বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
রাজনৈতিক প্রচারে আজকাল আমরা শুনতে পাচ্ছি, বিজেপি-র বি-টিম টিএমসি। টিএমসি আবার প্রচার চালাচ্ছে, বিজেপি-র বি-টিম হল বাম-কংগ্রেস। এই বিতণ্ডার মধ্যে কয়েক দশকের আগে ফিরে দেখলে আমরা খুব সহজেই খুঁজে পেয়ে যাই, এনডিএ-র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া আমাদের এখনকার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, কংগ্রেস দলে ভাঙ্গন তৈরি করে টিএমসি-র জন্মই হয়েছিল আরএসএস-এর অঙ্গুলিহেলনে। গত শতকের নয় এর দশকে অযোধ্যায় শিলান্যাসের পরপরই এই নব্য দলটির সৃষ্টির পর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। ফ্যাসিবাদ তার আগ্রাসী থাবা সারা ভারতকে গ্রাস করেছে। ফ্যাসিবাদী শক্তি ধর্মকে হাতিয়ার করে এগিয়ে চলেছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। যুক্তিবাদী মানুষকে কোণঠাসা করা হচ্ছে। আন্দোলনের ময়দানে এবং সংসদীয় রাজনীতিতে বাম শক্তির অবস্থান অনেক পিছনে চলে যাওয়ার সত্ত্বেও পারস্পরিক দোষারোপের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বাম দলগুলোর মধ্যে। অথচ যুক্তিনিষ্ঠ সাহসী নেতৃত্বকেই বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কোথায়?
আসলে ফ্যাসিবাদ ভয় পায় যুক্তিবাদকে। এই ভয় এতটাই বিস্তৃত যে সংসদীয় রাজনীতিতে তলানিতে যাওয়া বামেদের দিকেই আঙ্গুল তুলে বলা হচ্ছে যে, সব ব্যর্থতার দায় বামেদেরই। রাজ্য বা কেন্দ্রের রাজনীতির সংসদীয় আঙিনায় শাসক দলগুলির শক্তির সঙ্গে বামেদের শক্তির কোনও তুলনাই চলে না। তবু কেন এত ভয়? এর অনুসন্ধান করতে গেলেই আমরা দেখি, যুক্তিবাদের শক্তিতে বলীয়ান প্রতিবাদের ভাষাকে, শ্রমজীবী মানুষের পাশে থাকা, রাস্তায় নেমে পড়া মানুষগুলোকে, যাদের আজও সমঝে চলতে বাধ্য হন ফ্যাসিবাদী রাজনীতির দিকপালরা। তারা যে শুধুমাত্র বামেদেরই এড়িয়ে চলেন তেমনটা নয়, বরং যে কোনও যুক্তিবাদী মানুষকেই এড়িয়ে চলতে চান।
একের পর এক জায়গায় শুধুমাত্র অর্থ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সারা দেশে একাধিপত্য করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি। চন্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনে গুরুতর কারচুপি করে সেখানে কর্পোরেশন দখল করার চেষ্টা করেছিল বিজেপি। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তা হয়নি। বিহারের নীতিশ কুমার পালটি খেছেন। নীতিশ কুমারকে নিয়ে যখন ইন্ডিয়া জোট যাত্রা শুরু হয়েছিল তখনই টিএমসি সুপ্রিমো বলেছিলেন, আমি আর নীতিশদা ঠিক আছি। সংসদীয় নির্বাচন যত এগিয়ে এসেছে ততই ‘ঠিক আছি’র নমুনা বেরিয়ে পড়েছে। আসলে এই নড়বড়ে সমীকরণ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে কতটা রুখতে পারবে সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যাওয়ার পরেও যে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছেই, ফ্যাসিবাদী শক্তির কাছে সমগ্র দেশটা চলে গেলে ঠিক কোন ক্ষতির সম্মুখীন হবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই উত্তরপ্রদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই, সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘট নিষিদ্ধ করতে ‘এসমা’ জারি করল যোগী আদিত্যনাথ সরকার। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার ছ’মাসের জন্য জারি করেছে এই আইন। উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম অংশে এর মধ্যেই কৃষক আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে চলতি দফায়। সংযুক্ত কিসান মঞ্চ এবং ট্রেড ইউনয়ন সমূহের ডাকে ‘ভারত বন্ধ’-র প্রভাবও পড়েছে নয়ডার মতো বেশ কিছু এলাকায়। সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন ফেডারেশনও কৃষক এবং শ্রমিকদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে আগেই। পুরনো পেনশন ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে রাজ্যে রাজ্যে সরকারি কর্মীদের ক্ষোভ রাস্তায় নেমেছে।
উত্তরাখণ্ডের হলদওয়ানির হিংসার ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। হলদওয়ানিতে একটি মাদ্রাসা ভাঙতে গিয়ে পুলিশ ও স্থানীয়দের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ বাধে। ঘটনায় শতাধিক পুলিশ কর্মী আহত হন। সাংবাদিকরাও আহত হন। সব মিলিয়ে ৩০০ জনের বেশি আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। হিংসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যেই ৫০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। পাশাপাশি ৫০০০ জন অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। উত্তরাখণ্ড পুলিশ জানায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রসঙ্গত বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন হলদওয়ানির বনভুলপুরায় সরকারি জমিতে একটি মাদ্রাসা ও একটি মসজিদ সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভাঙতে যায়। এর প্রতিবাদ জানান স্থানীয়রা। ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। তারপরই দু’পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বাধে। প্রশাসনের দ্বারা ভেঙে দেওয়া এই মাদ্রাসাটি রেলওয়ে কলোনি এলাকায় অবস্থিত যেখানে ৪ হাজারেরও বেশি পরিবার গত ৪০ বছর ধরে বাস করছে। রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য এই এলাকার জমি প্রয়োজন কেন্দ্র সরকারের। রেলের এই নোটিসের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা আগেও প্রতিবাদ মিছিল করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থও হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের হয়ে শীর্ষ আদালতে বিষয়টি দেখছেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। বিষয়টি এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
অন্যদিকে, কৃষক নেতাদের দাবি যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের একটি অর্ডিন্যান্স আনা উচিত, যা বর্তমানে পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তের শম্ভু ও খানৌরি পয়েন্টে শিবির করা কৃষকদের প্রধান দাবি। কৃষক নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনার আগে এই দাবিটি এসেছে।
আরেকদিকে, লোকসভা নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে কংগ্রেস, যুব কংগ্রেসের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করলো আয়কর দপ্তর। যুব কংগ্রেস এবং কংগ্রেস পার্টির কাছ থেকে ২১০ কোটি টাকা রিকভারি চেয়েছিল আয়কর দপ্তর। এই অ্যাকাউন্টগুলিতে অনলাইন ক্রাউডফান্ডিংয়ের টাকা ছিল। কোনও পুঁজিপতির কাছ থেকে পাওয়া টাকা বা কর্পোরেট বন্ডের টাকা ছিল না। প্রায় ২৫ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে ক্রাউডফান্ডিং করে, এর মধ্যে সিংহভাগ লোকই ১০০ টাকা করে দিয়েছিলেন। আর যুব কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে থাকা ছিল মেম্বারশিপের টাকা। বিরোধীদের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা গণতন্ত্রকে ফ্রিজ করার সমতুল্য, বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই।
আসলে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি গড়ে তোলার বদলে দেশ জুড়ে মানুষের ধর্ম, জাতপাত, জাতিগত সংঘাত লাগানোর চেষ্টা চলছে পরিকল্পিতভাবে। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি, সদ্ভাব এবং সহাবস্থানের পরিবর্তে কিছু শক্তি পরিকল্পিতভাবে লাগাতার
তাদের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই শক্তি সফল হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের কোন বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত, কোন বিষয়ের বিরোধিতা করা উচিত তা নিয়েও মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছে। এই সময় একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে একটাই কথা শুধুমাত্র বলার – উৎপল দত্তের ভাষান্তরে গোর্কির ‘মা’ অবলম্বনে ব্রেখটের লেখা নাটক ‘ডী মুটার’-এ পাভেলের মৃত্যুতে মা ভেঙে পড়েছেন, আর তাঁর উদ্দেশে শ্রমিকরা গাইছেন—
“উঠে দাঁড়াও, পার্টির বিপদের দিনে।
জানি তুমি রোগগ্রস্ত, কিন্তু পার্টি মুমূর্ষু
জানি তুমি দুর্বল, তবু তোমারই সাহায্য চাই।
উঠে দাঁড়াও, পার্টির বিপদের দিনে।
জানি তুমি নানা দ্বিধায় দোদুল্যমান
কিন্তু আজ নেই কোনও দ্বিধার অবসর,
আমরা উপনীত চরম সীমায়।
জানি দিয়েছ পার্টিকে বহু অভিশাপ,
আজ আর নেই মান অভিমানের সময়
পার্টি আজ আক্রান্ত।
উঠে দাঁড়াও, পার্টির বিপদের দিনে।
উঠে দাঁড়াও এক্ষুনি!
জানি তুমি অসুস্থ, কিন্তু তোমায় দরকার।
মরার অনেক সময় পাবে পরে,
এখন চাই তোমার সাহায্য।
থেকো না দূরে দূরে, লড়াইয়ে যাচ্ছি আমরা,
উঠে দাঁড়াও পার্টির বিপদের দিনে,
উঠে দাঁড়াও।”