বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

বকেয়া মহার্ঘভাতার মহিরুহ

বকেয়া মহার্ঘভাতার মহিরুহ

অর্জুন সেনগুপ্ত

photo

সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘভাতা পাহাড় প্রমাণ ৩৫%। কোনও সরকারই কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘভাতা মিটিয়ে দেয়নি। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হল শ্রমিক-কর্মচারীদের দাবি আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরোত্তর নতুন দাবি উত্থাপন ও অর্জন। রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগপত্রে উল্লিখিত প্রাপ্যই এখনো অর্জিত হয়নি, নতুন দাবি তোলা তো দুরস্ত। ওয়াকিবহাল মানুষ মাত্রই জানেন, মহার্ঘভাতা পেলেও কর্মচারীর একটাকাও বেতন বৃদ্ধি হয় না। মূল্যবৃদ্ধি সাপেক্ষে বেতনের অবক্ষয়ের একাংশের ক্ষতিপূরণ হল ডিএ বা মহার্ঘভাতা। একাংশ, কারণ সরকারগুলো মহার্ঘভাতা গণনার এমন ফর্মুলা ফেঁদেছে যে পুরো ক্ষতিপূরণ কখনোই হয় না। অর্থাৎ ডিএ পেলেও কর্মচারীদের মূল বেতন কমতে থাকে মূদ্রাস্ফীতির কারণে। আর না পেলে তো অবস্থা কহতব্য নয়। কিন্তু রাজ্যের সরকারের ভাবখানা এমন যে ডিএ হল দয়ার দান, ইচ্ছে হলে দেবে আর না হলে নয়। ডিএ না দেওয়া মানে যে প্রতিশ্রুত বেতন না দেওয়া এবং দেশের আইনের লঙ্ঘন (Payment of wages & salary Act), তা তথাকথিত আদর্শ নিয়োগকর্তা সরকারই ভুলিয়ে দিতে চাইছে। দেশের বেতনভুক শ্রমিক, কর্মচারীদের ডিএ গণনা করা হয় সারা ভারত ভোক্তা মূল্য সূচক (All India consumer price index) অনুযায়ী। কেন্দ্রীয় সরকার তার কর্মচারীদের জন্য ওই সূচক অনুযায়ী বছরে দু’বার, জানুয়ারি ও জুলাই মাসে মহার্ঘভাতা ঘোষণা করে। কেন্দ্রের সপ্তম বেতন কমিশনের (এ রাজ্যের ষষ্ঠ) পর কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘভাতার পরিমাণ ৩৮%। পশ্চিমবঙ্গ দেয় ৩% ও ত্রিপুরা ২০%। অন্য সব রাজ্য সরকার কেন্দ্রের সমপরিমাণ বা কাছাকাছি মহার্ঘভাতা কর্মচারীদের দিতে বাধ্য হয়।
এ রাজ্যের সরকার উদ্দেশ্যমূলক ভাবে একটি অপপ্রচার করে, মিডিয়াগুলো তার সঙ্গে গলা মেলায়— শ্রমজীবীদের মধ্যে ২ শতাংশও ডিএ পায় না, তাই সুবিধাভোগী সংখ্যলঘু কর্মচারীদের বৃহত্তর স্বার্থে একটু মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। মুশকিল হল শ্রমজীবীদের যে বৃহৎ অংশ এই প্রয়োজনীয় প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত তারা সরকার ও মিডিয়ার প্রচারে প্রভাবিত হয়। সরকারি কর্মচারীদের ডিএ-র দাবি সামাজিক মান্যতা পায় না, অর্জিতও হয় না। সব শ্রমজীবীকে এটা অনুধাবন করতে হবে যে তথাকথিত আদর্শ নিয়োগকর্তা সরকার যদি তার শ্রমিক-কর্মচারীদের এই ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার ছাড়পত্র পেয়ে যায় তবে বেসরকারি মালিকেরা (খাতায় কলমে যাদের সরকারি নীতির অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়) কোনওদিনই শ্রমিকদের এই অধিকারের স্বীকৃতি দেবে না। মহার্ঘভাতার অধিকার সরকারি, বেসরকারি সব মজুরি শ্রমিক, বেতনভুক শ্রমজীবীর; সবাই মিলে লড়তে হবে এই দাবিটিকে সামনে রেখে।
সরকারের আর এক হাস্যকর বাহানা হল— এতো টাকা কোথা থেকে পাব? খেলা, মেলা, পুজো, দানখয়রাতের সময় টাকার অভাব হয় না, যত অর্থের অভাব ঘটে কর্মচারীদের ন্যূনতম প্রাপ্য মেটানোর বেলায়। অন্য রাজ্যগুলি কীভাবে দেয় সে প্রশ্নও উত্তরহীন থাকে। বর্তমান সরকারের বঞ্চনার মানসিকতা তুলনা বিহীন; আছে সর্বময় কর্ত্রীর আন্দোলনরত কর্মচারীদের সারমেয়, মার্জারের সঙ্গে তুলনা করে চরম অপমান। তবে বিগত সরকারগুলোরও কর্মচারীদের প্রাপ্য মেটানোর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির মূলগত পার্থক্য ছিল না। সমস্যা হতভাগ্য কর্মচারীদের।
২০১৬ সালে ত্রিপুরার কর্মচারীদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে এ রাজ্যের দুটি কর্মচারী সংগঠন মহার্ঘভাতাকে কেন্দ্র করে WBSAT এ মামলা করে; কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ (আইএনটিউসি) ও ইউনিটি ফোরাম। ঐ বছর বিজেপি প্রভাবিত কর্মচারী পরিষদও মামলার সহযোগী হওয়ার জন্য আবেদন করে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালে ঐ সংগঠন একই ই্যসুতে মামলা দায়ের করতে সক্ষম হয়। প্রথমোক্ত দুটি সংগঠনের মামলার দুটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল: ১) রাজ্য সরকার দ্বারা গৃহীত পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশে স্পষ্ট ভাবে লিখিত ছিল যে কেন্দ্র সরকার যে হারে ডিএ ঘোষণা করবে রাজ্য সরকারও একই দিন থেকে একই হারে তার কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা দিতে বাধ্য থাকবে, ২) এ রাজ্যের কর্মচারীরা যারা দিল্লির বঙ্গভবন বা দেশের অন্যত্র ডেপুটেশনে আছেন তাদের রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় হারে, কেন্দ্রের ডিএ প্রদানের দিন থেকে মহার্ঘভাতা দেয়। একই নিয়োগকর্তার অধীনে নিয়োজিত কর্মচারীদের পৃথক হারে বেতন দেওয়া দেশের আইন বিরুদ্ধ। পঞ্চম বেতন কমিশনের সময়কাল অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০১৬ কর্মচারীদের যে ডিএ ঠিক সময় দেওয়া হয়নি তার বকেয়া দাবি করে মামলাটি চালু হয়। দুর্ভাগ্য যে স্যাট সরকারের কথনকেই স্বীকৃতি দিয়ে রায় দেয় যে মহার্ঘভাতা আসলে দয়ার দান ও তার ঘোষণা সরকারের মর্জি মাফিক।
স্যাটের এই রায়ের বিরুদ্ধে কর্মচারী পক্ষ মহামান্য হাইকোর্টে যান। উচ্চ আদালত রায় দেয় যে মহার্ঘভাতা পাওয়া কর্মচারীর মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। স্যাটকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে মহার্ঘভাতা কী হারে ও কীভাবে দেওয়া হবে তা নির্দিষ্টকরণ করতে। স্যাট রায় দেয় তিন মাসের মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে কর্মচারীর প্রাপ্য মহার্ঘভাতা (কেন্দ্রীয় হারে) মিটিয়ে দিতে হবে। কর্মচারীদের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে তিন মাসের মাথায় আবার রাজ্য সরকার হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। ধরুন ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে গত ছ’মাসের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিপূরণ হিসাবে কেন্দ্র যে হারে ডিএ ঘোষণা করলো ও রাজ্য সরকার যা দিতে বাধ্য, সেই মহার্ঘভাতা যদি ২০১১ সালের জুলাই মাসে সরকার ঘোষণা করে, (বকেয়া নামক শব্দটি সরকারগুলোর অভিধানে নেই) কবেকার মূল্যবৃদ্ধির সে ক্ষতিপূরণ, তার হারই বা কী? মহামান্য হাইকোর্ট আবার স্যাটের রায়কেই বহাল রাখলো। এক্ষেত্রে একটি বিষয় বুঝে নেওয়া ভালো। আদালতের রায় দিলেন, মহার্ঘভাতা কর্মচারীদের মৌলিক অধিকার। সুতরাং ২০০৯ থেকে ২০২২ অবধি ডিএ কর্মচারীদের প্রাপ্য।
সরকার বাহাদুর জনগণের অর্থ অপচয় করে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার পর রায়ের পুনঃবিচারের আবেদন করলো। সরকারের কোষাগারের অর্থ নেই এই যুক্তি আদালতে সরকার গ্রহণযোগ্য রূপে পরিবেশন করতে পারেনি, রাখলেও বঞ্চনার অনুকূলে সে যুক্তি ধোপে টিকেনি। যথারীতি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সরকারের আপিল খারিজ করে দিয়েছে। সরকার আবার সুপ্রিম কোর্টে গেছেন! কর্মচারীর ন্যূনতম প্রাপ্য না মেটানোর তাগিদে সরকার মানুষের ট্যাক্সের টাকা জলের মতো খরচ করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ রাজ্যের বিদ্যুৎ পর্ষদের কর্মীরা তাদের ডিএ মামলায় হাইকোর্টে জয়লাভ করে। সরকার সুপ্রিম কোর্টে যায়। শীর্ষ আদালত হাইকোর্টের রায় শুধু বহালই রাখেননি, ডিএ প্রদানে বিলম্বের কারণে আরও ১০% সুদ চাপিয়েছে সরকারের ঘাড়ে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো পর্ষদের শীর্ষ কর্তাদের বেতন বন্ধ হয়েছে আদালত অবমাননার দায়ে। এরাজ্যের কর্মচারীরাও আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেছে সরকারের বিরুদ্ধে।
মামলা চালাতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়েছে তার সংকুলানে একটি সংগঠন বাদ দিয়ে অন্য সবাই মামলাকারীদের সাহায্য করেছে। কর্মচারীরাও এক্ষেত্রে উদার হস্ত হতে কার্পণ্য করেনি। প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠেছে এই যে দীর্ঘ ছ’বছর যাবত মামলা চললো, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হল তার কি দরকার ছিল? এই উদ্যোগ যদি কর্মচারীদের বাস্তব আন্দোলনে ব্যবহৃত হতো তবে কবে ডিএ আদায় হয়ে যেত! বস্তুত অন্য রাজ্যের কর্মচারীরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করেছে মামলা করে নয়, আন্দোলনের ময়দানে। বিহার, কর্ণাটক, সম্প্রতি গুজরাটের কর্মচারীদের আন্দোলন এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। অপর দিকে সুপ্রিম কোর্টে জিতেও ত্রিপুরার কর্মচারীরা ৮%-এর বেশি ডিএ আদায় করতে পারেনি।
এটি সঠিক যে কর্মচারী সংগঠনকে বুঝতে হয় কর্মচারীদের চাহিদা। একে তো চৌত্রিশ বছরের বন্ধু সরকারের তত্ত্ব কর্মচারীদের সরকারমুখী করে ছেড়েছে। তার উপর গত এগারো বছরের স্বৈরাচারী শাসন, প্রতিবাদী কর্মচারীদের দূরদূরান্তে বদলি করার জুজু কর্মচারীদের চেয়ার বন্দী করে রেখেছে। তাই তাঁরা আদালতের আইনি প্রক্রিয়াকে দাবি আদায়ের এসময়ের প্রযোজ্য পন্থা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সত্যের অপলাপ না ঘটালে স্বীকার করতেই হয় কিছু সংগঠন এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও রাস্তায়, দপ্তরে লড়াই গড়ার প্রচেষ্টা করেছে এবং সরকারের রোষ ও প্রত্যাঘাতের শিকার হয়েছে। নেতৃত্ব তাদের জীবিকাকে স্যাক্রিফাইস করেছে কিন্তু কর্মচারী আন্দোলনমুখী হয়নি। এমতাবস্থায় রাস্তা ও আইনি লড়াইয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করাই সঠিক কৌশল।
তবে ডিএ-র লড়াইকে কেন্দ্র করে সমাজকর্মীরা কি রাষ্ট্র চরিত্রের উন্মোচনের কাজ করতে পারে না? অবশ্যই পারে। প্রথম কাজ হল পেশার গণ্ডি পেরিয়ে সমগ্র শ্রেণীর জন্য মহার্ঘভাতার লড়াইয়ে নামা নিজ নিজ ট্রেড ইউনিয়নের এবং যৌথ মঞ্চ থেকে। তবে আইনি লড়াইকে শাপশাপান্ত করে কর্মচারীর আস্থা অর্জন করা যাবে না। ধৈর্য ধরে রাস্তার আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কর্মচারীদের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেই তুলে ধরতে হবে আইনি লড়াইয়ের বাস্তব সীমাবদ্ধতা। আইন আদালত রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ— এই সত্য প্রতিভাত করতে রাস্তার আন্দোলনের সঙ্গে লড়তে হবে আইনি লড়াই। কর্মচারীদের সঙ্গে মিশে থেকে রাষ্ট্র ও আদালতের প্রতি তাদের মোহ ভঙ্গ করার ধৈর্যসাধ্য কাজটি করতে হবে। তবেই শ্রেণী সংগ্রামের প্রতি তাদের বিশ্বাস ফেরানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করা যেতে পারে।
আশার কথা সম্প্রতি একটি শিক্ষক সংগঠনের উদ্যোগে সরকারি, আধা সরকারি, ডাক্তার, নার্স, শিক্ষা কর্মীদের ২৯টি সংগঠন ডিএ, স্বচ্ছ নিয়োগ ইত্যাদির দাবিতে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ গড়ে তুলছে। কিছুটা নজরকাড়া জমায়েত করতেও সক্ষম হয়েছে। সংগঠনশক্তি নির্বিশেষে সমস্ত সংগঠনকে সমমর্যাদা দিয়ে যৌথ মঞ্চ চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে— না হলে আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
এই সময়ে দুর্নীতির শিকার চাকরি প্রার্থীদের লাগাতার আন্দোলন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যৌথ মঞ্চ ও অন্যান্য সংগঠনকে এই লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। আজ সরকারি দপ্তরগুলিতে অনিয়মিত, চুক্তি ভিত্তিক, ঠিকা শ্রমিকদের সংখ্যা স্থায়ী কর্মীদের থেকে বেশি। উত্তরোত্তর এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের না আছে মহার্ঘভাতা, না আছে অন্যান্য সরকারি সুবিধা। অনেকে এমনকি পিএফ, মেডিকেল সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত। এই অস্থায়ী কর্মীদের যদি আন্দোলনের শরিক না করা যায় তবে আন্দোলন বৃহত্তর জয় ছিনিয়ে আনা কঠিন। মহার্ঘভাতা শুধু সরকারি কর্মচারী নয় সব বেসরকারি শ্রমিক-কর্মচারীর মৌলিক অধিকার।
সে দাবি উঠেছে বজ্র নির্ঘোষে। সাম্প্রতিক কালে পশ্চিম বঙ্গের সরকারি কর্মচারী আন্দোলনে জোয়ার এসেছে বর্তমানে বিভিন্ন পেশার ৪২টি সংগঠনের দ্বারা গঠিত সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। বিগত এক বছর ধরে সাড়া জাগানো মিছিল, কনভেনশন ইত্যাদি কর্মসূচির সফল রূপায়ণের পর গত ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ থেকে লাগাতার আন্দোলনে রাজপথে এই মঞ্চ। ঐদিন উচ্চারিত হয়েছে প্রধানত দুটি দাবি—উচ্চ আদালতের রায় অনুসারে সমস্ত বকেয়া মহার্ঘভাতা কেন্দ্রীয় হারে দিতে হবে এবং সরকারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ শূন্য পদ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পূরণ করতে হবে।
২৭ তারিখ মঞ্চের থেকে গণছুটি ও মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। যথারীতি এই রাজ্যের গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা প্রশাসন মিছিলের অনুমতি দেয় না। বাধ্য হয়ে মঞ্চকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। আদালতের রায়কে হাতিয়ার করেই শুরু হয় সাম্প্রতিক কালে এ রাজ্যের সব থেকে সাড়া জাগানো আন্দোলন। মিছিল শেষে সরকারি, আধা সরকারি কর্মচারী, আদালত কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষা কর্মী, অধ্যাপক, ডাক্তার, নার্স, লাইব্রেরিয়ান ইত্যাদি পেশার মানুষেরা শহিদ মিনারে সমাবেশে সামিল হন। শুরু হয় সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ পরিচালিত অবস্থান কর্মসূচি। আজ চলছে ৩৪ দিন। কর্মচারীরা অদম্য জেদে অনশনে আছেন টানা ১৯ দিন। চকলেট, স্যান্ডউইচ খেয়ে অনশন নয়, অনশনকারীরা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে। ব্লাড, ইউরিনে ধরা পড়ছে কিটন বডি। অর্থাৎ খাদ্যের অভাবে নিজেই নিজেকে খাচ্ছে। কিন্তু হৃদয়হীন, অমানবিক সরকারের কোনও হেলদোল নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা তো দুরঅস্ত, অনশনকারীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে খোঁজও কেউ নিতে আসেনি।
মঞ্চের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে একের পর এক কর্মসূচি। পয়লা ফেব্রুয়ারি দু’ঘন্টার কর্ম বিরতি পালিত হয়েছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় পূর্ণ দিবস কর্ম বিরতি। তারপর ২০-২১ ফেব্রুয়ারি দু’দিন ব্যাপি সফল কর্ম বিরতি পালন করেন রাজ্যের আপামর কর্মচারী, শিক্ষক। ইতিমধ্যে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটি পরিচালিত আর একটি সরকারি কর্মচারী, শিক্ষকদের যৌথ মঞ্চ। তারা গত ১৭ তারিখ বিধানসভা অভিযান করে ভোগ করেছেন পুলিশি নিপীড়ন। মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে একাধিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। এবার ভীত সন্ত্রস্ত সরকার গত ১৮ তারিখ বের করলো একটি হাস্যকর আদেশনামা। ২০-২১ তারিখ যারা কর্মক্ষেত্রে গরহাজির থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে বেতন কাটা ও কর্মজীবন থেকে একদিন বাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অপদার্থ সরকার কর্ম বিরতি আর গণছুটির পার্থক্যটুকু বোঝে না। সরকারের নেতা মন্ত্রীরা আউড়ে চলেছেন সরকারের ভিখারি অবস্থার মিথ্যা গাওনা। যে সরকারের সত্যিই আর্থিক অনটন আছে সে দানখয়রাত বৃদ্ধি করে নাকি! খেলা, মেলা, কার্নিভালে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ক্লাবগুলোকে দশ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৬০,০০০ টাকা করা হল। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে ২৫% অনুদান বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সর্বোপরি একটি চমক লাগানো খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যে আদানি আজ ব্যাপক আর্থিক কারচুপির অভিযোগে অভিযুক্ত তাকে তাজপুরে ১১২৬ একর জমি ৯৯ বছরের জন্য এক টাকার বিনিময়ে লিজ দিয়েছে সরকার। রেজিষ্ট্রেশন ফিজ, স্ট্যাম্প ডিউটি মুকুব করা হয়েছে। বেসরকারি মালিকের সঙ্গে সরকারের চুক্তিতে সাধারণত কর্ম সংস্থান সৃষ্টির যে শর্ত থাকে তাও অনুপস্থিত। ওদিকে কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি মেটানোর প্রশ্ন উঠলেই নেতারা বলছেন তারা তেলা মাথায় তেল দেন না! অবস্থানরত কর্মচারীদের নানা রাজনৈতিক রঙে রঞ্জিত করার অপচেষ্টা করছেন। যদিও সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও সম্পর্ক নেই। সরকার গড়া ফেলার খেলায় আমরা নেই, আমরা আছি শহিদ মিনার ময়দানে, নিজেদের পেটের দাবিতে।
কর্মচারীদের ধৈর্যের বাধ ভেঙেছে। ভয় ভীতি বিস্মৃত হয়ে তারা মরণ কামড় দিতে উদ্যত। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হল যখন বাজেট সেশনে সরকার মাত্র ৩% হিসাব বহির্ভূত মহার্ঘভাতা দয়ার দান হিসাবে কর্মচারীদের দিকে ছুড়ে দিল। আগামী ১০ মার্চ ২০২৩ দুটি মঞ্চ যৌথ ভাবে বকেয়া মহার্ঘভাতা, স্বচ্ছ নিয়োগ, অনিয়মিত কর্মীদের নিয়মিতকরণের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। কো-অর্ডিনেশন পরিচালিত মঞ্চের আর একটি দাবি হল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার।
আবারও বলছি সরকারের টাকার কোনও অভাব নেই। গত দশ বছর বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে যে টাকা ধার্য হয়েছে তার বহুগুণ বেশি ধার্য হয়েছে এনজিও খাতে ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকা— যে টাকার কোনও অডিট হয় না। সরকার নিজের কর্মচারীদের প্রতি চরম বঞ্চনা করে কর্পোরেটদের বার্তা পাঠাচ্ছে। কর্পোরেটরা শ্রমিক কর্মচারীদের অধিকার হরণের পদক্ষেপ নিলে শ্রমজীবীরা সরকারি রক্ষাকবচ পাবে না।
এ লড়াই শুধু সরকারি কর্মচারীদের লড়াই নয়, সমগ্র শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.