বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

রাষ্ট্রের শরীর, ক্ষমতার ভাষা

রাষ্ট্রের শরীর, ক্ষমতার ভাষা

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

দুই মাতাল চুর হয়ে মাঝরাতে ঘরে ফিরছে। হঠাৎ একজন মাঝরাস্তায় মা কালী হয়ে দাঁড়াল, অন্যজন তার পায়ের কাছে বসে পড়ল ঘট হয়ে। খানিক পরে দেখা দিল এক পুলিশ। কালীর একটু হুঁশ ছিল, সে চম্পট দিল। ঘট কিন্তু অবিচল। পুলিশের লাথি খেয়েও উঠল না, কাত হয়ে পড়ে বলতে লাগল, ‘বগ বগ বগ বগ।’ এ বার পিঠে পড়ল লাঠির ঘা। ঘট কাতর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘একটু দাঁড়াও মামা গো, ঘটের ভিতর জলটা বেরোতে দাও।’

আমাদেরও কি ওই ঘটের মতো দশা? না খেয়ে, লাঠি খেয়ে, কেস খেয়ে উলটে পড়েছি, তারপরেও ‘বিচার চাই, বিচার চাই’ বলে চলেছি। নিজেদের স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক ভাবার খোঁয়ারি থেকে বেরোতে পারছি না। নরেন্দ্র মোদির ভারত এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গে এত বছর বাস করেও যে এত লোক নাগরিক অধিকারের মন্ত্র জপ করে, ‘বিচার চাই’ আন্দোলন না দেখলে ঠাহর হতো না। হয়তো এই জন্যই জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক সরাসরি সম্প্রচার করা হল। এটা ছিল একটা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান।

কারও নামে অভিযোগ থাকলেই তাকে ‘অভিযুক্ত’ বলা যায় না, মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা শুনে এক জুনিয়র ডাক্তার তৎক্ষণাৎ ‘অভিযুক্ত’ এবং ‘দোষী’-র পার্থক্য তুলে ধরে বোঝাতে চাইলেন, ব্যাকরণে বা নৈতিকতায় ভুল নেই। মুখ্যমন্ত্রী ভারী শান্ত স্বরে ফের বললেন, “অভিযুক্ত বলা যায় না।” ভাষার এই পাঠ নতুন নয় - এ দেশের অগণিত থানায় পুলিশরা এই পাঠ পড়ায় ধর্ষিত মেয়েদের। চার ছেলেমেয়ের মা, গণধর্ষিতা ভাঁওরী দেবীকে রাজস্থান পুলিশের এক অফিসার প্রশ্ন করেছিলেন, “রেপ কাকে বলে তুমি জান?” ‘ধর্ষণ’ শব্দের অর্থ নির্ধারণের ক্ষমতা দরিদ্র, দলিত মেয়ের থাকার কথা নয়, অতএব নেই। অভিযোগ দায়ের করার ক্ষমতাও একটা ক্ষমতা। জনসংখ্যার আশি ভাগ ‘ছোট মুখে বড় কথা’ না বলার শিক্ষা পেতে পেতেই বড় হয়। কেবল ভাল নম্বর-পাওয়া ছেলেমেয়েরা ভাবে, তারা বুঝি শব্দ আর অর্থ জুড়তে শিখেছে। মমতা বোঝালেন, সে এক্তিয়ার তাদের নেই। ডাক্তারই হও আর আয়াই হও, নাগরিকের অভিযোগ অর্থহীন, যতক্ষণ না শাসক ‘অভিযোগ’ শব্দের সঙ্গে তার অর্থকে সংযোজিত করার অনুমতি দিচ্ছে। ডাক্তারদের ঔকাত বোঝাতে মমতা এক অকল্পনীয় তীব্র বাক্য বললেন। ভীতিপ্রদর্শন-সহ নানা অভিযোগে যে ৪৯ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছিল আর জি কর থেকে, তাদেরকেই ‘থ্রেট কালচার’-এর শিকার বলে আখ্যা দিলেন।

এই বৈঠকের পর এক জুনিয়র ডাক্তার বললেন, সরকারের ‘শরীরী ভাষা’ তাঁদের ভাল লাগেনি। কথাটা চিন্তা করার মতো। রাষ্ট্রের শরীর তার বিবিধ প্রতিষ্ঠান - পুলিশ, প্রশাসন, সংসদ, আদালত। রাষ্ট্রের ভাষা তার আইন, বিধি, সরকারি বিজ্ঞপ্তি। ক্ষমতায় এসে সরকার শপথ নেয় যে, রাষ্ট্র সংবিধান মেনে নাগরিকের অধিকার রক্ষা করবে। সেখান থেকে নাগরিক-সরকার সংলাপের শুরু। সংলাপের ভাষা হতে পারে বাক্য, হতে পারে শরীরও। নাগরিকও শরীর দিয়ে কথা বলেছে - জনসমাবেশে শরীরের সংখ্যা দিয়ে, মিছিলের দৈর্ঘ্য দিয়ে। আমরণ অনশনও এক শরীরী বার্তা।

অন্য দিকে, রাজ্য সরকারের শরীর - লালবাজার, হেয়ার স্ট্রিট থানা, স্বাস্থ্য ভবন, নবান্ন, পুরসভা - কথা বলেছে রাস্তায় ব্যারিকেড বেঁধে, প্রতিবাদীদের গ্রেফতার করে, সন্দীপ ঘোষের পদত্যাগ গ্রহণে অস্বীকার করে, ‘অপরাজিতা আইন’ নামে একটি অসার আইন পাশ করে, কার্নিভাল উদযাপনে, এবং সব শেষে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায়। যা বুঝিয়ে দিল, নাগরিকের কথা আর শাসকের কথা শুধু বিরুদ্ধ নয়, বিপরীত। নাগরিকের উৎপীড়ক সরকারের চোখে উৎপীড়িত। নাগরিকের ন্যায়ের দাবি শাসকের কাছে ভয়ানক ষড়যন্ত্র। অতঃপর কী বা আইন, আর কী বা আদালতে হলফনামা। যদি আদালতে প্রমাণ হয় যে ওই তরুণী ডাক্তার নিজেই নিজের চোখ উপড়ে, হাত-পা ভেঙে, মাথা ঠুকে আত্মহত্যা করেছে, এবং মরতে মরতেও কোনও এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসাতে তার শুক্রাণু নিজেই নিজের যোনিতে প্রবেশ করিয়েছে, তাতেই বা কী? অভিযুক্তকে ‘আক্রান্ত’ মনে করা গেলে, আক্রান্তকে অভিযুক্ত বলে দেখানো বাঁ হাতের খেলা।

সেই ছিন্নভিন্ন, নিথর দেহখানির ভাষা তার আঘাতচিহ্ন। সরকার যখন নাগরিক-সুরক্ষার অঙ্গীকার থেকে সরে আসে, তখন ক্ষমতার ভাষা এমন অক্ষরেই লেখা হয়। ভাষার আঘাতে ক্ষতের কথা পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে লেখে না, তবু সবাই পড়ে নিতে পারে। সে বার্তা অসহনীয় বলেই এত লোক শোকে-ক্রোধে উন্মাদ হয়ে রাস্তায় নেমেছিল। আর জি কর থেকে নবান্ন এক বিপরীত যাত্রা - ক্ষত থেকে অস্ত্রে। অর্থ থেকে শব্দে।

অনেকে মনে করছেন, নাগরিকের ভাষায় কথা বলতে যাওয়াই ভুল হয়েছিল। রাজনীতির সঙ্গে কথা বলা দরকার রাজনীতির ভাষায়। কিন্তু কী সেই ভাষা? সন্দেশখালিতে নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব রেখা পাত্রকে বিজেপি লোকসভা নির্বাচনের টিকিট দিল, ন্যায়বিচার দিল কি? যদি তিনি ভোটে জিতে সাংসদ হতেন, থানা ঘেরাও করতেন বারবার, তবু শাহজাহান আর তার দলবলের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা পড়ত কিনা, সন্দেহ থেকে যায়। এই ছবি রাজ্যে রাজ্যে। দলীয় রাজনীতি ক্ষমতাসীনকে বদলাতে আগ্রহী, ক্ষমতার নকশাকে বদলাতে রাজি নয়। সে চায় রাষ্ট্রের পুরনো শরীরে নতুন ভূত।

নাগরিক আন্দোলন সম্পর্কে সব দল সন্দিহান, কারণ এই ভূত অচেনা। অনেকে মনে করেন, ‘বিচার চাই’ আন্দোলনের সর্বাধিক বিস্ময়কর দিক জনসমাগম। প্রায় তিন মাস ধরে এত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান সত্যিই আশ্চর্য। এ রাজ্যে, এ দেশে, নাগরিক প্রতিবাদের জন্য সব প্রহর-মুহূর্তই অযাত্রা, জেনেও কেবল মনের তাগিদে মিছিল-সমাবেশে অগণিত মানুষ এসেছেন। তাঁরা অপরিচিতদের সঙ্গে হেঁটেছেন, গলা মিলিয়েছেন, এ ওকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন। দলীয় মেরুকরণে বিচ্ছিন্ন, বিষণ্ণ নাগরিকের কাছে এ এক পরম প্রাপ্তি।

কিন্তু আরও বড় একটা বিস্ময় কি নেই? জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের মুখপাত্ররা বয়সে নেহাত নবীন, মিডিয়ার সামনে কথা বলায় অনভিজ্ঞ। তারা প্রায় তিনমাস, প্রায় প্রতিদিন, সর্বসমক্ষে কথা অনেক বললেন। অথচ, একটাও বেফাঁস, আপত্তিকর কথা শোনা গেল না কারও মুখে। অন্যকে কালিমালিপ্ত না করে, কুৎসার মুখেও সৌজন্য বজায় রেখে কী করে নিজের কথা জোরের সঙ্গে বলা যায়, আমরা দেখলাম। মুখ্যমন্ত্রীর কথার ‘স্টিমরোলার’-ও তাদের কথার সামনে বারবার থমকাতে বাধ্য হল। এক নাগরিক আন্দোলন ফিরিয়ে দিল রাজনীতির ভাষা।

এ ভাষা যুক্তির। যা সকলকে আহ্বান করে - এসো, শোনো, বলো আমি ঠিক বলছি কি না। বলো, কেন তুমি একমত নও? এই হল ‘পাবলিক রিজ়ন’ বা যু্ক্তি-নির্ভর সম্মিলিত সংলাপ। গণতন্ত্রের ঊষাকালে গ্রীসে এই ‘পাবলিক রিজ়ন’ তৈরি করেছিল রাজনীতির পরিসর। এমন সংলাপে ধরে নেওয়া হয় যে সব নাগরিক সমান, সকলে স্বেচ্ছায় কথা বলছেন, আর নিজের কথাটাই বলছেন। সকলের কাছে যা গ্রহণযোগ্য, তা-ই রাজনীতির সিদ্ধান্ত। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের হয়তো অনেক দুর্বলতা আছে, কিন্তু তাঁরা এই রাজনীতির চর্চা করেছেন - ভিতরে জেনারেল বডি মিটিঙে, বাইরে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে। প্রতিটা সিদ্ধান্ত সকলের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রচণ্ড চাপের মুখেও এমন কোনও বাক্য বলেননি, যা কুরুচিকর, আপত্তিকর। টিভির পর্দার গলা-টেপা, কান-চেপা বিতর্ক থেকে এ যে কত বড় মুক্তি!

এই ভাষা নিয়ে তাঁরা বৈঠকে গিয়েছিলেন। অনিয়মের সব নালিশের উত্তরে মমতা বারবার বলছিলেন, “আমাকে বলোনি কেন?” টিভিতে সে দৃশ্য দেখে সমাজমাধ্যমে একজন কমেন্ট লিখেছেন, “আমিয়ামিয়ামিয়ামি।” মজার বটে, ভয়েরও বটে। ডাক্তাররা গণতন্ত্রের ভাষা দিয়ে রাষ্ট্রের শরীর তৈরির পক্ষে সওয়াল করছিলেন। যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন, কেন রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন, নির্বাচিত ছাত্র সংসদের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দরকার, কেন শয্যার জোগান, রোগী রেফারালের মতো ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করতে হবে। মমতা সেখানে ক্রমাগত নিজেকেই একমাত্র প্রতিষ্ঠান বলে প্রতিষ্ঠা করলেন (‘কলেজ কাউন্সিল ব্যাপারটা কী?’) এটা লক্ষ্যণীয় যে, বৈঠকে তিনি নিজের কথার সপক্ষে কোনও যুক্তি দেননি, বিপক্ষের যুক্তিকে খণ্ডনের চেষ্টাও করেনি। অর্থাৎ রাজনীতিতে যাকে বলে ‘রেটরিক’ - অপরকে নিজের দিকে আনার জন্য চতুর, চমৎকার বাক্যবিন্যাস - তার কোনও চেষ্টাই করেননি। তাঁর আশ্বাস, তাঁর কথা, তাঁর উচ্চারণ, তিনি নিজে। তিনিই প্রথম ও শেষ কথা।

এই কর্তৃত্বের ভাষা অনেকের খুব পছন্দ। একা এক নেতা সকলকে দমিয়ে রাখছে, ভেবে অনেকে বেশ স্বস্তি পান - দুর্বল শাসক কে-ই বা চায়? আজও অনেকে দুঃখ করেন যে ভারত ছেড়ে সাহেবরা চলে গিয়েছে। কোনও মতে কর্তার কানের নাগাল পেলেই যখন কাজ হয়ে যায়, তখন যুক্তি দেওয়ার ঝামেলা বইতে চায় কে?

ব্রিটিশ ভারতে ভয়ের ভাষা থেকে অভয়ের, যুক্তির, সহমর্মিতার ভাষায় রাজনীতির উত্তরণ হয়েছিল বহু কষ্টে, বহু জীবনের দামে। তাতে কী? কোনও জাতিই স্বাধীনতার আন্দোলন একবার লড়ে না। কে গঠন করবে রাষ্ট্রের শরীর, কে রচনা করবে রাষ্ট্রের ভাষা, সে প্রশ্ন প্রতিদিন ওঠে, প্রতিদিন তার নিষ্পত্তি হয়। আগামী কাল আর একটি দিন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.