বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

অভয়া আন্দোলন: কথোপকথন
ডা. পুণ্যব্রত গুণের সাক্ষাৎকার

অভয়া আন্দোলন: কথোপকথন
ডা. পুণ্যব্রত গুণের সাক্ষাৎকার

ঊর্মিমালা

photo

শ্রমজীবী ভাষা: অভয়া মঞ্চ কি?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: অভয়া আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ নেবার পর থেকেই বিভিন্ন গণসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের সমর্থনকে একটা সাংগঠনিক রূপ দেবার দাবি উঠতে থাকে। অক্টোবরের শুরু থেকে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল (২০১৭ সালে গঠিত পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি চিকিৎসক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ) এই গণসংগঠনগুলোর সঙ্গে যৌথ কর্মসূচি নিতে থাকে, যেমন কলেজ স্কোয়ার থেকে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস পর্যন্ত দীর্ঘ মিছিল বা দ্রোহের কার্নিভাল। অবশেষে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল এবং প্রায় ৮০টি গণসংগঠন মিলে ২৮ অক্টোবর গঠিত হয় অভয়া মঞ্চ।
তিনটি সাধারণ লক্ষ্যে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। প্রথম হল অভয়ার বিচার। আর জি করের অভয়া ও অভয়ার মতো যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের ধর্ষকদের ও যারা তাদের আড়াল করেছে তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। ভবিষ্যতে আর যেন অভয়া না হয়, এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা। দ্বিতীয় হল, নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার এবং সুরক্ষা। তৃতীয়ত, রাজ্যকে ভয়ের রাজনীতি মুক্ত করা। এই সভাতেই তিনজন আহ্বায়কের নাম প্রস্তাবিত হয় আমি, ডা. তমোনাশ চৌধুরী এবং মণীষা আদক।
এই আশিটা গণসংগঠনের মধ্যে এই পর্যায়ে গড়ে ওঠা সংগঠনও আছে, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান মহাম্যাডান সমর্থক যাঁরা অভয়ার বিচারের দাবি তুলেছিল তাঁরা আছেন, তেমন এপিডিআর, ব্যাঙ্ক বাঁচাও দেশ বাঁচাও-এর মতো পুরোনো সংগঠনও রয়েছে।
গণসংগঠনগুলো থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি (নিয়মিত ও বিকল্প) নিয়ে মুখোমুখি আলোচনার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

শ্রমজীবী ভাষা: এই আন্দোলন বা অভয়া মঞ্চ কি ‘অরাজনৈতিক’?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: অভয়া মঞ্চ বা জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল কখনোই এই আন্দোলনটাকে অরাজনৈতিক আন্দোলন বলেনি। আমরা মনে করিনা, এই পৃথিবীতে কোনও কিছু অরাজনৈতিক হতে পারে। বিশেষ করে ভয়ের রাজনীতির বিরোধিতা করাটা যখন আমাদের ঘোষিত লক্ষ্য। আমরা দলীয় আনুগত্যহীন। এটা অরাজনৈতিক নয়, অদলীয় বলা যায়। অনেক রাজনৈতিক মতের মানুষ, নিজস্ব দলীয় আনুগত্য বাদ দিয়ে সাধারণ কিছু লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছি।

শ্রমজীবী ভাষা: আমাদের দেশে যেখানে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার কথা সর্বজনবিদিত, যেখানে ২০২৪-এ শুধু পশ্চিমবঙ্গেই বকেয়া ধর্ষণ ও পকসো মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০ হাজার, সেখানে দ্রুত বিচার কার কাছে চাওয়া হচ্ছে? কি ধরনের বিচার পাওয়া যাবে বলে মনে করেন?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: আমাদের দেশে বিচারের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রিতা আছে এ নিয়ে আমাদের কোনও মোহ নেই। কিন্তু শুনানি স্থগিত রাখা, দেরি করে পরবর্তী শুনানির দিন ফেলা ইত্যাদি যেসব উপায়ে বিচার প্রক্রিয়াকে অকারণ বিলম্বিত করা হয়ে থাকে, সেটাকে আমরা প্রতিহত করতে চাই। কোর্ট যেন যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে কাজটা করে। তাছাড়া সিবিআই দায়িত্ব নিয়েছে বলেই সব সমাধান পাওয়া যাবে এমনটাও আমরা বিশ্বাস করি না, কারণ সিবিআই কাজ করে PMO-র অধীনে। রাজ্যের বড় বড় অনেক কেসেরই সমাধান হয়নি। আমাদের অনুমান সিবিআই-র কাছে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে। সেটাকে যাতে তারা সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে জমা করে এবং সমস্ত সন্দেহভাজনকে তদন্তের আওতায় নিয়ে আসে, সেটাই আমাদের দাবি। এটা দ্রুত বা কম সময়ে হবে না, কিন্তু আমরা যদি রাস্তায় না থাকি, আন্দোলনের দ্বারা চাপ সৃষ্টি না করি তাহলে এটুকুও আদায় করা যাবে না। এনকাউন্টার করে দেওয়া বা তড়িঘড়ি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবার মতো বিচার আমাদের কাম্য নয়, আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিচারের প্রত্যাশী।

শ্রমজীবী ভাষা: মূলত প্রচারমাধ্যমের সাহায্যেই বিপুলসংখ্যক মানুষকে এই আন্দোলনে টেনে আনা সম্ভব হয়েছিল। বিশেষ কোনও সংগঠন ছাড়া, রাজনৈতিক দল ছাড়া?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: এই আন্দোলন সম্পূর্ণত ‘মিডিয়া ক্রিয়েটেড’ এমনটা নয়। নিশ্চিতভাবে এর মধ্যে সংগঠিত শক্তি ছিল, যেমন চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে আমি বলতে পারি যে, সিনিয়র চিকিৎসক সংগঠনসহ আরো বহু সংগঠনই এই আন্দোলনে ছিল। আবার জুনিয়র ডাক্তারদের মতো অনেকে ছিলেন যারা আন্দোলনের শুরুতে সংগঠিত না থাকলেও পরবর্তীতে সংগঠিত হয়েছেন। ১৪ অগস্ট তারিখের বিপুল সংখ্যক মহিলাদের অংশ নেবার অন্যতম কারণ মহিলাদের রাতে বেরোনো রুখতে মুখ্যমন্ত্রীর ‘রাতের সাথি’ ঘোষণা। তাই পুরো আন্দোলনটা মিডিয়ার তৈরি করা এমনটা নয় ।

শ্রমজীবী ভাষা: আন্দোলনের এই বিপুল স্বতঃস্ফূর্ততা বা আবেগ কত দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: ভিলাইয়ের শ্রমিক আন্দোলন থেকে শুরু করে বেশ কিছু কিছু বড় আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছি, আমার অভিজ্ঞতা হল কোনও আন্দোলনই একমাত্রিক ভাবে একই গতিতে চলে না। স্বতঃস্ফূর্ততা আসে এক একটা মুহূর্তে। সব আন্দোলনেই জোয়ার-ভাঁটা থাকে।

শ্রমজীবী ভাষা: গণমাধ্যম বিশেষ করে মূলধারার মিডিয়া অভয়া আন্দোলনকে যথেষ্ঠ প্রচার দিয়েছে বা দিচ্ছে। এর কারণ কি বলে মনে হয়? কারণ আমরা এই শ্রেণীর গদি মিডিয়াকেই দেখি কৃষক আন্দোলনের মতো গণআন্দোলনগুলোকে তারা সচরাচর ঢেকে রাখে।
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: একটা সময়ের পর থেকে দু’-একটা মিডিয়া বাদ দিয়ে বেশিরভাগ মিডিয়া কিন্তু বিরুদ্ধ প্রচার শুরু করেছে। বেশির ভাগ কিন্তু পজিটিভ রোল নেয় নি।

শ্রমজীবী ভাষা: গোটা আন্দোলনটি আপাতত কয়েকটি ইস্যুআদায় ভিত্তিক। এই বিপুল জনজোয়ার সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে? জনমত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা কি শুধু অনুষ্ঠান-কার্নিভালের মঞ্চে মঞ্চেই হবে?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: ১০ দফা দাবিপত্র জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের দাবিপত্র। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স বা অভয়া মঞ্চের নয়। এই ১০ দফার মধ্যে তিনটে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত (centralised referral system, bed vacancy status ও শূন্যপদে লোক নিয়োগ)। আমরা জানি যে, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে পরিবর্তন প্রয়োজন সেটা এই তিনটে দাবি মিটলেই সম্পূর্ণ হয় না। প্রয়োজন সবার জন্য স্বাস্থ্য — ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স-এর সংগঠনগুলো স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবিগুলো মানুষের মধ্যে প্রচারের কাজ বহুদিন ধরেই করছে। সেভাবেই এখন অভয়া মঞ্চের সংগঠনগুলোর সদস্যদের নিয়ে আমরা স্বাস্থ্য অধিকার ও সুরক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন শিক্ষাশিবিরের আয়োজন করছি। কারণ শুধু বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলন করে কোনও পরিবর্তনই আনতে পারবে না, পরিবর্তন আনতে পারে সাধারণ মানুষ। তাঁদের কাছে বার্তা পৌঁছানোর সেই উদ্যোগটাই আমরা নিয়েছি। কেবল শহর অঞ্চলে নয়, জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়বার প্রক্রিয়াও চলছে। কিন্তু কতটা সফল হতে পারবো সেটা তো এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলা সম্ভব নয়।

শ্রমজীবী ভাষা: গরিব শ্রমজীবী মানুষের, গ্রামের মানুষের কিছু কিছু প্রতীকী অংশগ্রহণ থাকলেও মূলত এই আন্দোলন শহর কেন্দ্রিক। তাই কেউ কেউ বলতে চান এই আন্দোলন কিছু উচ্চমধ্যবিত্তদের পয়সায় শহুরে মধ্যবিত্তদের হুজুগ। এই প্রসঙ্গে আপনারা উত্তর দিতে চান?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: ডক্টর্সস ডায়ালগ-এ অভয়া মঞ্চের সদস্য গোপা মুখার্জির লেখায় এর উত্তরগুলো পাবেন। https://thedoctorsdialogue.com/peoples-movement-politics-of-democrarcy-lessons-for-futurs/
https://thedoctorsdialogue.com/fire-of-revolt-or-middle-class-thoughts/

শ্রমজীবী ভাষা: এই আন্দোলনের জমায়েতগুলোতে যেভাবে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা হচ্ছে, প্রবেশপত্র পেয়ে যাচ্ছে দেশভক্তি, জাতীয়তাবাদ কিংবা ব্রাহ্মণ্যবাদ। দেবী দুর্গাকে করা হচ্ছে নির্যাতিতার প্রতীক। এই প্রসঙ্গে আপনার উত্তর?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: সাধারণ মানুষ যে আবেগ নিয়ে জাতীয় পতাকা তুলছেন বা সংবিধানকে যে মর্যাদা দিচ্ছেন, সেখানে আমার মনে হয়েছে ব্যক্তিগত ভাবে আমি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি বা না-করি, সাধারণ মানুষের আকাঙ্খাকে মূল্য দেওয়া উচিত। পাশাপাশি যদি আমাদের দেশের স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপটা মানুষকে বোঝাতে পারি, তাহলে আমার মনে হয় না এতে বিপদ আছে। আর মানুষ তো কিছু অধিকার রক্ষা করার জায়গা থেকেই সংবিধান হাতে তুলছেন। দুর্গার সঙ্গে তুলনা করাটা অংশগ্রহণকারীরা কেউ কেউ আবেগের বশে করে থাকেন। তবে আমরা চেষ্টা করি, সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মসংক্রান্ত প্রতীক বা অনুষ্ঠানগুলো বাদ দিতে। মালদায় একটা অনুষ্ঠানে একটি প্রতিবাদের নৃত্যে দেবী দুর্গার নাচ করেছিল দুটি মেয়ে, তাঁদের একজন হিন্দু অপরজন মুসলমান। এমন অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছে। সুতরাং তর্কের খাতিরে আমরা যে একমাত্রিক চোখ দিয়ে প্রতীকগুলোর ব্যাখ্যা করি, যাঁরা প্রতীকগুলো ব্যবহার করছেন তাঁদের চোখে তেমনটা সবসময় নাও হতে পারে।

শ্রমজীবী ভাষা: বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররাও এই আন্দোলনের সমর্থনে থেকেছেন। তাঁরা কি সত্যিই বেসরকারি হাসপাতালের দুর্মূল্যতা, ডাক্তার-কর্পোরেট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: বেসরকারি ডাক্তাররা হাসপাতালের মালিক নন। হাসপাতালের যে রোজগার হয় তার ১০% থেকে ১২% তাঁরা পান। রোগীর কাছ থেকে যদি ১০০ টাকা নেওয়া হয় তার ১০-১২ টাকা তাঁরা পান, কোভিডের সময় এটা কমে আড়াই টাকা হয়েছিল। বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও সরকারি ডাক্তারদের থেকে বেসরকারি ডাক্তারদের জীবনটা অনেক কষ্টকর। তাঁদের কোনও নিরাপত্তা নেই, যেকোনও সময় তাঁদের কনট্র্যাক্ট শেষ করে দেওয়া যায় তার জন্য কোনও আইনি সুরক্ষা নেই। টার্গেট পূরণ করতে না পারলে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়। যাঁরা এই প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের কাছে পাল্টা প্রশ্ন যে চিকিৎসা নিতে আপনারা কেন বেসরকারি জায়গায় যান? স্বাস্থ্যটা মৌলিক মানবাধিকার হওয়া উচিত ছিল। ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সনদে তাই ছিল। কিন্তু আমাদের সংবিধানে স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পায়নি। সরকার আমাদের কাছে কর নেন, এমনকি যাঁরা কর দেন না তাঁরাও কিন্তু কোনও না কোনওভাবে সরকারকে প্রতি মুহূর্তে কর দিচ্ছেন। তারই একটা অংশ সরকার খরচ করেন স্বাস্থ্যখাতে, যেটা অতি সামান্য। কেন্দ্রীয় বাজেটে খরচের ৭ নম্বরে রয়েছে স্বাস্থ্য। অথচ ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ আমলা জন ভোর কমিটির রেকমেন্ডেশন মানা হলে সরকারি খরচে মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা হতে পারতো। আমরা যখন ডাক্তারি পড়েছি তখনো সরকারি হাসপাতালে ফ্রিতে সব কিছু পাওয়া যেত, এন্টিবায়োটিক থেকে ক্যান্সারের ওষুধ। কিন্তু পরবর্তীতে দেশের বা রাজ্যের সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের কাছে নতিস্বীকার করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সার্ভিস সেক্টরগুলো থেকে ক্রমাগত সরে এসেছে। তার ফল আজ ভুগতে হচ্ছে। এজন্য প্রাইভেট ডাক্তারদের দায়ী করলে, আড়াল করা হয় আসল দোষী সরকার পক্ষকে। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স ২০১৯-এ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একটা দাবিসনদ দিয়েছিল, ডক্টর্স চার্টার অফ ডিমান্ড, সেখানে বলা ছিল আমরা এমন একটা ব্যবস্থা চাই যেখানে রোগীর সঙ্গে চিকিৎসক-চিকিৎসা কর্মীদের পয়সার আদানপ্রদান থাকবে না। চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মীরা হবেন রাষ্ট্রের বেতনভুক। এটা কাল্পনিক না, পৃথিবীর ৪০% দেশে এটা বাস্তব। সরকার ‘আয়ুষ্মান ভারত’ বা ‘স্বাস্থ্যসাথী’তে ব্যয় না করে, কেন নিজের পরিকাঠামোকে উন্নত করবে না, এই দাবি না করে, স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা না বলে বেসরকারি ডাক্তারদের দায়ী করা ভুল।
তাছাড়া একজন খারাপ মানুষও যদি একটা ভাল ইস্যুতে প্রতিবাদ করলে আপনি তাকে সঙ্গে নেবেন না?

শ্রমজীবী ভাষা: জেলা ব্লকের সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর বেহাল অবস্থাই কি শহরের হাসপাতালগুলোয় ভিড় এবং অব্যবস্থার অন্যতম কারণ নয়? স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি বাজেট কি যথেষ্ঠ? সেই প্রশ্নগুলো কি এই আন্দোলনের অংশ নয়?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবি নিয়ে, আমাদের সংগঠন, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্সস ফোরাম বহুদিন ধরেই সরব। ২০১২র শেষে একটা হাতিয়ার এসেছিল। ২০১০এ প্ল্যানিং কমিশন সবার জন্য স্বাস্থ্যের লক্ষ্যে উচ্চস্তরীয় একটা বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে। ২০১০এ জিডিপির ৪.১% স্বাস্থ্যখাতে খরচ হতো (১.৪% সরকারের, বাকি প্রাইভেট, যার বেশির ভাগটাই আসতো রোগীর পকেট থেকে)। ২০১১তে তাঁদের সুপারিশের মূল কথাটা ছিল, ২০১৭র মধ্যে সরকারের খরচ বাড়িয়ে ২.৫% করতে হবে। ২০২২ র মধ্যে ৩% করতে হবে। এরপরে যে তিন বছর ইউপিএ সরকার ছিল, সেসময় সরকারের খরচ সামান্য বাড়িয়ে ১.৫৮% করা হয়। আর ২০১৪ সালে মোদি এসে প্রথমেই স্বাস্থ্যখাতে ২০% ব্যয় কমিয়ে দেয়। এখন সরকার স্বাস্থ্যখাতে গড়ে জিডিপির ১% খরচ করে। যার বেশির ভাগটাই খরচ করে বীমাগুলোর প্রিমিয়াম দেওয়াতে। যার অর্থ সরকার বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে জনগণের করের টাকাটা তুলে দিচ্ছে। এই ব্যবস্থাটা পাল্টাতে গেলে কি লাগবে? যেসব দেশে ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার আছে সেখানেও শাসককে বাধ্য করতে হয়েছে। সরকারকে বাধ্য করতে পারেন সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষকে সচেতন করার সেই কাজ আমরা ২০১৩ থেকেই করে চলেছি, ছাত্র ও বিজ্ঞান সংগঠনগুলোর সাহায্যে আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে। এই লক্ষ্যে ২০১৫তে ‘অল ওয়েস্ট বেঙ্গল হেল্প ফর অল ক্যাম্পেইন’ কমিটি তৈরি করেছি। ২০১৬ জানুয়ারিতে বিভিন্ন জেলায় জাঠা ও কনভেনশন করে আন্দোলন তীব্র করেছি। সেখানে হাই লেভেল গ্রুপের চেয়ারপারসন শ্রীনাথ রেড্ডি, বিনায়েক সেন, অরুণ সিং ছিলেন। ২০১৭ থেকে আমাদের সঙ্গে অন্যান্য ডাক্তারদের সংগঠনগুলোও ক্রমে সচেতন বা সরব হয়। এখন অভয়া মঞ্চের মধ্যে দিয়ে সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবিকে তীব্র করার একটা সুযোগ এসেছে, সেটা আমরা যেখানে যেভাবে পারবো করবার চেষ্টা করবো।

শ্রমজীবী ভাষা: এই আন্দোলনে নার্স, আয়া, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবকর্মী, মর্গ প্রমুখ সহায়কদের নিরাপত্তা, দাবিদাওয়া ও অংশগ্রহণ সম্পর্কে কি ভাবছেন?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: আমরা সুরক্ষা চাই চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীদের। সুরক্ষা কেবল সিসিটিভি, আলো কি নিরাপত্তা রক্ষী দিয়ে হতে পারে না। চিকিৎসক সহ ফ্রন্ট লাইনার-রা মূলত আক্রান্ত হন রোগীর বাড়ির লোকজনের দ্বারা। তাঁদের মনে তৈরি হওয়া ক্ষোভ যাঁরা সামনে থাকেন তাঁদের ওপর আছড়ে পড়ে। কিন্তু যে উপযুক্ত পরিষেবার অভাব ওই ক্ষোভের কারণ তার প্রকৃত দায়ভার প্রশাসনের, স্বাস্থ্যসচিবের মতো পদাধিকারীদের। অর্থাৎ চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষাও কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত।

শ্রমজীবী ভাষা: অভয়া আন্দোলনে সরকারি ডাক্তার পড়ুয়াদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, কর্মবিরতি কি পরোক্ষে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিঠানগুলোর পক্ষে চলে যাচ্ছে না?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে বোঝায় প্রাথমিক থেকে টারশিয়ারি প্রতিষ্ঠান অবধি, যার মধ্যে কর্মবিরতি কিন্তু চলেছে শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই। বাকি জায়গায় কিন্তু পরিষেবা আগের মতোই চালু ছিল। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও যেসব সিনিয়র সরকারি চিকিৎসক বা শিক্ষক চিকিৎসকরা ছিলাম, আমরা কিন্তু ঐসময়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের হয়ে সেইসব পরিষেবাগুলো, ইনডোর, আউটডোর, এমার্জেন্সি ইত্যাদি চালু রেখেছি। তবুও স্বাভাবিকভাবেই ধর্মঘটের খবর পেয়ে, ভিড় কিছুটা কম ছিল, ঐসময় কিছু মানুষ চিকিৎসার জন্য অন্য কোথাও গিয়ে থাকবেন। কিন্তু পরিকল্পনা করে ধর্মঘট করে বেসরকারি প্রতিঠানগুলোর ব্যবসা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা শাসকের সুরে কথা বলছেন।

শ্রমজীবী ভাষা: ওষুধ বা মৃতদেহ নিয়ে ব্যবসা শুধু কি একটা আরজিকর হাসপাতালে? কিংবা প্রশ্নপত্র বিক্রি ব্যবস্থা? শুধু কি আমাদের রাজ্যেই? তাহলে কেবল কিছু লোককে বরখাস্ত করে লাভ কি? এই আন্দোলন কি ডাক্তারদের এক লবি থেকে অন্য লবির হাতে ক্ষমতা ট্রান্সফার হওয়ার লড়াই?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো তার প্রত্যক্ষ দাবিগুলোর কথা আমাদের বলতেই হবে, কিন্তু সত্যি যদি এই ‘মন্দ’গুলো থেকে মুক্তি পেতে হয় তাহলে আমাদের যেতে হবেই “ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার”-এর পথে।
যদি স্বাস্থ্যকে আপনি পণ্য হিসেবে ধরেন (যদিও আমরা মনে করি স্বাস্থ্য হওয়া উচিত পরিষেবা) তাহলে অন্য পণ্যের থেকে এর একটা তফাৎ আছে। কারণ ওষুধ বা স্বাস্থ্যপরীক্ষা আপনাকে করাতে হয় ডাক্তারের মতানুসারে। ফলে ডাক্তার দুর্নীতিগ্রস্ত হলে রোগীর বিপদ ধনে-প্রাণে। অথচ এই দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের মধ্যে থেকে সব ডাক্তাররাই যে ধোয়া তুলসীপাতা হবেন তেমনটা হতে পারে না। সুতরাং এমন একটা ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে দুর্নীতির সুযোগ কম। সেটাই হচ্ছে “ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার”। কিউবা বা ইউনাইটেড কিংডমে এর যে রূপটা প্রচলিত, তা হল অসুস্থ হলে কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন, কোথা থেকে ওষুধ কিনবেন, কোন ল্যাবে টেস্ট করাবেন, সেটা পূর্ব নির্ধারিত, সেখানে কোনও পয়সা লাগবে না। সেখানে স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইড লাইনে (প্রামাণ্য চিকিৎসা বিধি) নির্দিষ্ট করা থাকে কোন উপসর্গ থাকলে কি ওষুধে চিকিৎসা হবে, কি কি টেস্ট করা হবে। সব চিকিৎসককেই সেটা মেনে চলতে হয়। উপযুক্ত কারণ ঘটলে তবেই চিকিৎসক প্রয়োজনীয় বিকল্প ব্যবস্থা নিতে পারেন। কোন ক্ষেত্রে জেনারেল ফিজিসিয়ান কোন স্পেশালিস্টের কাছে রেফার করবে সেগুলোও নির্দিষ্ট করা থাকে। অর্থাৎ একটা full proof সিস্টেম। সুতরাং টেস্ট লিখে ডাক্তারদের কমিশন পাওয়া বা বিদেশ যাওয়ার সুযোগ সেখানে নেই।

শ্রমজীবী ভাষা: কঠোরতর আইন এনে, মৃত্যুদন্ড দিয়ে অপরাধীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখা যায় কি? অভয়ার আন্দোলনেও এমন দাবি শোনা যাচ্ছে। এ সম্পর্কে অভয়া মঞ্চের মত কি?
ডা. পুণ্যব্রত গুণ: অভয়া মঞ্চ হিসেবে আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলেছি। ফাঁসির পক্ষে বা বিপক্ষে অভয়া মঞ্চ কোনও স্ট্যান্ড নেয়নি। আমাদের বেশির ভাগই হয়তো মনে করেন না যে ফাঁসি দিয়ে অপরাধকে রোধ করা যায়। প্রয়োজন সামাজিক অবস্থাটাকে পাল্টানো।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.