বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১— অভিধান পড়ে জেনেছি, ভান্ডার শব্দটা এসেছে ভাণ্ডাগার থেকে। ভাণ্ড এবং আগার— এই দুটি শব্দে ধড়েমুড়ো সন্ধি করে ভাণ্ডাগার। সংস্কৃত ভাণ্ডের বাংলা রূপ হল ভাঁড়। অতএব ভান্ডার-এর মধ্যে একটি ভাঁড় আছে। তাই লক্ষ্মীর ভান্ডার শুনলে যদি লক্ষ্মীর ভাঁড়ের কথা মনে পড়ে, খুব অন্যায় বলা যাবে না। ছোটবেলায় বাড়িতে ঘরের দেওয়ালের একটি তাকের এক কোণে সেটি রাখা থাকত, ভর্তি হওয়ার অনেক আগেই মাস ফুরিয়ে আসত, অতএব শুরু হতো তার ভিতর থেকে পয়সা বার করার কসরত— ভর্তি না হলে লক্ষ্মীর ভাঁড় ভাঙতে নেই, তা ছাড়া নতুন কিনতে পয়সাও লাগে, অতএব তার লম্বা ও সরু ছিদ্রপথে চুল বাঁধার কাঁটা ঢুকিয়ে চিমটের মতো করে ধরে এক একটা পয়সাকে মহানিষ্ক্রমণে বাধ্য করা। মাছ ধরিনি কোনও দিন, তবে মাটির ভাঁড়ের মধ্যে পয়সা ধরা তার চেয়ে কম কিসে?
কী থেকে যে কী হয়— রাজ্য সরকারের লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের শুভমুক্তির পর থেকে তার বিপুল জনপ্রিয়তার চলৎ-চিত্র দেখতে দেখতে আর তার ধারাবিবরণী পড়তে পড়তে সেই স্মৃতি মনের মধ্যে ঘাই মেরে উঠল। মাসে পাঁচশো টাকার জন্য এমন প্রচণ্ড ভিড় জমতে দেখে অনেকেই চমৎকৃত হয়েছেন। চমকানোর কোনও কারণ নেই। পশ্চিমবঙ্গের রোগাভোগা অর্থনীতির হাল অতিমারির ধাক্কায় যা দাঁড়িয়েছে, তাতে বহু লোকেই পাঁচশো টাকাকে তুচ্ছ করার কথা ভাবতে পারেন না। তার ওপরে আছে আমাদের আটপৌরে, গেরস্ত-পোষা পিতৃতন্ত্র। বাইরে থেকে সব সময় তাকে ঠিক চেনা যায় না বটে, কিন্তু তলায় তলায় তার বেজায় দাপট। সংসারে প্রচণ্ড অভাব না থাকলেও বহু বাড়িতেই মেয়েরা নিজের টাকা বলে কিছু পান না, অতএব মাসে মাসে সরকারি অবদানটি হাতে পাওয়ার জন্য তাঁরা যদি বিশেষ আগ্রহী হন, অবাক হওয়ার কিছু নেই। দু’কোটি গ্রাহকের লক্ষ্যমাত্রা পার হয়ে যাওয়া, কিছুই না।
সরকারি নীতিকুশলীরা ব্যাপারটা মোক্ষম ধরেছেন। একদিকে একটা হালভাঙা পালছেঁড়া অর্থনীতি আর অন্যদিকে ঘরে ঘরে মেয়েদের নিজস্ব সামর্থ্যের এবং অধিকারের অভাব— দুইয়ে মিলে যে অগণন করতল কিছু পাওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছে, সেখানে মাসে মাসে পাঁচশো টাকা তুলে দিতে পারলে জনপ্রিয়তার উচ্চফলনশীল চাষ করা যাবে, এ-হিসেবের কোনও মার নেই। জনবাদী রাজনীতির এই রন্ধনপ্রণালী নতুন কিছুই নয়, তবে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকরা যেভাবে সে-রান্নার বিচিত্র সম্ভার তৈরি করেছেন এবং নিত্যনতুন পদ পরিবেশন করে চলেছেন আর লোকে যেভাবে তা চেটেপুটে খেতে চাইছে, সেটার মহিমা অনস্বীকার্য। এমনকি পোড়-খাওয়া সিপিআইএমের প্রবীণ ও নবীন নেতারাও ঢোক গিলে বলতে বাধ্য হচ্ছেন, এত রকমের প্রকল্প দিয়ে সত্যিই রাজ্যের মানুষকে অনেকটাই আকর্ষণ করা গিয়েছে। লক্ষ্মীর ভান্ডার সেই ধারার সাম্প্রতিকতম সৃষ্টি। জনপ্রিয়তার বিচারে সফলতমও বটে।
এই প্রকল্পের নাম নিয়ে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে। সরাসরি ধর্মীয় অনুষঙ্গে এমন নামকরণের পিছনে যদি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক সঙ্কেত থাকে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। জনপ্রিয়তার রাজনীতিতে ‘ডগ হুইস্ল’ বহুল ব্যবহৃত প্রকরণ— যা বলা হল, তার ভাঁজে থাকল অন্য সুর, যাদের কানে সে-সুর পৌঁছোনোর, তাদের কানে তা ঠিক ঠিক পৌঁছে গেল। সে-দিক থেকে এই নামটির মার নেই। লক্ষ্মী-নাম শুনে অনেকের মনেই শাঁখ বাজবে, আবার কেউ আপত্তি করলে বলা যাবে, ‘ও মা! সে কী? মা-লক্ষ্মী তো ঘরে ঘরে, তাতে আবার ধর্মের কথা উঠছে কেন?’ তার পরেও আপনি সাবধান করে দিয়ে বলতে পারেন— কড়াপাকের হিন্দুত্বকে নরম ধাতের হিন্দুয়ানি দিয়ে প্রতিহত করা যায় না, বরং শেষ পর্যন্ত সমাজের মানসিকতায় ধর্মাশ্রিত রাজনীতির জমিটাকেই আরও ভাল করে তৈরি করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই সতর্কবাণী শোনার সময় এবং প্রয়োজন নীতিকুশলীদের আছে বলে মনে হয় না। তাঁদের জনবাদ জিরাফে আছে, ধর্মেও আছে।
তবে আসল সমস্যা নামের নয়, ধারণার। কেবল একটি বা দুটি বিশেষ কর্মসূচি নয়, অষ্টোত্তর শতনামে নামাঙ্কিত প্রকল্পগুলির মধ্যে দিয়ে সরকার এবং সমাজের মধ্যে, রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্কের যে ধারণা তৈরি করা হচ্ছে বা তৈরি হয়ে উঠছে, সমস্যা তাকে নিয়েই। এক কথায় বললে, সম্পর্কটা দাতা এবং গ্রহীতার। সরকার দান করবে, নাগরিকরা গ্রহণ করবে। কোনও দান শর্তাধীন, কোনওটি শর্তহীন। যেমন, কন্যাশ্রীর শর্ত একটা নির্ধারিত স্তর অবধি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া, লক্ষ্মীর ভান্ডারে কোনও শর্ত নেই। শর্ত থাকলে তার মধ্যে দিয়ে প্রাপকদের কোনও একটা কাজ সম্পন্ন করার প্রেরণা বা চাপ দেওয়া হয়, শর্ত না থাকলে তেমন কোনও দায় নেই। দু’ধরনের দানেরই যুক্তি আছে, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক যুক্তি। বিশেষজ্ঞরা সে-সব নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, করছেন, তাঁদের পরামর্শ অনুসরণ করে দেশে দেশে এমন নানা প্রকল্প তৈরি হচ্ছে, কার্যকর হচ্ছে। আবার জনবাদী রাজনীতিকদের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে উদ্ভাবিত নানা প্রকল্প নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও নতুন সমীক্ষা এবং নতুন চিন্তার রসদ পাচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই এমন উদ্যোগ দেখা গিয়েছে। তামিলনাড়ু তার একটা পুরনো এবং বহুচর্চিত দৃষ্টান্ত। পশ্চিমবঙ্গের জনবাদী প্রকল্পের ধারণাগুলি অভিনব কিছু নয়।
সরকারি অনুদান বা সহযোগিতার আয়োজন নিয়ে সাধারণভাবে আপত্তির সঙ্গত কারণ নেই। একটা নিতান্ত প্রাথমিক সত্য হল— সরকারের নিজের একটা কানাকড়িও নেই, থাকা সম্ভব নয়, সরকারি টাকা মানে নাগরিকদেরই টাকা। সুতরাং অন্য সমস্ত দিক বাদ দিলেও এই ধরনের প্রকল্প আসলে সমাজের সম্পদ পুনর্বণ্টনের এক একটি উপায়। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাপকরা দরিদ্র বা অল্প-আয়ের মানুষ, তাই পুনর্বণ্টনের স্বাভাবিক যুক্তি সহজবোধ্য। তার উপরে আছে কয়েক দশক ধরে ক্রমশই বেড়ে চলা আর্থিক বৈষম্য, গত দেড় বছরে যা আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। তার ফলে পুনর্বণ্টনের পক্ষে এখন অ-স্বাভাবিক যুক্তিও রয়েছে বইকি। এই বিপর্যয়ের মধ্যেও যাঁরা অম্লানবদনে সওয়াল করছেন যে, ‘খয়রাতির রাজনীতি’ করে বিনিয়োগের ক্ষতি করা হচ্ছে বা মানুষের শ্রমের উৎসাহ নষ্ট করা হচ্ছে, তাঁরা আসলে পুনর্বণ্টন ব্যাপারটাকেই সহ্য করতে পারেন না, সুতরাং তাঁদের ছেঁদো কথায় কান না দিলেও চলে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, পুনর্বণ্টনকে কীভাবে দেখা হচ্ছে? কীভাবে দেখানো হচ্ছে? একটা সরকার যদি বলে, বহু মানুষের বহু অভাব এখনও মেটেনি, মেটানো যায়নি, তাই তাঁদের প্রাথমিক কিছু প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা সাধ্য মতো সাহায্যের চেষ্টা করছে, তা হলে পুনর্বণ্টন প্রকল্পের একটা মানে তৈরি হয়। কিন্তু যদি বলা হয়— এক বার নয়, বার বার ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশাল বিশাল ছবি টাঙিয়ে বলা হয়— দেখো, সরকার তোমাদের জন্য কত কী করছে, তোমাদের কত কী দিচ্ছে, তোমাদের কারও কোনও অভাব রাখছে না, আর কত করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি, তা হলে মানেটা পাল্টে যায়, পাল্টে যেতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদের ক্ষেত্রে সেটাই খুব বড় আকারে ঘটেছে। প্রতিনিয়ত সরকারি অনুদানের বহুমুখী আয়োজনের নতুন নতুন মুখ তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরোত্তর এই ধারণাটিকে প্রচার করা হচ্ছে যে, এ-সবই জনসাধারণের প্রতি শাসকের বদান্যতা। এই প্রচার যে অনেক দূর অবধি সফল হয়েছে, সেটা এখন স্পষ্ট। বহু নাগরিকই এখন সরকারকে দাতা হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছেন। দানের পরিমাণ আরও বাড়ানো হোক, আরও নতুন নতুন দানের ব্যবস্থা হোক, আরও অনেককে দানের আওতায় নিয়ে আসা হোক— এ-সব চাহিদা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেটা গ্রহীতার চাহিদা, সে-চাহিদা আরও বদান্যতার জন্য, আরও অনুগ্রহের জন্য।
সরকার যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়, তা হলে এই দাতা এবং গ্রহীতার ধারণাটি আরও বেশি জোরদার হতে বাধ্য। ভারতের অন্য একাধিক রাজ্যের মতোই পশ্চিমবঙ্গেও বর্তমান জমানায় শাসক দল তথা রাজ্য সরকারের সর্বময়ী নেত্রীর প্রতিমাটি অতিকায়, দিনে দিনে তার কায়া আরও প্রসারিত হচ্ছে, সরকারের সমস্ত কাজে, এমনকি নিতান্ত খুঁটিনাটি ব্যাপারেও তাঁর ভূমিকা, কেবল প্রধান নয়, একমাত্র ভূমিকা হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। এই বাতাবরণে রকমারি অনুদানের প্রকল্পগুলি সবই নাগরিকের চোখে দেখা দিচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর জনদরদি বদান্যতা রূপে। এর ফলে নাগরিক নিজেকে কতখানি ‘প্রজা’ মনে করছেন তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু বহু নাগরিক বা প্রজা যে নিজেদের ভক্ত হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছেন সে বিষয়ে সংশয়ের কারণ নেই। পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ভক্তিমার্গের ঐতিহ্য রীতিমতো প্রবল। এখন রাজনীতিতেও ভক্তিরসের প্লাবন না হোক, জোয়ার চলছে।
প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির সমস্যা ও সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী আন্দোলন যে-সমস্যার সম্মুখীন, তার একটা বড় কারণ নিহিত রয়েছে এই বাস্তবের মধ্যেই। জনবাদী অনুদানের বহুধাবিস্তারী তরঙ্গ এবং সেই অনুদান নিয়ে প্রবল প্রচারের কলরোল প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির ভিতটাকে দুর্বল করে দেয়। এই অভিজ্ঞতা কেবল এই রাজ্যের বা এ-দেশের নয়, দুনিয়া জুড়েই জনবাদের অভিযান বামপন্থী রাজনীতিকে সমস্যায় ফেলেছে। সেই সমস্যার নানা দিক আছে, কিন্তু সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি এই যে, শাসকের অনুগ্রহে কৃতার্থ বোধ করলে শ্রমজীবী মানুষের চেতনায় যে ব্যাধির সংক্রমণ ঘটে, তা রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলার প্রতিকূল। এই কারণেই ধর্মবিশ্বাসকে সংগ্রামী চেতনার পক্ষে ক্ষতিকর বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সেই ধর্মবিশ্বাস যদি শাসকের প্রতি ভক্তিভাবের রূপ ধারণ করে, তা হলে ক্ষতিটা যে বহুগুণ বেড়ে যায়, সেটা বুঝতে কোনও সমস্যা নেই।
তবে কি জনবাদী ভক্তিরসের কাছে বামপন্থী রাজনীতিকে হার মেনে নিতে হবে? অবশ্যই নয়। বরং, মনে রাখতে হবে, যে কোনও সমস্যাই আবার একটা সুযোগও বটে। কিন্তু সমস্যাকে সুযোগে পরিণত করতে গেলে বাস্তবকে অস্বীকার করলে চলবে না, তাকে ব্যবহার করে, তার মধ্যে থেকে রসদ সংগ্রহ করেই গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধাকে নির্মাণ করতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবই সেই নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণটিকে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়। তার নাম নাগরিক অধিকার। নাগরিকের অধিকার। নাগরিক অধিকার বলতে সচরাচর বোঝানো হয় বাক্স্বাধীনতা বা প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলনের স্বাধীনতার মতো অধিকারগুলিকে, যারা ‘নেগেটিভ লিবার্টি’ বা নেতিবাচক স্বাধীনতার অধিকার বলে পরিচিত— এই কারণে নেতিবাচক যে, রাষ্ট্র বা অন্য ক্ষমতাবানের অন্যায়ের কারণে এই অধিকারগুলি হরণের বা খর্ব করার আশঙ্কা থাকে। এ-রাজ্যেও তেমন অন্যায় একেবারেই বিরল নয়, ফলে এই অধিকারগুলিকে সুরক্ষিত রাখার জন্যও সচেতন নাগরিকদের অবশ্যই সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজন আছে। বামপন্থী রাজনীতি সেই কাজে নেতৃত্ব দেবে, এটাই দরকারি।
কিন্তু তার পাশাপাশি, গুরুত্ব দিতে হবে নাগরিকদের প্রয়োজন পূরণের অধিকারকেও, যা ‘পজিটিভ লিবার্টি’ বা ইতিবাচক স্বাধীনতার অধিকার নামে অভিহিত। খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামগ্রিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা— এগুলি, এবং এ-ধরনের নানা বিষয়ে সক্ষমতা প্রত্যেক নাগরিকের প্রাপ্য। এবং প্রাপ্য যথার্থ কর্মসংস্থান, যে কাজের মধ্যে দিয়ে নাগরিক সমাজের প্রতি তাঁর ভূমিকা সার্থকভাবে পালন করবেন। বস্তুত, এই দু’ধরনের অধিকারকে মার্কসীয় চিন্তার সেই বহুচর্চিত আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়: প্রত্যেকের কাছ থেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী নেওয়া এবং প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী দেওয়া। ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম-এর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত আর আমাদের রাজ্য বা দেশের সমকালীন পরিস্থিতির মধ্যে অবশ্যই বিস্তর ফারাক, কিন্তু সেই নীতির মূল সূত্রটি এখানেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। বস্তুত, আমরা সেই সূত্রটি ধরেই অধিকারের রাজনীতির পুনর্নির্মাণের পথে এগোতে পারি।
সেই পথের দুটি দিক। একদিকে যথার্থ কর্মসংস্থানের দাবির মধ্যে নিহিত আছে সামর্থ্য অনুযায়ী দেওয়ার প্রশ্ন। ‘যথার্থ’ শব্দটি এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে কর্মসংস্থানের সংজ্ঞা যা দাঁড়িয়েছে, যে-সংজ্ঞা অনুযায়ী কর্মী এবং বেকারের পরিসংখ্যান নির্মাণ ও প্রকাশ করা হয়, তাতে কার্যত যে কোনও একটা কাজ করলে এবং তার জন্য যা হোক একটা মজুরি বা বেতন পেলেই লোককে কর্মী বলে গণ্য করা হয়। সেই কাজ এবং তার বিনিময়-মূল্য কর্মীকে ন্যূনতম সক্ষমতার (কেপেবিলিটি) সংসাধন দিতে পারছে কি না, সেটা দেখা হয় না। প্রসঙ্গত, অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ী যাকে ‘মর্যাদাপূর্ণ উন্নয়ন’ (ডেভেলপমেন্ট উইথ ডিগনিটি) বলেছেন, তার ভিতটাই হল এমন কর্মসংস্থান যাতে কর্মীর মর্যাদা সুরক্ষিত থাকে। সেটাই নাগরিকের অধিকার।
অন্যদিকে আছে প্রয়োজন পূরণের স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতার অধিকার। প্রয়োজনের দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদির উল্লেখ করেছি। এখানে একটা মৌলিক প্রশ্ন ওঠে। প্রয়োজনের পরিধি কী হবে এবং তার গভীরতাই বা কেমন হবে? অর্থাৎ, কোন কোন প্রয়োজনকে অধিকারের ন্যায্য বিষয় বা পরিসর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, এবং সেই পরিসরে কত দূর অবধি প্রয়োজন পূরণের দাবি জানানো হবে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্মানের সঙ্গে বাইরে চলাফেরা করার উপযোগী পোশাকের অধিকারও কি দাবি-সনদের জন্য স্বীকৃত হবে? (এটি অমর্ত্য সেনের সক্ষমতার তত্ত্বের আলোচনায় একটি পরিচিত প্রশ্ন, যা উঠে এসেছে অ্যাডাম স্মিথের নৈতিকতার ধারণার সূত্র ধরে।) আবার, শিক্ষার অধিকার বলতে আমরা কী বুঝব— প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর অবধি শিক্ষার অধিকার, না কি উচ্চশিক্ষার অধিকারও? যে যে বিষয়ে যত দূর পড়াশোনা করতে চায়, তার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের দাবিও কি তোলা হবে?
এই প্রশ্নগুলি নিয়ে একটু ভাবলেই বোঝা যায় যে, এগুলির কোনও পূর্বনির্ধারিত উত্তর মেনে নিতে আমরা বাধ্য নই। বস্তুত, কিসের প্রয়োজন এবং কত দূর অবধি প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে যথার্থ মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান বলতেই বা কী বোঝানো হবে, সেগুলোই আসলে রাজনীতির উপজীব্য বিষয়, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে রাজনীতির অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই। উল্টো দিক থেকে বলা যায়, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজাটাই রাজনীতির কাজ। এবং সেটা অনিবার্যভাবেই প্রতিস্পর্ধার কাজ। প্রতিস্পর্ধা মানে কেবল চ্যালেঞ্জ নয়, বিকল্প নির্মাণের দাবিও বটে। ক্ষমতা যে ব্যবস্থাকে ন্যায্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার বিকল্প ব্যবস্থার দাবি। চিরাচরিত বামপন্থী রাজনীতিতে এই বিকল্প নির্মাণকে প্রধানত অথবা সম্পূর্ণত রাষ্ট্রব্যবস্থার দখল নেওয়ার কার্যক্রম হিসেবেই গণ্য করা হয়, ‘সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন’ শব্দবন্ধটি সেই রাষ্ট্র-দখলের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেটাই বিকল্প নির্মাণ তথা প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির একমাত্র সংজ্ঞা নয়।
আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং তার উপসংহার হিসেবে বলা দরকার— রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধীশ্বররা তাঁদের মতো করে প্রয়োজনের যে ধারণা ঠিক করে দিতে চান, প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির দায়িত্ব হল সেই ধারণাকে শেষ কথা বলে মেনে না নিয়ে প্রয়োজনের ভিন্ন ধারণা তৈরি করা, যা রাষ্ট্র-নির্ধারিত প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি বিস্তৃত এবং অনেক বেশি গভীর। কিন্তু তফাতটা কেবল বিস্তার ও গভীরতার পরিমাণগত নয়, গুণগতও। ‘অধিকার’-এর ধারণাই সেই গুণগত তফাতটাকে গড়ে দিতে পারে। ক্ষমতা তার অনুগ্রহ দিয়ে যে প্রয়োজন মেটাতে চায়, তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে নাগরিকের প্রয়োজন পূরণের সামর্থ্যকে অধিকার হিসেবে দাবি করতে হবে— এটাই প্রতিস্পর্ধার ধর্ম। ক্ষমতা বলে: সে যা দিচ্ছে সেটাই প্রয়োজন, প্রয়োজন বলেই তো সে দিচ্ছে। প্রতিস্পর্ধার বক্তব্য: প্রয়োজন কী, তা ক্ষমতা ঠিক করে দেবে না, সেটা ঠিক হবে রাজনীতির পরিসরে, যে রাজনীতি প্রয়োজনের ধারণাকে উত্তরোত্তর বিস্তৃততর ও গভীরতর করে তোলার সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই পাল্টাতে থাকবে, ক্ষমতাকে সেই দাবি মানতে হবে, তাকে সেই দাবি মানতে বাধ্য করতে হবে। এটাই শাসকের জনবাদী রাজনীতির মোকাবিলায় বামপন্থী রাজনীতি নির্মাণের পথ। রাজনীতির বিষয়বস্তু এবং তার ধারণা, দুটিকেই একই সঙ্গে, একই প্রক্রিয়ায় পাল্টানোর চেষ্টা করা জরুরি। আমাদের বামপন্থী রাজনীতি সেটা কতটা পারবে, কতটা চাইবে, তার উপরে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে। এখনও অবধি যা অভিজ্ঞতা, তাতে এ-বিষয়ে খুব একটা আশা করার কারণ দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যেমন চলছে তেমনই যদি চলে, তবে মাসের শেষে ভাঁড় থেকে পয়সা বের করে দিনগত পাপক্ষয়ই ভবিতব্য।