বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
কিছু দিনে আগে পুরুলিয়ার দুয়ারসিনিতে সাতগুড়ুম নদীর ধার ঘেঁষে শেষ বিকেলের আলোয় দেখেছিলাম মানুষের মেলা। রঙ বেরঙের পোশাকপরা আদিবাসি পুরুষ মহিলা। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে কোনও উৎসব। শনিবারের হাট। কত কত মহিলা মাথায় করে বড় বস্তায় মাল নিয়ে এসে বসছেন। আমার নাক-উঁচু বন্ধু পঞ্চাশ টাকা দিয়ে তাঁদের একজনের থেকে একখান ব্লাউজ কিনে ফেলল। অবাক চোখে তাকিয়ে আছি দেখে বলল, “এতে একটু অ্যাপ্লিক করে নিলে দারুণ হবে।” কান পরিষ্কারের ওষুধ থেকে তেল নুন মশলা সব আছে সে হাটে। দশ টাকা কেজি টমেটো। আট টাকা কেজি বেগুন। পাশাপাশি গ্রামের কত কত মানুষ এসেছে সপ্তাহের বাজার করতে। মনে পড়ল, অর্থনীতির অধ্যাপক শুভেন্দু দাশগুপ্তের সেমিনারের কথা। যেখানে অত্যন্ত সহজ ভাষায় তিনি ব্যাখ্যা করতেন, কীভাবে এই হাটগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে। স্বল্প-পুঁজি তৈরি করেছে নিজস্ব বাজার। ব্যক্ত করতেন তাঁর আশঙ্কার কথাও।
বহু বছর ধরে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডের হরিসাহার হাটে ব্যবসা রতনবাবুর। বাড়িতে ছোট মতো কারখানা আছে, নিজেরাই সেখানে মাল কাটিং করেন। আগে দেখেছি রবি আর বুধবার ভোর চারটে থেকে প্রায় একটা দেড়টা অবধি হাটে থাকেন। সেদিন এগারোটা বাজতে না বাজতেই তল্পিতল্পা গোটাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “এখনি চলে যাচ্ছেন?” বললেন, “কী করব দিদি খদ্দের নেই। হাটের অবস্থা খুব খারাপ।” এখন রতন বাবু দুপুরের পর জোমাটো-তে কাজ করেন। মাঝে মাঝে সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবেও কাজ করেন। তবুও সংসার চালাতে হিমসিম।
কলকাতার হাট মুকুন্দরামের চন্ডিমঙ্গলের কাল থেকে। সেই ষোড়শ শতাব্দী। মনসামঙ্গলেও আছে হাটের উল্লেখ। এখনকার বাগবাজার, শোভাবাজার, চিতপুর অঞ্চল জোব চার্নকের কালে ছিল সুতানুটি। সেকালে এই অঞ্চলে বসত সুতানুটির হাট। বিক্রি হতো সুতো, কাপড়। পরবর্তকালে এই হাট বড়বাজার অঞ্চলে চলে গেলে বাগবাজারের ব্যবসায়ী হরিদাস সাহা খান্না গৌরীবাড়ি এলাকায় বসান রেডিমেড পোশাকের হাট। তাইই আজকের হরি সাহার হাট। কিছু বছর আগেও ছিল যার রীতিমত রমরমা। কলকাতার শহরতলি থেকে বিক্রেতারা আসেন এই হাটে। বেশির ভাগই নিজেরাই বাড়িতেই উৎপাদন করেন। কাপড় কেনেন শোভাবাজার, কুমারটুলি, সালকিয়া থেকে। এরা প্রত্যেকেই ছোট উৎপাদক, small producer.
গুজরাটের বড় ব্যবসায়ীর থেকে সুতো কিনছে বড়বাজার মেটিয়াবুরুজ এলাকার বড় মাঝারি মাপের ব্যবসায়ী, সুতো থেকে কাপড় তৈরি হচ্ছে শোভাবাজার কুমারটুলিতে। সেই কাপড় কাটিং হচ্ছে সোদপুরে দুর্গানগরের বাড়ির একটা বা দুটো মেসিনের কারখানায়। তৈরি মাল আসছে হরিসাহার হাটে, চেতলা হাটে, মঙ্গলা হাটে। ভোর ভোর গ্রামের ছোট দোকানদার এসে কিনে নিচ্ছেন পাইকারি দামে সেই তৈরি মাল। গ্রামের মানুষ কিনছেন তাদের থেকে।এভাবেই স্বল্প পুঁজি ছোট কারখানা ছোট ব্যবসায়ী গরীব মানুষের মধ্যে গড়ে উঠছে এক চেন। তৈরি হচ্ছে ছোট উৎপাদক ছোট বিক্রেতা ছোট ক্রেতার অর্থনীতি। হাটে একই জিনিষ কেউ বেচেন ৫০ টাকায়, কেউ ৬০ টাকায়, কেউ বা ৫৫ টাকায়, কেউ শেষ বেলায় ৪০ টাকাতেও ছেড়ে দেন। মহাজনের টাকা অন্তত শোধ হবে এই আশায়। দামের উপর তাদের ‘স্বাধীন’ নিয়ন্ত্রণ।
সাত থেকে আট হাজার পাইকারি ব্যবসায়ি এখন হরি সাহার হাটে। তার মধ্যে মেরে কেটে একশ মহিলা পাইকার। খুচরো ব্যবসায়ী হাজার জন মতো আছেন। “মহিলা এত কম কেন?” আমার প্রশ্নের উত্তরে রতনবাবু বললেন, আমরাই পারছি না মহিলারা কী করে পারবেন। ওঁদের তো পুরো সংসার সামলে ব্যবসা করতে হয়। যে মহিলারা এই হাটে ব্যবসা করেন, বেশির ভাগেরই পুরো সংসারের দায় তাদের। কারোর স্বামী মারা গেছেন কারো বা স্বামীর কাজ নেই।
সোদপুর থেকে আসা নমিতাদি, নমিতা কুন্ডু, উল্টোডাঙ্গার স্বপ্নাদি, স্বপ্না দাস সবারই এক কথা। হাটে এখন বিক্রি নেই। শোভাবাজার কুমারটুলির ছোট ছোট কাপড়ের কারখানাগুলোর বেশির ভাগই বন্ধের মুখে। এখন কাপড় আসে মূলত তামিলনাড়ুর তিরুপতির থেকে। অনেক বড় কারখানা, উৎপাদন বেশি তাই দাম কম। নগদ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। বিক্রিবাট্টা কম বলে মহাজনরা ধার দিতে চায় না। পণ্যের সঞ্চলন হলেও, টাকা ফেরত পেতে দেরি হয়ে যায়।
রীতা পাল সোদপুর থেকে আসেন। পাইকারদের থেকে কিনে ছোট মেয়েদের টেপ, ফ্রক খুচরো বিক্রি করেন। বললেন, “বেশিরভাগ খদ্দের এসে খানিক নাড়াচাড়া করে তারপর, ‘অনলাইনে সস্তা’ বলে মাল রেখে চলে যায়। একে তো ঠিকঠাক বসার জায়গা পাওয়া যায় না। এমন জায়গায় বসি লোকের চোখে কম পড়ে। তারপর যে ক’জন বা দেখে, তাদেরও বেশির ভাগ কেনে না। পাইকারের দাম বাদ দিয়ে আজ দেড়শো টাকার বিক্রি হয়েছে। এভাবে কতদিন চালাতে পারব কে জানে!” এভাবেই এইসব ছোট মহিলা ব্যবসায়ীরা বাধ্য হবেন একদিন ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যেতে।
এখন হাটের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। লকডাউনের পরে অনেক মানুষের কাজ চলে যাওয়ায় অল্প পুঁজি সম্বল করে স্থানীয় এলাকায় বিক্রি শুরু করেছেন। কেউ কেউ এখান থেকে পাইকারি কিনে নিজের এলাকায় বিক্রি করছেন। ফলে আগে বারুইপুর, দুর্গানগর এমনকি নদীয়া, মুর্শিদাবাদ থেকে মানুষ কিনতে আসতেন, এখন দূর থেকে খুব কম মানুষই আসেন। “তাছাড়া চাষের অবস্থা ভাল নয়, “তাছাড়া চাষের অবস্থা ভাল নয়, মানুষের হাতে টাকা নেই, কিনবে কি করে,” রতনবাবুর পাশে গামছা, লুঙ্গি নিয়ে বসা নিতাই বাবু যোগ করলেন।
বিভিন্ন কর্পোরেট স্টার্টআপ কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম দামে অনলাইনে জিনিষপত্র বিক্রি করছে। একটা মাত্র মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ঘটছে ক্রেতা-বিক্রেতার সংযোগ। পুঁজির সঙ্গে শ্রমের সংযোগ। এই সংযোগ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অবশ্যই পুঁজির শাসনে।
সব হাটেরই অবস্থা সঙ্গীন। মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগর দীপক ভার্মা বসেন হাওড়ার সমবায়িকা হাটে। রেডিমেড পোশাক, হোসিয়ারি জিনিষের দোকান। তাঁরও একই বক্তব্য, হাটের অবস্থা খুব খারাপ। লকডাউনের পর থেকেই একদম খরিদ্দার নেই। “নিজেরা বাড়িতে কাটিং করি। বানাই। মজবুত সেলাই দিই। তবু বাজার নেই।”
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ব্যানার্জীহাটে দাঁ, করাত, ডালের কাঁটা, জাঁতি নিয়ে বসেন বৃহস্পতি কর্মকার। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে। বছর পাঁচেক হল। বাড়িতে একটা ছোট কারখানা আছে, যেখান এগুলো তৈরি হয়। এই হাটে বসেন বৃহস্পতিবার, রবিবার। শনিবার বসেন আমতলার হাটে। তাঁরও বিক্রি ভীষণ ভাবে কমে গেছে। বললেন, “তবুও আসি, আমরা কর্মকার, এসব বানানোই আমাদের ধর্ম। নাহলে লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হবে। তাতে তো সম্মান নেই।ছেলে মেয়ে দু্টো পড়ে। যতদিন পারি চালাব।”
দীর্ঘদিন ছোট ব্যবসায়ীদের সাথে কাজ করছেন মুরাদ হোসেন। হাটের অবস্থা কেমন জানতে গেছিলাম তাঁদের অফিসে। বললেন, “কর্পোরেট পুঁজির ধাক্কায় কতদিন বেঁচে থাকতে পারে এই সব হাট, সেটাই দেখার। হুড়মুড়িয়ে পুঁজি ঢূকে পড়ছে সব ক্ষেত্রে। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের ছেলে মেয়েরা টিকবে কী করে!” পাশ থেকে আরেক জন বললেন, ‘সিরাজউদ্দোল্লা ক্লাইভের গল্পটা জানেন তো। ক্লাইভ বলেছিলেন শুল্ক ছাড়া ব্যাবসা করবেন, সিরাজ রাজি হননি। তাতেই যুদ্ধ। আমাদেরও একটা কিছু করতেই হবে। এখন তো একটাই এজেন্ডা, হিন্দু মুসলিম গিলিয়ে বড় পুঁজির ব্যবসার পথ সুগম করা”।
ফেরার পথে ভাবছিলাম একদম ঠিক বলেছেন ওঁরা। অধ্যাপক শুভেন্দু দাশগুপ্ত আমাদের মতো মানুষদের মনোবল জুগিয়েছেন। শিখিয়েছেন এই হাটগুলো কিভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বলেছেন এই ছোট পুঁজির বাজার রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার কথা।