বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

অতিমারি এবং শিক্ষাসঙ্কট

অতিমারি এবং শিক্ষাসঙ্কট

অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১— কি রে স্কুল যাবি না?… কথাটা শুনে ছেলেটি বাবার দিকে তাকালো। সে সবে প্রাইভেট টিউশন পড়ে বেরিয়েছে, বাবা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুয়ারে, এখনই আবার আরেক জায়গায় পড়া আছে। অতএব কারোর সঙ্গে কথা বলার সময় নাই, তড়িঘড়ি বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে উত্তর পাওয়া গেল- না না যা করোনা, কার কী ইনফেকশন আছে, রিস্ক নেওয়া যাবে না…।
কিংবা
আফসাররা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে... শেফালী, মমতাজ, তৌসিফ, আনন্দ। পিন্টু স্যারের পড়া। সপ্তাহে চার দিন। আফসাররা সেভেনে পড়ে। সেই ফাইভে থাকতে স্কুলে গিয়েছিল, তারপর আর যায়নি। বাবা বলেছে, নাইনে উঠলেই আবাসিকে দেবে। তবে কি আর স্কুল যাওয়া হবে না? স্কুল গেলে খুব মজা হয়। আফসার আব্বাকে জিজ্ঞাসা করেছিল স্কুল কবে খুলবে, আব্বা বলেছিল- “গাধা”।
মেঘলাল ইলেভেনে উঠেছে। কালকেই ইংরেজি পড়তে গিয়ে হাবিব স্যারকে বলেছিল স্কুল যাওয়ার কথাটা। শুনে স্যার বকা দিলেন, হতভাগা আর স্কুল গিয়ে কী করবি? মেঘলালও তাই ভাবে, কি হবে... বন্ধুরাও ঘাড় নাড়ে। আজ দুপুরেই বাংলা স্যারের পড়া...
ইয়াসিন আলির মেয়েকে নিয়ে বড়ো আশা ছিল। পড়বে, চাকরি করবে। তিনি মেয়েকে স্বপ্ন দেখান, বড় হওয়ার স্বপ্ন। এখন স্কুল বন্ধ। মেয়ে বাড়িতেই থাকে, প্রাইভেটে যায়। পেছন পাড়ার মহবুল মেয়েটাকে ষোলো বছরেই বিয়ে দিয়ে দিল, পাত্রের ভাল রোজগার। ইয়াসিন তা করবেন না। তিনি সময় হাতড়ান। দিদিমনিকে জিজ্ঞাসা করেন, কোনও উত্তর পান না, দিদিমনিও উত্তর খোঁজেন। মেয়েটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায়, ইয়াসিন আলি জেগে থাকেন।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরতে বাসে উঠতেই শিক্ষক দেখলেন, ওরা দল বেঁধে কাজে যাচ্ছে। কোথায়, জিজ্ঞাসা করতেই জানালো, সেকেন্দ্রাবাদ। টাওয়ারের কাজ। জনা চারেক ছাত্রকেও দেখতে পেলেন। বাবা দাদার সঙ্গে ওরাও যাচ্ছে, গত বছর লকডাউনের পর থেকেই। দাদন খাটতে। স্কুল? জিজ্ঞাসা করতেই হাবেভাবে বোঝালো ওরা আর পড়বে না। মাস্টারের মন ভারী হয়ে এলো।
বাদল তার খাবারের গাড়িটাকে ঠেলতে ঠেলতে স্কুলের সামনে এনে লাগাল। অবশেষে স্কুল খুলেছে দিনকতক হল। বেচাকেনাও শুরু হয়েছে। এই পনেরো ষোল মাস বাদলের খুব কষ্টে কেটেছে। বাবুদের কাজকারবার সে বোঝে না। এই খোলে তো এই বন্ধ!তাদের পেটে লাথি মেরে কার যে কি লাভ হয়! সে বিড়িটা ধরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো…
দীর্ঘ বিশ মাস পরে স্কুলে আবার পঠনপাঠন শুরু হলে এইসব টুকরো টুকরো ছবি পাওয়া গেল। এই দীর্ঘ অবসরে স্কুলগুলি আংশিকভাবে খোলার পরে যে বাস্তবতার সম্মুখিন হতে হচ্ছে, তাতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যাচ্ছিল না। বিশেষ করে, সরকার পরিচালিত বিভিন্ন স্কুলে, গ্রামেগঞ্জে বা শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের অনুপস্থিতি সাধারণের শিক্ষা বিপন্ন করেছে। শুধু পড়াশোনার ধারাবাহিকতা নয়, ছাত্রছাত্রীদের মানসিক, শারীরিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ, পুষ্টি এবং সামাজিকতা শিক্ষার নজরদারির যে নিরবিচ্ছিন্নতা বজায় ছিল তাতে বড় ধরনের ছেদ পড়েছে। দেখা গেল, সারা দেশে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললেও থেমেছিল শুধু শিক্ষার চাকা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নগর-বন্দর, হাট-বাজার, অর্থনীতি রাজনীতি জোরকদমে চললেও শিক্ষা কেন চলতে পারেনি তা বোঝা খুব একটা সহজ নয়। ফলে ঘর-বন্দী অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে কঠিন সময় পার করেছে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন গোষ্ঠী করোনাকালে আরও পিছিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে।
চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী শৈশব, কৈশোর, স্কুলবিহীন, বন্ধুবিচ্ছিন্ন সমস্ত রকম সামাজিকতা থেকে দূরে একটা নিয়ন্ত্রিত যাপন ছাত্রছাত্রীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তুলেছে, শিশুদের সামাজিক আবেগগত শিক্ষা (সোশিয়ো ইমোশনাল লার্নিং) ব্যাহত হয়েছে, শারীরিক দূরত্ব সামাজিক দূরত্ব রচনা করেছে। এর বিকল্প হিসাবে অনলাইনে শিক্ষা বলে এক নয়া ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করছেন বটে রাষ্ট্রনেতারা, যা কথিত হয়েছে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতেও (২০১৯) আরো ব্যাপকরূপে। মোবাইল ব্যবহার বাড়লেও বিপরীত চিত্র উঠে আসে ডিজিটাল বা ই-লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে এই রাজ্যে। ২০২১-এ কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারও মোবাইল ফোন, ভয়েস কল, টিভি চ্যানেল ও অনলাইন শিক্ষার নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পড়াশোনা চালানোর চেষ্টা করেছে, দেরিতে হলেও দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের ট্যাব কেনার পয়সা দেওয়া হল। যদিও সেই টাকা অভাবের সংসারে কিসে খরচ হল, তার খোঁজ নেই। সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমীক্ষা দেখিয়েছে, ডিজিটাল-লার্নিং ব্যবস্থায় বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর কোনও যোগাযোগ নাই। এবং প্রায় ৯০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর ই-লারনিংয়ের দ্বারা মুল্যায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্য অফলাইনে অ্যাসেসমেন্ট টেস্টের মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। সেটার শিখন অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্যরকম, অন্য অবসরে আলোচনা করা যাবে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ৬০ শতাংশের উপর ছাত্রছাত্রী অনলাইনে ক্লাস করতে আগ্রহী হচ্ছে না (আনন্দবাজার পত্রিকা)। শহর বা গ্রামীণ ভারতের প্রান্তিক পরিবারগুলো ছেলেমেয়েদের কাছে মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ বা পরিকাঠামো তৈরি করা যায়নি। প্রান্তিক পরিবারের একটি বাড়িতে একটি স্মার্ট ফোন থাকলেও বাড়ির রোজগেরে মানুষটিকে কাজে বেরোতে হচ্ছে - তিনি তাঁর সন্তানের সঙ্গে একটি স্মার্টফোন কীভাবে ভাগাভাগি করে নেবেন, এসবই এক জ্বলন্ত সমস্যা। বেসরকারি স্কুলগুলি (বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যমের), কিংবা প্রথম সারির কিছু বাংলা মাধ্যমের নামজাদা স্কুলে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সাধারণ সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিস্তর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থানগত বা পরিচালনগত সুবিধায় (অবশ্যই উচ্চমূল্যের বিনিময়ে) এই বৈষম্যের সৃষ্টি। শিক্ষার এই বাজারও কম বড় নয়, বছরে প্রায় কয়েক হাজার কোটির উপর। এর হাত ধরেই রমরমা বাইজু, আকাশ, টিউটোপিয়া বা অন্যান্য অসংখ্য বেসরকারি লার্নিং অ্যাপের। দরিদ্র অংশের ছাত্রছাত্রীরা এর ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারে না। অতিমারিকালে প্রায় বিশ মাস বিদ্যালয়-মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠন বন্ধ থাকলেও অনলাইনে লেখাপড়ার সুযোগ তাদের অর্ধেকেও পায়নি। ছাত্রছাত্রীরা ডিজিটালি ডিভাইডেড। মালদার মত প্রান্তিক, ভাঙ্গন অধ্যুষিত জেলায় এই বাস্তবতা আরও প্রকট। দেখা যাচ্ছে অনলাইনে পড়াশোনা বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যাও তৈরি করেছে। অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে মোবাইল ব্যবহারে আসক্তি... নানা ধরনের ফ্রি-ফায়ার, পাবজির মতো ভয়ঙ্কর মোবাইল গেমগুলো, ফেসবুক এবং হোয়াটস-অ্যাপের মত সামাজিক মাধ্যম, এমনকি নানারকম যৌনগন্ধী নিরন্তর ভিডিও, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। পাশাপাশি, জনসংখ্যার গরীব অংশের পরিবারে সঙ্কট আরো ভয়াবহ... একদিকে পড়ালেখায় না থাকা, অন্যদিকে পারিবারিক টানাপোড়েনে বহু শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে শিক্ষা থেকে। বেড়েছে স্কুলছুট, বেড়েছে শিশুশ্রম। পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে বহু ছাত্র (বা ছাত্রীরাও) কাজ করতে চলে গিয়েছে অন্য রাজ্যে, যুক্ত হয়ে পড়েছে পারিবারিক কাজে, ব্যাপকভাবে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। শিশুরা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হচ্ছে অনেক বেশি। মিড ডে মিলের মাধ্যমে বাড়ন্ত বয়সের ছাত্রছাত্রীদের যে পুষ্টির ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চলছিল তা এইসময় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এখনও প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণীর জন্য স্কুল বন্ধ। বন্ধ তাদের পুষ্টিসাধনের ব্যবস্থা। সবমিলিয়ে ক্রমাগত বেড়েছে শিক্ষায় অসাম্য। অবশ্য ভেবে দেখলে প্যাটার্নটা একই – যেভাবে করোনাকালে ধনী অতিধনী হয়েছে, উপরের দশ শতাংশের আয় বেড়েছে বহুগুণ, ধান্দাপুঁজি লাভবান হয়েছেস... অথচ পিরামিডের নীচের অংশে থাকা সাধারণ নাগরিক রুজিরুটিr সঙ্কটে পড়েছে। তেমনি বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়েছে, সঙ্কটে পড়েছে সাধারণের সরকারি শিক্ষা।
ইতিমধ্যেই করোনার প্রভাব কমে এসেছে। অন্যান্য রাজ্যে আগেই স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছিল। টালবাহানার পরে এই রাজ্যেও স্কুল খুলছে। গ্রামেগঞ্জের অনেক অভিভাবক, এমনকি শহরাঞ্চলের এক অংশের পড়ুয়া এবং অভিভাবকদের একটা বড় অংশও চাইছিলেন তার সন্তান স্কুলে যাক। স্কুলে যেতে পারাটা যে পড়াশুনো বা অন্যান্য বিষয়ের চর্চা করার ইচ্ছার অনুঘটক। বাড়িতে বা অনলাইন পড়াশোনায় ক্লাসরুমের মতো বুঝিয়ে দেওয়ার খামতি থেকে যাচ্ছিল৷ বেশিরভাগ বাবা-মা অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর সেখানে স্কুলে না যাওয়া বাচ্চাকে বাড়িতে পড়াশোনায় সাহায্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। একলা ঘরে বসে অবয়বহীন একটি ক্লাসরুমে অনলাইন শিক্ষা, শিক্ষক-শিক্ষিকার-শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণে শেখার বিকল্পও হতে পারে না। সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা, গল্প, খেলাধূলা ইত্যাদিও স্কুল জীবনের অঙ্গ, ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক, সামাজিক শিক্ষার মাধ্যম। এক বন্ধুবান্ধবহীন, আত্মকেন্দ্রীক জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষক-শিক্ষিকারাও নিছক পিছিয়ে পড়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের সান্নিধ্যে শিক্ষক শতফুলে বিকশিত হন। পঠনপাঠন থেকে দূরে থাকার যে মানসিক কষ্ট সেটা একনিষ্ঠ শিক্ষক মাত্রই অনুভব করেন। এই অবস্থায় যা দরকার ছিল তা হল শিক্ষক এবং অভিভাবক সংগঠনগুলির তরফ থেকে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। একটি-দুটি শিক্ষক সংগঠন ছাড়া এবং অভিভাবক সংগঠনগুলির নিষ্ক্রিয়তা স্কুল খোলার ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনাহীন এবং নীরব থাকার প্রয়াসকে মান্যতা দিয়েছে। অথচ সরকার, বা শিক্ষা নিয়ামক সংস্থা কেউই বিকল্পের সন্ধানের কার্যকরি চেষ্টাই করেননি, পুরোটাই ছেড়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট স্কুলের উপর এবং স্কুল ছেড়ে দিয়েছেন শিক্ষকদের উদ্যোগের উপর। উপর থেকে নীচে এইভাবে দায় ঝেড়ে ফেলা শিক্ষার পণ্যায়নের রাস্তা সুগম করে, করোনা সংকটে যা পরিষ্কার দেখা গেল।
অনেকদিন বাদে স্কুল খুলেছে। তার উপর এত নিয়মের বেড়াজাল তাদের মধ্যে একটা সংকোচ, কতকটা অনীহাও তৈরি করেছে। এসব স্বাভাবিক। ক্লাস শুরু হওয়ার পর ছোটখাট সমস্যাও শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন বাড়িতে থেকে একরকম জীবনযাপনে টানা ক্লাস করার অভ্যাসটি চলে যাওয়ায় ক্লান্তি আসছে, বাড়ছে স্কুলে যাওয়া বা ক্লাসে থাকার অনীহা। এই অবস্থায় শিক্ষার্থীকে পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনা একটা চ্যালেঞ্জ। এমতাবস্থায় তাদের জন্য পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক— নিয়মিত কাউন্সিলিং, কর্মশালার ব্যবস্থা, সৃজনশীল এবং বৃত্তিমূলক বিষয়গুলোর সঙ্গে অ্যাকাডেমিক পাঠের ভারসাম্য রাখা, মুক্ত আলোচনায় অংশ নেওয়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হল, সরকার পরিচালিত স্কুলগুলির বাস্তবতায় এই ব্যবস্থা করবে কে? এমনিতেই বর্তমানে রাজ্যের স্কুলগুলিতে লক্ষাধিক শিক্ষকপদ শূণ্য। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে হিসেব দিয়েছে, ভারতে ২০২১-এ ১১ লক্ষ ১৬ হাজার শিক্ষক পদ শূন্য, আর এই রাজ্যেই এক লাখ দশ হাজার। এর মধ্যে ৬৯ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলিতে৷ অর্থাৎ শিক্ষকের ঘাটতি থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রান্তিক পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা৷ তেমনই দীর্ঘদিন স্কুলভবন তালাবন্ধ থাকায় সেগুলির জরাজীর্ণ অবস্থা পঠনপাঠনের উপযুক্ত নয়। সবমিলেয়ে স্কুল খুললেও পরিস্থিতি আশানুরূপ নয়। এখনও প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুল খোলেনি। কাজেই তাদের মানসিক সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা একটা থেকেই যাচ্ছে।
মালদার একজন শিক্ষক তন্ময় দাসের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায়,“স্কুলের মাঠ আগে শত ছাত্রছাত্রীর কোলাহলে মুখর থাকত, সেই মাঠে এখন গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রী, ক্লাসগুলিতেও জনাকয়েক উপস্থিত। পড়াতে গিয়ে বোঝা গেল অনেকেরই বহুদিন পড়াশোনার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নাই…”।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে, তাতে কোনও সন্দেহ নাই। এখনও ছাত্রছাত্রীরা স্বতস্ফুর্তভাবে স্কুলে আসতে আগ্রহী নয়। এর কারণ হিসাবে শুধু অতিমারিকে দেখলে ভুল হবে। অনেকদিন থেকেই স্কুলে উপস্থিতি ক্রমহ্রাসমান। প্রাইভেট টিউশন বা কোচিং নির্ভর সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা এর অন্যতম কারণ। শহর এবং গ্রাম, উভয়ক্ষেত্রেই। এবং আজকের বাণিজ্যিক শিক্ষাব্যবস্থার এটাই প্রথম ভিত। ফলে স্কুলের প্রয়োজন ফুরাচ্ছে। এই সংকট সরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে গুরুতর। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি অবশ্য এই ব্যবস্থার সঙ্গে একটা কার্টেল তৈরি করে নিতে পেরেছে। এর সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারের ছাত্রদের বাইরে কাজ করতে যাওয়ার প্রবণতা স্কুলে উপস্থিতির হার কমিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানান সরকারি শিক্ষানীতি এই সমস্যার সমাধান করার বদলে সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তা পুঁজির ব্যবসায়িক স্বার্থেই। বাজারের প্রয়োজনে সস্তা শ্রমের যোগান দিতে। অতিমারি স্রেফ স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থার সংকটকেই আরও প্রগাঢ় করেছে।
এই অবস্থায় স্কুল খুলেছে, আংশিকভাবে হলেও। এখন অপেক্ষা, কত দ্রুত সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক পঠনপাঠনের স্রোতে ফিরিয়ে আনা যায়। ততদিন টিকে থাকার লড়াই...

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.