বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

দেউচা পাচামি কি বিতর্ক ও প্রতিবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠবে

দেউচা পাচামি কি বিতর্ক ও প্রতিবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠবে

অভিজ্ঞান সরকার

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১— পশ্চিমবঙ্গে জমিঅধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন ছিল শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, দেউচা পাচামিতে ভুগর্ভস্থ কয়লা উত্তোলনের ফলে হাজার বিশেক মানুষের (সংখ্যাগুরু আদিবাসী, এছাড়া সিডিউলড কাস্ট ও মুসলিম) উচ্ছেদ সম্ভাবনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টনক নাড়িয়েছে ভালভাবেই – ভারতবর্ষের ‘সেরা পুনর্বাসন প্যাকেজ’ ঘোষণা করে আঁতুড়ঘরে নুন দিয়ে উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনকে নির্মূল করার ভাবনা সরকারের ছিল। সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি জানিয়েছেন দশ হাজার কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্পের কথা। টাকার অঙ্কে বিপুল এই প্যাকেজ – এবং কর্পোরেট মহলের কাছে এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে অনন্য এক বার্তাও বটে। জমি অধিগ্রহণ ও উচ্ছেদ নিয়ে বিগত কয়েক দশকে ভারতবর্ষে কম বিবাদ হয়নি, টাটা-জিন্দাল-এসার-বেদান্ত-পস্কো-রিওটিংটো ইত্যাদি কোম্পানির জন্য জমি দখল করতে গিয়ে রাজ্য সরকারগুলি বারবার আদিবাসী জনজাতির প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, গুলি চলেছে। ওড়িশার কলিঙ্গণগরে টাটার কারখানার জন্য বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণে ১৩ জন আদিবাসিকে পুলিশ গুলি করে মারে ২০০৬এ। ২০০১এ শিলিগুড়ির উপকন্ঠে চাঁদমনি চা বাগানে উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে দুই জন শ্রমিক মারা যান। নিয়মগিরির আন্দোলন এখনো জোরতালেই চলছে। অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যেখানে কর্পোরেটের স্বার্থে বিভিন্ন রঙের ক্ষমতাসীন সরকার বলপূর্বক সহিংস উচ্ছেদ করতে গেছে, এবং ধিক্কৃত, নিন্দিত এমনকি নির্বাচনে পরাজিত পর্যন্ত হয়েছে। মনে রাখা দরকার, দেউচা পাচামির কয়লা উত্তোলনে প্রাইভেট প্লেয়ারদেরই আমন্ত্রণ করা হবে।
শাসকরা ইতিহাস থেকে দ্রুত শিক্ষা নেয়, তড়িঘড়ি বিপুল পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদিকে উচ্ছেদ সম্ভাবনায় বিপন্ন মানুষের মসিহা রূপে অবতীর্ণ হবার অবস্থান রাখলেন, অন্যদিকে কর্পোরেট তুষ্টির ঢিল মারলেন। কর্পোরেটরা ঝুটঝামেলা চায় না, পুঁজির মসৃণ চলাচলে আন্দোলন প্রতিবাদ খুবই আপত্তিকর তাদের কাছে। সরকার যদি পুনর্বাসনের টাকা জুগিয়ে মূলনিবাসী বাসিন্দাদের হঠাতে পারে বিশেষ উচ্চবাচ্য ছাড়াই, কর্পোরেট তবে খুশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের বিভিন্ন প্রদেশে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রসার বাড়াতে চাইছেন, লোকসভায় দ্বিতীয় প্রধান বিরোধী দল হবার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন – কর্পোরেট সাহায্য ও টাকাপয়সা তার দরকার। আদানির সাথে নবান্নে বৈঠক, মুম্বাইয়ে শিল্পপতিদের সাথে বৈঠক ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির প্রবল চেষ্টায় আছেন তিনি। তবে গ্রহণযোগ্যতা তো বৈঠকের চিঁড়েতে ভিজবে না, মুখ্যমন্ত্রীকে প্রমাণ করতে হবে তিনি কত বড় কর্পোরেট-বন্ধু। এখন, কর্পোরেট-বন্ধু হবার কতকগুলি মাপকাঠি আছে – যেমন প্রায় বিনামূল্যে তাদের জমি দিতে হবে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে দিতে হবে, ট্যাক্সের দীর্ঘমেয়াদি ছাড় দিতে হবে, SEZ বানাতে দিতে হবে, পরিবেশ আইনকানুনের তোয়াক্কা রাখলে চলবে না, ছিঁটেফোঁটা শ্রমিক অধিকারগুলি বিলোপ করতে হবে ইত্যাদি। বিনিময়ে কিছু ম্যানেজারিয়াল কাজ, কিছু প্রকৌশলী দক্ষতার কাজ ও বিপুল পরিমাণে ঠিকা শ্রমিক তৈরি হবে। এটা একটি বিশ্বব্যাপী শিল্প মডেল যেখানে পরিবেশ, সংস্কৃতি, শ্রমিক, ভূমিপুত্রদের চুষে ছিবড়ে করে বিপুল কর্পোরেট মুনাফা তৈয়ার হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বসুরি এই মডেল পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ করতে গিয়ে তার দলকে ডুবিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একই অর্থনৈতিক মডেলের মডেলের মানবিক মুখ নিয়ে ময়দানে নেমেছেন। যে সূক্ষ্মতা নিয়ে তিনি জমি অধিগ্রহণ ও উচ্ছেদের তেতো পাঁচন মধু বলে জনগণকে গেলাতে চাইছেন তা অভিনবত্ব দাবি করে। সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেউচা পাচামির ভূমিপুত্রদের প্রায় সকলের চাকরি হবে, দেউচার কয়লা শিল্পকে কেন্দ্র করে মোট একলক্ষ চাকরি, এলাকার পাথরখাদান মালিকের জন্য ত্রাণ, ওখানকার পাথর খাদানে কাজ করা আদিবাসী শ্রমিকের জন্য আর্থিক ত্রাণ, কৃষি মজুরের জন্য আর্থিক প্যাকেজ, নতুন কলোনি তৈরি করে সেখানে আদিবাসীদের পুনর্বাসন– যা যা ‘ভালো ভালো’ মানবিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায়, তার ম্যানেজারেরা খুঁজে পেতে সবকটাই ঢুকিয়ে রেখেছিল প্রেস নোটে। প্রতিশ্রুতিগুলি যে কতখানি ফাঁপা-ফোলানো সেগুলি তো সরকার নিজমুখে বলবে না, রাজনৈতিক সমাজের দ্বায়িত্ব সেটি বলা, এবং সঠিক ভাবে বলা। ‘শিল্প কি আকাশে হবে’ এই ধ্বনিতে বাংলার আকাশ বাতাস ভরিয়ে, দেড় দশক আগে কর্পোরেটদের স্বার্থে বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণ করতে গেছিলেন যারা তাদেরও দেউচা পাচামি নিয়ে বক্তব্য রাখার আগে আত্মউপলব্ধির প্রয়োজন আছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুনর্বাসনের প্রকল্প ইতিমধ্যেই দেউচা পাচামির ভূমিপুত্রকন্যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার সদস্য, কয়লাখনি বিরোধী আদিবাসী নেতা সুনীল মুর্মু পুনর্বাসন প্যাকেজের সীমাবদ্ধতার কথা বললেন - তাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকেন্দ্রিক সমাজ-সাংস্কৃতিক জীবনকে ছয়শ স্কোয়ার ফিটের কুঠুরির মধ্যে বেঁধে ফেলার শহুরে অপউন্নয়নের ছককে তারা মানবেন না। সুনীল বলছিলেন - বেনিয়ারা ভাবে, কাঁচা টাকার বিনিময়ে আদিবাসিদের জল-জঙ্গল-জমি-সম্মান কিনে নেওয়া যায়। ২০১৬ সাল থেকেই দফায় দফায় কয়লা খনির বিরোধিতা করেছেন বিভিন্ন সংগঠন। আগেও পাথরক্রাশার গড়ে ওঠার সময় সেটাকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের কথা তাদের বোঝানো হয়েছিল। দুই দশক পরে, সাড়ে চারশো পাথর ক্রাশারর ওগরানো ধুলোর বিষে এমনিতেই ক্ষত জমেছে বুকে, আর নতুন করে উচ্ছেদ হতে তারা চান না। এই অঞ্চলে জমি কাঠা প্রতি দুই লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়, সেখানে বিঘায় তের লক্ষের প্রস্তাব যথেষ্ট অবমূল্যায়ন। বটগাছ যেমন শিকড় সুদ্ধ তুলে অন্য যায়গায় বসালে বাঁচে না, আদিবাসিও অচেনা সংস্কৃতি পরিবেশ অর্থনীতিতে প্রতিস্থাপিত হলে খাবি খায়। তিনশ একরের প্রাকৃতিক অরণ্য, আলগোছে বেড়ে ওঠা গাছপালা, টিলা, ঘাসজমি – সব তাদের সম্পদ।
খোলামুখ খনিগুলি ক্ষুধার্ত দানবের মত, গোঁগোঁ করে মেশিনের গোঙানি আসে তার পেট থেকে - গাছপালা চাষের জমি, বাড়িঘর, পুকুর, হাঁস মুরগি গরু ছাগল, গ্রাম, ইতিহাস, পূর্বপুরুষের স্মৃতি গিলে নেয় সেই দানব, শুষে নেয় মাটির তলার জল। রাণিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলে, পান্ডবেশ্বরের শোনপুর বাজারি, মহালক্ষ্মী প্রোজেক্টে পাঁচটি আদিবাসি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেল খোলামুখ খনির সম্প্রসারণে। আদিবাসীরা কি পেয়েছেন সেই উন্নয়ন তান্ডবে? নতুন মাইনিং কোম্পানির অধীনে ঠিকা শ্রমিকের চাকরি ছাড়া কিছু জুটবে না তা সুনীলদের কাছে স্পষ্ট - রাণিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলে খোলামুখ খনিতে ঠিকা শ্রমিকদের অবস্থা তাদের জানা। বাকি চাকরি, যেমন জুনিয়ার কনস্টেবলের বাইশ হাজার টাকার চাকরি নিয়ে শতাধিক বছরের ভিটেমাটি ছেড়ে দেবার বিনিময় প্রস্তাব তাদের কাছে অপমানজনক। খনিশিল্প স্থাপনের সরকারি উদগ্র উদ্যোগ একপাক্ষিক, গণশুনানি না করেই। কোনও খনি প্রকল্প বা শিল্পের জন্য কতগুলি পর্যায় রয়েছে, প্রকল্পের এলাকায় মানুষ ও প্রকৃতির উপর প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য প্রকল্প শুরুর আগে কয়লাখনি এলাকার সামাজিক-অর্থনৈতিক সমীক্ষা হয় - পরিবেশের উপর কয়লাখনির প্রভাব বিষয়ে তৈরি হয় এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকল্প অঞ্চলে গণশুনানি করে অঞ্চলের মানুষের সম্মতি পেলে তবেই এই খনিপ্রকল্প পরিবেশ দপ্তর-সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ছাড়পত্র পাবে। দেউচা পাচামিতে কোনও অ্যাসেসমেন্ট এখনো হয়নি। শিল্প স্থাপনের গরজে প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত ও আইনি ধাপগুলি সম্পূর্ণ না করেই চাকরি, পুনর্বাসন প্যাকেজ ইত্যাদির গঙ্গাস্নান সেরে ফেলেছে রাজ্য সরকার। এই ব্লকের কয়লার সঞ্চয় রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলের তুলনায় প্রায় পঁচিশ গুণ কম। রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলে কয়লা শিল্পের তিপ্পান্ন হাজার স্থায়ী শ্রমিক নিয়ে মোট কর্মসংস্থান প্রায় পঁচাত্তর হাজার। স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত এক লক্ষ চাকরী নিয়ে একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন থেকে যাচ্ছে। কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন অ্যাক্ট) ২০১৫এর পর নিলামের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বেসরকারি কোম্পানি কয়লা উৎপাদনের দ্বায়িত্ব পেতে পারে - রাজ্যের বিদ্যুতমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় পোলান্ডের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সেদেশের মাইনিং কোম্পানিদের সাথে আলোচনা চালিয়েছেন বিগত কয়েক বছরে, কিন্তু আদৌ তারা বিনিয়োগ ও উৎপাদন করবে কিনা তা অনিশ্চিত। পোলান্ডের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে কত স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হবে সেটাও ভাবার।
প্রশাসনের তরফে অলচিকি ও বাংলায় পুনর্বাসন প্যাকেজের হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করার কথা হচ্ছে, যদিও গ্রামগুলিতে ঢুকে সেগুলি প্রচার করতে গেলে কয়লা খাদানবিরোধী জনতার বিরোধিতার মুখেও পড়েছে প্রশাসন। ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সেফটি প্যাসেজ দিয়ে উচ্ছেদ প্রকল্প নামানোর পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই মুখ থুবড়েছে –বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টে অনিচ্ছুক আদিবাসীদের বয়ান, স্থানীয় মাঝিহারামের ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে কয়লাখনির বিরোধিতা, গ্রামে-গ্রামে ছোটবড় কয়লাবিরোধী, উচ্ছেদবিরোধী প্রতিবাদ সভাগুলির তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
সরকারপক্ষও বসে নেই, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের গাজর না চললে লাঠির ব্যবহার করতে পিছুপা হবে না। হিংলো গ্রাম পঞ্চায়েতের দেওয়ানগঞ্জ, কেন্দপাহাড়ী, হরিনসিঙ্গা, চাঁদপুর গ্রামগুলিতে নজরদারী বেড়েছে, রাতে পুলিশের টহল ঘন ঘন হচ্ছে, গ্রামে ঢোকা বেড়ানোর পথে সিভিক পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে, বীরভূমের তৃণমুল নেতা অনুব্রত মন্ডল ‘কয়লাখনি হবেই’ বলে মহম্মদবাজারে হুঙ্কার ছাড়ছেন। সম্মতি নির্মাণের চেষ্টায় ইতিমধ্যে অভিনেতা পরমব্রতকে সামনে রেখে একটি কমিটি গঠন হয়েছে, এবং ‘বাংলা সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ নামক সংগঠনের নেতৃত্বকে ময়দানে নামানো হয়েছে – মহম্মদবাজার এলাকায় মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে যাদের প্রভাব রয়েছে। তারা ‘ভালো, পরিবেশবান্ধব’ খোলামুখ খনির স্বপক্ষে কি-বোর্ড ধরেছেন। সর্বোপরি, বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার এক দোর্দান্ডপ্রতাপ নেতা আগে থেকেই প্যাকেজের স্বপক্ষে অবস্থান নিয়ে বসে আছেন। এবং কিছুদিন আগেই প্যাকেজের সুফল বোঝাতে গিয়ে গ্রামের আদিবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পরে পালিয়ে এসেছেন।
দেউচা পাচামির কোল ব্লকের প্রাথমিক মালিকানা ছিল রাষ্ট্রীয় কয়লা উত্তোলনকারী সংস্থা কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডের। অঞ্চলে দুটি কয়লার ব্লক রয়েছে, একটি দেউচা পাচামি, অন্যটি হরিণশিঙ্গা দেওয়ানগঞ্জতে। জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এখানে ‘রিজিওনাল ড্রিলিং’ অর্থাৎ দুই কিলোমিটার অন্তর অন্তর ড্রিল করে সমীক্ষা চালায় প্রায় তিনদশক আগে। কত কয়লা আছে তা জানা যেমন জরুরি, কয়লার উপর কত মাটি ও পাথর (ওভার বার্ডেন) রয়েছে সেটার হিসাব জরুরি। জিএসআই আরো খনন সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছিল রিপোর্টে কারণ এরপরের পর্যায়ে আর এক দফা বিশদে অনুসন্ধান (ডিটেইলড এক্সপ্লোরেশন) জরুরি যেখানে ছয়শ মিটার দূরে দূরে ড্রিলিং করা হয়। এর পরে তৈরি হবার কথা জিওলজিকাল রিপোর্ট এবং এই জিওলজিকাল রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে মাইন প্ল্যানিং - অর্থাৎ কি ভাবে ওই কয়লার স্তরে ঢোকা হবে, সেই পর্যালোচনা করা - মাটির অনেক নীচে কয়লা থাকলে কুয়োর মত গর্ত কেটে লংওয়াল আন্ডারগ্রাউন্ড খনি হবে, উপরের দিকে থাকলে সুরঙ্গ করে (ইনক্লাইন) বা ওপেন কাস্ট মাইনিং (খোলামুখ খাদান)। মাইন প্ল্যানিং বিশেষ কারিগরি জ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়, ভারতবর্ষের যাবতীয় খনিতে এই কাজটি যারা করেন সেই সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিসাইন ইন্সটিটিউটকে (সিএমপিডিআই) দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পরবর্তী ড্রিলিং ও মাইন প্ল্যানিং করার, গত দশকে। সেই সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধায় তারা ফিরে যান। তার পরবর্তীতে এখনো কোনও অনুসন্ধান ও প্লানিং আর হয়নি।
জিএসআই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে দেউচা পাচামির কয়লার স্তরটি (যেখানে আনুমানিক দুইহাজার পঁচিশ মিলিয়ন টন কয়লা জমা আছে) মাটির প্রায় তলায় কোথাও দেড়শ মিটার কোথাও বারোশো মিটার নীচে অবস্থিত। তার চেয়েও সমস্যাদায়ক বিষয়টি হল, এই স্তরের উপরে একটি ব্যাসল্ট পাথরের স্তর রয়েছে যা স্থানবিশেষে একশ মিটার পুরু। কয়লা তুলতে গেলে এই ব্যাসাল্টের আচ্ছাদনটি একাধিক কুয়ো করে তবে কয়লার স্তরে পৌঁছাতে হবে (আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং) বা ব্যাসাল্টের স্তরটি সরিয়ে ফেলতে হবে (ব্যাসাল্ট স্তর অব্ধি খোলামুখ খনি করে তারপরে সুড়ঙ্গ বা ইনক্লাইন), এই ক্ষেত্রেও বিপুল বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি দক্ষতা প্রয়োজন যা ভারতে অনুপস্থিত। অত্যাধিক খরচের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং ভারতবর্ষে প্রায় বন্ধ হবার মুখে। কোল ইন্ডিয়ার অধিকাংশ নতুন খনিগুলি খোলামুখ, অন্তত গত তিন দশকে। দেউচা পাচামির কয়লার স্তরের উচ্চতা কোথাও দশ মিটার, কোথাও আশি মিটার। আন্ডারগ্রাউন্ডে পনের মিটারের বেশি উচ্চতা কয়লার স্তরে উৎপাদনও ভারতে খুব কমই হয়েছে। দ্বিতীয় পদ্ধতি যদি হয়ও, তবে ওই বিপুল পরিমান ব্যাসল্ট সরিয়ে কয়লার স্তর অব্ধি পৌঁছাতে বেশ কয়েক বছর লাগার কথা এবং বিপুল পুঁজি এক্সপেন্ডিচার/বিনিয়োগ প্রয়োজন। খোলা মুখ খনিতে দেড়শ থেকে আটশো মিটার গভীর যাবার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন ২৮৫ জন পাথর ভাঙার যন্ত্রের মালিক ছয় মাস ধরে ১০ ট্রাক ব্যাসল্ট বিনামূল্যে পাবেন। ওই ব্যাসাল্টের কথাই ভেবেছেন হয়তো।
কিন্তু মূল বিষয়টি হল, সিএমপিডিআইএর অনুসন্ধান বাতিল হবার পরে আর কোনও সমীক্ষা ও পরিকল্পনা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে এখনই সমীক্ষা অনুসন্ধান শুরু হলে তার জন্য অন্তত পাঁচ বছর লাগার কথা। কোল ইন্ডিয়াও এই ব্লক থেকে কয়লা উৎপাদনে উৎসাহ দেখায়নি। বরং ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ-সহ আরো পাঁচ রাজ্যকে এই কোল ব্লক বণ্টন করা হয়। বাকি রাজ্যগুলি একে একে সরে যাওয়ায় ২০১৮-এর সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের হাতেই আসে এই কোল ব্লক, ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (ডাবলুবিপিডিসিএল) এই ব্লকের মালিকানা পায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ডাবলুবিপিডিসিএলের কয়লা উৎপাদনের প্রযুক্তি ও উপকরণ কিছু নেই, তাদের অধীনে থাকা পাঁচটি খোলামুখ খাদানে উৎপাদনের দ্বায়িত্বে আছে বিভিন্ন প্রাইভেট মাইনিং কোম্পানি। ২০১৮ থেকে আজ অব্ধি দেউচা পাচামির খনন সমীক্ষা বা মাইন প্ল্যানিং কোনটিই হয়নি। গতবছর জুলাই মাসে রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা দেউচা পাচামি সংক্রান্ত আলোচনাসভায় জানিয়েছিলেন পুজোর পর কয়লার অনুসন্ধানকার্য শুরু হবে ও তার দেড় বছর পর কয়লা উৎপাদন শুরু হবে। কারা অনুসন্ধান করবে আর কারা উৎপাদন শুরু হবে তা আমলার কথায় স্পষ্ট নয়।
অন্য ব্লক হরিণশিঙ্গা দেওয়ানগঞ্জে কয়লা আছে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি, এখান থেকেই কয়লা উৎপাদন শুরু হবে ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। যদিও সঞ্চিত কয়লার পরিমান মাত্র আটতিরিশ মিলিয়ন টন। খোলামুখ খনি হলে তাতে পাঁচশ ছয়শো ঠিকা শ্রমিকের নিয়োগের মাধ্যমেই এখানে উৎপাদন সম্ভব।
সরকার বনাম আদিবাসীদের সংঘাতের সম্ভাবনা বাদ দিলেও অন্যান্য দার্শনিক সংঘাতগুলিও বোধহয় জারি থাকবে। এবারের বর্ষায় পশ্চিমবঙ্গে বিপুল বন্যার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের পাশাপাশি গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে দায়ী করেছেন। কার্বন নিঃসরণের সাথে যার সরাসরি যোগ রয়েছে, কয়লার ব্যবহারের সাথেও। গ্লাসগোতে সিওপি২৬ সামিটে প্রধানমন্ত্রী ২০৭০ সালের মধ্যে ভারতের কার্বণ নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কয়লাকে কেন্দ্র করে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ কিন্তু রাজ্যে ও দেশের প্রধানের পরিবেশ নিয়ে মতামতের বিরোধী।
এই সমগ্র অঞ্চলে আদিবাসী, মাল বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের ছোট বাচ্চাদের হাতের খেলনাগুলি দেখবেন এক্সক্যাভেটার শভেল বা ডাম্পার ট্রাকের প্লাস্টিকের প্রতিরূপ। গ্রামের মেলাগুলোতে খেলনার দোকানে উচ্চারিত হচ্ছে যন্ত্রদানবের অনিবার্যতা। কাদের পরিকল্পনায় আদিবাসীদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে তাদেরই বাসভূমি ছিন্নভিন্ন করার প্রতীকগুলির সাথে পরিচয় করানো হচ্ছে জানা নেই। তবু দেউচা-পাচামি-হরিণশিঙ্গায় প্রকৃতি, পরিবেশ, আদিবাসী ও সরকারের শিল্প-উন্নয়ন পরিকল্পনার দ্বন্ধ বর্তমান, জোরদার ভাবেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.