলছেন, “অনুমতি ছাড়া ফোল্ডিং খাট আনা হচ্ছিল বলে আমরা বাধা দিই। সেই সময়ে কুস্তিগির আর তাদের কিছু সমর্থক ব্যারিকেডের সামনে চলে আসেন আর খাটগুলো ভেতরে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখনই কিছুটা ধাক্কাধাক্কি হয়েছে।” আসলে তার আগের রাত্রে প্রবল বৃষ্টিতে ধর্নাস্থলে জল জমে, তাই তারা ফোল্ডিং খাট নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন।
রেহাই পাননি দিল্লি মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়ালও, ওই ধর্না মঞ্চে রাতে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
ভারতের খেলোয়াড়দের সঙ্গে কর্মকর্তাদের মতভেদ হয়েই থাকে, কিন্তু তিন অলিম্পিকস পদক জয়ী, দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সহ এতজন কুস্তিগির ফেডারেশন প্রধানের শাস্তির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে ধর্না দিচ্ছেন রাস্তায় বসে, এরকম ঘটনা আগে হয় নি।
পদকজয়ী কুস্তিগির ভিনেশ ফোগট প্রথম যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলেন।
তিনি নিজে ফেডারেশন প্রধানের দ্বারা হেনস্থার শিকার না হলেও অন্তত সাত জন নারী কুস্তিগির তার কাছে যৌন হেনস্থার কথা জানিয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন কুস্তিগির ফোগট।
ওই সব হেনস্থা যেমন বিদেশে টুর্নামেন্ট চলাকালীন সময় হয়েছে, তেমনই WFI প্রধান দপ্তর যা আবার ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের আবাসস্থলেও হেনস্থা হয়েছে, বলে অভিযোগ।
হেনস্থার শিকার হওয়া কুস্তিগিরদের মধ্যে একজন নাবালিকা কুস্তিগিরও আছেন।
প্রথমে অভিযোগ জানাতে গেলে দিল্লি পুলিশ এফআইআর নিতে চায়নি, শেষে কুস্তিগিররা সুপ্রিম কোর্টে এ ব্যপারে অভিযোগ করায় শীর্ষ আদালতের নির্দেশে পরে এফআইআর নিতে বাধ্য হয় পুলিশ।
কুস্তিগীর সাক্ষী মালিক বলেন, “আমরা লড়াই করছি যাতে তরুণ ও উদীয়মান কুস্তিগীররা সরাসরি স্পন্সর পেতে পারেন, যা ব্রজভূষণ কিছুতেই হতে দেননি।“
ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধনের দিন দিল্লিতে মিছিল করতে গেলে পুলিশ বিখ্যাত কুস্তিগিরদের বলপ্রয়োগ করে আটক করে এবং তাদের ধর্না শিবির ভেঙ্গে দেয়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগিরদের ওপরে পুলিশের ওই বলপ্রয়োগের ঘটনাকে নিন্দা জানায় ‘আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটি’ এবং বিশ্ব কুস্তির নিয়ামক সংগঠন ‘ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড রেসলিং’।
ভারতের বিজেপি সরকার কোনও সদর্থক পদক্ষেপ না নিলেও, বিশ্ব কুস্তি সংস্থা কিন্তু কঠোর পদক্ষেপ করেছে। এই ঘটনায় ফেডারেশনকে সতর্ক করেছিল বিশ্ব কুস্তি সংস্থা ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড রেসলিঙ। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য এশীয় প্রতিযোগিতা সরিয়েও নেওয়া হয়। ফেডারেশনকে নির্বাচিত কমিটি দিয়ে পরিচালনা করতে হবে বলে নির্দেশও দেয়।
২৭ এপ্রিল ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থা (IOA) জাতীয় কুস্তির নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি অ্যাড-হক প্যানেল তৈরি করে দিয়েছিল। ঐ প্যানেল গঠন হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা।। বিশ্ব কুস্তি সংস্থার তরফেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল যে নির্বাচন না হলে WFIকে নির্বাসিত করা হবে। সেই নির্দেশের পরেও দু’ দফায় নির্বাচন পেছিয়ে দেয় ঐ অ্যাড-হক কমিটি। শেষপর্যন্ত বিশ্ব কুস্তি সংস্থা নির্বাসন দিল WFIকে।
এরই মধ্যে, WFI নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের একটি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন হরিয়ানা কুস্তি অ্যাসোসিয়েশনের সচিব ইন্দ্রজিৎ সিংহ। তাঁর দাবি ছিল, “তাঁদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে রিটার্নিং অফিসার ‘হরিয়ানা অ্যামেচার কুস্তি অ্যাসোসিয়েশন’কে ইলেক্টোরাল কলেজে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ ভাবে কোনও সংস্থাকে সদস্যপদ বা ভোটাধিকার দেওয়া যায় না। কোনও ক্রীড়া সংস্থা সদস্যপদ পাবে কিনা, তা ঠিক হতে পারে শুধু সর্বভারতীয় সংস্থার সাধারণ সভায়। তা ছাড়া রাজ্য অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের স্বীকৃত নয় এমন কোনও ক্রীড়া সংস্থা সেই খেলার সর্বভারতীয় সংস্থার সদস্য পদ পেতে পারে না।” অভিযোগ, আসলে নিজের সপক্ষে ভোট পেতে পেটোয়া লোক ও সংস্থাকে ঢোকাচ্ছে ব্রিজভূষণ। অত্যন্ত সুচতুর ভাবে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হল যে পরিণতিতে এইবার স্বীকৃতি সাসপেন্ড করে দেওয়া হল। প্রকারন্তরে ব্রিজভূষণের শাস্তি হল না, শাস্তি পেল WFI। আসন্ন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের কুস্তিগিরদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে ‘দেশহীন’ হিসাবে। ভারতের পতাকা ব্যবহার করতে পারবেন না তারা। তবে ২৩ সেপ্টেম্বর চীনের হাউঝোউইয়ে ‘এশিয়ান গেমসে’ তারা ভারতের হয়ে লড়তে পারবেন। এশিয়ান গেমসে প্রতিদ্বন্দ্বীদের তালিকা যাচ্ছে IOA র তরফে, ফেডারেশনের তরফে না। ‘দেশহীন’ হিসাবে দেশের খেলোয়াড়কে নামতে হলে একটা দেশের পক্ষে এটা কতবড় লজ্জার ব্যপার! আর এই লজ্জাজনক ঘটনা ঘটবে বিজেপি সরকারের দৌলতে।
জাতীয় ক্রীড়া নীতি অনুযায়ী ১২ বছরের বেশি সভাপতি পদে ব্রিজভূষণ নিজে এ বার প্রার্থী হতে পারেননি। তবে সভাপতি পদে সঞ্জয় কুমার সিংহ সহ ১৮ জন ঘনিষ্ঠ কর্তাকে প্রার্থী করছেন।
এই কলঙ্কময় ঘটনা শুধুমাত্র কুস্তিগিরদের ব্যাপার নয়। সমগ্র ক্রীড়াজগতের ব্যাপার। শ্রদ্ধা জানাতে হয় মহিলা কুস্তিগিরদের যারা আমাদের মতন রক্ষণশীল দেশেও নিজেদের কলঙ্কের ভয় না পেয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। আমরা গর্বিত।
আজ সমস্ত সুস্থ মানসিকতার সমস্ত মানুষের, বিশেষত সমস্ত ক্রীড়াজগতের মানুষের, কর্তব্য সরব হওয়া। আজ যারা রাষ্ট্রের, বিজেপির বা ক্রীড়া সংস্থাগুলি মাথায় বসে থাকা কদর্য মানুষগুলির ভয়ে মুখ খুলছেন না, কাল যদি আমার আপনার বাড়ির মেয়েকে এই নিগ্রহের মুখে পরতে হয়, তখন কিন্তু পাশে কাউকে থাকবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.