বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পশ্চিমবঙ্গে এক সামাজিক নব-জাগরণের ইঙ্গিত

পশ্চিমবঙ্গে এক সামাজিক নব-জাগরণের ইঙ্গিত

দীপক পিপলাই

photo

‘মানুষ’ আন্দোলন গড়ে তোলে। দুনিয়া জুড়ে ইতিহাসে তার অসংখ্য উদাহরণ আছে। কিন্তু আন্দোলন ‘মানুষ’ গড়ে তোলে, এমন ঘটনা চোখের সামনে দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে এখন। এই পশ্চিমবাংলায়। কোনও নির্দিষ্ট ‘দল’, কিম্বা ‘ঝাণ্ডা’, অথবা ‘আদর্শ’ নিয়ে না। পুরোপুরি ‘সামাজিক মানুষ’ হিসাবে।

সার্বিক অবক্ষয় দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সবদিক থেকেই। সমাজে কোনওকিছু ভালো এবং সুন্দর যে থাকতে পারে, সেই বিশ্বাসটুকুও মানুষের চলে যেতে বসেছিল! খুন, ধর্ষণ, চুরি, জালিয়াতি, তোলাবাজি, কুকথা, – সমাজ-জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছিল প্রতিদিন! মিথ্যা, অসততা, হুমকিবাজী, গুণ্ডাগিরি, এইসব অপগুণ ছাড়া রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী থাকতে পারে, জনগণের কাছে তা অলৌকিক কাহিনীর মতো হয়ে উঠছিল। অথচ এখানে একটা “⁸নির্বাচিত সরকার” ক্ষমতায় রয়েছে। তার জবরদস্ত্ পুলিশ-প্রশাসন-আমলাবাহিনী সবই মজুত আছে। আইন-আদালত-বিচারব্যবস্থা, কোনওকিছুরই অভাব নেই। সবই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তৈরি এবং পোষিত। অথচ, প্রত্যেকটি মানুষই এক দমবন্ধ করা পরিবেশে, ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছিলেন! সেই ভয় এবার ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

ধর্ষণ তো প্রতিদিনের পৈশাচিকতা হয়ে উঠেছে! এর সঙ্গে স্বাভাবিক যৌনতার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা ‘ক্ষমতা’ দেখানোর এক জঘন্য ও বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ। নারীর উপর পুরুষের; দুর্বলের উপর সবলের; গরীবের উপর বড়লোকের। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি সবরকম ধর্ষণেই সমাজ আজ বিদ্ধস্ত!

নারীর উপর পুরুষের ধর্ষণ হলেই ক্ষমতাসীন শাসক বলে ওঠেন “এরকম তো কতোই হয়”; অথবা “এটা সাজানো ঘটনা”; কিংবা “অন্যান্য রাজ্যেও ধর্ষণ হয়”; বা “এ সবই বিরোধীদের চক্রান্ত”; ইত্যাদি। মানুষ কিন্তু এসব নির্লজ্জ ও বিবেকহীন কথাবার্তা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন! যদি কেউ বা কারা শাসকের বিরোধিতা অথবা প্রতিবাদ করতে চান, তবে তাঁদের কুৎসিত ভাষায় শাসক পক্ষের গুণ্ডামি, গালাগালি ও হুমকির মুখে পড়তে হয়। এই রকম বিচিত্র ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা দেখতে দেখতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন।

হঠাৎ সবকিছুই কেমন যেন ওলটপালট হতে শুরু করলো একমাস আগে, ৯ অগস্ট থেকে। সরকারি আরজিকর হাসপাতালের এক তরুণী ডাক্তার ‘তিলোত্তমা’ হাসপাতালের মধ্যেই – ৩৬ ঘন্টা রোগীদের সেবা করার পর – বিভৎসভাবে ধর্ষিতা ও খুন হলেন! অকল্পনীয়! হাসপাতাল থেকে ‘তিলোত্তমা’-র বাবাকে ফোনে বলা হল, “আপনার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।” তারপর হাসপাতালে বাবা-মাকে তিনঘন্টা বসিয়ে রাখা হল, নিহত কন্যার দেহ দেখতে না দিয়ে! তড়িঘড়ি ‘তিলোত্তমা’-র মৃতদেহ পুড়িয়েও ফেলা হল! যেখানে ধর্ষণ ও খুন হয়েছিল, সেখানে বহু সন্দেহজনক ব্যক্তিও ভিড় করেছিলেন বাবা-মায়ের আগে! ফরেন্সিক পরীক্ষার আগেই ঘটনাস্থলে ভাঙচুর করা হল ‘সংস্কার’-এর অজুহাতে, যাতে ধর্ষণ-খুনের ‘সূত্র’ নষ্ট হওয়া অনিবার্য। সবকিছু থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, এটা কোনও বিকৃতকাম একজন মাত্র “আসল দোষী”-র কুকীর্তি হতে পারে না। এটা অনেক পিশাচের একটা সংগঠিত ও সুপরিকল্পিত ঘৃণ্য অপরাধ। ভয়ঙ্কর কোনও ‘চক্র’ জড়িত থাকার সম্ভাবনা ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠছে!

এই পৈশাচিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে, অভূতপূর্বভাবে সমাজ আন্দোলিত হতে শুরু করলো। অবিভক্ত বাংলা আর পশ্চিমবাংলা বহু যুগ ধরে, অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম দেখেছে। বহু সন্তানের রক্তে ভিজেছে এখানকার রাস্তা-মাঠ-ঘাট-শিক্ষালয়। কোনও দলের কর্মসূচি, অথবা কোনও নেতৃত্বের ডাক, কিংবা কোনও রাজনৈতিক পরিকল্পনা, – এগুলোর ভিত্তিতেই হয়েছিল আন্দোলনের আরম্ভ। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ খুন এক নতুন পর্বের সূত্রপাত ঘটালো।

সামাজিক ক্ষোভ ও ক্রোধের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ কাকে বলে, তার নয়া-ইতিহাস তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিরাতে। শুরু হওয়া এক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বলে মনেই হচ্ছে না। প্রতিমুহূর্তেই জন্ম নিচ্ছে এক নতুন সম্ভাবনা। এক নতুন আন্দোলন। প্রতিদিনই যার শুরু।

জীবনে কোনও মিছিলে যারা কখনও হাঁটার কথা ভাবেনও নি, তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে “বিচার চাই” (‘We Want Justice’); “বিচার পেতে, আলোর পথে”; “গর্জে উঠুক লক্ষ স্বর, জাস্টিস ফর আর জি কর”; “ক্ষুধার রাজ্য গদ্যময়, নারী তোমার খাদ্য নয়”; “পথে নেমে হোক লড়াই, তিলোত্তমার বিচার চাই”; “তিলোত্তমার মননে, ভয় পাইনে মরনে”; “চুড়ি পহেনকে হল্লা বোল”; “কন্ঠ যতোই করবে রোধ, বাড়বে ততোই প্রতিরোধ” শ্লোগান তুলছেন। পোস্টারে-ব্যানারে এইসব স্বতঃস্ফূর্ত দাবি নিয়েই পথ হাঁটছে কলকাতা। ‘তিলোত্তমা’-র ন্যায়বিচারের দাবিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মিছিলে পা মিলিয়েছেন। রাতের পর রাত জেগে পথেই কাটাচ্ছেন। একজন-দু’জন কিংবা একলক্ষ-দু’লক্ষ নন, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হচ্ছেন এই প্রতিবাদ আন্দোলনে। স্কুলের ছাত্রছাত্রী, কলেজ পড়ুয়া, প্রাক্তনী-শিক্ষার্থী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গবেষক, বিজ্ঞানকর্মী, সাহিত্যিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নাট্যকার, প্রযোজক, আইনজীবী, চিত্রশিল্পী, গৃহবধূ, অবসরপ্রাপ্ত, খেলোয়াড়, চির প্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল-প্রেমিক… ক্রমবর্ধমান এই কাতারে কে নেই? এ এক অভাবনীয় সামাজিক ঘটনা! যে অশীতিপর বৃদ্ধা শারীরিক অক্ষমতার জন্য রাস্তায় নামতে পারেন নি, তিনিও ঘর থেকে মোবাইলের আলো জ্বেলে সংহতি জানিয়েছেন। তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানশিক্ষক, বিজ্ঞানগবেষক, বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের ৩০০ জনের এক মিছিলের সামনে ব্যানারে লেখা ছিল, “আমরা আজ একসঙ্গে পথে নেমেছি, আগামীকালের সুরক্ষিত সমাজের জন্য”।

আসলে, পশ্চিমবঙ্গে সবকিছুই সাধারণ জনগণের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বহুদিন যাবৎ।
শাসন এবং বিচার, দুই ব্যবস্থাই ১০০ শতাংশ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন বলতে কিছুই আর নেই; কেউ-ই নেই; কোথাও-ই নেই। সরকারের কিছু বেতনভুক দাস আছে, যাদের কর্তব্যই হল সরকারি অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়া। তাই অভিযোগ জানাবার কোনও জায়গা নেই; অভিযোগ নেবার মতো মেরুদণ্ডী মানুষ নেই। যদি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবে দু’চারটে অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়েও থাকে, তা চাপা পড়েই থাকে। “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।” এটাই বাস্তব।

পুরো পশ্চিমবঙ্গই এখন আঁধারে ঢেকে আছে; বিষবাষ্পে ভরা! শাসক দলের ‘জনপ্রতিনিধি’-দের মুখনিঃসৃত অমৃত বাণীসমূহ সকলের হৃদয়কে ঋদ্ধ ও আনন্দে ভরপুর করে তুলছে! শাসকের দাসত্বে নিবেদিতপ্রাণ উচ্চশিক্ষিত আমলা-পুলিশের দল পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনকে তথা সারা পশ্চিমবঙ্গকে যে দুর্গন্ধযুক্ত পাঁকে ডুবিয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে একটু অন্তত দুর্গন্ধমুক্ত প্রশাসন আদৌ কবে দেখা যাবে, সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন!

শাসক বাচাল, কিংবা ‘বিশেষভাবে সক্ষম’, অথবা প্যাথলজিকালি অসৎ, তা দেখার কোনও দরকারই নেই।
সব আমলেই শাসকদের সঙ্গে চোর ও লুম্পেনরা থাকে। এখন চোর এবং লুম্পেনদের দলেই শাসক রয়েছেন। এটাই পার্থক্য।
তবে, ‘সমাজ’ এখন উৎসাহব্যঞ্জক ভাবে জেগে উঠছে।

হ্যাঁ, শাসকের উচ্ছিষ্টভোগী কিছু মেরুদণ্ডহীন অবশ্যই চেষ্টায় খামতি রাখছে না। আর উদো-মাস্তানবাহিনী চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বালখিল্যসুলভ হুমকি-ধমকি।
যারা খুব বেশি ফটরফটর করছে, জনগণকে ধমকানো-চমকানোর স্পর্ধা দেখাচ্ছে, অসহ্য ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে মানুষকে যখনতখন অপমান করছে, পশ্চিমবঙ্গের ন্যূনতম ইতিহাসটুকুও আসলে তাদের জানা নেই। থাকলে, একটু সমঝে চলতো। এইসব ছেনো মস্তানদের জ্ঞাতার্থে, পুরানো একটা উদাহরণ দিই।

কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি ভেঙে বেরিয়ে এসে লক্ষ্মীকান্ত বসু নতুন পাল্টা সংগঠন গড়ে তুলেছেন এনএলসিসি। তারাতলা রোডের জে স্টোন কোম্পানিতে তখন শ্রমিক আন্দোলন চলছে। দাপুটে নেতা লক্ষ্মীকান্ত বসু সেই আন্দোলন ভাঙতে একদিন নিজে সেখানে গিয়ে হাজির। গাড়ি থেকে নেমে, রিভলবার হাতে এগোচ্ছেন শ্রমিকদের জমায়েতের দিকে। শ্রমিকরা দূর থেকে দেখেই, দলবদ্ধভাবে হাতে রড-লাঠি নিয়ে তাড়া করেছেন। হাতে খোলা রিভলবার নিয়ে, লক্ষ্মীকান্ত বসুরা উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছেন প্রাণভয়ে। এই হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ।

লালবাজারে ধীরস্থির, শান্ত কিন্তু দৃঢ়চিত্ত, জুনিয়ার ও সিনিয়ার ডাক্তারবাবুদের সাহসী মেরুদণ্ড পশ্চিমবঙ্গবাসীদের মনে নতুন করে সাহস যোগাচ্ছে। বোবা, ভীত, শঙ্কিত মানুষের দীর্ঘদিনের জড়তা এই গণ-আন্দোলনের প্রভাবে কেটে যাচ্ছে। মানুষ সাহস পাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। প্রশ্ন করছে। শ্লোগান তুলছে। পচনশীল সমাজকে সাবধানবাণী শোনাচ্ছে। এক সামাজিক নব-জাগরণের জোয়ার আমরা এখন দেখছি।

‘সময়ের বাণী’ বড়োই সুগন্ধি। ‘দেয়ালের লিখন’ খুবই আশাপ্রদ। “The time is always right to do what is right.” (মার্টিন লুথার কিং)।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.