বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

ভোঁতা টিনের তলোয়ার

ভোঁতা টিনের তলোয়ার

কমল কুমার দাস

photo

একথা ঠিক যে এই মুহূর্তে কর্পোরেট মদতপুষ্ট আরএসএস-বিজেপি’র উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সব থেকে বড় বিপদ। দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক এই শক্তি। অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে গড়ে ওঠা বহুত্ববাদী ভারতকে বাঁচাতে হলে এই উগ্র হিন্দুত্ববাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সমাজের সচেতন ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের সক্রিয় উদ্যোগ ছাড়া আরএসএস-বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি প্রতিহত করা সম্ভব নয়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রোলিমা থাপার তাঁর “সার্চিং ফর দ্য পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল” শীর্ষক লেখায় দেশের এই বিপজ্জনক সময়ে আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও বুদ্ধিজীবীদের শাসকের রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে জাগ্রত ভূমিকার কথা সুগভীর প্রজ্ঞতায় আলোচনা করেছেন। সচেতন বুদ্ধিজীবীরা সমাজের জাগ্রত বিবেক।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল এই যে পশ্চিমবাংলার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ “প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যে”র দানবীয় চেহারা শুধুমাত্র কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় থাকা আরএসএস-এর সমর্থনপুষ্ট বিজেপি সরকারের কার্যক্রমে দেখতে পারছেন। রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল দল ও সরকারের কাজকর্মেও যে শাসকীয় রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিবিম্ব ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে তা তাঁরা হয় দেখতে পারছেন না, বা পেলেও সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন অথবা তার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করতে ভয় বা দ্বিধা করছেন। এই রাজ্যে শাসকদের নেতৃত্বে মুহুর্মুহু ঘটে চলা প্রাতিষ্ঠানিক অত্যাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজের একটা অংশ হয় নীরব নতুবা সরকারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একাধিত্যের সঙ্গে আপোষ করে তথাকথিত নিরপেক্ষ দিনাতিপাত করছেন। কেউ কেউ আত্মসম্মান অকাতরে বিকিয়ে দিয়ে সরকারের বশংবদ হয়ে সরকারি উচ্ছিষ্ট আহরণে তৎপর। অনেকে আবার সরাসরি রাষ্ট্র ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করে প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের শরিক হয়ে উঠেছেন।

রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল সরকার ক্রমাগত গণতন্ত্র চর্চার পরিসরকে সংকুচিত করেছে। মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সে বিষয়ে তাঁরা আশ্চর্য রকমভাবে মৌন। রাজ্যের সাধারণ নাগরিকের ভোটাধিকারকে হরণ করে, গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরতে যে দল কুন্ঠাবোধ করে না, তাদেরকে বিজেপির সঙ্গে তুলনামুলক বিচারে “লেসার এভিল” আখ্যা দিয়ে আসলে এই রাজ্যের শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট চরিত্রকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যে কোনও রকমের বিরুদ্ধ কন্ঠস্বরকে নির্মমভাবে দমন করতে বিন্দুমাত্র কণ্ঠাবোধ না করা একটি রাজনৈতিক শক্তিকে এঁরা কার্যত প্রচ্ছন্নে সহযোগিতা করছেন। সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটে ৪৭ জন মানুষের জীবনের বিনিময়ে গণতন্ত্রের যে শবদাহ অনুষ্ঠিত হল তা যে শাসকের স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট চরিত্রকেই প্রকাশ করে, সে বিষয়ে কি সন্দেহের অবকাশ আছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া থেকে শুরু করে গণনা পর্ব পর্যন্ত তৃণমূল দল পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় কার্যত তৃণমূল স্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে ধূলিসাৎ করে একাধিপত্য কায়েম রেখেছে। সমাজের সর্বস্তর অঘোষিত দুষ্কৃতিরাজ কায়েম করে কায়েমি স্বার্থ বলবৎ রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি আর স্বৈরতান্ত্রিক অপশাসনের প্রকৃষ্টি দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নীরাবতা শুধু বিস্ময় উদ্রক করে না, হাড় হিম করা ভয়ও সঞ্চার করে। বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশের এই নীরবতা যতই দীর্ঘায়িত হবে, ততই বাংলার ভবিষ্যত আরো অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। কারণ সামাজিক পট পরিবর্তনে বা রাজনৈতিক পালা বদলে বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের মতামতকে সংগঠিত করার শক্তি তাঁদের আছে। দেশ, কাল, সমাজ নির্বিশেষে বুদ্ধিজীবী সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণে রাষ্ট্র বিপ্লব উজ্জীবিত হয়েছে। বুদ্ধিজীবী সমাজের এই শক্তিকে স্মরণে রেখে গ্রামসি তাঁর “লেটার ফ্রম প্রিজন” নোটবই-এ লিখেছিলেন, “Civil society works to create attraction for the bourgeois way of life or values” রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার বহনকারী বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল যত তাড়াতাড়ি এই সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন তাতে বাংলার মঙ্গল। তাঁদের তলোয়ার টিনের হলেও কোষমুক্ত। তবে মরিচা পড়ে টিনের তলোয়ার ভোঁতা হয়ে গেলে দুশ্চিন্তার বিষয়।

শেষ কথা, রাজ্যের শাসক দলের সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র হরণ তথা স্বৈরতান্ত্রিক অপশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলতে দ্বিধা করলে কেন্দ্রের ক্ষমতাশীল বিজেপিকে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এই রাজ্যের শক্তি সংগ্রহ এমনকি ক্ষমতার কেন্দ্রে আসার অবাধ সুযোগ করে দেওয়া হবে। এ অপরাধের ক্ষমা নেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.