বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
বীরভূমের আদিবাসী অধ্যুসিত গ্রাম, মালিগ্রাম বা পয়ড়া উড়া-তে দু’বছর সান্ধ্য স্কুল চালানোর অভিজ্ঞতা।
এখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্তই শিশুদের দু’বছর হল পড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ছেলেমেয়েদের নাচ, গান শেখানো হয়। সাঁওতালী গান-নৃত্য ছাড়াও আধুনিক, রবীন্দ্র নৃত্য বিশেষ অনুষ্ঠানে শিশুরা পরিবেশন করে। আঁকাতেও শিশুদের উৎসাহ দেওয়া হয়। একটি অল্প বয়সী মেয়ে কারও কাছে না শিখে এত সুন্দর আঁকে যে বলার নয়। তাকে উৎসাহ দিতে একটা ইলেকট্রনিক স্লেট কিনে দিয়ে তার প্রতিভাকে সম্মান জানানো হয়। সাঁওতালীদের মধ্যে নাচ ও আঁকার প্রবণতা তাঁদের সংস্কৃতির ঐতিয্য।
প্রতিদিন প্রত্যেক শিশুকে একটা করে বাদাম-গুড়ের চাক বা চিক্কি এবং অর্ধেক করে ডিম টিফিন দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের খাবার ওদের মনের জগতকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে। যেসব খাবার ওরা দেখেনি বা স্বাদ পায়নি মাঝেমধ্যে সেসব ধরনের টিফিন দেওয়া হয়। কোনও দিন আরবের খেজুর, আবার কোনও দিন জ্যাম ও কোয়ার্টার পাউন্ডের অর্ধেক পাউরুটি দেওয়া হয়। একদিন হিমসাগর আমের সঙ্গে দু’টি করে লিচু দেওয়া হয়েছিল। শ্রীনিকেতন যাওয়ার পথে পুরন্দরপুরে ফলের দোকান থেকে আম্রপালি দু’টি আম কিনেছিলাম। দু’দশকের বেশি সময় ধরে, বীরভূমের গ্রাম থেকে বাড়ি ফেরার পথে শ্রীনিকেতনের সুরুলে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাড়িতে উঠি। এত বছরে ওই বাড়ির পরিজনেরা আমাকে পরিবারের একজন করে নিয়েছেন। ওঁনার ছোট ছেলে স্কুল শিক্ষক। দু’দশকের বেশি সময় ধরে একটা এনজিও, ‘সুরুল সুপ্রীতি সোসাইটি’ নামে চালান। নাবার্ডের মাধ্যমে মহিলাদের অনেক ধরনের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সহায়তায় আদিবাসীদের উন্নয়নের কাজে দশটি গ্রামে যুক্ত থেকেছেন। যাই হোক ওঁর মা-র জন্য দু'টি আম্রপালি আম কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওঁনাকে বলেছিলাম আমার সামনেই খেতে। খাওয়ার পর জিজ্ঞেস করেছিলাম, আম কেমন ছিল? উনি বললেন এত কম আনলে হয়। এটা শুনে আমি অরবিন্দকে ফোনে করলাম, পয়রা উরা গ্রামে যেন টিফিনে শিশুদের আম্রপালি আম খাওয়ানোর দেওয়া হয়।
অরবিন্দ এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। অরবিন্দের সঙ্গে আমি তিন দশক, ওখানকার বিভিন্ন গ্রামে সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত আছি। এত পরোপকারী ছেলে আমি দেখিনি। গ্রামের যার যখন দরকার, অরবিন্দ সব সময় দিনে কি রাতে ওদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে সততা, ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে পুরো নিরপেক্ষতা বজায় রেখে। যেমন রেশন কার্ড করে দেওয়া, জন্ম তারিখ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করা, আধার কার্ড করানো, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে সহায়তা করা ইত্যাদি। একটা বড় সমস্যা গ্রামের অপ্রাপ্ত বয়সের মেয়েদের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে। তখন ওকে ছুটতে হয় থানায়। তারপর জানা যায়, এক অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। গ্রামে এখন নৈমিত্তিক এধরনের ঘটনা ঘটছে। আগে বাবা-মায়েরা বাল্যবিবাহ দিতেন তা যে বন্ধ হয়েছে তা নয়। এরকমই দু’টি কম বয়সি ছেলে ও মেয়ে নিজেরাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অভিভাবকদের এই বিয়েতে অমত না থাকায় তাঁরা বিয়ের আয়োজন শুরু করে। গ্রামে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা অরবিন্দের একটি ব্রত। ওদের বোঝানো হয়, এক-দুই বছর পর ওদের যখন আঠারো বছর হবে, তখন বিয়ের কোনও আইনি বাধা থাকবে না। এসব কথায় কান না দিয়ে একদিন ছেলেটি মেয়েটির কপালে সিঁদুর পড়িয়ে দেয়। এ খবর জানার পর বিডিও পুলিশ নিয়ে আসে এবং বলে সিঁদুর মুছে ফেলতে। ছেলে, মেয়ে দু’জনেই সিঁদুর মুছতে নারাজ। তারা বলে আপনারা মুছে দিন। একথা শুনে আধিকারিকরা চমকে যায়। অগত্যা তাঁরা ফিরে যেতে বাধ্য হয় এবং ওরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করতে থাকে। গ্রামে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা আকছার ঘটছে। তারপর বছর না ঘুরতে বাপের বাড়ি ফিরে আসছে। আরেক ধরনের সমস্যা অনেক সময় স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানদের ছেড়ে অন্য মহিলার সঙ্গে চলে যায়। সেসময় মায়েরা সন্তান নিয়ে অরবিন্দের শরণাপন্ন হয়। তখন অরবিন্দকে বিডিও অফিসে ছুটতে হয় কুড়ি-পঁচিশ কেজি চাল জোগাড় করে দেওয়ার জন্যে। মেয়েদের আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়াটা যে কতটা জরুরি যা এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। গ্রামের মানুষের কত বিচিত্র ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় অরবিন্দকে, তা বলে বা লিখে শেষ করা যায় না।
সাজিনা গ্রামের সাঁওতাল পাড়ায় তিনটি কলেজে পড়া মেয়ে ওই গ্রামের আদিবাসীদের ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে বিনা পারিশ্রমিকে। যদিও নিজেরাই ভাল মতো কিছু জানে না। তাই সাক্ষরতার প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কীভাবে পড়াতে হয় সে বিষয়েও তারা জানে না। বিএড কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল আমাকে বলেছিলেন, শিক্ষার ওপর গবেষণার কাজ করা হয় যারা লেখাপড়ায় ভাল ফল করতে পারে না তাদের পরীক্ষার খাতা থেকে। কারণ সেখান থেকেই জানা যায় ভুলের উৎস কোথায়। সাজিনা গ্রামের সাঁওতাল পাড়ার সঙ্গে আমি তিন দশক ধরে জড়িত। ওখানে সান্ধ্য স্কুলে নিয়মিত তিরিশ জন শিশু পড়তে আসে। এখানে রোজ টিফিন দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবুও শিশুরা রোজ আসে। ওই পাড়ার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে বিকেল সাড়ে চারটায় স্কুল বসে। ওই শিশুদের মধ্যে আগ্রহ জাগাতে কোনও কোনও দিন বিশেষ খাবার দেওয়ার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। যেমন জ্যাম ও পাউরুটি দু’তিন দিন, অন্যদিন কাজু, আখরোট, কিসমিস আরও বিভিন্ন ধরনের শুকনো বাদাম মেশানো খাবার। শীতের সময় মধু ও পাউরুটি দেওয়ার ইচ্ছে আছে। সেসময় পয়ড়া উরা গ্রামের শিশুরাও বাদ পড়ে না।
পয়রা উরায় যারা পড়ানোর দায়িত্বে আছেন তাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। তাদের কোনও মাসিক বেতন বা সাম্মানিক দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই তাদের কোনও মাসে এক কেজি জ্যাম, অন্য কোনও মাসে আচার দেওয়ার হয়। এবার অর্ধেক লিটার তেল, অর্ধেক কেজি ডাল এবং অর্ধেক কেজি সয়াবিন দেওয়া হয়। যেটা গত তিন মাসের খরচের হিসাবে দেখানো হয়েছে।
যার বাড়িতে ক্লাস হয় সেই বাড়ির স্বামী-স্ত্রী উভয়ই পড়ানোর দায়িত্বে আছেন। শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল নয়। কয়েকজনকে নিয়ে কোঅপারেটিভ করে, ওঁদের রোজগার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ছোট একটা ধান ভাঙাবার মেসিন কিনে দেবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কারণ গ্রামের চাষিদের ধান ভাঙানোর জন্য ধানের বস্তা ভ্যানে করে পুরন্দরপুর নিয়ে, ধান ভাঙিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পাঁচশ টাকা খরচ। ধান ভাঙাবার মেশিন গ্রামে হলে গ্রামবাসীদের আর খরচ করে পুরন্দরপুর যেতে হবে না। তবে শর্ত রাখা হয়েছে ধীরে ধীরে সামান্য করে হলেও মেশিনের দাম পরিশোধ করতে হবে। এবারে ধান কাটার আগেই মেসিন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
'গড়িয়া সহমর্মী সোসাইটি' ইতিমধ্যেই বর্ষার আগে শ’খানেকের বেশি ছাতা আর একব্যাগ শুকনো খাবার গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। কথা দিয়েছেন ছেলেমেয়েদের পুজোর আগে জামা-কাপড় দেবেন। আর শীতকালে কম্বল দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
আদিবাসীদের জীবন চর্চায় সামান্য পরিবর্তনের জন্য কয়েকজনকে রেন কোট কিনে দেওয়া হয়েছিল। বর্ষায় ধান রোপনের সময় যাতে ভিজতে না হয়। রেন কোট পড়ে রোপনের ছবি তুলে ভদ্রমহিলা আমায় পাঠিয়েছেন। ভাবনাটা এসেছিল বৃষ্টিতে ধান রোপন করতে গিয়ে এক মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর জীবিকা বন্ধ হয়ে যায়। একজন আদিবাসী মহিলাকে, হাঁটু পর্যন্ত রেন কভার কিনে দিয়েছিলাম। যাতে বর্ষায়, দিনের পর দিন মাঠে জলে দাঁড়িয়ে ধান রোপন করতে না হয়। ফোনে মহিলা আমাকে জানিয়েছিলেন, বৃর্ষ্টি হচ্ছে তাই হালকা রেন কোট এবং জুতোর রেন কভার পড়ে মাঠে জলের মধ্যে ধান রোপন করতে খুব সুবিধে হচ্ছে। অনেকে ওঁকে জিজ্ঞেসও করেছে এ নিয়ে। সম্প্রতি এক চাষীর লাঙল দেওয়ার সময় পায়ে কি ফুটে গিয়ে সেপটিক হয়ে যায়। সে সময় তাঁর স্ত্রীকে একাই ধান রোপন করতে হওয়াতে ওঁর খুব মন খারাপ হয়ে পড়ে। তাই ওদের জন্যও জুতোর কভার কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা ভাবা হয়েছে।
সান্ধ্য স্কুলের এক আদিবাসী শিক্ষিকার বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। দু’তিনবার বিয়ে হয়েছে। স্বামীরা ওঁকে ছেড়ে দিয়ে অন্য মহিলার সঙ্গে ঘর বেঁধেছে। ওঁর কাছে কোনও সরকারি কাগজপত্র নেই। অরবিন্দের সহায়তায় আধার কার্ড, গ্রামের বাসিন্দাপত্র, প্যান কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করা সম্ভব হয়েছে। পরিবারের ভিটেতে, ভাঙাচোরা একটি মাটির ঘরে ওদের থাকতে দিয়েছে ওর পরিজনেরা। ছয় বছরের সন্তান নিয়ে উনি ওই ঘরেই থাকে। মাটির মেঝেতে শুতে হয়। বর্ষাকাল, মেঝে স্যাঁতসেঁতে। নীচে শোওয়ার জন্য সাপের কামড় খাওয়ার ভয় আছে। এছাড়াও খড়ের ছাদ দিয়ে জল পড়ে। এই অবস্থা দেখে ওদের জন্য খাট, তোষক, বালিস ও চাদর কিনে দেওয়া হয়। ছাদ দিয়ে যাতে জল না পড়ে সেজন্য দু’টি ত্রিপলের ব্যবস্থা হয়েছে। ওঁর আরেকটি মেয়ে অষ্টম শ্রেণী সম্পূর্ণ করে ভালবেসে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে গিয়েছিল। দু’বছর সংসার করার পর শ্বশুর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি ওঁর মার কাছে ফিরে এসেছে। মা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে কিছু পায় না। কিভাবে সংসার চালায় কে জানে! ওর পরিবারের জন্য মাস কিছু ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি স্কুলে ছেলেটি মিড-ডে মিল পায় এবং সান্ধ্য স্কুলে মা ও ছেলে গুড়-বাদামের চিক্কি ও অর্ধেক করে ডিম পায়। মাসে দুই কেজি চাল ও দুই-তিন কেজি আটা ওদের রেশন থেকে বরাদ্দ। এতে সারা মাসে মোটে কয়েক দিন চলে। বিপিএল লিস্টে নাম না ওঠায় রেশনে পনেরো কেজি চাল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা কবে অনুমোদিত হবে কে জানে? ওঁর বিধবা মা বেঁচে আছেন। যার এক ছেলে মারা যাবার পর স্ত্রী সন্তানদের ছেড়ে অন্য লোকের সঙ্গে চলে যায়। বিধবা ঠাকুমার কাঁধে ওই তিন সন্তানের দায়িত্ব এসে পড়ে। শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে মাসে মাসে ব্যক্তিগত ভাবে সামান্য ভাতা তাঁকেও দেওয়া হয়, ছেলেমেয়েদের পুষ্টির কথা ভেবে। আদিবাসীদের মধ্যে মদ বা হাঁড়িয়া খাওয়ার প্রবণতা বেশি। এখন এরা চোলাই খেতে অভ্যস্ত হয়েছে। সেজন্যই হয়ত আদিবাসী পুরুষরা কম বয়সে মারা যায়। অমানুষিক পরিশ্রম, পুষ্টির অভাব, স্বাস্থ্য চেতনার অভাব, নেশা এবং রোগ সম্পর্কে উদাসীনতা এদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এদের অনেকেই এখনও মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে মাঠেই প্রাতঃকৃত্য করে অভ্যস্ত। পুকুরে স্নান করার জন্য মহিলাদের ও পুরুষদের ঘাট আলাদা। এই গ্রামে বেশ কিছু পরিবার আছে খ্রিস্টান। তাঁদের মধ্যে লেখাপড়ার চল বেশি। মদ খাওয়ার প্রবণতা কম। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী স্বামী-স্ত্রী চণ্ডি ও ঠাকুরণের বাড়িতেই সান্ধ্য স্কুল বসে সন্ধে ছয়টা থেকে আটটা। আরেকজন বিধবা খ্রিস্টান ভদ্রমহিলা আছেন যিনি লেখাপড়া না জানা সত্ত্বেও খুবই বিদুষী। এত সুন্দর ভাবে উনি গুছিয়ে সমস্যাগুলি তুলে ধরেন যা অবাক হতে হয়। সমস্ত কাজে উনি যেভাবে এগিয়ে আসেন তা বলার নয়। খুব শান্ত স্বরে, মার্জিতভাবে কথা বলেন।
সুকু সোরেনের চার মেয়ে। সুকু সারাদিনই মদের নেশায় থাকত। এদিকে স্ত্রী কয়েক মাস হল সংসার ছেড়ে চলে যায়। সুকুকে বলেছিলাম, তোমার সংসারের দায়িত্ব নেব, কিন্তু তাঁকে নেশা ছাড়তে হবে। বড় মেয়েটি সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে। সুকুকে বলেছি, মেয়েকে নার্সিং ট্রেনিং-এ ভর্তি করে দেব। ইদানীং ওঁর স্ত্রী, বাড়ি ফিরে এসেছে। একদিন সুকু ও ওঁর স্ত্রী সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। দু’জনেই জানাল সুকু আর নেশা করে না। জেনে খুব ভাল লেগেচছে। ইচ্ছে আছে পয়ড়া উড়া গ্রামের কয়েকটি মেয়েকে ওখানকার একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার।
পয়ড়া উড়া গ্রাম থেকে সকালে সাজিনায় দশ-বারো মেয়ে আমার কাছে পড়তে আসে। এছাড়াও রাতে সাজিনা স্কুলের হোস্টেলের ছেলেদের পড়ানোর দায়িত্বও নিতে হয়েছে। মাসে দু’বার করে বীরভূম যেতে হয় সামাজিক বাধ্যবাধকতায়।
ওঁদের রীতি, যাদের ওরা বন্ধু বলে মনে করে সেসব অতিথিদের আদিবাসী পুরুষেরা ঢোল বাজিয়ে সঙ্গে সাঁওতালি মহিলারা সারি বেঁধে গান গাইতে গাইতে নেচে নেচে অভ্যর্থনা জানায় এবং গ্রামের বাইরে থেকে ভিতরে নিয়ে আসে।
ওঁদের প্রধান উৎসব ‘বাদনা’। কার্তিক মাসের ধান কাটার পর এই উৎসবে ওরা নাচে গানে মেতে ওঠে। যেমন বীরভূমের ‘লবান’ উৎসব। নবান্নের সময় গ্রামে গ্রামে পালিত হয়। সাঁওতালদের অন্ অর্থাৎ অন্নের দেবতা ‘মাড়াং বুরু’। বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ওঁদের ভাষায় কথা বলার। সে আশা আর এ জীবনে পূরণ হবার নয়। আদিবাসীদের গ্রামে সাঁওতালদের সঙ্গে সামাজিক কাজকর্মের যুক্ত হয়ে উপলব্ধি হয়েছে, আন্তরিকভাবে যদি ওঁদের পাশে দাঁড়ানো যায় তাহলে ভাষা বা পোশাক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না।