বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
আমাদের বাড়ি ছিল গ্রামে। গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল। কর্মসূত্রে কলকাতায় সল্ট লেকে আসা। প্রথমে স্কুলে আয়ার কাজ করতাম। মেয়েদের মধ্যেই কাজ ছিল। কিন্তু যখন ছেলেদের সঙ্গে কাজ করতে গেছি, যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছি। অভয়া মৃত্যুর মতো বড় ঘটনা না হওয়া পর্যন্ত আমরা এক জোট হতে পারিনি। রোজকার হিংসা, হেনস্থা, অত্যাচারগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনি।
আমি সাত বছর ধরে একটা বেসরকারি হাসপাতালে হাউসকিপিং-এর কাজ করি। যে দিন থেকে এ কাজে ঢুকেছি, বুঝেছি এর পরিবেশটাই অন্য রকম। বেশির ভাগই ঠিকা কর্মী। রোগীদের কাছ থেকে অপমানিত হতে হয় না। যে সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করছি, তাদের কাছ থেকে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমানিত হওয়া, খারাপ ভাষা — এ সবই সহ্য করতে হয়। সেটা যৌন নির্যাতনের থেকে নয়। এত কষ্টের পরেও এত কথা শুনতে হয়। প্রতিবাদ গড়ে ওঠার সুযোগটাও সেখানে নেই। কেউ যদি প্রতিবাদ করেন, সেই মুহূর্তে তাঁকে বার করে দেবে।
আমি সংগ্রামী গৃহ শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য। প্রতিবাদ করতে করতে সাতটা বছর ওখানে টিকে আছি। আমি নিজের বিষয়েও যেটুকু পারি প্রতিবাদ করি, আর অন্য মেয়ের উপরে অন্যায় হলেও আমি প্রতিবাদ করি। আমি মেনে নিচ্ছি না বলে হয়তো আমাকে কাজ থেকে বার করে দেবে! আমি রাস্তা ঝাঁট দেব সেও ভাল, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই যাব।
এক দিনের কাজের মজুরি তিনশো টাকা। ৮ ঘণ্টা দিনের ডিউটি আর ৯ ঘণ্টা রাতের ডিউটি। ওভার টাইমের জন্য কোনও বেশি টাকা পাই না। রাতের শিফটে অনেক সময় একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ থাকে — বেঞ্চে মাথা রেখে একটু জিরিয়ে নেওয়া। যেমন আমাদের অভয়া দিদি নাইট ডিউটির সময় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কী ভয়ানক পরিণতি হল তাঁর। আমাদের মতো হাউসকিপিং স্টাফদের অনেক সময় প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাও ডিউটি দিতে হয়। আমাদের বিশ্রাম নেওয়া, বসে থাকা কেউ পছন্দ করে না। এটা বোঝে না যে সেই মানুষটা হয়তো ১৮/ ২০ ঘন্টা ডিউটি করে চলেছে।
আমাদের গ্রামে ছেলেবেলা থেকেই মেয়েদের চালচলন, পোশাক-আশাক, বাড়ির বাইরে বেরোনো, সব কিছুতে বাড়ির মানুষদের কাছ থেকে বাধা আসে। বাইরের বেরোলে আশপাশের মানুষেরা যেটুকু সমর্থন করে, বাড়ির মানুষেরা সেটুকুও করে না। বলে, সমাজ কী বলবে? আমার প্রশ্ন, সমাজটা কি আলাদা! আমরা আশেপাশের প্রতিবেশীরা মিলেমিশে থাকি, সেটা নিয়েই তো সমাজ। বাড়ির লোকেরাই যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা হলে পাশের বাড়ির লোকেরাও বাধা হয়ে উঠবে। তাদের নজরদারিতে মেয়েদেরকে চলতে হবে।
বাড়ির লোকেরা যদি নিজেদের মেয়েদের সমালোচনা করে — ‘তোমার কথা ভাল না, চলা ভাল না, বলা ভাল না, তোমার সঙ্গীসাথীরা ভাল না’ — তা হলে সে মেয়েটির বাড়ির বাইরে গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। সে মেয়ে যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, তা হলে বাইরের লোকে ঘুরিয়ে বলার সাহস করে। অনায়াসে বলে যে, ‘তোমাকেই তো বাড়ি থেকে শুনতে হয়, তুমি আবার এই নিয়ে প্রতিবাদ করতে এসেছ! তোমার লজ্জা লাগে না!’
এই যন্ত্রণা ছোট থেকেই সহ্য করতে হয়। গরিব পরিবারের মায়েরা চায় যে মেয়ে স্কুলে যাক, আমার থেকে ভাল পরিবেশ পাক। কিন্তু মেয়েরা তেমন গাইডেন্স পায় না। মেয়েরা স্কুলছুট হয় গাইডের অভাবে। মেয়েকে মানুষ করার জন্য কেউ সাহায্য করে না। চোদ্দ কি ষোল বছর হলে বিয়ে দিতে চায়। মেয়েকে মানুষ করার বদলে মেয়েকে বোঝা ভেবে নেয়। মেয়েকে ঘরে রাখাটা ভয়ের। মেয়েকে রেখে কাজে যাওয়া অসুবিধার। ভয়ের কারণে নাবালিকাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলে যেন সবাই বেঁচে গেল। গ্রামে ঘরে ঘরে এমনই হচ্ছে। “দশ জনে তো ছিঁড়ে খাবে না, একজনই খাক” — এই ভেবে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়।
গ্রামের মধ্যে সব থেকে দরিদ্র, নিচুতলার পরিবারের দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে আজকে মেয়েদের কী অবস্থা! আজ অভয়ার বাবা-মা তাকে কষ্ট করে এত পড়াশোনা শেখালেন, কিন্তু মেয়েটি ডাক্তার হয়েও যৌন হিংসার নৃশংস বলি হল। তার জীবন ফুটে ওঠার হওয়ার আগেই শেষ করে দিল। আমি চাইব গ্রামের মেয়েদের জীবন কুঁড়িতেই যেন নষ্ট না হয়। সবাই মিলে গ্রামের মেয়েদের সমর্থন করি — তা হলে তারা অনেকেই প্রতিবাদ করার জোর পাবে। q অভয়া মঞ্চের সভায় প্রদত্ত ভাষণ, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫