বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
অভয়ার বিচারহীন সময় যত এগোচ্ছে, জমে উঠছে অজস্র ঘটনা। আর প্রযুক্তির সাহায্যে আছড়ে পড়ছে টেলিভিশন, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ই-মেল ইত্যাদিতে। সেইসঙ্গে হাজির আছে বাজার। হরেক রকম সংবাদ মাধ্যম। প্রখ্যাত অখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা। রেডিমেড উত্তর তৈরি হচ্ছে ব্যবসায় লাভক্ষতির নিয়ম মেনে। লেখককে শুধু ভাবতে হয়, কি কি বেছে নিয়ে, কি কি এড়িয়ে, কি কৌশলে সাজালে, তিনি পছন্দ মতো উত্তরটিতে পৌঁছতে পারবেন। নিতান্ত যদি তথ্যপ্রমাণ না জোটে, সেখানে ব্যক্তিগত অনুমান। যেমন, অমুকে স্বপ্নে পুঁজিবাদী, সাংস্কৃতিকভাবে মধ্যবিত্ত, আর্থিকভাবে উচ্চবিত্ত বলে দিতে ট্যাক্স লাগে না।
কিছু বিশ্লেষক আবার পুরোটাই নস্যাৎ করে দিতে চান। মানুষের সহজাত মনুষ্যত্বেই এদের অবিশ্বাস। তাদের মতে আন্দোলনই এখন বিনোদন। আর তাই নিতান্ত একঘেয়েমি ক্লান্তি কাটাতেই এত মানুষ পথে নেমেছেন নিতান্ত হুজুগের বশেই। কারুর মতে গোটা ব্যবস্থাটাই যেহেতু ঘুণধরা, সুতরাং বিচার চেয়ে আর লাভ কী। দেবে কে।
সব পক্ষেরই ভাবটা হল, “এ এক সঙ্কট ঠিকই, কিন্তু এমন সঙ্কট আসবে, যাবে।” ভিন্নভাবে বেশির ভাগ বিশ্লেষকেরই অভিমত, স্থিতাবস্থা বজায় থাকুক। রাজ্যে বর্তমান শাসকদলই কায়েম থাকুক, নচেৎ ক্ষমতা চলে যাবে মৌলবাদী শক্তির হাতে।
রাজ্যের শাসক তো মৌলবাদী নন। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বন্ধুত্ব ২০০৩ সালের থেকে -রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় বিজেপির সঙ্গে ছিলেন। তাঁর আদর্শগত পরামর্শদাতা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। মোহন ভাগবতের সঙ্গে ওঁনার সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। আরজি কর নিয়ে মোহন ভাগবত প্রকাশ্যেই বলেছেন রাজ্যসরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থার কথা। পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-রর শাখা ২০১১ সালে ছিল ৫৮০টি, ২০১৭তে সেটা ১৫০০ ছাড়িয়েছে। আরএসএস পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা ২০১৫ সালে ছিল ৩১৪টি, ২০২০-তে বেড়ে ৫০০০ এরও বেশি। (সূত্র: দ্য ক্যারাভ্যান)
অযোধ্যার রাম মন্দিরের মতো দীঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরিতে রাজ্য সরকার ২০ একর জমি এবং ২০০ কোটি টাকা দিয়েছেন। ভাগবত পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস প্রশিক্ষণ শিবিরে আসলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপার রাজ্য সরকারের নির্দেশমতো ফলমিষ্টির ঝুড়ি সহযোগে দেখাশোনার দায়িত্ব পান। মতাদর্শ অভিন্ন। সংঘের দুর্গার পক্ষে তাই কলকাতায় গঙ্গা আরতি উদ্বোধন কিংবা দুর্গাপূজার সম্মানী বাড়িয়ে ৮৫ হাজার টাকা করাটাই স্বাভাবিক। হিন্দু্ত্ববাদের বিপদ এখন কল্পনা নয়, সেই বিপদ ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের দুয়ার পেরিয়ে ঘরে ঢুকে গেছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ২০১১ সালে নারীর বিরুদ্ধে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা ছিল ২,২৮,৬৫০। আর ২০২১ সালে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২২৮২৭৮ -বৃদ্ধির হার ৮৭%। ২০২২ সালে গোটা ভারতে নথিভুক্ত হয়েছে ৪,৪৫,২৫৬টি কেস। দিনে প্রায় ১২২০টি অপরাধ। তাও এ শুধু নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা। বাস্তবে সংখ্যা অনেক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
দেশের জনসংখ্যার ৭.৫% অংশ থাকেন পশ্চিমবঙ্গে। লোকসভার রেকর্ড অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের নথিভুক্ত মামলার সংখ্যা ২০১৩ সালে ২৯১৩৩টি -গোটা দেশে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের প্রায় ১২.৭%। ২০২১-এ সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৩৫৮৮৪। (সূত্র: https:// loksabhadocs. nic.in)।
ন্যাশেনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট অনুসারে ২০২২ সালে নিখোঁজ নারীদের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গে শীর্ষে। কলকাতায় নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে -২০২০ সালে ১১২৮, ২০২১ সালে ১৭৮৩, ২০২২ সালে বেড়ে ১৮৯০।
২০২৪-এ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলায় অভিযুক্ত সাংসদ ও বিধায়কদের সংখ্যার বিচারে ভারতে শীর্ষস্থানের অধিকারী পশ্চিমবঙ্গ। ২০২৪-এর শেষাশেষি পশ্চিমবঙ্গে ঝুলে থাকা ধর্ষণ ও পকসো মামলার সংখ্যা ৮৯৫৮০। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলা আটকে থাকার হার ৯৭.৫ শতাংশ, যা নাকি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ (সূত্র: এবিপি)। রাজ্যে প্রতি লক্ষ মানুষ পিছু পুলিশ রয়েছে মাত্র ১০১.১৩ জন এবং অপরাধ নথিভুক্ত হবার পরিসংখ্যানও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয়।
অভয়া আন্দোলন সাড়া ফেলেছে গরীব শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যেও। অংশ নিয়েছেন নানা শ্রেণীর নানা পেশার মানুষ, ডাক্তার-নার্স থেকে আইটি কর্মী, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, আইনজীবী থেকে ক্যাব চালক, ডেলিভারি বয়দের মত গিগ কর্মীরা। পেশাদার থেকে অপেশাদার, বিখ্যাত থেকে অখ্যাত, বর্ষীয়ান থেকে শিশু সকল বয়েসের মানুষ। হেদুয়া থেকে কলেজস্ট্রিট পর্যন্ত মিছিল করেছেন টানা রিকশার চালকরা। পথে নেমেছেন পুরুলিয়া, মালদা, হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর জেলার খেতমজুররা সম্প্রদায় নির্বিশেষে। নয়াগ্রামের শিল্পীরা আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে লিখেছেন পটের গান।
জনবাদী রাজ্যসরকার গরীব মানুষদের জন্য নানা রকম ভাতার বন্দোবস্ত করেছেন। তবুও গরীব মানুষরা জীবন ধারণ থেকে বুঝতে পারছেন যে, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। মেহনতের রোজগার আর অনুদানের ভাতা মিলিয়েও সংসার চালানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। তার সঙ্গে বেড়েছে সরকারের পোষ্যবাহিনীর তোলাবাজি। কমছে মেয়েদের নিরাপত্তা। কাজের সুযোগ কমছে রাজ্যে। বীজ ও সারের কালোবাজারিতে চাষিদের দুরবস্থা বাড়ছে। সরকারি দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন গরীব মানুষ। তাঁদের আবাসের টাকা, ১০০ দিনের কাজের টাকা¸ স্কুলপড়ুয়াদের ট্যাব কেনার টাকা ঢুকে যায় ভুয়ো অ্যাকাউন্টে। চুরি যায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের অনুদান। শিক্ষক ও পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতির পর স্বাস্থ্য দুর্নীতিতে রেকর্ড করতে চলেছে বিশ্ববাংলা। শাসকদলের নেতাদের কাটমানি দিয়েও আবাস যোজনার তালিকায় গরিবের নাম ওঠে না, প্রতিবাদ করলে পিটিয়ে খুন। বন্ধু-শত্রু গরীব নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই চিনবেন।
একটা দুরভিসন্ধিমূলক প্রচার হচ্ছে যে “নামীদামী চিকিৎসকদের মহৎ আদর্শ থাকা অসম্ভব”। বাজারের পাদপ্রদীপের আড়ালে কিন্তু বহু ডাক্তার আজীবন নিরলসভাবে নিয়োজিত থাকেন মানুষের সেবায়। থাকেন আন্দোলনেও। এদেশের চিকিৎসকসহ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সাধারণ মানুষের পাশে নিয়ে এমন কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে স্মরণীয় উনিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যালেরিয়া নিবারণী সমিতি ও স্বাস্থ্যমেলা, ১৯৪০এর দশকে সাইক্লোন রিলিফ কমিটি, পিপলস রিলিফ কমিটি, ১৯৭০এর জামখেদ উদ্যোগ, ৮০র দশকে জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি প্রতিষ্ঠা, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ। অনেক বিকল্প পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদাহরণ পাওয়া যাবে এদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের ইতিহাসেও। যার মধ্যে বিশিষ্টতম বোধহয় নেল্লোরে ডাক্তার রামচন্দ্রণ রেড্ডির উদ্যোগে পিপলস পলিক্লিনিক। অতিমারির মধ্যে তো ডাক্তার ও নার্সরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা করেছেন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে। লকডাউনে পাশে থাকেনি কোনও সরকার।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সিনিয়র ডাক্তারদের বেশিরভাগেরই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দীর্ঘসময়ের। বর্তমানেও অনেকেই যুক্ত রয়েছেন শ্রমজীবী হাসপাতালের মত বিকল্প নানা উদ্যোগে। ২০১৮তেও এঁরা প্রতিবাদ করেছেন ডাক্তার-নার্সদের নিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্রমশ বেসরকারিকরণ, সরকারি দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে। লাগাতার চেষ্টা করে গেছেন হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বাড়াতে কিংবা ও পরিসেবা উন্নত করতে। সরকারি কোপদৃষ্টির ঝুঁকি নিয়েই করেছেন। যেজন্য এমন দরদী সরকারি ডাক্তারের বদলি ঠেকাতে মালদার গ্রামবাসীরা ২০১৪-তে পথ অবরোধ পর্যন্ত করেছেন। জুনিয়র ডাক্তাররা তো শুধু জীবিকা নয়, নিজেদের জীবন বাজি রেখে আমরণ অনশনের ডাক দিয়েছিলেন। অবস্থানে বসেই চালিয়েছেন অভয়া-ক্লিনিক। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও পথে ছিলেন আর ঠিক এই মুহূর্তেও শীত উপেক্ষা করেও অবস্থান করছেন কলকাতার রাজপথে। মহৎ ডাক্তারদের অভাব এরাজ্যে ততটা হয়নি যতটা গদিমিডিয়া দেখাতে চাইছে।
কেউ যদি ভেবে থাকেন যে, এই আন্দোলনে সরকারি হাপাতালের গরীব রোগীদের অসুবিধে হচ্ছে, তাঁদের বলব এই আন্দোলনের দাবিদাওয়া সম্পূর্ণত রোগীদের স্বার্থেই। আন্দোলন আগে হাসপাতালের পরিষেবার যে অবস্থাটা ছিল তা রোগীদের কতটা অনুকূল ছিল। বিছানা প্রতি রোগী সংখ্যার অনুপাত, স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামোর অসম বন্টন, ঘাটতি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার হাল, বেড পেতে ফড়েদের রমরমার সামান্য অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরাই জানেন। তাছাড়া সিন্ডিকেটকে টাকা খাইয়ে অযোগ্য ছাত্ররা পাস করে ডাক্তারি শুরু করলে, বিপদটা যে কোনও মানুষেরই। সে আপনি সরকারি হাপাতালের উপভোক্তা হন বা না হন।
সুতরাং যারা অবিশ্বাসের বিষ ঢেলে আন্দোলন কমজোরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা আসলে শক্ত করছেন সেইসব ধনকুবেরের হাত, যাদের লোভ গোটা পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের মুখোমুখি।
“পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু এটাই নিয়তি” এমন কথা যে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীরা বলছেন তা আধিপত্য বিপদজনক।
সংকট আপনা আপনি কেটে যাবে না। চূড়ান্ত বাধাবিপত্তি কাটিয়েই সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যেতে হবে। দিনের পর দিন। ক্লান্তিহীন ভাবে। সেটাই পথ। আর যেতে হবে শ্রমজীবী প্রান্তিক গরীব মানুষের জীবন যন্ত্রণা আর লড়াইয়ের মাঝে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ চিরদিনই একাজ করেছেন, এখনো করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন।
ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার চেলারা নিশ্চয়ই শুনেছেন যে খোদ প্রবক্তাও ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ বিষয়ে আগের মতো ততটা নিশ্চিত নন। পিছু হটে বরং উদারনীতি জনিত অসন্তোষ ও আত্মতুষ্টি বিষয়ে সতর্ক হতে উপদেশ দিচ্ছেন।