বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা: অভয়া মঞ্চ কি ভাবে স্লোগান নির্বাচন করে? এক্ষেত্রে কি নিজেদের মধ্যে বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়?
মণীষা আদক: গোটা রাজ্য জুড়েই অভয়ার বিচারের দাবিতে নানান স্লোগান উঠেছিল, কখনো জুনিয়র ডাক্তাররা দিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীরা, কখনো নাগরিকরা দিয়েছেন। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মতো। কিছু স্লোগান তাৎক্ষণিক তৈরি হয়েছে। কিন্তু যে স্লোগানগুলো আমরা বেশি বেশি বলেছি “We want justice” বা “তিলোত্তমা ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই” সেগুলো কিন্তু শুরু থেকে রাজ্য জুড়ে সবাই দিয়েছে। We want justice তো এখন আমাদের কাছে একটা বাণীর মত হয়ে গেছে। তাই স্লোগানগুলো পরিকল্পনা করে কিছু তৈরি করা এমন নয়।
অভয়া মঞ্চ একটা মঞ্চ যেখানে ৮০টার বেশি সংগঠন আছে এবং কোনও নির্দিষ্ট দল এটা পরিচালনা করছে না। স্বাভাবিকভাবেই কিছু মতানৈক্য হয়তো হয়েছে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটা পারস্পরিক বোঝাবুঝির জায়গাতেও আমরা পৌঁছেছি, কখনো বয়ঃকনিষ্ঠদের কিছু হয়তো বুঝিয়ে বারণ করেছি যে এটা বলার দরকার নেই। কখনো একটু রাগ করেছে, মেনেও নিয়েছে। এভাবেই একটা বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে চলেছে।
শ্রমজীবী ভাষা: এই আন্দোলন কি ‘অরাজনৈতিক’? অভয়া মঞ্চ কি ‘অরাজনৈতিক’?
মণীষা আদক: যেহেতু একটা রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি। তাই এই আন্দোলন অদলীয় হতে পারে, কিন্তু ‘অরাজনৈতিক’ কোনওভাবেই হতে পারে না। অভয়া মঞ্চ কোনও দল নয়, একটা মঞ্চ যেখানে একটা নির্দিষ্ট দাবিতে বিভিন্ন মতের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
শ্রমজীবী ভাষা: বিচার কার কাছে চাওয়া হচ্ছে? ধর্ষণ তো চিরকালই হয়ে এসেছে তাহলে?
মণীষা আদক: যে কোনও আন্দোলন যখন শুরু হয় তার পিছনে থাকে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বঞ্চনা বা অত্যাচার। ধরুন সতীদাহ প্রথা রদ বা বিধবা বিবাহ আন্দোলনের কথাও যদি ভাবি, তার আগেও এমন বহু ঘটনা ঘটেছিল, হয়তো কিছু মানুষ তার বিরুদ্ধেও কথা বলেছিলেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে সেই আন্দোলনটা রূপ পায় এবং পরবর্তীকালে তার একটা ফলও আমরা পাই। সেভাবেই আমি মনে করি, ধর্ষণ যে আজকে নতুন তা নয়। অতীতেও ঘটেছে। শুধু রাজ্যে কেন, গোটা দেশ ও পৃথিবীতে। কিন্তু চলে এসেছে বলেই যে সেটার বিরুদ্ধে আজকে আমরা বলবো না বা আন্দোলন গড়ে উঠবে না সেটা হতে পারে না। তাই আমি মনে করি খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে থেকেও ২০২৪ একটা ভাল বছরও বটে। কারণ যে আন্দোলনটা হবার দরকার ছিল কিন্তু হয়নি সেটা হয়ত শুরু হল।
শ্রমজীবী ভাষা: নারীর অধিকারের লড়াই তো পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ভিতরের অসাম্য ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই, সেটা তো প্রতিদিন প্রতিটা মেয়েকে নিজের জীবনে লড়তে হয়। সেটা কি আন্দোলনের মঞ্চে লড়া যায়?
মণীষা আদক: আমি পুরুষতান্ত্রিকতা কথাটা এখন আর বলি না, বলি অধিকারতন্ত্র। যেহেতু নারী বা পুরুষের ওপর বিষয়টা এখন আর নির্ভর করে না। মানে দখলদারি, সেটা নারী কর্তৃকও হতে পারে। যে কোনও আন্দোলন মানুষকে ধাক্কা দেয়। যেমন আমি হয়তো বাড়িতে রোজ ভাবি যে আমার বাড়িতে যেটা ঘটছে সেটা অনুচিত। সেজন্য আমি হয়তো একা একা কষ্ট পাই। কিন্তু যখন দেখি, ওই কষ্টের কথাটাই আমার পাড়ার সামনে কেউ চিৎকার করে বলছেন, বাড়িতেও যে অত্যাচারিত হচ্ছেন তাঁর মুখ খোলা উচিত। তখন আমি কিছুটা জোর পাই। সুতরাং আন্দোলনের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। ভিতরে ভিতরে নিজেদের মধ্যে একা ভাবা এক জিনিস কিন্তু বাইরে যখন একটা স্বর শুনি তখন কিন্তু আমরা এক থেকে অনেকে পরিণত হই। তখন আমার মনের ভিতরের শক্তিটাও আরো জোরালো হয়। বুঝতে পারি যে কষ্ট আমার একার নয়, লড়াইটাও আমার একার নয়। তখন আমি অনেক বেশি শক্তিশালী হই। একজন চাষিও যদি দিনের পর দিন বঞ্চিত থাকেন, তাঁর জন্যও একটা কৃষক আন্দোলন জরুরি। তখন সে বল পায়। তখন প্রতিটি চাষি আরো জোরে বলতে পারেন যে তিনি কি চান। অভয়া আন্দোলন মেয়েদের তো বটেই, প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের, বা আরো বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলব যে, শুধু মেয়ে নয়, যে কোনও বঞ্চিত অত্যাচারিত মানুষের মুক্তির স্বাধীনতার আন্দোলন। শ্রমজীবী মানুষ পুরুষ হলেও আমাদের দেশ ও রাজ্যে ভীষণভাবে বঞ্চিত, আন্দোলনে তাঁদের সকলের মধ্যেই কোথাও না কোথাও একটা জোরের সঞ্চার হয়। তাই আন্দোলন খুব জরুরি।
শ্রমজীবী ভাষা: গরিব শ্রমজীবী ও গ্রামের মানুষের প্রতীকী অংশগ্রহণ থাকলেও মূলত এই আন্দোলন শহর কেন্দ্রিক। গ্রামের বা শহরেরও প্রান্তিক অঞ্চলসমূহের, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের অংশগ্রহণ কেন কম বলে মনে করেন?
মণীষা আদক: আমরা অতি অবশ্যই একথা ভাবছি। এই আন্দোলনকে আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই আরো বিভিন্ন জায়গায়, রাজপথ থেকে গলিপথে এবং আলপথে। এই প্রক্রিয়াটা কিন্তু খুব সহজ না। কারণ শহরে আমরা অনেক নিরাপদ জীবন যাপন করি। কিন্তু একটা বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল যেখানে আশেপাশে থানা পুলিশ নেই, অধিকাংশ পরিবারের পুরুষরা বাইরে অন্য রাজ্যে কাজ করেন, সেখানে নারীরা অনেক বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। তাঁদের পক্ষে একটা প্রশাসনিক শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলা অনেক বেশি কঠিন। আপনি খোঁজ করলে দেখতে পাবেন, ১৪ অগস্টের বহু জায়গায় গ্রামাঞ্চলের মানুষও বেরিয়েছিলেন। মেয়েরা বিশেষ করে। কিন্তু তারপর তাঁরা কেন আর বেরোতে পারছেন না? তার কারণ তাঁরাও কিন্তু থ্রেটের মুখে পড়ছে। শহরের মানুষের তুলনায় নিরাপত্তাহীনতা বেশি থাকার কারণেই তাঁদের গুটিয়ে থাকতে হয়। একই ঘটনা ঘটে শহরের দরিদ্র মানুষদের ক্ষেত্রেও। তাঁদের লড়াইটা প্রতিদিন করতে হয়। রিক্সা স্ট্যান্ডে রিক্সা চালাতে পারবেন কিনা, চায়ের দোকান খুলতে পারবেন কিনা, সবজিওয়ালা বাজারে বসতে পারবেন কিনা, সবটাই তো নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনৈতিক কোনও শক্তির দ্বারা, সেক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে তাঁরা আতঙ্কে থাকেন। তাই বেরিয়ে এসে কথা বলা তাঁদের পক্ষে অনেক বেশি কঠিন। কিন্তু তারমানে এই নয় যে তাঁরা কোনওদিনই বলবেন না বা আমরা তাঁদের সাহস সঞ্চারের চেষ্টা করবো না। হয়তো সময়সাপেক্ষ, কিন্তু তাঁদেরকেও আমাদের বলে যেতে হবে। আর এক থেকে অনেক হওয়ার শক্তি, যেভাবে একটু আগেই বললাম, একদিন হয়তো তাঁরা অর্জন করবেন। এই আশাতেই আমরা চলছি। বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং মেয়েদের তথা প্রান্তিক যৌনতার মানুষের স্বাধীনতার যে লড়াই সেটা অবশ্যই আমরা ছড়াতে চাই, কিন্তু সেটা কঠিন এটা মানতেই হবে।
শ্রমজীবী ভাষা: গণমাধ্যম বিশেষ করে মূলধারার মিডিয়া অভয়া আন্দোলনকে যথেষ্ঠ প্রচার দিয়েছে বা দিচ্ছে। এর কারণ কি বলে মনে হয়? পুরোটাই মিডিয়ার তৈরি আন্দোলন?
মণীষা আদক: প্রথমত আমার মনে হয়, আর জি করের ঘটনাটা কিন্তু খুব সাধারণ স্বাভাবিক একটা ঘটনা না। আমাদের এখানে এমন ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। হাসপাতালের মধ্যে তাঁর ডিউটি চলাকালীন একজন ডাক্তার যখন এরকমভাবে ধর্ষিতা ও খুন হন, তখন কিন্তু মনে হয় সেটা আমার বাড়ির মেয়ের সঙ্গে ঘটেছে। যেমন আমরা বাড়ির ভিতরে সবথেকে বেশি নিজেদের নিরাপদ মনে করি, তেমনি হাসপাতালেও কিন্তু আমরা বাঁচতে যাই, মরতে নয়। তাই এই ঘটনায় সমগ্র জনগণ, আমরা কিন্তু একটা বিরাট ধাক্কা খাই। যেকারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষ তখন বেরিয়ে আসে। একজন ডাক্তার সে মেয়ে বলেই ধর্ষিত হওয়ায় প্রশ্নটা আসছে, সুতরাং সেটা সব নারীসত্বাকেই আঘাত করে, প্ররোচিত করে। ১৪ তারিখে মেয়েরা যখন রাত দখলে বেরিয়েছিল তাতে যেমন অভয়ার জন্য কষ্ট ছিল, বিচারের দাবি ছিল, তেমন প্রতিটি মেয়ের নিজের জীবনের যন্ত্রণার প্রকাশ ছিল। এই আঘাতটা কোথাও একটা মানুষের হৃদয়ের সেই তারে গিয়ে বেজেছিল, সেখান থেকেই এত মানুষ পথে নেমে এসেছিলেন। শুধুমাত্র মিডিয়া বলেছে বলে লোকে এসেছেন এমনটা নয়। সোশ্যাল মিডিয়া তো অনেক খবর দেখায়, অনেক কল দেওয়া হয়। তাতে কি এত লক্ষ লক্ষ মানুষ বেরোন? বেরোন না। বারে বারে যে বেরোবেন তাও না। হয়ত একদিনই ঘটেছে, সে ঘটনাটা কিন্তু ভয়ঙ্কর একটা অবিশ্বাস ও ব্যাথা থেকেই ঘটেছে।
শ্রমজীবী ভাষা: এই আন্দোলনের জমায়েতগুলোতে যেভাবে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা হচ্ছে, প্রবেশপত্র পেয়ে যাচ্ছে দেশভক্তি, জাতীয়তাবাদ কিংবা ব্রাহ্মণ্যবাদ। দেবী দুর্গাকে করা হচ্ছে নির্যাতিতার প্রতীক। এই প্রসঙ্গে আপনার উত্তর?
মণীষা আদক: আমার হাতে কোনও রাজনৈতিক দলের ঝান্ডা নেই, এখানে আমার একমাত্র পরিচয় আমি ভারতবাসী। তা বোঝানোর জন্য প্রথম থেকে জাতীয় পতাকা সকলে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন বলে আমার মনে হয়। সেই মুহূর্তে মানুষ হয়তো এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে এখানে আমরা সবাই সমান। সবাই ভারতীয়। কোনও বিভেদ ছাড়া একটাই প্ল্যাটফর্ম থেকে আমরা লড়াই করছি।
দুর্গা ব্রাহ্মণ্যবাদের পরিচয় বহন করে এই মতটি এখনো একটি শ্রেণীর মধ্যেই থেকে গিয়েছে। অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মত হয়ে ওঠেনি। দুর্গাকে নারী শক্তি হিসেবেই তারা দেখে থাকেন। তাই এই আন্দোলনে সেই প্রতীক বারে বারে উঠে এসেছে হয়তো কিছুটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আমার দুর্গা দেবী নয় অভয়ার মধ্যেই আছে, তাও বলা হয়েছে। তবে আমরা কোনও রকম ঠাকুর দেবতাকে সামনে রেখে এই আন্দোলন করতে চাই না। এ কথা ঠিক একটি ধর্মের প্রতীকগুলি বারে বারে উঠে আসায় হয়তোবা অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষরা নিজেদের কিছুটা বিচ্ছিন্ন মনে করেছেন। এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। আবার যে সাধারণ মানুষ আবেগ থেকে দেবী দুর্গাকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন তাকে ব্যঙ্গ করা বা কটুক্তি করা খুব বিবেচনার কাজ বলে মনে হয় না। যে কথাগুলি বিগত শত শত বছরে মানুষ নিজের কথা বলে মনে করতে পারেননি, তা এই আন্দোলনের সময়ে কয়েক দিনেই বুঝিয়ে ফেলতে পারব, সেই ভাবনা অসম্ভব বলেই মনে হয়। তবে আমরা নিশ্চিত ভাবেই এই আন্দোলন যে কোনও ধর্ম আচারের বাইরে চালিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
শ্রমজীবী ভাষা: কঠোরতর আইন এনে, মৃত্যুদন্ড দিয়ে অপরাধীর মনে আতঙ্কসৃষ্টি করে দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখা যায় কি? অভয়া মঞ্চের মত কি?
মণীষা আদক: যেহেতু ৮০টার বেশি সংগঠন আছে, তাঁদের সকলের মত এই মুহূর্তে আপনাকে বলতে পারবো না। এই নিয়ে আরো চর্চা বা আলোচনা আমাদের করতে হবে। তবে অবশ্যই এই মতটা আমাদের মধ্যে আছে যে ফাঁসি দিয়েই অন্যায়ের অবসান হবে না। চরমতম শাস্তি ফাঁসি দিয়েও তো নির্ভয়া থেকে শুরু করে কোথাও এমন অপরাধ আটকাতে আমরা পারিনি।