বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
মহাদেবদা মারা গেছেন। গতকাল সন্ধ্যার সময়। খুসখুসে কাশি আর অল্প বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে। গত পরশু বেমক্কা স্ট্রোক হয়ে গেল। আর তারপর দিন খরচের খাতায়। মহাদেবদার মৃত্যুতে তার ছত্রিশ বছরের পুরনো বৌ ছাড়া কারও শোক উথলে ওঠার কথাও না। কিন্তু ফল্গুর চোরা স্রোতের মতো গল্পটা অন্য দিকে বাঁক নেয়।
নিঃসন্তান মহাদেবদাকে ছেলে ছোকড়ার দল “মহাদেবদা” বলে ডাকতো। তখন সে বলেছিল, “এই তোরা আমাকে দাদা বলিস কেন রে! আমি তোদের বাপের থেকেও বয়সে বড়ো। জেঠু বলবি”। তারপর থেকে এই ছেলে ছোকড়াদের কাছে মহাদেবজেঠু হয়ে গেছিল। চার ফুট, ন’ইঞ্চি উচ্চতা, সারা শরীরে শ্বেতির দাগ, খয়াটে গড়নের লোকটাকে দেখলে ভক্তি, শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম কিছুই জাগবার কথা না। মাঝে মধ্যে মুফতে পেলে ঢুকু ঢুকু রঙিন পানীয় যে চলতো না তা নয় কিন্তু চা ছিল মানুষটার বাঁচবার সঞ্জীবনী সুধা। কেউ কোনওদিন শোনেনি, “মহাদেবদা চা খাবে” বললে সে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছে। মাথাতে একসময় বেশ বাবরি ধাঁচের চুল ছিল তা এখনও কাঁচাপাকা চুলের জঙ্গল দেখলে বোঝা যায়। আর একটা সাংঘাতিক নেশা ছিল মানুষটার লুডো খেলা। আগে সবসময় সঙ্গে করে লুডোর বোর্ড আর গুটি নিয়ে ঘুরতো। কাউকে পেলেই হাসিমুখে বলতো, “এক দান হয়ে যাক”। এন্ড্রয়েড ফোন নেওয়ার পর থেকে এখন মোবাইলেই খেলে। তবে একেবারে ছোট থেকে যে বিষয়টা তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল তা হল তার পরোপকারের বাতিক। হওয়া, মরা সব কাজেই তাকে ডাকার আগেই পাওয়া যেত। আর এমন অনাহুত মানুষকে না সংসার না সমাজ কেউ মূল্য দেয় না। সারা জীবন তারা শেষ বেঞ্চির ছাত্র, ছাত্রী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়।
করবীর সঙ্গে মহাদেবের আলাপ হয়েছিল সুতোরকল মিউনিসিপ্যালিটিতে ‘দুয়ারে সরকার’-এ কাজ করতে এসে। খাদ্য দপ্তরের কর্মচারী করবী। তায় একটা গাল ভারিক্কি পদ আছে অফিসে, “বড়দি”। আসলে সরকারি অফিসে প্রধান করণিকের পোশাকি নাম “বড়োবাবু” আর মহিলা হলে ঐ “বড়দি”। মিউনিসিপ্যালিটিতে দু’তিন জন ছাড়া সকলেই প্রায় করবীর থেকে বয়সে অনেক ছোটো। কেউ কেউ তো প্রায় মেয়ে বুলটির বয়সি। ঐ দু’তিন জনের মধ্যে একজন ছিল মহাদেবদা। প্রথম দিন চারদিকে মাছি ওড়াকে নিয়ে করবী একটু গজগজ করছিল, “এখানে মনে হচ্ছে কাঁঠাল ভাঙা হয়েছে”।
মহাদেবদা খুব ব্যস্ত হয়ে একে ওকে ডেকে বলে, “একটু ফিনাইল বা ব্লিচিং দে না এখানে। সত্যি খুব মাছি উড়ছে”।
কেউ যে মহাদেবদার কথা শুনছিল বা পাত্তা দিচ্ছিল তেমনটা একেবারেই না। কিন্তু বারবার ঘ্যান ঘ্যান করে যাওয়ার জন্য কে একটা এসে খানিক ফিনাইল ছড়িয়ে দিল আর বলে গেল, “তুমি না মহাদেবজেঠু জ্বালিয়ে মারলে”।
করবী ভ্রূ কুঁচকে তাকালেও মহাদেব হে হে করে হেসে দেয়।
রেশন দপ্তরের কাজ কখনও ফুরায় না। বাচ্চা জন্মালে রেশন কার্ড করতে লাগে। সেই বাচ্চা বৃদ্ধ, বৃদ্ধা হয়ে গত হলে সেই রেশন কার্ড জমা দিয়ে যেতে হয়। এছাড়াও কত নিত্য নতুন সমস্যা নিয়ে পাবলিক যে আসে। তবে করবীর মহাদেবকে ভালো লেগে যায় সেদিন, যেদিন এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসে বলেন, “আমার ছেলে জেন্ডার পরিবর্তন করে মেয়ে হয়েছে। ওর রেশন কার্ডটা তো এবার মেয়ে হিসেবে লাগবে, তাই কী করতে হবে ম্যাডাম?’’
এরকম একটা সমস্যা আগে আসেনি কখনও। তাই করবীকে ওপরওয়ালার কাছে একটু ফোনাফুনি করে সমাধান বাতলাতে হয়। কিন্তু চমকটা আসে ভদ্রলোক চলে যেতে। মহাদেবদা ওনার চিরাচরিত প্রসন্নমুখে বলেন, “দেখলেন বড়দি দিন কত বদলাচ্ছে। কী যে ভাল লাগে এগুলো দেখলে, শুনলে। জানেন তো বাবা, মা সন্তানের পাশে থাকা মানে পৃথিবীর সব শক্তির তার পাশে থাকা”।
কথাটা করবীর কান হয়ে মনে প্রবেশ করে। তাই তো একদম ঠিক বলছে মহাদেবদা। সে নিজেই কি বুলটি এরকম কিছু করলে সকলের সামনে এত অকপট হয়ে সমর্থন করতে পারতো!
এত লোকের মাঝে একা চা খাওয়াটা খুব বিড়ম্বনার। কিন্তু আজ মিউনিসিপ্যালিটি থেকে চাটুকুও দেয় নি। চায়ের নেশা করবীরও আছে। তাই আর না পেরে করবীকে কাজে সাহায্য করতে বসা পিন্টু, রক্তিম আর মহাদেবদাকে বলে, “চা খাবেন তো?’’
মহাদেবদা মাথা নেড়ে সায় দেয় - খাবে।
লোকটাকে বেশ ভালো লেগে যায় করবীর। এরা সবাই মিউনিসিপ্যালিটির ক্যাজুয়াল স্টাফ। নো ওয়ার্ক নো পে। মাস দেড়েক আগে মহাদেবদা পা ভেঙে হাসপাতালে ছিল বেশ ক’দিন। সব মিলিয়ে সেরে উঠতে মাস খানেক লেগেছে। এখনও খুঁড়িয়ে হাটে।
পিন্টু বলছিল, “তুমি একবার চেয়ারম্যানের সঙ্গে গিয়ে নিজে কথা বলো না যাতে ঐ এক মাসের মাইনে না কাটে। চলবে কী করে তোমার? জেঠিমার অসুখের পেছনেও তো কত খরচ হয়”।
মুখ নীচু হয়ে বসে ছিল মহাদেব।
করবীও বলে ওঠে, “হ্যাঁ আপনি একবার সরাসরি কথা বলুন”।
মুখ নীচু করেই মাথা নাড়ে মহাদেব।
রক্তিম একটু চারপাশ দেখে নিয়ে বলে, “আসলে বড়দি আমাদের চেয়ারম্যান খুব মুখ খিস্তি করে”।
পিন্টু বলে ওঠে, “আমাদের তো গায়েও হাত তুলে দেয় রাগ হয়ে গেলে। জেঠুর অবশ্য গায়ে হাত তুলবে না। যতই হোক সেই কবে থেকে এক সঙ্গে রাজনীতি করছে”।
করবীর মাথায় কিছু ঢুকছিল না। কিন্তু কান, মাথা যেন ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে।
“কী বলছো তোমরা! মুখ খারাপ করে, গায়ে হাত তোলে মানে?”
মহাদেব মুখ তুলে খুব করুণ হেসে বলে, “হ্যাঁ বড়দি ওরা ঠিক বলছে। সেই হাফপ্যাডেলের বয়স থেকে এক সঙ্গে রাজনীতি করেছি, আমি বোকাসোকা মানুষ তাই উঠতে পারি নি। এই মিউনিসিপ্যালিটির আজ আমি ক্যাজুয়াল লেবার আর ও চেয়ারম্যান”।
কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে, “এখানে কি রেশন কার্ডের কাজ হচ্ছে?”
করবী কিছু বলার আগেই মহাদেবদা বলে ওঠে, “এই তুই কলেজ যাস নি?”
মেয়েটা বলে, “কীভাবে যাব, দেখোনা রেশন কার্ডে আমার নামের বানান ভুল আছে। ওটা ঠিক করাতে এলাম”।
মহাদেব একটু গম্ভীরভাবে বলে, “একদম ঠিক করিস নি। স্কুল, কলেজ একদম কামাই করতে নেই। দেখছিস না আজ আমার অবস্থা। তুই আমার বাড়ি এসে দিয়ে গেলেই তো আমি নিয়ে আসতাম”।
মেয়েটা হাসে। করবী আর একবার আড়চোখে মানুষটাকে দেখে। কিচ্ছু না থাকা কোনও কোনও মানুষকেও কখনও কখনও যে কী সুন্দর লাগে। এই এখন যেমন লাগছে মহাদেবকে। পড়ন্ত বেলার কমলা রোদ শ্বেতিময় সাদা মুখটাতে পড়ে যেন কী এক অপার্থিব দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
করবী নিজেও পা, কোমরের সমস্যাতে প্রচণ্ড ভীড় ট্রেনে উঠতে পারে না। মাঝে মাঝে ওলা, উবের চড়তে হয়। অনেকগুলো টাকা গচ্চা যায়। কিন্তু কী করা যাবে। তবে আজ কি এক অদ্ভুত কারণে ওদের পাশে বসে উবের বুক করতে পারে না। উঠে গিয়ে বড় রাস্তাতে উঠে, ওদের চোখের আড়ালে গিয়ে উবের বুক করে।
পিন্টু কথাটা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলেছিল। আর করবীর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না এটা সত্যিই ঘটেছে। মাঝে মাত্র দুটো দিন গেছে। শনি, রবি। শুক্রবার শেষ দেখা হয়েছিল মহাদেবদার সঙ্গে। পিন্টু প্রায় ফিসফিস করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “বড়দি জানেন কাল বিকেলে মহাদেবদা মারা গেছে”।
কথাটায় যতটা না চমকে ছিল, মর্মাহত হয়েছিল করবী এর পরের বক্তব্য পিন্টুর কাছে শুনে প্রায় ছিটকে গেছিল।
পিন্টু জানায়, “আমাদের কথামতো জেঠু গিয়েছিল চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান শুনে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে জেঠুর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে হাত, পা নেড়ে খিস্তি করে। প্রায় মারবার অবস্থা”।
করবীর মাথায় আসছিল না, কিন্তু কেন!
পিন্টু যেন করবীর মন পড়ে ফেলে। বলে, “ক্ষমতার দম্ভ দিদি। চেয়ারম্যানের ঘর থেকে জেঠু প্রায় টলতে টলতে বাইরে আসে। যেতে ভয় পাচ্ছিল মানুষটা। আমাদের তাই বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে গেছিল। আমাদের সামনে এসে পড়ে যায়। বলে বুকটায় অল্প ব্যথা করছে। খুকখুক করে কাশছিলও। আমরাই হাসপাতালে ভর্তি করাই কিন্তু শেষ রক্ষা হল না”।
বেশ খানিকটা দূরে অনেক পুরোনো একটা নিম গাছের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে বসেছিল করবী। তার মাথাটা পুরো খালি হয়ে গেছে। চোখ দুটো কড়কড় করছে। কেমন আগুনের ভাপ বের হচ্ছে যেন। আচ্ছা মহাদেবদার মৃত্যুটা কি সাধারণ মৃত্যু নাকি এর পেছনে অনেক কারণ, অনেকের হাত আছে! সে তো নিজেও বলেছিল ঐ রাক্ষসটার কাছে যেতে। তাহলে কি...।
করবীর চোখের সামনে সাত নম্বর ফর্ম ফিলাপ করা ডেথ সার্টিফিকেট সহ রেশনকার্ড চিরকালের সারেন্ডারের জন্য দুলতে থাকে। দুলতেই থাকে। দুলতেই থাকে।