বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন। বাংলার বাইশটি জেলার নাগরিকদের অংশগ্রহণ করার কথা এই নির্বাচনে।
বাংলার গ্ৰামের পর গ্ৰাম আগুনে জ্বলছে, বুকে বুলেট নিয়ে রক্তাক্ত গরীব মানুষ ছটফট করছে রাস্তার ধুলোয়, বোমা পড়ছে মুড়ি মুড়কির মতো, লাঠি গুলি বারুদের গন্ধে শান্ত সবুজ গ্রামগুলোর আকাশে নেমেছে আশঙ্কার মেঘ। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শাসক তৃণমূল দলের পেশিশক্তিতে এই রাজ্যে গণতন্ত্র প্রকাশ্যে ধর্ষিত হচ্ছে।
গণতন্ত্র এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনকে নিষ্ফল করে দেওয়ার সুপরিকল্পিত আয়োজনে চলছে। হিংসা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নগ্ন চেহারায় ত্রস্ত জনগণ। কলকাতা হাইকোর্ট উদ্বিগ্ন, প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ত ভূমিকায় যথেষ্ট বিরক্ত। যদিও তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোট গ্রহণ হচ্ছে জেনেও অনলাইনে মনোনয়ন পত্র জমা নেওয়ার নির্দেশ দেন নি। অবশ্য তাঁরা সংবিধান ও সাধারণ মানুষকে বাঁচাবার জন্যে তাঁরা একের পর এক কিছু ইতিবাচক নির্দেশ দিচ্ছেন। আর রাজ্যের শাসক, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন নানা ছলে ও কৌশলে ওইসব নির্দেশ কাটিয়ে চলেছে। এদিকে একের পর এক নিরীহ প্রাণ ঝরে পড়ছে। গ্রামের ঘরে ঘরে সর্বত্র আতঙ্কের ছায়া। ইতিমধ্যে নিখোঁজ বা গ্ৰামছাড়া অনেক মানুষ। বিরোধী দলের অনেক মনোনীত প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি। লুটপাট আর বন্দুকবাজিতে গণতন্ত্র ও পঞ্চায়েতিরাজের স্বপ্ন ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। অথচ এই অশ্রু ও রক্তময় বাস্তবতার মধ্যেও কী এক অলৌকিক মন্ত্রবলে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে শাসকদলের ৪০ হাজার মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। হায়! নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক সংস্থার শোচনীয় অবনমন ও নতজানু অবস্থা নজিরবিহীন।
শাসকের দম্ভ, স্বৈচ্ছাচার অসহনীয় আকার নিয়েছে।
শাসক যতই স্বপ্ন দেখুক “সে চিরস্থায়ী” কিংবা যতই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলুক, তাদের অভিপ্রায় ব্যর্থ হবেই। রাজ্যবাসী নিজের মতো করে গড়বে ভবিষ্যৎ। ইতিহাসের শিক্ষা হল, মানুষের ‘ক্রোধ’ যদি রুদ্ধ কপাটের অর্গল ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসে তাহলে তাকে সামলানোর ক্ষমতা কোনও শাসকের থাকে না।
যেদিন রাজীব সিনহা রাজ্যপাল কর্তৃক রাজ্যের নতুন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেলেন ঠিক পরের দিনই তিনি ঘোষণা করলেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন। সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী নির্ঘন্টে বলা হল, পরের ছয় দিন ধরে দিনে চার ঘণ্টা করে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ হবে। ১৫ জুন পর্যন্ত ধার্য করা হল মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার শেষ দিন।
কিন্তু কেন এতো তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন ঘোষণা করা এতই জরুরি হয়ে পড়ল? এটা কি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিরোধী দলগুলোকে অপ্রস্তুত করে দেওয়ার ছক নয়?
অতীতে সব নির্বাচনেই নির্বাচন কমিশন নিজেদের এবং সমস্ত রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের প্রস্তুতির জন্য সময় দিতো। আর তারা সব রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে নির্বাচন ঘোষণার আগে একটা সভা করতো। শুধুমাত্র আমাদের রাজ্যেই নয় সব রাজ্য নির্বাচন কমিশনাররাই এই প্রথা মেনে চলেন। এবার করা হয় নি। রাজীব সিনহা এই প্রথা ভাঙলেন।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এই উন্মাদের মতো পদক্ষেপের ফল কি হয়েছে তা রাজ্যের মানুষ দেখছেন। কার্যত প্রস্তুতির অভাবে প্রতিটি বিডিও ও এসডিও দপ্তরে সৃষ্টি হল চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ শুরুই করা যাচ্ছিল না। এমনকি নির্বাচন কমিশনের ঘোষণার আটচল্লিশ ঘণ্টা পরেও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র না পৌঁছানোর জন্য মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজই হয়নি অনেক ব্লক অফিসে। প্রথম তিন দিনে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী মাত্র চুয়াল্লিশ হাজার মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল।
আর শেষ দু’দিন? অথচ জেলায় জেলায় বহু ব্লক অফিস দখল নিয়েছিল বোম-পিস্তল হাতে শাসকদল তৃণমূলের সশস্ত্র দুস্কৃতিরা। কিন্তু তারা মনোনয়ন জমা দিল পঞ্চম দিন পর্যন্ত ৯,৩২৮টি, আর শেষ দিন ১৫ জুন ওই সংখ্যাটা হয়ে গেল ৭৩,৮৮৭! এমনকি বিদেশে থাকা মানুষেরও মনোনয়ন পত্র জমা হল। কোন যাদু বিদ্যায়!
সোজা কথায় নির্বাচন কমিশনার এমন ভূমিকা গ্রহণ করল, যাতে নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যকর হয় শাসক দলের পক্ষে একতরফা। বিরোধী দলগুলির প্রার্থীরা যাতে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারে তার জন্য শাসকদল তৃণমূলের সঙ্গে রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মিলিত চেষ্টার কোনও খামতি রইল না। মনোনয়নপত্র জমার পরেও স্কুটিনী পর্বেও দেখা গেল বোমা-পিস্তল-বন্দুকসহ সমাজবিরোধীরা সব জড়ো হয়েছে তৃণমূলের নেতৃত্বে। তারা বিরোধীদের আটকাবার জন্য বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়ে, মারধর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করাচ্ছে। পুলিশের একাংশ সক্রিয়ভাবে গণতন্ত্র বিরোধী কাজে অংশ নিচ্ছে। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে, আট জন সহনাগরিকে জীবন দিতে হল। তার মধ্যে একাধিক তৃণমূল সমর্থকও আছে। কিন্তু তাতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত নয় তৃণমূল কংগ্রেস দল। পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই কি এই আচরণ! সংবাদ মাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারলেও পুলিশ গুলি বোমার আওয়াজ কিছুই শুনতে পারছে না। মৃতের লাশের খবরও জানতে পারছে না। এমনকি নির্বাচন কমিশনের কাছেও মৃত্যুর সংবাদ নেই!
এত কিছুর পরেও পুলিশই আবার বিরোধী দলের প্রার্থীদের আটকাবার জন্য হুমকি দিচ্ছে, তাতে কাজ না হলে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করছে। এটা অবিশ্বাস্য যে মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে সব সমাজবিরোধীরা বোমা-পিস্তল-বন্দুক নিয়ে বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া রুখতে ময়দানে নেমে পড়েছিল?
তৃণমূলের এত ভয় কিসের? তাহলে কি তারা বুঝতে পারছে, এই রাজ্যের মানুষ অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে তাদের দলের অস্তিত্ব থাকবে না! আমাদের রাজ্যের যা ডিএনএ তাতে একথা নিশ্চিত তৃণমূলের অস্তিত্ব সংকট হলে একই আশঙ্কা ঘনিয়ে আসবে বিজেপি দলেরও!
বামপন্থীরা এ বাংলায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন কেবল আশু সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নয়। তাদের এই কাজের মধ্যে ছিল, আশু ও দূরের লক্ষ্য। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় উদ্ভুত সমস্যাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু স্থানীয়ভাবে সমাধান করা এবং সামগ্রিক সমাজ জীবনের অগ্রগতিতে তৃণমূল স্তরের মানুষকে যুক্ত করা। যাতে করে তারা সমাজের অগ্রগতিতে নতুন দিশা খুঁজে পাবে। দক্ষিণপন্থীরা বুঝেছিল এই সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত। তাই তারা বানচাল করতে উদ্যোগী পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকেই।
বর্তমানে মানুষের সামনে এটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে, দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলের মাথাদের রক্ষা করছে কেন্দ্রের সরকার। তাই এখনও এক দশক আগে শুরু হওয়া সারদা সহ অন্যান্য চিটফান্ড মামলা অথবা নারদা ঘুষ মামলা এখনো ধামাচাপা রয়েছে। কে না জানে এই তদন্তের ভার রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্সি ইডি-সিবিআই ওপরে! সংবাদ মাধ্যমে কয়লা-বালি-সোনা-গরু সব পাচারেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর নাম উঠে আসা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে ডেকে পাঠানো ছাড়া কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা হচ্ছে না। প্রশ্ন জাগে, সিবিআই-ইডি কেন্দ্রীয় সরকারের ওই সমস্ত এজেন্সির বোঝা পড়ার জন্য কি কিছু হচ্ছে না। রাম বানাম রাবণের ভীষণ যুদ্ধ চলছে! কিন্তু তারপরেই গ্রীন রুমে একই বিড়িতে সুখ টান!
বাম ও অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে হিংস্রভাবে বাধা দেওয়া হলেও, কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে মনোনয়ন জমা দেয়া নিয়ে তৃণমূল বিজেপি সংঘাত হলেও বেশিরভাগ বিজেপি প্রার্থীই প্রায় বিনা বাধায় মনোনয়ন জমা দিয়েছে। রাস্তায় বিজেপি কোথাও নেই, আছে মিডিয়ায়। এই বাস্তব সত্যকে ঢাকার জন্য কর্পোরেট মিডিয়া বিজেপি তৃণমূলের সংঘর্ষের খন্ড চিত্রগুলো সারাদিন ধরে প্রচার করেছে। তৃণমূলের টিকিট কিনতে ব্যর্থ হাজার হাজার চোর লুটেরা তৃণমূলী দিব্যি বিজেপির টিকিটে। আশার কথা, এইসব গোপন বোঝাপড়ার ফল ক্রমশ মানুষের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। এখন বাংলার মানুষ বুঝেছেন তৃণমূলের রক্ষাকর্তা বিজেপি। এত দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেও মুখ্যমন্ত্রী অথবা তার পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখার প্রতিদান হিসাবে, তৃণমূল গোয়া-মেঘালয়-মণিপুর-ত্রিপুরা ইত্যাদি রাজ্যে নিজেদের প্রার্থী দিয়ে, বিরোধী দলগুলির বিধায়ক ভাঙিয়ে বিজেপিকে সরকার গড়তে সাহায্য করেছে। সংসদেও বিজেপি’র আনা বিভিন্ন জনবিরোধী স্বেচ্ছাচারী আইনগুলি পাশ করাতেও তৃণমূল ঘুরপথে সাহায্য করেছে। বামফ্রন্টের শাসনকালে এইসব দাঙ্গাবাজদের কোনওদিনই স্থান ছিল না। তখন আরএসএস-র অস্তিত্ব ছিল সীমিত। আজকে তৃণমূলের শাসনকালে তাদের বদান্যতায় এই রাজ্যে এখন আরএসএস-এর কয়েক হাজার শাখা আর স্কুল গজিয়েছে। এই রাজ্য থেকে তৃণমূলের বদান্যতাতেই বিজেপির অনেকগুলো সাংসদ আর সাতাত্তর জন বিধায়ক ভোটে জিতে এসেছে। অথচ বামফ্রন্টের সময়কালে হাতে গোনা কাউন্সিলার বা পঞ্চায়েত ছিল বিজেপি’র। এই জন্যই প্রয়াত জ্যোতি বসু বলতেন - “মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় অপরাধ এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিজেপি-আরএসএস’কে স্থান করে দেওয়া।” পঞ্চায়েতের লক্ষ্য ছিল তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্রের প্রসার। আর এখনই তৃণমূল সরকারের সব থেকে বড় অপরাধ - রাজ্যে সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া, বিরোধীদের ওপর স্বৈরাচারী কায়দায় আক্রমণ চালানো আর পঞ্চায়েত পৌরসভার মত স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থাগুলি ধ্বংস করা।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় গড়ে উঠেছিল গ্রামের মানুষের দ্বারা গ্রাম সংসদ পরিচালিত পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা। ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্টের পঞ্চায়েত আইন ছিল গোটা দেশের সামনে মডেল। ৮০-র দশকে পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্টের পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার আদলে সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল সমগ্র দেশের জন্য পঞ্চায়েত আইন। বামফ্রন্ট নতুন পঞ্চায়েত আইন তৈরি করে গরীব খেটে খাওয়া মানুষের হাতে ক্ষমতা এবং একই সঙ্গে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে গরীব ভূমিহীন মানুষের হাতে জমি তুলে দিয়ে গ্রামবাংলার এক মহান পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এগারো লক্ষ একরেরও বেশি জমি ভূমিহীন চাষীদের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে গ্রামবাংলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছিল।
এর ফলে শুধুমাত্র গ্রামবাংলাতেই তৈরি হয়েছিল ভোগ্যপণ্যের বাজার। যার ফলশ্রুতিতে ৮০ দশকের শেষের দিকে শুরু হওয়া শিল্পায়ন, ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গকে শিল্পবিনিয়োগে একেবারে ওপরের সারিতে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক সাফল্যের সুফল পেয়েছিল মফস্বল-শহরের তরুণ প্রজন্ম। তৈরি হয়েছিল অনেক নতুন ছোট খাটো কল-কারখানা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিল্পতালুক, আইটি হাব এই পশ্চিমবাংলাতেই। ১৯৭৭ সালের তুলনায় রাজ্যে দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা ৪৫% কমেছিল ২০০০ সালে। ওই সময় অগ্রগতি হয়েছিল সাক্ষরতা ক্ষেত্রেও। গড়ে উঠেছিল “সাক্ষরতা প্রসার সমিতি”! বামফ্রন্ট সরকার আসার আগে পশ্চিমবঙ্গ ছিল খাদ্যের জন্য অন্য রাজ্যের ওপর নির্ভরশীল, তা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শুধুমাত্র খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে তাই নয়, বরং উদ্বৃত্ত ধান-সব্জি অন্য রাজ্যে পাঠানোর কাজ শুরু করে।
একদিকে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে গরীব ভূমিহীন মানুষের আয় বৃদ্ধি, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গরীব খেটেখাওয়া মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কাজ, একই সঙ্গে সমস্ত মানুষকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার জন্য তৈরি করা হয়েছিল অসংখ্য স্কুল-কলেজ। গ্রামের গরীবের ক্ষমতায়ন হয়েছিল অধিকার-আয়বৃদ্ধি-শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে। এই ভাবেই গ্রাম বাংলার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল বামফ্রন্ট। যাকে বলে মানব সম্পদের উন্নয়ন।
বামফ্রন্টের আমলে গড়ে ওঠা হাজার হাজার প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি আজ ধুঁকছে উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকা না থাকার জন্য। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে, বেসরকারি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের হাতে শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়াই তৃণমূলের মূল লক্ষ্য। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বেসরকারি কেজি স্কুল থেকে শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। এখন রেকর্ড সংখ্যায় কমেছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।
বর্তমানে যা তৃণমূল শাসনে ধ্বংস হয়েছে, গ্রামীণ অর্থনীতি দখল নিয়েছে ফড়ে-দালালরা। এদের কাছে কৃষক অত্যন্ত কম দামে তার ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয় আজ। একদিকে কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না, অন্যদিকে তৃণমূলের ফড়ে-দালালরা বাজারে চড়া দামে চাল-সব্জি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুঠছে। বামফ্রন্টের আমলে গড়ে ওঠা কৃষি-মৎস্য ও অন্যান্য সমবায়গুলি ধ্বংস করে দিয়েছে তৃণমূল। এই সমবায়গুলির পরিবর্তে এখন ফড়ে-দালালরাই গ্রামবাংলার অর্থনীতিকে শাসন করে। ফলে একদিকে মরছে কৃষক, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির চাপে ধুঁকছে গ্রাম বাংলার ক্রেতারা।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গড়ে ওঠা অনেক শিল্প একে একে রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছে তোলাবাজীতে অতিষ্ঠ হয়ে। নতুন কোনও শিল্প তৈরি হয়নি রাজ্যে তৃণমূলের আমলে। বামপন্থীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর একশো দিনের কাজের “রেগা প্রকল্প”এ ছিল কাজের নিশ্চয়তা। অথচ বিগত প্রায় দু’বছর ধরে রাজ্যে এক জন মানুষও ওই প্রকল্পে কাজ পায়নি, পঞ্চায়েতের তৃণমূলী মাতব্বরদের চুরির জন্য। গ্রাম বাংলায় কাজের আকাল। তৃণমূলের শাসনে গ্রাম বাংলার ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ, তরুণতরুণী ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে কাজের সন্ধানে। সম্প্রতি উড়িষ্যার বালাসোরে করমন্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আহত-নিহত প্রায় সবাই কাজের সন্ধানেই ভিন রাজ্যে যাচ্ছিলেন।
যে পঞ্চায়েত বামফ্রন্টের আমলে গ্রাম সংসদের মাধ্যমে মানুষের অংশগ্রহণে পরিচালিত হতো, তা এখন চোর-জোচ্চর-লুঠেরাদের দখলে চলে গেছে। একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা বা গরীব মানুষের ঘর, রাস্তা-খাল-পুকুর সংস্কারের অর্থ লুটে খেয়েছে তৃণমূলীরা। এমনকি অসহায় বৃদ্ধদের বার্ধক্য ভাতা বা বিধবা ভাতা থেকেও কাটমানি খেতে ছাড়ে না এই লুটেরা তৃণমূলীরা। যে গরীব কৃষক বাম আমলে জমির পাট্টা-বর্গার অধিকার পেয়েছিল, তৃণমূলী জমি মাফিয়ারা সে সব জমি লুটে নিচ্ছে। সরকারি জমি এমনকি খাল-পুকুরও বেচে দিচ্ছে তৃণমূলীরা। সর্বগ্রাসী লুটই এখন তৃণমূল দলের টিকে থাকার হাতিয়ার।
এর পাশাপাশি তৃণমূল সরকার আরেক খেলায় মেতেছে, জাত-ভাষা-ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ করে শাসন টিকিয়ে রাখা। জাত-ধর্ম-ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করার আরএসএস-বিজেপির ঘৃণ্য নীতি বাংলায় প্রায় একই কায়দায় তৃণমূল গ্রহণ করেছে। আসলে দেশজুড়ে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, বেনজির বেকারি, বেহাল অর্থনীতি, রেল-ব্যাঙ্ক-বীমা-খনি-বিদ্যুৎ বেসরকারি মুনাফাখোরদের হাতে তুলে দেওয়া এই সব অপরাধ আড়াল করার জন্যই বিজেপি জাত-ধর্ম-ভাষার ভিত্তিতে গরীব-সাধারণ মানুষকে বিভক্ত করার নীতি নিয়ে চলে। বাংলায় সেই নীতি নিয়েই চালাতে চাইছে তৃণমূল নিজেদের অপরাধ আড়াল করার জন্যই। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে চোর মুক্ত পঞ্চায়েত গঠনের প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই জন্যেই লুটেরা-দাঙ্গাবাজ বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে মাঠকে অনেক বড় করে বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে।
কর্ণাটকের নির্বাচনের ফল, সাগরদিঘির নির্বাচনের ফল যেমনভাবে শাসক বিরোধীদের উৎসাহিত করে ঠিক তেমনিভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলও নতুন বার্তা দিতে পারে। তাই জরুরি ভিত্তিতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াইয়ের ময়দানে নামা কর্তব্য।