বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

চটশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা

চটশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা

অশোক ঘোষ

photo

কয়েকদিন আগে রাজ্যের চটশিল্পের মালিকদের সংগঠন আইজেএমএ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের কাছে দাবিপত্র পেশ করে। তাদের মূল দাবি, বিপন্ন পাটশিল্প বাঁচাতে সরকারের সাহায্য প্রয়োজন। আইজেএমএ-এর বক্তব্য হলো: বাজারে কাঁচা পাটের অভাব ও দাম বেশি, আর শ্রমিকদের বাসস্থানগুলিতে করোনা সংক্রমণের কারণে শ্রমিকের অনুপস্থিতি। এর জন্য ধাক্কা খাচ্ছে বস্তা উৎপাদন। সম্প্রতি কাঁচা পাটের সমস্যার ফলে সাসপেনশন অফ ওয়ার্ডের নোটিশ পড়েছে বজবজ জুটমিলে। সাময়িকভাবে কাজ হারিয়েছেন পাঁচ হাজার শ্রমিক। তারপরে আরও ছয়টি মিলে সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক হয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহের বক্তব্য: পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রধান শিল্প হয়েও চটশিল্প দীর্ঘকাল উপেক্ষিত ও অস্বচ্ছতায় পূর্ণ। কাঁচা পাটের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি হয়েছে, আর এই কৃত্রিম অভাবের কারণেই পাটের মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু চটকল মালিকেরা নিয়মিত বাংলাদেশের থেকে পাট কিনে থাকে। কত বেল পাট কেনা হয়েছে সেই তথ্য সাধারণত প্রকাশ্যে আসে না। চটকলগুলিতে পুরাতন পাট মজুত থাকে। কিন্তু শিল্পের বাৎসরিক প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন কতটা কম হয়েছে সেই হিসাবও কখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
যদিও এই বছর করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা পরিস্থিতি জটিল করেছে। গত বছরে আমফান ঘূর্ণিঝড়ের ও লকডাউন পরিস্থিতির কারণে রাজ্যে কাঁচা পাটের উৎপাদন কম হয়েছে আর এ সম্পর্কে কোনও তথ্য রাজ্য সরকারের কাছে নেই। মালিকপক্ষের বক্তব্য এই অবস্থা চলতে থাকলে বস্তার উৎপাদনে ঘাটতি হবে। নির্বাচনের পরে এক তৃতীয়াংশ চটকল বন্ধ হতে পারে। অর্থাৎ কমপক্ষে কুড়িটি চটকল সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের মুখে পড়বে। প্রশ্ন উঠেছে পাটের যোগান কম হলেও, কারখানা বন্ধ করার মত অবস্থা ঘটেছে কি?
সত্যিই যদি কুড়িটি চটকল বন্ধের মুখে পড়ে তাহলে প্রায় একলক্ষ কর্মচারী সাময়িকভাবে কাজ হারাবেন। তাহলে রাজ্যের অর্থনীতি ও বাংলার সমাজ জীবনে এক ভয়ঙ্কর সঙ্কট সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় চটের বস্তার অভাব তীব্র হবে। আইজেএমএ কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন চটকলগুলির আধুনিকীকরণের জন্য দ্রুত ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করতে। যদিও বিভিন্ন সময় চটকলগুলির আধুনিকীকরণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কয়েকটি চটকল ছাড়া অধিকাংশই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ দেখায় নি। প্রায় সব চটকলেই পুরানো মেশিন ও পুরানো উৎপাদন পদ্ধতি চালিয়ে যাচ্ছে।
মাঝেমধ্যেই রাজ্যের চটকলগুলিতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অঘটন ঘটে। খুন-জখম পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত এই ঘটনাবলী ‘আইন শৃঙ্খলার অবনতি’ বলেই প্রশাসন দেখতে অভ্যস্ত। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ করে থাকে। কিন্তু প্রত্যেক ঘটনার পেছনে যে ‘আর্থ সামাজিক কারণ’ থাকে সেসব খুঁজে দেখা হয় না। সংবাদ মাধ্যমও শ্রমিকদের অভিযুক্ত করে থাকে। কিন্তু চটশিল্পের অভ্যন্তরীণ সমস্যার গভীরে ঢুকে বিচার ও বিশ্লেষণ হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে শুধু নয়, একসময় ভারতের অর্থনীতিতে চা, পাট, ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেক্সটাইলস শিল্পের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। এই চারটি শিল্প ছিল শ্রম নিবিড়। ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেক্সটাইলস শিল্পে আগের গুরুত্ব আর নেই। কিন্তু এখনও চা ও চটকল রাজ্যের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যক্ষ- পরোক্ষভাবে কমপক্ষে দশ লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা দিয়ে যাচ্ছে এই
শিল্প। চটশিল্পের সঙ্গে যেমন আড়াই লক্ষ শ্রমিক যুক্ত তেমন ৪০ লক্ষ পাটচাষি যুক্ত। এই শিল্পের গুরুত্ব বাংলার সমাজ জীবনে অপরিসীম। তাই সমস্যার গভীরে প্রবেশ করেই চটশিল্প সম্পর্কিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
গত বছর ভার্চুয়াল ভাষণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্যের বণিকসভার অধিবেশন উদ্বোধন করে শিল্পপতিদের উদ্দেশ্যে চটজাত দ্রব্যের ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছিলেন। দু’ দশক আগে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি চটশিল্পের আধুনিকীকরণে আগ্রহ দেখিয়ে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। সেই টাকায় আধুনিকীকরণ কতটুকু হয়েছে সে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু রাজীব গান্ধির পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মৌখিকভাবে চটশিল্পের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকৃত সহযোগিতা পাওয়া গেলে রাজ্যের চটশিল্প ও পাটচাষ লাভবান হবে। প্রধানমন্ত্রীর আরও পরামর্শ, যেসব জেলায় পাটচাষ হয় সেখানে জেলা ভিত্তিক পাটশিল্পগুচ্ছ গড়ে উঠুক। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে হয়ত রাজনীতি আছে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে চটশিল্পের সমস্যা ও প্রকৃত সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যাক।
সোনালি তন্তু বা গোল্ডেন রেয়ন-এর খ্যাতি বিশ্বের সর্বত্র। চলতি কথায় যাকে পাট বলা হয়। পাটের আঁশ ধুয়ে মুছে পরিস্কার হওয়ার পর কাঁচা সোনার বর্ণ ধারণ করে। সেকারণেই পাটের আর এক নাম সোনালি তন্তু। পাঠজাত প্রতিটি পণ্যই পরিবেশ বান্ধব, বিশ্বের সর্বত্র রয়েছে পাটের কদর। পাঠজাত পণ্যের চাহিদা বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকার পাট ও পাঠজাত পণ্যের বহুমুখী উৎপাদনের প্রয়োজনে গবেষণায় গুরুত্ব দিলে সমগ্র দেশ উপকৃত হতো।
গঙ্গার দু’ধার ধরে বজবজ থেকে কলকাতা, হাওড়া,হুগলি ও নদিয়া পর্যন্ত মাইলের পর মাইল চটকল। ১৮৫৪-৫৫ সালে প্রথম যে চটকল তৈরি হয় তার নাম ছিল রিষড়া স্পিনিং মিল, পরে নাম পরিবর্তন করে হয় ওয়েলিংডন জুট মিল। ১৮৭০ সালে তৈরি হয় প্রথম কম্পোজিট মিল বরাহনগর জুট মিল।
সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পর ভারতে পাকাপাকি ইংরেজ শাসন চালু হলে ভারতে রেল পরিবহন চালু হয়। বাংলায় বহু বস্ত্রকল ও চটকল গড়ে ওঠে।
তখন থেকেই বাংলাদেশে পাট চাষে গুরুত্ব বাড়ে। উনিশ শতক ধরেই গড়ে ওঠে শ্রমনিবিড় শিল্পসমূহ। গত ১৭০ বছরে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার বহু ভাঙ্গা গড়া সত্ত্বেও চটশিল্পের গুরুত্ব কমেনি, বরং চটজাত পণ্যের দুনিয়াজুড়ে ব্যবহার বেড়েছে। শুধু পশ্চিমবাংলায় ২.৫ লক্ষ শ্রমিক চটশিল্পে প্রত্যক্ষ কর্মসূত্রে জীবিকা নির্বাহ করে তাই নয়, এখনও নতুন কর্ম সংস্থানের সুযোগ রয়েছে।
সরকারের জ্ঞাতসারেই পাট শিল্পে এক অদ্ভূতুড়ে শ্রমিক নিয়োগ করে সামান্য মজুরি দিয়ে চূড়ান্ত শোষণ চলে। যেমন বাধ্য হয়ে ভিআরএস নেওয়া, শ্রমিকরা বকেয়া টাকা না পেয়ে জিরো নম্বরে পুনর্বহাল হয়ে অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোথাও কোনও রেজিস্টারে এরা তালিকাভুক্ত নন। এরা সকলেই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের বাইরে। আর আছে স্পেশাল বদলী শ্রমিক। এদের অনেকে কাজের বোঝার চাপ কমাতে ম্যানেজারের জ্ঞাতসারেই ভাগী বা ভাগাওয়ালা মজুর নিয়ে এসে নিজের মজুরির ভাগ দেন। এছাড়া আছে কম মজুরিতে নিযুক্ত ভাউচার, ট্রেনী এবং ঠিকা মজুর। কয়েক দশক ধরেই এই মাৎস্যন্যায় চলছে। এর ফলে শ্রমিক কর্মচারীদের সীমাহীন বঞ্চনা সত্ত্বেও কোনও সুস্থ শ্রম সম্পর্ক নির্মাণ করতে ব্যর্থ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শ্রম নিবিড় শিল্প, যার সঙ্গে ৪০ লক্ষ পাট চাষির জীবন ও জীবিকা যুক্ত। স্থায়ী, অস্থায়ী, চুক্তিবদ্ধ, জিরো নাম্বার, ভাগাওয়ালা সব মিলিয়ে প্রায় ২.৫ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারী কাজ করেন। চটশিল্পে নেই ন্যূনতম বেতন, নেই নির্দ্দিষ্ট বেতন কাঠামো। অতি দক্ষ স্থায়ী শ্রমিকের বেতন দৈনিক ৫৩৭ টাকা। অদক্ষ শ্রমিকের বেতন ৩৭০ টাকা থেকে শুরু, আধাদক্ষ, দক্ষ শ্রমিকদের বেতন দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে।
এখন প্রতিটি চটকলে কমপক্ষে ১০-১১ ঘন্টা কাজ করতে হয়। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে অনেক শ্রমিকই মাসে ২৬ দিন কাজ করতে পারে না। মাসের শেষে হাতে টাকা
কম পায়, সংসার প্রতিপালনে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আর আধাদক্ষ দক্ষ,অতিদক্ষ শ্রমিকদের সম্প্রতি কোনও বেতন বৃদ্ধি হয়নি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য পশ্চিমবঙ্গের শিল্প শ্রমিকদের বেতন তুলনামূলকভাবে কম। শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়টা সরকারের বিবেচনায় নেই।
পশ্চিমবঙ্গে ছোট-বড় মিলিয়ে সরকারি হিসাবে চটকলের সংখ্যা ৭৭টি, কিন্তু কম্পোজিট চটকল ৫৯টি, তারমধ্যে কয়েকটি বন্ধ আছে। কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত ৫টি চটকল
আছে, কিন্তু সেগুলি বন্ধ। চটকলগুলির মধ্যে গোটা ২৪ বাদ দিলে প্রায় কোনও চটকলেই নির্দ্দিষ্ট মালিকানা নেই। আছে লিজ নেওয়া ইজারাদার, কোর্টের মাধ্যমে দখলদারি নেওয়া, লাইসেন্সি ইত্যাদি। যারা আদৌ শিল্পপতি নয়, শিল্পের সাথে যাদের সম্পর্ক কম, যাদের লক্ষ্য কম খরচে বেশি লাভ নিশ্চিত করা। বরং পুঁজি বিনিয়োগ না করে এরা চটকলের সম্পত্তি ‘ড্রেন আউট’ করে চলেছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে এদের সম্পর্কের কারণেই দেখা যায় এরা আইন উপেক্ষা করলেও সরকার নির্বিকার থাকে। এই তথ্যগুলি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহেরও অজানা নয়। কিন্ত এই অব্যবস্থা মেনে নেওয়াটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
অনেক সময় মালিকরা শ্রমিক কর্মচারীদের পাওনা মেটাতে অসমর্থ হলে কোর্টের আদেশে কাঁচাপাটের আড়তদার ও মিলের পাওনাদারদের হাতে মিলের লীজ দিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে মিলের লাইসেন্সী, সাব লাইসেন্সী, লীজ, সাবলীজের মাধ্যমে কে কখন মালিক হচ্ছেন বোঝা কঠিন। শ্রমবিরোধের ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বাঁধনে মালিকদের পক্ষে আইজেএমএ থাকলেও পাঁচমিশেলী মালিকানা থাকায় গোলমেলে মালিকরা চুক্তির আওতা থেকে পালিয়ে যায়।
আধুনিকীকরণ হয়নি এই ইজারাদার ও লাইসেন্সিদের অনীহায়। ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর চটকল আধুনিকীকরণের জন্য দেওয়া ৪০০ কোটি টাকা হয় খরচ হয়নি, নতুবা হিসাব নেই।
চটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সকলেই জানেন যে, কালো টাকার এক মাফিয়া অর্থনীতি সামান্তরালভাবে চলছে। সরকার কখনও কখনও সদর্থক পদক্ষেপ করতে চাইলেও এই মাফিয়া চক্র স্বচ্ছ ও সার্বিক নীতি নির্ধারণে বাধা দিয়ে এসেছে।
চটশিল্পে গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে এক অস্থিরতা কাজ করছে। শিল্পের অভ্যন্তরে চলছে অব্যবস্থা। প্রায় দু'দশকের কিছু আগে বরাহনগর জুট মিলের লেবার অফিসারের নিজস্ব রিভলবারের গুলিতে একজন শ্রমিক নিহত হলে, ক্ষিপ্ত শ্রমিকেরা লেবার অফিসার ও চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারকে খুন করে। সেই সময় তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার স্বরাষ্ট্রসচিব সৌরীন রায়কে দিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। তখন থেকে পরের এক দশকেরও বেশি সময় একাধিক জুটমিলে শ্রমিকদের সঙ্গে কারখানার কর্তৃপক্ষের সংঘাত ঘটে। বিভিন্ন জুটমিলে খুন জখমও হয়।
রাজ্য সরকার মুখ্যত সেই কারণেই স্বরাষ্ট্র সচিবকে দিয়ে কমিশন গঠন করে ছিলেন।
কমিশন শুধু আইন শৃঙ্খলার সমস্যার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। কমিশনের প্রতিবেদনে শ্রমিকদের প্রতি বঞ্চনার বিষয়সমূহ লিপিবদ্ধকরে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশ প্রকাশের পরে প্রায় দু’ দশক কেটে গিয়েছে, সরকারের পরিবর্তনও হয়েছে। কিন্তু কোনও সরকারই সুপারিশ অনুসারে বিশেষ কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
স্বরাষ্ট্র সচিবের রিপোর্ট পাওয়ার পরেই তদানীন্তন সরকার আরও একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিতে ছিলেন শ্রমসচিব, শ্রম কমিশনার, প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনার, ইএসআই ডাইরেকটর প্রমুখ, যারা জুটমিলগুলিতে গিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখবেন পরিস্থিতি, শ্রমিকদের বক্তব্য শুনবেন ও বকেয়া আদায়ে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এই কমিটি সাত আটটি জুটমিল পরিদর্শনে যায়। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে এই কমিটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সৌরীন রায় কমিটি সেই সময় (প্রায় ২০ বছর আগে) জানিয়েছিল যে, জুটমিলগুলিতে কুড়ি হাজার শ্রমিকের গ্রাচ্যুইটি বাকি আছে আর সেই বকেয়া অর্থের পরিমাণ তখন ছিল ৬০০ কোটি টাকা। সেই সময় রাজ্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অবশ্যই বকেয়া টাকার পরিমাণ কমতো।
আর আজ জুটমিলগুলিতে কমপক্ষে ৫০-৬০ হাজার শ্রমিকের গ্রাচ্যুইটি বাকি, টাকার অঙ্কে ১০০০ কোটি টাকার বেশিই হবে। সব জুটমিলেই চালু নিয়ম হচ্ছে অবসর গ্রহণের পরে যতদিন পর্যন্ত গ্রাচ্যুইটির টাকা পরিশোধ না হবে ততদিন সেই শ্রমিক কারখানায় কাজ করতে থাকবে। এভাবেই বহু শ্রমিক গ্রাচ্যুইটি না পেয়ে কাজ করতে করতে মারা গিয়েছেন। মৃত শ্রমিকের পরিবারবর্গ পর্যন্ত টাকা পায়নি। চটকলগুলিতে সম্পূর্ণ গ্রাচ্যুইটি পেয়েছেন এমন শ্রমিকের সংখ্যা কম।
গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় চটশিল্পে কোনও উল্লেখযোগ্য আধুনিকীকরণের চেষ্টা ও পুঁজি বিনিয়োগ কোনওটাই হয়নি।পুরানো আমলের মেশিন, ভাঙ্গা লুম আর জোড়াতালি দিয়ে উৎপাদন চলছে। পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চটশিল্পে মালিকানার হাত বদল এবং লোকসানের গল্প, কারখানা বন্ধের হুমকি। স্বাভাবিকভাবেই কারখানা বন্ধের আশঙ্কা শ্রমিকদের বিপর্যস্ত করে তোলে। জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে আন্দোলনে শ্রমিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যায়। তাছাড়া কয়েকটা জুটমিল মাঝে মধ্যে বন্ধ করেও রাখা হয়।
চট থেকে বহু আকর্ষণীয় মনোমুগ্ধকর ব্যবহার্য দ্রব্য হতে পারে। কিন্তু সেই বহুমুখী উৎপাদন এখন চটকলে হয় না।
এখন চটকলগুলির উৎপাদন সম্পূর্ণ নির্ভর করে চটের ব্যাগের সরকারি অর্ডারের উপর। খাদ্যদ্রব্য প্যাকেজিং-এর জন্য প্রয়োজন চটের বস্তা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশও তাই। চটশিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো সিন্থেটিক লবি। তারা সরকারকে প্রভাবিত করে সিন্থেটিক ব্যাগ ব্যবহারের অনুমতি দিতে। আর সরকার সেই অনুমতি দিয়েও দেয়। ফলে চটশিল্প সঙ্কটে পড়ে। এটা এক চক্রাকার প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
চটের বস্তার উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রবি মরসুমে খাদ্যশস্য জন্য প্রয়োজনীয় চটের বস্তার যোগান নেই। বিপাকে পড়েছে বিহার, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র ও ওড়িশার মতো রাজ্যগুলি। এখন ঘাটতি পূরণ করতে আরও বেশি চটের বস্তার উৎপাদন প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের চটকলগুলিকে উৎপাদন বাড়িয়ে এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। জুন মাসের মধ্যে তিন লক্ষ বেল বস্তা দিতে হবে (এক বেলে ৫০০ বস্তা)। চটের বস্তার অভাবের কারণে বস্ত্র মন্ত্রক ইতিমধ্যেই ৬.৫ লক্ষ প্লাস্টিক ব্যাগ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ওপরে জুলাই মাস থেকে লাগবে খরিফ শস্য রাখার বস্তা, যা ১৭ লক্ষ বেল হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার (জেসিআই) ভূমিকা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কাঁচাপাট সংগ্রহের মূল দায়িত্ব জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার। কিন্তু এত পাট ক্রয় ও সংগ্রহের পর গুদামজাত করা এবং পাটের গুণগত মান যাচাই করার পরিকাঠামো জেসিআই-এর নেই। ফলে অধিকাংশ ছোট আর প্রান্তিক চাষি (প্রায় ৪০ লক্ষ চাষি) ফড়েদের মাধ্যমে জেসিআই-এর লাইসেন্সধারী আড়তদারদের কাছে সহায়ক মূল্যের চেয়ে কম দামে বেচে দেন। এই মজুতদাররা অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের ভ্যালু যুক্ত করে জেসিআই-এর অনুমতি সাপেক্ষে চটকল মালিকদের হাতে তুলে দেয়। এমনিতেই এতে চাষিরা লাভজনক মূল্য পাচ্ছেন না। নতুন কৃষিপণ্য বিপনন আইনের করাল গ্রাসে আরো কত চাষি পরিবার যে পথে বসবেন ও আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন কে জানে। ফলে বহু কৃষক পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
গত ১৫০ বছরে চটশিল্পে সূর্যাস্ত হয়নি। এই শিল্পের পূর্ণ সম্ভাবনা এখন খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। উৎপাদনের অব্যবহৃত ক্ষেত্রগুলি ফিরে দেখাও জরুরি। ন্যূনতম বেতন নির্ধারণে প্রয়োজন ওয়েজ বোর্ড, শ্রম আইন মেনে চলাও অত্যন্ত জরুরি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা জমা না পড়লে অবসরের পর শ্রমিকের পেনশন বন্ধ থাকে। এখন হাজার হাজার শ্রমিক পেনশন থেকে বঞ্চিত।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো শিল্প সম্পর্ক ধরে রাখা। যে শিল্পে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, যে শিল্প পণ্যের ক্রেতা দেশের সরকার, সেখানে শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক রক্ষা জরুরি। শ্রমিকেরা ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবে না সেই নিশ্চয়তা কোথায়। মনে রাখা প্রয়োজন “শ্রমিকেরা শিল্পের সম অংশীদার আর শ্রমের প্রতিটি বিষয় কার্যত সামাজিক বিষয়।”

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.